স্ট্রিম ডেস্ক

সেপ্টেম্বরের শেষদিকে তালেবানরা আফগানিস্তানে হঠাৎ করে দেশজুড়ে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেয়। এতে ৪৩ মিলিয়ন মানুষ টানা ৪৮ ঘণ্টা ডিজিটাল বিচ্ছিন্নতায় পড়ে। মোবাইল ফোন, স্যাটেলাইট টিভি এবং ল্যান্ডলাইন যোগাযোগও মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। কোনো আগাম ঘোষণা বা ব্যাখ্যা ছাড়াই সর্বোচ্চ নেতা মৌলভি হিবাতুল্লাহ আখুন্দজাদা এ নির্দেশ দেন। পর্যবেক্ষকদের মতে, আধুনিক সংযুক্তির যুগে এটি ছিল তালেবানের জন্য এক কঠোর শিক্ষা। তারা ১৯৯০-র দশকের মতো বিচ্ছিন্ন সমাজ ফিরিয়ে আনতে চাইছে। কিন্তু দেখা গেল, সময়কে উল্টে দেওয়া এত সহজ নয়।
৪৮ ঘণ্টার অন্ধকার
২৯ সেপ্টেম্বর (সোমবার) বিকেল ৫টা থেকে ১ অক্টোবর (বুধবার) পর্যন্ত সব মোবাইল নেটওয়ার্ক, ল্যান্ডলাইন ও ইন্টারনেট সেবা বন্ধ থাকে। নেটব্লকস একে ‘সম্পূর্ণ ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট’ বলে বর্ণনা করে। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, এক্স (সাবেক টুইটার), টিকটক অচল হয়ে যায়। হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা পৌঁছায় না। আন্তর্জাতিক কলও সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়।
এর আগে দেশটির উত্তরের প্রদেশগুলোর মধ্যে বিশেষ করে বালখে ফাইবার-অপটিক ইন্টারনেট নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। সেখানে বলা হয়েছিল, ‘অশ্লীল কার্যকলাপ’ ঠেকাতেই এই নিষেধাজ্ঞা। তবে অপরিহার্য প্রয়োজনের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা আনার আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। দেশজুড়ে ব্ল্যাকআউটের সময় তালেবান নীরব থাকে। গুজব ছড়িয়ে পড়ে আসন্ন যুদ্ধ বা পূর্ণ সেন্সরশিপ নিয়ে।
যখন ইন্টারনেট সেবা পুনরায় চালু হয়, তখন নেটওয়ার্কে অস্বাভাবিক চাপ সৃষ্টি হয়। আফগানিস্তানের হাতে গোনা কিছু (১০-এর কম) ইন্টারনেট সেবা সরবরাহকারী তা সামলাতে হিমশিম খায়। অনেক হতাশ নাগরিক পাকিস্তান সীমান্তের তোরখামে ছুটে যান কেবল সীমান্ত পেরিয়ে সিগনাল পাওয়ার জন্য। সেখানকার সিমকার্ডগুলো স্বাভাবিকভাবে কাজ করছিল।
কেন এই পদক্ষেপ নিয়েছিল তালেবান?
মূলত বাইরের বিশ্বের সঙ্গে আফগানদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করাই ছিল এ উদ্যোগের উদ্দেশ্য। এর সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে তথাকথিত ‘নৈতিক শুদ্ধতা।’ বালখ প্রদেশের মুখপাত্র হাজি জায়েদ বলেছিলেন, ইন্টারনেট ব্যবহার অনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়াচ্ছে। আখুন্দজাদার লক্ষ্য হলো পশ্চিমা প্রভাবমুক্ত এক কট্টরপন্থী সমাজ গড়ে তোলা।
২০২১ সালের আগস্টে ক্ষমতায় আসার পর থেকে তালেবান ধারাবাহিকভাবে স্বাধীনতা সংকুচিত করছে। নারীদের মাধ্যমিক শিক্ষা, অধিকাংশ চাকরি ও পার্কে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পোশাকবিধি এবং গণমাধ্যমেও কড়া নিয়ন্ত্রণ জারি রয়েছে।
ইন্টারনেট হয়ে উঠেছে সবচেয়ে বড় বিতর্কের জায়গা। এটি আন্ডারগ্রাউন্ড শিক্ষার হাতিয়ারও, যেমন মেয়েদের হোয়াটসঅ্যাপ-ভিত্তিক ক্লাস। এটি অধিকারবাদী কর্মকাণ্ড এবং প্রবাসী আয় পাঠানোরও মাধ্যম। সবকিছুই তালেবান নিয়ন্ত্রণকে চ্যালেঞ্জ করে।
নির্বাসিত সাবেক আফগান এমপি মরিয়ম সুলাইমানখিল বলেন, ইন্টারনেট কেটে দিয়ে তালেবান বাইরের প্রভাব সরিয়ে ফেলতে চায়। এতে জনসম্মুখে বেত্রাঘাতের মতো নৃশংসতা লুকিয়ে রাখা সম্ভব হয়। প্রযুক্তিকে তারা সবসময় ‘পাপের পথ’ হিসেবে দেখে এসেছে। কারণ এর মধ্য দিয়ে সংগীত থেকে শুরু করে অনিয়ন্ত্রিত সংবাদ অবাধে প্রচারিত হয়।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: ১৯৯০-র দশকের প্রতিধ্বনি
এই ব্ল্যাকআউট মনে করিয়ে দেয় তালেবানের প্রথম শাসনকাল (১৯৯৬-২০০১)। তখন আফগান সমাজ ছিল সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। গৃহযুদ্ধের মধ্যে নাগরিক সমাজ ভেঙে পড়ে। তথ্যপ্রবাহ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়—রেডিও নিষিদ্ধ করা হয়, প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হতো।
সে সময় আফগানিস্তান ছিল প্রাক-স্মার্টফোন যুগে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল ন্যূনতম। গণহত্যার মতো ভয়াবহ ঘটনাও অলিখিত ও অদেখাই থেকে যেত। ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন আগ্রাসনে তালেবানের পতনের পর আন্তর্জাতিক সহায়তায় অবকাঠামো পুনর্নির্মাণ হয়। তখন ইন্টারনেট প্রবেশাধিকার এক নতুন অগ্রগতির প্রতীক হয়ে ওঠে। ২০০১ সালে যেখানে প্রবেশাধিকার ছিল প্রায় শূন্য, ২০২১ সালে সেখানে মোবাইল ব্যবহার ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র।
২০২১ সালে তালেবানের ফেরত আসার পরপরই প্রশ্ন ওঠে— ইন্টারনেটের তথাকথিত ‘পাপের পথ’ কতদিন টিকে থাকবে? তবে ১৯৯০-র দশকের মতো নয়, বর্তমান আফগানিস্তান এখন ডিজিটালি সংযুক্ত। এমনকি শহুরে তালেবান সমর্থকরাও বড় হয়েছেন স্মার্টফোন সংস্কৃতিতে। তাই সম্পূর্ণ পশ্চাদগমন অনেকের কাছেই ‘অচেনা’ মনে হয়।
তাৎক্ষণিক প্রভাব: আতঙ্ক, স্থবিরতা ও মানবিক ক্ষতি
ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট ছড়িয়ে দেয় ব্যাপক আতঙ্ক। কাবুলের সাংবাদিক হেওয়াদ ওয়াতান্দার বলেন, মানুষ এমনভাবে ভীত হয়েছিল যেন তাদের প্রাণ শরীর ছেড়ে গেছে। পরিবারগুলো যোগাযোগ হারায়। নারীরা— যারা আগে থেকেই গৃহবন্দি— আরও বেশি বন্দিত্ব অনুভব করে। প্রবাসী আফগানরা, যেমন সাবেক ফুটবলার ফাতিমা ইউসুফি, রাত জেগে কাটিয়েছেন আত্মীয়দের খোঁজ নিতে না পেরে।
অধিকার কর্মী নিগিন বলেছিলেন, এটি ছিল যেন ‘জীবিত অবস্থায় কবর দেওয়া।’ তিনি কয়েক মাইল হাঁটেন শুধু ছাত্রছাত্রীদের আশ্বস্ত করতে।
অর্থনীতিতেও আঘাত আসে। ব্যাংক লেনদেন বন্ধ হয়ে যায়। অনলাইন পেমেন্ট থেমে যায়। বাজার ভেঙে পড়ে। মানুষ নগদ টাকার জন্য লম্বা লাইনে দাঁড়ায়। দোকান বন্ধ হয়ে যায়। ফল ব্যবসায়ীরা পাকিস্তানে ফল রপ্তানির সমন্বয় করতে না পেরে বিপাকে পড়েন। পচনশীল পণ্য নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি দেখা দেয়।
ফ্লাইট বন্ধ হয়ে যায়। ত্রাণ কার্যক্রম থেমে যায়। মেয়েদের অনলাইন শিক্ষাও ব্যাহত হয়। সোলাক্স-এর মতো উদ্যোগে ৩৪ প্রদেশেই শিক্ষার অনুরোধ কমে যায়।
সংযোগ ফিরলে আনন্দের সঙ্গে ক্ষোভও প্রকাশ পায়। বিদেশে কল করা সম্ভব হলেও অনেকের ক্ষোভ ছিল তীব্র। গৃহিণী ফাওজিয়া রহিমি এটিকে আখ্যা দেন, ‘মৌলিক মানবাধিকার থেকে বঞ্চনা।’

প্রযুক্তি নির্ভরতার যুগে পেছনে ফেরা কেন কঠিন
তালেবানের ভুল ছিল স্পষ্ট। এমন এক দেশে, যেখানে তরুণ প্রজন্মের কাছে স্মার্টফোন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ, সেখানে জোরপূর্বক বিচ্ছিন্নতা উল্টো ফল বয়ে আনে। নেটওয়ার্ক সংস্থা কেনটিকের ডাগ ম্যাডরি একে তুলনা করেছেন আরব বসন্তের সময় মিশরের ২০১১ সালের ইন্টারনেট বন্ধের সঙ্গে। তাঁর মতে, এতে অর্থনীতি ভেঙে পড়ে কিন্তু প্রতিবাদ দমন হয় না।
‘অশ্লীল’ কনটেন্ট ফিল্টার করা প্রযুক্তিগতভাবে কঠিন, কারণ ওয়েবের বিস্তার ব্যাপক। এর মধ্যেও মানুষ ভিপিএন বা পাচার করা স্টারলিংক ডিভাইস দিয়ে বিকল্প পথ খুঁজে নেয়। তবে এসব ঝুঁকিপূর্ণ, কারণ অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির টম ওয়ার্থিংটনের মতে, তালেবান প্রতিশোধ নিতে পারে।
এমনকি সরকারের ভেতরকার অনেককেও বিষয়টি হতবাক করেছে। সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত জালমে খলিলজাদের ভাষায়, তালেবান নেতারা এর ফল কী হতে পারে তা সঠিকভাবে অনুমানই করতে পারেননি।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সাহার ফেতরাত বলেছেন, এই অবরোধ ছিল যেন ৩০ বছর আগের আফগানিস্তানের দৃশ্যপট। কিন্তু তরুণ আফগানদের কাছে ইন্টারনেট হলো তালেবানের অধীনে ‘কারাগারে থাকার মতো জীবন এড়ানোর শেষ উপায়।’ তাই তারা সহজে এটি ত্যাগ করবে না।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও বিস্তৃত প্রভাব
ঘটনার পরপরই বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় উঠে। জাতিসংঘ, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল একে ‘অত্যাচারী’ পদক্ষেপ বলে নিন্দা জানায়। জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদক রিচার্ড বেনেট সতর্ক করেন—এতে অর্থনীতি ভেঙে পড়তে পারে, বিশেষ করে নিষেধাজ্ঞা, খরা ও শরণার্থী সংকটে জর্জরিত আফগানিস্তানে।
ঘটনাটি দেখায় আফগানিস্তানের ভঙ্গুরতা। সাহায্য কমে গেছে, খাদ্য সংকট ঘনিয়ে আসছে। এই ধরনের ব্ল্যাকআউট হয়তো মেধাপাচার ও অস্থিরতা বাড়িয়ে তুলবে।
আগামী দিনে তালেবানকে কৌশল পুনর্বিবেচনা করতে হবে। পূর্ণ ব্ল্যাকআউট তাদের নিজস্ব শাসন ও অর্থনীতির ক্ষতি করে। আংশিক নিয়ন্ত্রণও উল্টো বিদ্রোহকে উস্কে দিতে পারে।
একবিংশ শতাব্দীর সংযুক্ত দুনিয়ায় প্রযুক্তিগত অগ্রগতি একবার প্রতিষ্ঠিত হলে তাকে মুছে ফেলা যায় না। আফগানরা সীমান্তে সিগনাল খোঁজা থেকে স্যাটেলাইট সম্প্রচার ব্যবহারে যে দৃঢ়তা দেখিয়েছে, তা এ সত্যকে প্রমাণ করে।
এ থেকে তালেবান যে শিক্ষা পেল তা হলো, ২০২৫ সালে সময়কে উল্টো দিকে ফেরানো শুধু কঠিনই নয়, বরং তা ক্ষোভ ডেকে আনে।
সূত্র: সিএনএন

সেপ্টেম্বরের শেষদিকে তালেবানরা আফগানিস্তানে হঠাৎ করে দেশজুড়ে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেয়। এতে ৪৩ মিলিয়ন মানুষ টানা ৪৮ ঘণ্টা ডিজিটাল বিচ্ছিন্নতায় পড়ে। মোবাইল ফোন, স্যাটেলাইট টিভি এবং ল্যান্ডলাইন যোগাযোগও মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। কোনো আগাম ঘোষণা বা ব্যাখ্যা ছাড়াই সর্বোচ্চ নেতা মৌলভি হিবাতুল্লাহ আখুন্দজাদা এ নির্দেশ দেন। পর্যবেক্ষকদের মতে, আধুনিক সংযুক্তির যুগে এটি ছিল তালেবানের জন্য এক কঠোর শিক্ষা। তারা ১৯৯০-র দশকের মতো বিচ্ছিন্ন সমাজ ফিরিয়ে আনতে চাইছে। কিন্তু দেখা গেল, সময়কে উল্টে দেওয়া এত সহজ নয়।
৪৮ ঘণ্টার অন্ধকার
২৯ সেপ্টেম্বর (সোমবার) বিকেল ৫টা থেকে ১ অক্টোবর (বুধবার) পর্যন্ত সব মোবাইল নেটওয়ার্ক, ল্যান্ডলাইন ও ইন্টারনেট সেবা বন্ধ থাকে। নেটব্লকস একে ‘সম্পূর্ণ ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট’ বলে বর্ণনা করে। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, এক্স (সাবেক টুইটার), টিকটক অচল হয়ে যায়। হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা পৌঁছায় না। আন্তর্জাতিক কলও সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়।
এর আগে দেশটির উত্তরের প্রদেশগুলোর মধ্যে বিশেষ করে বালখে ফাইবার-অপটিক ইন্টারনেট নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। সেখানে বলা হয়েছিল, ‘অশ্লীল কার্যকলাপ’ ঠেকাতেই এই নিষেধাজ্ঞা। তবে অপরিহার্য প্রয়োজনের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা আনার আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। দেশজুড়ে ব্ল্যাকআউটের সময় তালেবান নীরব থাকে। গুজব ছড়িয়ে পড়ে আসন্ন যুদ্ধ বা পূর্ণ সেন্সরশিপ নিয়ে।
যখন ইন্টারনেট সেবা পুনরায় চালু হয়, তখন নেটওয়ার্কে অস্বাভাবিক চাপ সৃষ্টি হয়। আফগানিস্তানের হাতে গোনা কিছু (১০-এর কম) ইন্টারনেট সেবা সরবরাহকারী তা সামলাতে হিমশিম খায়। অনেক হতাশ নাগরিক পাকিস্তান সীমান্তের তোরখামে ছুটে যান কেবল সীমান্ত পেরিয়ে সিগনাল পাওয়ার জন্য। সেখানকার সিমকার্ডগুলো স্বাভাবিকভাবে কাজ করছিল।
কেন এই পদক্ষেপ নিয়েছিল তালেবান?
মূলত বাইরের বিশ্বের সঙ্গে আফগানদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করাই ছিল এ উদ্যোগের উদ্দেশ্য। এর সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে তথাকথিত ‘নৈতিক শুদ্ধতা।’ বালখ প্রদেশের মুখপাত্র হাজি জায়েদ বলেছিলেন, ইন্টারনেট ব্যবহার অনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়াচ্ছে। আখুন্দজাদার লক্ষ্য হলো পশ্চিমা প্রভাবমুক্ত এক কট্টরপন্থী সমাজ গড়ে তোলা।
২০২১ সালের আগস্টে ক্ষমতায় আসার পর থেকে তালেবান ধারাবাহিকভাবে স্বাধীনতা সংকুচিত করছে। নারীদের মাধ্যমিক শিক্ষা, অধিকাংশ চাকরি ও পার্কে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পোশাকবিধি এবং গণমাধ্যমেও কড়া নিয়ন্ত্রণ জারি রয়েছে।
ইন্টারনেট হয়ে উঠেছে সবচেয়ে বড় বিতর্কের জায়গা। এটি আন্ডারগ্রাউন্ড শিক্ষার হাতিয়ারও, যেমন মেয়েদের হোয়াটসঅ্যাপ-ভিত্তিক ক্লাস। এটি অধিকারবাদী কর্মকাণ্ড এবং প্রবাসী আয় পাঠানোরও মাধ্যম। সবকিছুই তালেবান নিয়ন্ত্রণকে চ্যালেঞ্জ করে।
নির্বাসিত সাবেক আফগান এমপি মরিয়ম সুলাইমানখিল বলেন, ইন্টারনেট কেটে দিয়ে তালেবান বাইরের প্রভাব সরিয়ে ফেলতে চায়। এতে জনসম্মুখে বেত্রাঘাতের মতো নৃশংসতা লুকিয়ে রাখা সম্ভব হয়। প্রযুক্তিকে তারা সবসময় ‘পাপের পথ’ হিসেবে দেখে এসেছে। কারণ এর মধ্য দিয়ে সংগীত থেকে শুরু করে অনিয়ন্ত্রিত সংবাদ অবাধে প্রচারিত হয়।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: ১৯৯০-র দশকের প্রতিধ্বনি
এই ব্ল্যাকআউট মনে করিয়ে দেয় তালেবানের প্রথম শাসনকাল (১৯৯৬-২০০১)। তখন আফগান সমাজ ছিল সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। গৃহযুদ্ধের মধ্যে নাগরিক সমাজ ভেঙে পড়ে। তথ্যপ্রবাহ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়—রেডিও নিষিদ্ধ করা হয়, প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হতো।
সে সময় আফগানিস্তান ছিল প্রাক-স্মার্টফোন যুগে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল ন্যূনতম। গণহত্যার মতো ভয়াবহ ঘটনাও অলিখিত ও অদেখাই থেকে যেত। ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন আগ্রাসনে তালেবানের পতনের পর আন্তর্জাতিক সহায়তায় অবকাঠামো পুনর্নির্মাণ হয়। তখন ইন্টারনেট প্রবেশাধিকার এক নতুন অগ্রগতির প্রতীক হয়ে ওঠে। ২০০১ সালে যেখানে প্রবেশাধিকার ছিল প্রায় শূন্য, ২০২১ সালে সেখানে মোবাইল ব্যবহার ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র।
২০২১ সালে তালেবানের ফেরত আসার পরপরই প্রশ্ন ওঠে— ইন্টারনেটের তথাকথিত ‘পাপের পথ’ কতদিন টিকে থাকবে? তবে ১৯৯০-র দশকের মতো নয়, বর্তমান আফগানিস্তান এখন ডিজিটালি সংযুক্ত। এমনকি শহুরে তালেবান সমর্থকরাও বড় হয়েছেন স্মার্টফোন সংস্কৃতিতে। তাই সম্পূর্ণ পশ্চাদগমন অনেকের কাছেই ‘অচেনা’ মনে হয়।
তাৎক্ষণিক প্রভাব: আতঙ্ক, স্থবিরতা ও মানবিক ক্ষতি
ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট ছড়িয়ে দেয় ব্যাপক আতঙ্ক। কাবুলের সাংবাদিক হেওয়াদ ওয়াতান্দার বলেন, মানুষ এমনভাবে ভীত হয়েছিল যেন তাদের প্রাণ শরীর ছেড়ে গেছে। পরিবারগুলো যোগাযোগ হারায়। নারীরা— যারা আগে থেকেই গৃহবন্দি— আরও বেশি বন্দিত্ব অনুভব করে। প্রবাসী আফগানরা, যেমন সাবেক ফুটবলার ফাতিমা ইউসুফি, রাত জেগে কাটিয়েছেন আত্মীয়দের খোঁজ নিতে না পেরে।
অধিকার কর্মী নিগিন বলেছিলেন, এটি ছিল যেন ‘জীবিত অবস্থায় কবর দেওয়া।’ তিনি কয়েক মাইল হাঁটেন শুধু ছাত্রছাত্রীদের আশ্বস্ত করতে।
অর্থনীতিতেও আঘাত আসে। ব্যাংক লেনদেন বন্ধ হয়ে যায়। অনলাইন পেমেন্ট থেমে যায়। বাজার ভেঙে পড়ে। মানুষ নগদ টাকার জন্য লম্বা লাইনে দাঁড়ায়। দোকান বন্ধ হয়ে যায়। ফল ব্যবসায়ীরা পাকিস্তানে ফল রপ্তানির সমন্বয় করতে না পেরে বিপাকে পড়েন। পচনশীল পণ্য নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি দেখা দেয়।
ফ্লাইট বন্ধ হয়ে যায়। ত্রাণ কার্যক্রম থেমে যায়। মেয়েদের অনলাইন শিক্ষাও ব্যাহত হয়। সোলাক্স-এর মতো উদ্যোগে ৩৪ প্রদেশেই শিক্ষার অনুরোধ কমে যায়।
সংযোগ ফিরলে আনন্দের সঙ্গে ক্ষোভও প্রকাশ পায়। বিদেশে কল করা সম্ভব হলেও অনেকের ক্ষোভ ছিল তীব্র। গৃহিণী ফাওজিয়া রহিমি এটিকে আখ্যা দেন, ‘মৌলিক মানবাধিকার থেকে বঞ্চনা।’

প্রযুক্তি নির্ভরতার যুগে পেছনে ফেরা কেন কঠিন
তালেবানের ভুল ছিল স্পষ্ট। এমন এক দেশে, যেখানে তরুণ প্রজন্মের কাছে স্মার্টফোন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ, সেখানে জোরপূর্বক বিচ্ছিন্নতা উল্টো ফল বয়ে আনে। নেটওয়ার্ক সংস্থা কেনটিকের ডাগ ম্যাডরি একে তুলনা করেছেন আরব বসন্তের সময় মিশরের ২০১১ সালের ইন্টারনেট বন্ধের সঙ্গে। তাঁর মতে, এতে অর্থনীতি ভেঙে পড়ে কিন্তু প্রতিবাদ দমন হয় না।
‘অশ্লীল’ কনটেন্ট ফিল্টার করা প্রযুক্তিগতভাবে কঠিন, কারণ ওয়েবের বিস্তার ব্যাপক। এর মধ্যেও মানুষ ভিপিএন বা পাচার করা স্টারলিংক ডিভাইস দিয়ে বিকল্প পথ খুঁজে নেয়। তবে এসব ঝুঁকিপূর্ণ, কারণ অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির টম ওয়ার্থিংটনের মতে, তালেবান প্রতিশোধ নিতে পারে।
এমনকি সরকারের ভেতরকার অনেককেও বিষয়টি হতবাক করেছে। সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত জালমে খলিলজাদের ভাষায়, তালেবান নেতারা এর ফল কী হতে পারে তা সঠিকভাবে অনুমানই করতে পারেননি।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সাহার ফেতরাত বলেছেন, এই অবরোধ ছিল যেন ৩০ বছর আগের আফগানিস্তানের দৃশ্যপট। কিন্তু তরুণ আফগানদের কাছে ইন্টারনেট হলো তালেবানের অধীনে ‘কারাগারে থাকার মতো জীবন এড়ানোর শেষ উপায়।’ তাই তারা সহজে এটি ত্যাগ করবে না।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও বিস্তৃত প্রভাব
ঘটনার পরপরই বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় উঠে। জাতিসংঘ, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল একে ‘অত্যাচারী’ পদক্ষেপ বলে নিন্দা জানায়। জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদক রিচার্ড বেনেট সতর্ক করেন—এতে অর্থনীতি ভেঙে পড়তে পারে, বিশেষ করে নিষেধাজ্ঞা, খরা ও শরণার্থী সংকটে জর্জরিত আফগানিস্তানে।
ঘটনাটি দেখায় আফগানিস্তানের ভঙ্গুরতা। সাহায্য কমে গেছে, খাদ্য সংকট ঘনিয়ে আসছে। এই ধরনের ব্ল্যাকআউট হয়তো মেধাপাচার ও অস্থিরতা বাড়িয়ে তুলবে।
আগামী দিনে তালেবানকে কৌশল পুনর্বিবেচনা করতে হবে। পূর্ণ ব্ল্যাকআউট তাদের নিজস্ব শাসন ও অর্থনীতির ক্ষতি করে। আংশিক নিয়ন্ত্রণও উল্টো বিদ্রোহকে উস্কে দিতে পারে।
একবিংশ শতাব্দীর সংযুক্ত দুনিয়ায় প্রযুক্তিগত অগ্রগতি একবার প্রতিষ্ঠিত হলে তাকে মুছে ফেলা যায় না। আফগানরা সীমান্তে সিগনাল খোঁজা থেকে স্যাটেলাইট সম্প্রচার ব্যবহারে যে দৃঢ়তা দেখিয়েছে, তা এ সত্যকে প্রমাণ করে।
এ থেকে তালেবান যে শিক্ষা পেল তা হলো, ২০২৫ সালে সময়কে উল্টো দিকে ফেরানো শুধু কঠিনই নয়, বরং তা ক্ষোভ ডেকে আনে।
সূত্র: সিএনএন

যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে হোয়াইট হাউসের কাছে দুজন ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া ন্যাশনাল গার্ড সদস্য গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তাদের অবস্থা গুরুতর। কর্মকর্তারা এটিকে একটি পরিকল্পিত হামলা হিসাবে উল্লেখ করেছেন।
১৬ ঘণ্টা আগে
পশ্চিম আফ্রিকার ছোট দেশ গিনি-বিসাউ আবারও সামরিক অভ্যুত্থানের কবলে। দেশটি দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও মাদক পাচারের সমস্যায় জর্জরিত। গত ২৩ নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর উত্তেজনা বাড়তে থাকে।
২০ ঘণ্টা আগে
হংকংয়ের তাই পো জেলার ওয়াং ফুক কোর্ট সরকারি আবাসিক কমপ্লেক্সে বুধবার (২৬ নভেম্বর ২০২৫) ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। অল্প সময়ের মধ্যেই এটি কয়েক দশকের মধ্যে শহরের সবচেয়ে বড় দুর্যোগে পরিণত হয়।
১ দিন আগে
পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান কি কারাগারে খুন হয়েছেন? সামাজিক মাধ্যমে, বিশেষ করে ভারতের বিভিন্ন মিডিয়ায় আবারও এই গুজব ছড়িয়ে পড়ছে।
১ দিন আগে