leadT1ad

ভারতের পাসপোর্টের মান কমছে কেন

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক
ঢাকা

হেনলি পাসপোর্ট সূচকে ১৯৯টি দেশের মধ্যে ভারতের পাসপোর্ট ৮৫তম স্থানে রয়েছে। ছবি: সংগৃহীত।

কয়েক মাস আগে এক ভারতীয় ট্রাভেল ইনফ্লুয়েন্সার একটি ভিডিওতে ভারতের দুর্বল পাসপোর্ট নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ভুটান ও শ্রীলঙ্কার মতো প্রতিবেশী দেশগুলো ভারতীয় পর্যটকদের স্বাগত জানালেও পশ্চিমা ও ইউরোপীয় দেশগুলোর ভিসা পাওয়া এখনো কঠিন।

তার এই অভিযোগ মিলে গেছে হেনলি পাসপোর্ট ইনডেক্সের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনের সঙ্গে। বিশ্বব্যাপী পাসপোর্টের ভিসামুক্ত ভ্রমণ সুবিধার ওপর ভিত্তি করে তৈরি এ সূচকে ভারত ১৯৯টি দেশের মধ্যে ৮৫তম স্থানে রয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় পাঁচ ধাপ নিচে। ভারত সরকার এখনো এই প্রতিবেদন নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।

অর্থনৈতিকভাবে ভারতের চেয়ে অনেক ছোট দেশ—যেমন রুয়ান্ডা (৭৮তম), ঘানা (৭৪তম) ও আজারবাইজান (৭২তম) এই সূচকে ভারতের চেয়ে উপরে অবস্থান করছে। বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি হওয়া সত্ত্বেও ভারতের এই অবস্থান অনেক বিশ্লেষককে বিস্মিত করেছে। গত এক দশকে ভারতের র‍্যাংক সাধারণত ৮০-র ঘরেই ছিল, এমনকি ২০২১ সালে তা নেমে যায় ৯০তম স্থানে।

তুলনায়, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও সিঙ্গাপুরের মতো এশীয় দেশগুলো টানা শীর্ষ স্থানে রয়েছে। ২০২৫ সালেও সিঙ্গাপুর প্রথম স্থানে রয়েছে, যার নাগরিকরা ১৯৩টি দেশে ভিসামুক্ত ভ্রমণ করতে পারেন। দক্ষিণ কোরিয়া (১৯০ দেশ) দ্বিতীয় এবং জাপান (১৮৯ দেশ) তৃতীয় স্থানে। অন্যদিকে ভারতীয় পাসপোর্টধারীরা ৫৭টি দেশে ভিসামুক্তভাবে প্রবেশ করতে পারেন—যা আফ্রিকার মৌরিতানিয়ার সমান; এই দুই দেশই যৌথভাবে ৮৫তম স্থানে আছে।

পাসপোর্টের শক্তি একটি দেশের কূটনৈতিক প্রভাব ও ‘সফট পাওয়ার’-এর প্রতিফলন। এটি নাগরিকদের বৈশ্বিক চলাচল, ব্যবসা এবং শিক্ষার সুযোগও বাড়ায়। দুর্বল পাসপোর্ট মানে হলো বেশি কাগজপত্র, বেশি ভিসা ফি, কম ভ্রমণ সুবিধা এবং দীর্ঘ অপেক্ষার সময়। তবে র‍্যাংক কমলেও, গত দশকে ভারতীয়দের ভিসামুক্ত ভ্রমণ সুবিধা আসলে কিছুটা বেড়েছে।

উদাহরণস্বরূপ, ২০১৪ সালে ভারতীয়রা ৫২টি দেশে ভিসামুক্তভাবে যেতে পারতেন। তখন ভারতের র‍্যাংক ছিল ৭৬তম। ২০১৫ সালে তা নেমে আসে ৮৫-তে, ২০২৩ ও ২০২৪ সালে কিছুটা উন্নতি হয়ে ৮০-তে ওঠে, এবং ২০২৫ সালে আবার ৮৫-তে ফিরে যায়। বর্তমানে ভারতীয়দের ভিসামুক্ত গন্তব্য ৫৭টি, যা ২০১৫ সালের ৫২টির চেয়ে বেশি, তবু র‍্যাংক একই রয়েছে।

র‍্যাংক কমার কারণ কী

বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রধান কারণ হলো বৈশ্বিক ভ্রমণ প্রতিযোগিতা বেড়ে যাওয়া। এখন দেশগুলো নিজেদের নাগরিকদের সুবিধা দিতে নতুন নতুন ভ্রমণ অংশীদারত্ব গড়ে তুলছে। ২০২৫ সালের হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্স প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৬ সালে গড়ে একজন ভ্রমণকারী ভিসামুক্তভাবে ৫৮টি দেশে যেতে পারতেন, ২০২৫ সালে তা বেড়ে ১০৯-এ পৌঁছেছে। উদাহরণস্বরূপ, গত দশকে চীন তার নাগরিকদের ভিসামুক্ত গন্তব্য ৫০ থেকে বাড়িয়ে ৮২ করেছে। ফলে তাদের র‍্যাংক ৯৪তম থেকে বেড়ে ৬০তম হয়েছে।

অন্যদিকে, ভারত জুলাই মাসে ৫৯টি দেশে ভিসামুক্ত প্রবেশাধিকার পেয়ে ৭৭তম স্থানে ছিল। কিন্তু অক্টোবরে দুটি দেশ হারানোর পর তা নেমে আসে ৮৫তম স্থানে।

কূটনীতি, স্থিতিশীলতা ও ইমেজের প্রভাব

ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত আছল মালহোত্রার মতে, একটি দেশের পাসপোর্ট শক্তি নির্ভর করে তার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং বিদেশি নাগরিকদের প্রতি উন্মুক্ততার ওপর। যুক্তরাষ্ট্রের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘বিশ্ব রাজনীতিতে নিজেদের সীমাবদ্ধ অবস্থানের কারণে মার্কিন পাসপোর্ট এখন ইতিহাসে প্রথমবারের মতো শীর্ষ দশের বাইরে, ১২তম স্থানে।’

তিনি স্মরণ করেন, ১৯৭০-এর দশকে ভারতীয়রা অনেক পশ্চিমা দেশে ভিসামুক্তভাবে যেতে পারতেন। কিন্তু ১৯৮০-র দশকে খালিস্তান আন্দোলনের পর পরিস্থিতি বদলে যায়। অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা এবং পরবর্তী রাজনৈতিক টানাপোড়েনে ভারতের স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

মালহোত্রা বলেন, ‘অনেক দেশ এখন অভিবাসী প্রবাহ নিয়ে বেশি সতর্ক। ভারত থেকে প্রচুর মানুষ বিদেশে অভিবাসন করেন বা ভিসার সময়সীমা অতিক্রম করেন—এটি ভারতের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করে।’

নিরাপত্তা ও প্রশাসনিক জটিলতা

পাসপোর্টের নিরাপত্তা মান ও অভিবাসন প্রক্রিয়ার কার্যকারিতাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ভারতের পাসপোর্ট এখনো জালিয়াতি ও নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছে। ২০২৪ সালে দিল্লি পুলিশ ভিসা ও পাসপোর্ট জালিয়াতির অভিযোগে ২০৩ জনকে গ্রেপ্তার করে। ভারতের অভিবাসন প্রক্রিয়াও ধীর ও জটিল হিসেবে পরিচিত।

তবে প্রযুক্তিগত উন্নতি পরিস্থিতি কিছুটা বদলাতে পারে। সম্প্রতি চালু হওয়া ভারতের ই-পাসপোর্টে একটি চিপ সংযুক্ত করা হয়েছে, যাতে পাসপোর্টধারীদের বায়োমেট্রিক তথ্য সংরক্ষিত থাকে। এটি জাল বা পরিবর্তন করা কঠিন।

তবু বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শুধু প্রযুক্তি নয়, আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ও নতুন ভ্রমণ চুক্তিই ভারতের পাসপোর্টের বৈশ্বিক মর্যাদা বাড়াতে পারে। এই প্রচেষ্টাই ভবিষ্যতে ভারতীয় নাগরিকদের বিশ্বে সহজ ও মর্যাদাপূর্ণ চলাচলের পথ প্রশস্ত করবে।

সূত্র: বিবিসি

Ad 300x250

সম্পর্কিত