leadT1ad

কাতারে ইসরায়েলি হামলায় ধ্বংস হলো আন্তর্জাতিক কূটনীতি

মঙ্গলবার কাতারে হামাসের যুদ্ধবিরতি আলোচনার প্রতিনিধিদের ওপর বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল। এই বিমান হামলাকে কুটনীতির নিয়ম-নীতির নজিরবিহীন লঙ্ঘন হিসেবে দেখা হচ্ছে আন্তর্জাতিক কুটনৈতিক মহলে। এই ঘটনা কেবল গাজার চলমান যুদ্ধকে আরও জটিল করেনি, বরং কাতারের নিরপেক্ষ ও নিরাপদ কূটনৈতিক কেন্দ্র হিসেবে দীর্ঘদিনের ভাবমূর্তিকেও প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। বিবিসির আন্তর্জাতিক সম্পাদক জেরেমি বাওয়েন বলেন, এতে গাজা যুদ্ধঘিরে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক প্রচেষ্টা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। স্ট্রিম পাঠকদের জন্য তার বিশ্লেষণ তুলে ধরা হল।

স্ট্রিম ডেস্ক
প্রকাশ : ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৫: ২৯
আপডেট : ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৫: ৩৩
হামলার স্থানটি ছিল ইসরায়েলি ও মার্কিন প্রতিনিধিদের থাকার জায়গার কাছাকাছি। সংগৃহীত ছবি

প্রায় এক বছর আগে দোহায় আমি হামাস নেতা ও প্রধান আলোচক খালিল আল-হাইয়ার সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। মঙ্গলবার ইসরায়েল যে ভবনে হামলা করে তার খুব কাছের একটি বাড়িতেই আমি তার সাক্ষাতকার গ্রহণ করি।

গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই আল-হাইয়া ছিলেন হামাসের প্রধান আলোচক। তিনি কাতারি ও মিশরীয় মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে ইসরায়েল ও আমেরিকার সঙ্গে বার্তা আদান-প্রদান করতেন। যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা দেখা দেওয়ায় আল-হাইয়াসহ মঙ্গলবার যাদের টার্গেট করা হয়, তারা ইসরায়েলি ও মার্কিন প্রতিনিধিদলের অল্প দূরত্বেই থাকতেন। হামলার মুহূর্তে তারা গাজা যুদ্ধ শেষ করা এবং অবশিষ্ট ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্তির বিষয়ে আমেরিকার সর্বশেষ প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করছিলেন।

ফলে সেখানে ইসরায়েলি হামলার পরপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জল্পনা ছড়িয়ে পড়ে—আমেরিকার সর্বশেষ প্রস্তাব আসলে হামাস নেতাদের এক জায়গায় জড়ো করার একটি কৌশল ছিল। যাতে তাদের সহজে টার্গেট করা যায়।

গত বছরের ৩ অক্টোবর আমি যখন খালিল আল-হাইয়ার সাক্ষাতকার নিতে গিয়েছিলাম, তখন আমরা একটি সাধারণ ও নিচু দোতলা ভিলায় দেখা করি। তার নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল খুবই সীমিত, যা দেখে আমি বিস্মিত হই। আমাদের শুধু ফোন জমা দিতে হয়েছিল। আর তার সঙ্গে এসেছিলেন মাত্র কয়েকজন দেহরক্ষী। বাইরে সাধারণ পোশাক পরা কাতারি পুলিশ একটি এসইউভিতে বসে ধূমপান করছিল। ব্যাস, এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল তার নিরাপত্তা ব্যবস্থা। তবে শত শত দেহরক্ষীও কোনও বিমান হামলা ঠেকাতে পারত না। কিন্তু আল-হাইয়া ও তার সহকর্মীরা ছিলেন নিশ্চিন্ত ও আত্মবিশ্বাসী।

মূল বিষয় ছিল— কাতারকে নিরাপদ জায়গা ধরা হতো। তারা মনে করতেন এখানে যথেষ্ট নিরাপত্তা রয়েছে এবং তুলনামূলকভাবে খোলামেলাভাবে চলাফেরা করা সম্ভব।

২০২৪ সালের ৩১ জুলাই ইসরায়েল হামাসের রাজনৈতিক নেতা ইসমাইল হানিয়াহকে ইরানের তেহরানে হত্যা করে। সেসময় তিনি ইরানি প্রেসিডেন্ট মাসউদ পেজেশকিয়ান-এর শপথ অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছিলেন।

গাজায় যুদ্ধ চলতে থাকার সময়ে আমি ভেবেছিলাম— খালিল আল-হাইয়ার সঙ্গে একই ঘরে বসা হয়তো বিপজ্জনক হতে পারে। কিন্তু তার মতো আমিও ভেবেছিলাম কাতার নিরাপদ জায়গা।

গত কয়েক দশক ধরে কাতার মধ্যপ্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড হওয়ার চেষ্টা করেছে। যা এমন একটি জায়গা, যেখানে শত্রুরাও বসে চুক্তি করতে পারে।

আমেরিকানরাও কাতারের দোহায় বসে আফগান তালেবানের সঙ্গে আলোচনা করেছিল। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের হামলার প্রায় দুই বছর ধরে কাতার ছিল যুদ্ধবিরতি ও শান্তিচুক্তির আলোচনার কেন্দ্রস্থল। এখানেই মূল কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চলছিল।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ এই শান্তি প্রচেষ্টা চালাচ্ছিলেন। কিন্তু এগুলো ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছিল। এখন সেই প্রচেষ্টা সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত। এক সিনিয়র পশ্চিমা কূটনীতিকের ভাষায়—‘এখন আর কোনো কূটনীতি নেই।’

হামাস নেতা ও প্রধান আলোচক খালিল আল-হাইয়া। সংগৃহীত ছবি
হামাস নেতা ও প্রধান আলোচক খালিল আল-হাইয়া। সংগৃহীত ছবি

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তার জনগণকে বলেছেন— তাদের শত্রুরা আর কখনো নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারবে না, ৭ অক্টোবরের হামলার নির্দেশ দেওয়ার জন্য তারা এখন মূল্য দিচ্ছে।

গাজায় ইসরায়েলি হামলা আরও তীব্র হচ্ছে। দোহায় আক্রমণের কয়েক ঘণ্টা আগে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী আইডিএফ গাজা সিটির সব ফিলিস্তিনিকে দক্ষিণে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। ধারণা করা হচ্ছে, প্রায় ১০ লাখ সাধারণ মানুষ এতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

নেতানিয়াহু তার টেলিভিশন ভাষণে গাজার ফিলিস্তিনিদের উদ্দেশে বলেন— ‘এই হত্যাকারীরা (হামাস) যেন তোমাদের বিভ্রান্ত না করে। তোমাদের অধিকার ও ভবিষ্যতের জন্য দাঁড়াও। আমাদের সঙ্গে শান্তি স্থাপন করো। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রস্তাব গ্রহণ করো। চিন্তা করো না, তোমরা পারবে। আমরা ভিন্ন ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি দিতে পারি। তবে আগে তোমাদের এই মানুষগুলোকে সরিয়ে দিতে হবে। যদি তা করো, আমাদের যৌথ ভবিষ্যতের কোনো সীমা থাকবে না।’

কিন্তু গাজার ফিলিস্তিনিরা যদি তার কথা শুনতেও পারে, সেগুলো তাদের কাছে শূন্যই মনে হবে। কারণ ইসরায়েল ইতিমধ্যেই তাদের লাখো মানুষের বাড়িঘর ধ্বংস করেছে। ধ্বংস হয়েছে হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুল।

গাজা এখন অনাহার ও দুর্ভিক্ষে জর্জরিত। গাজা সিটি দুর্ভিক্ষে আক্রান্ত। গোটা এলাকায় মানবিক বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে। এর মধ্যে আরও মানুষের জোরপূর্বক স্থানান্তর শুধু বেসামরিক জনগণের ওপর ইসরায়েলের প্রাণঘাতী চাপকে বাড়িয়ে তুলবে।

গাজায় এখন পর্যন্ত ইসরায়েল ৬০ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। এদের অধিকাংশই বেসামরিক নাগরিক। প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধেই আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার তদন্ত চলছে।

দোহায় হামলা প্রমাণ করে নেতানিয়াহু ও তার সরকার শুধু গাজাতেই নয়, সব দিকেই সর্বোচ্চ চাপ বাড়াতে চাইছে। তারা আত্মবিশ্বাসী— আমেরিকার সমর্থনে ইসরায়েলি সেনারা যেকোনো অবস্থায় নিজেদের ইচ্ছা চাপিয়ে দিতে পারবে।

এই হামলার ঘটনায় হোয়াইট হাউস থেকেও সমালোচনা আসে, যা এক বিরল ঘটনা। কারণ কাতার যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র। সেখানে বিশাল মার্কিন সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। একই সঙ্গে কাতার যুক্তরাষ্ট্রে বড় বিনিয়োগকারী।

তবুও নেতানিয়াহু মনে করছেন— ডোনাল্ড ট্রাম্প ছাড়া অন্য কারও কথায় তাকে কান দিতে হবে না। তিনি হয়তো হিসাব করছেন, ট্রাম্প কেবল প্রতীকী কূটনৈতিক ভর্ৎসনাতেই সীমাবদ্ধ থাকবেন।

এদিকে গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এর মধ্যেই জাতিসংঘে এই মাসের শেষে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিতে যাচ্ছে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং আরও কয়েকটি পশ্চিমা দেশ। এই সম্ভাবনাকে ঠেকাতে নেতানিয়াহুর অতি-জাতীয়তাবাদী মন্ত্রিসভা আবারও দখলকৃত পশ্চিম তীরকে সংযুক্ত করার দাবিতে চাপ বাড়াচ্ছে।

বিষয়:

Ad 300x250

সম্পর্কিত