.png)
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষিদ্ধ করার প্রতিবাদে আন্দোলনের সূচনা হলেও এর মূল চালিকাশক্তি ছিল দীর্ঘদিনের জমে থাকা হতাশা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে ক্ষোভ এবং নেতৃত্ব পরিবর্তনের দাবি। এটি রাজতন্ত্রবিরোধী বিপ্লবের ব্যর্থতা থেকে উদ্ভূত আন্দোলন নয়। বিক্ষোভকারীরা গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে নয়; বরং যাঁরা গণতন্ত্রের অপব্যবহার করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন। নতুন প্রজন্মের দাবি—প্রবীণ নেতৃত্বের পরিবর্তে তরুণ ও যোগ্য নেতৃত্ব উঠে আসুক।

স্ট্রিম ডেস্ক

ব্যাপক গণবিক্ষোভের দ্বিতীয় দিনেই পদত্যাগ করেছেন নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলি। এর আগে বিক্ষোভের প্রথমদিন সোমবার সন্ধ্যায় দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও পদত্যাগ করেছিলেন। বিশেষ করে জেনারেশন জেড তথা জেন জি-র সক্রিয় অংশগ্রহণ আন্দোলনকে অপ্রত্যাশিত মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে।
এই আন্দোলন আকস্মিক কিনা, নতুন পরিস্থিতিতে দেশটির অভিমুখ কোন দিকে যেতে পারে, আন্দোলনকারীদের দাবি কী ছিল, এতে কোন কোন নিয়ামকগুলো ভূমিকা পালন করেছে—এসব বিষয়ে স্ট্রিমের সঙ্গে বিষদ আলোচনা করেছেন দেশটির প্রখ্যাত সাংবাদিক রমেশ ভুষাল।
স্ট্রিম: এই আন্দোলনের সূচনা কোথা থেকে, কীভাবে গড়ে উঠল এবং কীভাবে তা ছড়িয়ে পড়ল?
রমেশ ভুষাল: এই আন্দোলনের শুরু কোথা থেকে এবং কীভাবে এটি ছড়িয়ে পড়ে—তা বুঝতে হলে আগে দেখতে হবে এর পেছনের প্রেক্ষাপট।
মূলত ‘জেনারেশন জেড’ নামে পরিচিত তরুণরা রাস্তায় নেমে এসে সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করে। তাদের প্রধান অভিযোগ ছিল—দেশ দুর্নীতিগ্রস্তদের হাতে চলে গেছে। রাজনীতিবিদেরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখছেন না। এই দীর্ঘস্থায়ী দুর্নীতি ও অনিয়মে তরুণসমাজ চরম হতাশায় ভুগছিল।
এর মধ্যেই নেপাল সরকার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়। কারণ হিসেবে জানানো হয়, এইসব প্ল্যাটফর্ম নেপালে আনুষ্ঠানিকভাবে নিবন্ধিত নয়। সরকারের এই সিদ্ধান্ত তরুণদের ক্ষোভে ঘি ঢেলে দেয়।
তারা মনে করে, এভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করে তাদের মত প্রকাশের অধিকার হরণ করা হচ্ছে। সরকারের এই পদক্ষেপকে তারা নিয়ন্ত্রণমূলক ও কর্তৃত্ববাদী বলে মনে করে। ফলে তারা প্রতিবাদে ফেটে পড়ে।
তবে আন্দোলনের উদ্দেশ্য কেবল ফেসবুক বা টিকটক নিষিদ্ধের বিরোধিতা নয়। এটি ছিল বহুদিনের জমে থাকা হতাশা ও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়া দুর্নীতি, রাজনৈতিক স্বচ্ছতার অভাব এবং তরুণদের কণ্ঠ রোধ করার চেষ্টার বিরুদ্ধে এক সম্মিলিত প্রতিবাদ।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করবার এই সিদ্ধান্ত আন্দোলনের মধ্যে তাৎক্ষণিক এক ঝড় সৃষ্টি করেছে এতে সন্দেহ নেই। তবে এই এই বিস্ফোরণের মূল অন্তর্নিহিত কারণ—একটি ভঙ্গুর, দুর্নীতিগ্রস্ত শাসনব্যবস্থার প্রতি তরুণ প্রজন্মের গভীর ক্ষোভ।

স্ট্রিম: সরকার কেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষিদ্ধ করল?
রমেশ ভুষাল: আসলে, নেপালের সর্বোচ্চ আদালত—সুপ্রিম কোর্ট—একটি রায় দিয়েছিল। সেখানে বলা হয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কোম্পানিগুলোকে নেপালে আনুষ্ঠানিকভাবে নিবন্ধন করতে হবে। এই রায়টি গত বছর দেওয়া হয়েছিল।
মানে, সরকার যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ করল তা তাৎক্ষণিক কোনো সিদ্ধান্ত ছিল না। সরকার সেই পুরানো রায়কে ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করে দাবি করে যে, এই কোম্পানিগুলো নেপালে অবৈধভাবে পরিচালিত হচ্ছে। তাদের নিবন্ধন করা বাধ্যতামূলক। এরপর সরকার তাদের মাত্র এক সপ্তাহের মতো সময় দেয়। কিন্তু সময়টা খুবই অল্প। এই সময়সীমা শেষ হওয়ার পরই সরকার এসব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করে দেয়।
স্ট্রিম: এই আন্দোলন বা উত্তাল পরিস্থিতি কি কোনো সংগঠিত গোষ্ঠী নেতৃত্ব দিচ্ছে?
রমেশ ভুষাল: সরাসরি কোনো স্বীকৃত নেতাদের অস্তিত্ব নেই এই আন্দোলনে। তবে আন্দোলনটি একটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম গ্রুপের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধভাবে এই আন্দোলনকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো কোনো একক গোষ্ঠী তৈরি হয়নি।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আসলে আন্দোলনের নেতা কে? এখন প্রায় সবাই তাদের ক্ষোভ ও রাগ প্রকাশ করছে। ফলে কোনো স্পষ্ট নেতৃত্ব না থাকার কারণে অবস্থা ক্রমশ বিশৃঙ্খল হয়ে উঠতে পারে। বিক্ষোভের সঙ্গে সহিংসতা বা ভাঙচুর আরও বেড়ে যেতে পারে।
মূল সমস্যাটা হলো সরকার এই আন্দোলনের সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না। আর যেই গোষ্ঠী আন্দোলনের সূচনা করেছিল, তাদের কোনো সুসংগঠিত নেতা বা প্রতিনিধি নেই যাদের সঙ্গে সরকার বা অন্য কেউ যোগাযোগ করতে পারে।
এই মুহূর্তে পরিস্থিতি এমন—যেখানে সবাই সবখানে রয়েছে, আবার কোথাও কেউ নেই। মানে, কোনো কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নেই। সবাই নিজের নিজের জায়গা থেকে প্রতিবাদ করছে।

স্ট্রিম: বাংলাদেশের জুলাই আন্দোলন ও গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে কি এই বিক্ষোভের কোনো মিল বা প্রভাব আছে? আপনি কীভাবে দেখছেন বিষয়টি?
রমেশ ভুষাল: আমার মনে হয়, নেপালের পরিস্থিতি বাংলাদেশের তুলনায় আলাদা। তবে কিছু মিল অবশ্যই আছে। দুই ক্ষেত্রেই আন্দোলনের সূচনা হয়েছে তরুণদের হাত ধরে। তরুণেরা হতাশ, ক্ষুব্ধ। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল অনেক বেশি কঠোর। সেখানে ছিল দীর্ঘদিন ধরে একজন ব্যক্তি ও একটি দল কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত শাসনব্যবস্থা। সেখানে শুধু সাধারণ মানুষ নয়, বিরোধী দলগুলোর মধ্যেও এক ধরনের তীব্র হতাশা ও ক্ষোভ জমে ছিল।
নেপালের রাজনৈতিক বাস্তবতা তুলনামূলকভাবে ভিন্ন। এখানে সরকার গঠন হয়েছে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত রাজনৈতিক দলগুলোর মাধ্যমে। হ্যাঁ, মাঝে মাঝে সরকারের পক্ষ থেকেও কিছু নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা দেখা গেছে। কিন্তু নেপালে সব মিলিয়ে একটি তুলনামূলকভাবে উদার রাজনৈতিক পরিবেশ ছিল।
এখানে মূলত যে ব্যাপারটি নিয়ে ক্ষোভ—তা হলো, বছরের পর বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা, বয়সে আশি পেরোনো, অভিজ্ঞ কিন্তু অকার্যকর নেতাদের ব্যর্থতা। তারা জনসাধারণের প্রত্যাশা পূরণে বারবার ব্যর্থ হচ্ছেন। কিন্তু তবুও ক্ষমতা ছাড়ছেন না। এই জায়গা থেকেই তরুণদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়েছে। শুধু তরুণ নয়—যারা আর তরুণ নন কিংবা যারা কোনো রাজনৈতিক দলে নেই, তারাও ক্ষুব্ধ।
সুতরাং, একে একটি দল বা একটি সরকারের বিরুদ্ধে সরাসরি আন্দোলন বলা যাবে না। এই আন্দোলন বরং পুরো ব্যবস্থার মধ্যে থাকা দীর্ঘদিনের স্থবিরতা ও ব্যর্থতার বিরুদ্ধে জনগণের সম্মিলিত হতাশা থেকে জন্ম নেওয়া একটি ক্ষোভ।
এই পরিস্থিতিতে একদম নতুন কিছু রাজনৈতিক শক্তির উত্থানও আমরা দেখছি। নতুন তরুণ নেতা উঠে আসছেন। স্বাধীন মতাদর্শের মানুষ রাজনীতিতে যুক্ত হচ্ছেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা পার্টির কথা। তারা আগের নির্বাচনে ভালো আসন পেয়েছে। এখন সংসদে শক্তিশালী অবস্থানে আছে। একদিকে রাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনার একটা হালকা দাবির সুরও আছে। আবার অন্যদিকে পুরানো দলগুলো তাদের জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে।
সব মিলিয়ে পরিস্থিতি জটিল। এই আন্দোলন শুধু একজন শাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলন নয়, যেমনটা বাংলাদেশে হয়েছিল। তবে হ্যাঁ, নেপালের বিক্ষোভও শুরু হয়েছে তরুণদের এক গভীর হতাশা থেকে। তারা সুযোগ চায়, পরিবর্তন চায়।

স্ট্রিম: আপনি বলছেন নেপালে একটি তুলনামূলকভাবে গণতান্ত্রিক ও সুষ্ঠুভাবে নির্বাচিত সরকার আছে। তাহলে কি এই চলমান সংকটের পেছনে কোনো বহিরাগত প্রভাব, অনুপ্রেরণা বা হস্তক্ষেপ কাজ করছে বলে আপনি মনে করেন?
রমেশ ভুষাল: হ্যাঁ, এমন সম্ভাবনা অবশ্যই রয়েছে। কারণ, নেপাল ভূ-রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত সংবেদনশীল এলাকা। এখানে নানা বৈশ্বিক শক্তির উপস্থিতি রয়েছে। তারা হয়তো এর পেছনে কোনো না কোনোভাবে ভূমিকা রেখেছে। আমরা এখনই নির্দিষ্ট করে বলতে পারছি না যে, তারা কী পরিমাণে প্রভাব ফেলেছে বা এখনো ফেলছে।
তবে এটা সত্য যে যেসব দাবি জনগণ তুলেছে, যেমন—সুশাসন, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন, এইসব চাওয়ার প্রতি জনগণের আবেগ ও প্রত্যাশাকে হয়তো কিছু বাহ্যিক শক্তি কাজে লাগাতে চেয়েছে। কিংবা তাদের আবেগকে পুঁজি করার চেষ্টা করেছে।
আমরা নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছি না। কারণ এখনো পর্যন্ত তাদের সরাসরি কোনো করপোরেট বা রাষ্ট্রীয় ভূমিকা চিহ্নিত করা যায়নি। কিন্তু এটাও সত্য যে ভারত ও চীনের মাঝখানে অবস্থিত হওয়ায় নেপালে এক ধরনের ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা সব সময়ই থাকে। পাশাপাশি নানা আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীরও এখানে আগ্রহ ও সক্রিয়তা রয়েছে। সুতরাং, এরা কেউ হয়তো এমন পরিস্থিতির জন্ম দিতে সাহায্য করেছে বা করছে বা করার চেষ্টা করছে।
নিরাপত্তা বাহিনী যেভাবে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করেছে, সেটি মোটেও একটি স্বাভাবিক ঘটনা নয়। নেপালে অতীতেও বহু গণতান্ত্রিক আন্দোলন হয়েছে। কিন্তু কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এমন ‘টার্গেটেড কিলিং’-এর নজির আগে দেখা যায়নি।
আমরা জানি না, এর পেছনে ভেতরে ভেতরে কী ঘটেছে। কিন্তু এটুকু পরিষ্কার— এটি স্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়। হয়তো ইচ্ছাকৃতভাবে একটি সহিংস পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে, যাতে আন্দোলন চরমে ওঠে। সরকার বা নিরাপত্তা বাহিনী যা করেছে, তা কোনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার আওতায় পড়ে না। এভাবে নির্বিচারে বলপ্রয়োগ, নাগরিক হত্যা—এটি বর্বরতা। সরকার মানুষের বিরুদ্ধে, নিজের দেশের নাগরিকদের বিরুদ্ধে এই ধরনের আচরণ করতে পারে না। বিশেষ করে যখন তারা শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করছিল।
এত কিছু করার কোনও দরকারই ছিল না। পরিস্থিতি যা ছিল তাকে খুব সহজভাবে সমাধান করা যেত। কিন্তু সরকার সেটা করেনি। বরং সরকার আরও সহিংস প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। এখন বিবিসির তথ্য অনুযায়ী, অন্তত ২২ জন নিহত হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন? কেন এমনটা করতে হলো?
আমি মনে করি, প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অত্যন্ত ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেছেন। তিনি বাস্তবতা বুঝতে পারেননি। তরুণ প্রজন্ম কী চাইছে, কী ভাবছে, তিনি সেটি অনুধাবন করতে পারেননি। তিনি একদিকে অযোগ্য, অন্যদিকে খুব অহংকারী। তিনি যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন। এই সংকট তাঁরই তৈরি করা।
এই অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব ছিল, যদি তিনি নম্র হতেন, আগে থেকেই জনগণের কথা শুনতেন। কিন্তু তিনি এসব কিছুই করলেন না। তিনি বহুদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে এসেছেন। তিনি পরিস্থিতি এমন জায়গায় নিয়ে এসেছেন, যেখানে তাঁকে এই সংকটের মুখোমুখি হতে হয়েছে।
সরকারকে বুঝতে হবে—মানুষ তাদের ওপর আর আস্থা রাখছে না। আবার, সাধারণ জনগণকেও বুঝতে হবে—সহিংসতা দিয়ে সমস্যার সমাধান আসবে না। আমরা যদি সত্যি উন্নত, সমৃদ্ধ ও স্থিতিশীল দেশ চাই, তবে আমাদের শান্তিপূর্ণভাবে কিন্তু দৃঢ়ভাবে নিজেদের বক্তব্য জানাতে হবে। ভবিষ্যতের জন্য এটাই সম্ভবত একমাত্র পথ।

স্ট্রিম: বিক্ষোভকারীদের মূল দাবিগুলো কী? তারা ঠিক কী চায়?
রমেশ ভুষাল: বিক্ষোভকারীদের সবচেয়ে বড় ও সরাসরি দাবি ছিলো—প্রধানমন্ত্রীর অবিলম্বে পদত্যাগ। তারা মনে করেন, এই সরকার আর জনগণের আস্থার যোগ্য নয়। তবে এখানেই থেমে নেই তাদের দাবি। শুধু একজন প্রধানমন্ত্রীর বিদায় নয়, তারা চাচ্ছে—এই ‘পুরানো, বয়স্ক, ব্যর্থ নেতৃত্বের বৃত্ত’ থেকে দেশকে বের করে আনা হোক।
বিক্ষোভকারীরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে তিনজন নেতা—মূলত নেপালের কমিউনিস্ট পার্টির কেপি শর্মা অলি (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী), পুষ্পকমল দাহাল প্রচণ্ড এবং আরেকজন প্রবীণ নেতা—ঘুরে ফিরে বারবার প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন। এঁরা সবাই বহুবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। এক ধরনের ‘গণতান্ত্রিক সিন্ডিকেট’ তৈরি করে রেখেছেন তাঁরা। এমন অবস্থায় সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ বা নবীন নেতৃত্বের উত্থান অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
এই ‘গণতন্ত্রের সিন্ডিকেটাইজেশন’ বা দলীয় শাসনের দুষ্টচক্রই এখন বিক্ষোভকারীদের অন্যতম প্রধান উদ্বেগ ও প্রতিবাদের কারণ। তারা বলছে, শুধু সরকার পরিবর্তন নয়, এই পরিবর্তনের অর্থ হতে হবে নতুন ও তরুণ নেতৃত্বের উত্থান। এমন নেতৃত্ব যারা সত্যিকারের সংস্কার আনতে পারবে।
তাদের আশা, একটি নতুন নেতৃত্ব। তারা হবে তরুণ, সাহসী ও দূরদর্শী। তাদের দাবি এমন সরকার গঠন করা যারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেবে, জনগণের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করবে আর তরুণ প্রজন্মের কণ্ঠস্বর শুনবে, তাতে গুরুত্ব দেবে।
তারা বলেছে— সেই পুরানো মানুষদের দিয়ে নতুন কিছু সম্ভব নয়। নেতৃত্বে পরিবর্তন শুধু মুখে নয়, আনতে হবে মানসিকতা ও প্রজন্মের দৃষ্টিভঙ্গিতে। তারা এই রকম একটি আশাব্যঞ্জক রূপান্তর আশা করছে। আমরাও আশাবাদী—এই আন্দোলন দেশের জন্য ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা হতে পারে।
স্ট্রিম: এই গণআন্দোলনের প্রেক্ষাপটে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান কী? তারা কি বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে আছে? তাদের দাবি-দাওয়ার মধ্যে কি মিল আছে?
রমেশ ভুষাল: হ্যাঁ, বিরোধী দলগুলোও প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ চেয়েছে। তাদের বক্তব্য হলো এই সরকার আর জনগণের আস্থা ধরে রাখতে পারেনি। তাই সরকারকে দ্রুত বিদায় নিতে হবে।
যদিও বিরোধী শিবির নিজেরাই বেশ দুর্বল অবস্থানে রয়েছে। কারণ, বর্তমান ক্ষমতাসীন জোট গঠিত হয়েছে দুটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল নিয়ে। তারা আগে বিরোধী অবস্থানে থাকলেও পরে মিলিতভাবে সরকার গঠন করে। ফলে বিরোধী পক্ষ অনেকটাই দুর্বল হয়ে গেছে।

প্রায় সব পক্ষের প্রাথমিক দাবি ছিল একটাই— এই সরকারকে সরে যেতে হবে। এরপর কী হবে, নতুন সরকার কীভাবে গঠিত হবে, সেই বিষয়ে এখনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা বা ঐকমত্য গড়ে ওঠেনি।
সোজা কথায়, আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বিরোধী দলগুলোর প্রথম ধাপে দাবি মিলে গেছে— আগে সরকার বিদায় হোক। তবে তাদের মধ্যে ভবিষ্যৎ কৌশল বা রূপরেখা নিয়ে এখনো কিছুটা ধোঁয়াশা রয়েছে।
স্ট্রিম: এই আন্দোলন কি নেপালের বিদ্যমান রাজনৈতিক কাঠামোর ব্যর্থতার ফল? নাকি পুরনো রাজতন্ত্রবিরোধী বিপ্লব ব্যর্থ হয়েছে বলেই নতুন করে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে? আপনি কী মনে করেন— নেপালের রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা তরুণদের শক্তিকে অবমূল্যায়ন করেছে?
রমেশ ভুষাল: আমি নিশ্চিতভাবে মনে করি, তরুণদের শক্তিকে রাজনৈতিক নেতৃত্ব যথেষ্টভাবে গুরুত্ব দেয়নি। বরং পুরোপুরি অবমূল্যায়ন করেছে। এটা স্পষ্ট যে, একটা অংশ নেপালে রাজতন্ত্র ফেরানোর চেষ্টা করছে। তারা হয়তো এই আন্দোলনের নেপথ্যে কিছু ভূমিকা রেখেছে।
কিন্তু আমার দৃষ্টিতে এই আন্দোলন সরাসরি রাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনার জন্য নয়। এটা কোনোভাবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরোধিতা নয়। আন্দোলন বরং তাদের বিরুদ্ধে যারা গণতন্ত্রের সুযোগ নিয়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছে, গণতন্ত্রকে অপব্যবহার করছে।
এই বিক্ষোভের মূল বার্তা গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে নয়। বরং যারা গণতন্ত্রকে বিকৃত করছে তাদের বিরুদ্ধে। জনগণের মধ্যে বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে এই উপলব্ধি গভীরভাবে তৈরি হয়েছে।
আমি মনে করি, নেপালের বেশিরভাগ মানুষই রাজতন্ত্র ফেরানোর পক্ষে নন এবং তারা তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার হারাতে চান না।

ব্যাপক গণবিক্ষোভের দ্বিতীয় দিনেই পদত্যাগ করেছেন নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলি। এর আগে বিক্ষোভের প্রথমদিন সোমবার সন্ধ্যায় দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও পদত্যাগ করেছিলেন। বিশেষ করে জেনারেশন জেড তথা জেন জি-র সক্রিয় অংশগ্রহণ আন্দোলনকে অপ্রত্যাশিত মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে।
এই আন্দোলন আকস্মিক কিনা, নতুন পরিস্থিতিতে দেশটির অভিমুখ কোন দিকে যেতে পারে, আন্দোলনকারীদের দাবি কী ছিল, এতে কোন কোন নিয়ামকগুলো ভূমিকা পালন করেছে—এসব বিষয়ে স্ট্রিমের সঙ্গে বিষদ আলোচনা করেছেন দেশটির প্রখ্যাত সাংবাদিক রমেশ ভুষাল।
স্ট্রিম: এই আন্দোলনের সূচনা কোথা থেকে, কীভাবে গড়ে উঠল এবং কীভাবে তা ছড়িয়ে পড়ল?
রমেশ ভুষাল: এই আন্দোলনের শুরু কোথা থেকে এবং কীভাবে এটি ছড়িয়ে পড়ে—তা বুঝতে হলে আগে দেখতে হবে এর পেছনের প্রেক্ষাপট।
মূলত ‘জেনারেশন জেড’ নামে পরিচিত তরুণরা রাস্তায় নেমে এসে সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করে। তাদের প্রধান অভিযোগ ছিল—দেশ দুর্নীতিগ্রস্তদের হাতে চলে গেছে। রাজনীতিবিদেরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখছেন না। এই দীর্ঘস্থায়ী দুর্নীতি ও অনিয়মে তরুণসমাজ চরম হতাশায় ভুগছিল।
এর মধ্যেই নেপাল সরকার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়। কারণ হিসেবে জানানো হয়, এইসব প্ল্যাটফর্ম নেপালে আনুষ্ঠানিকভাবে নিবন্ধিত নয়। সরকারের এই সিদ্ধান্ত তরুণদের ক্ষোভে ঘি ঢেলে দেয়।
তারা মনে করে, এভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করে তাদের মত প্রকাশের অধিকার হরণ করা হচ্ছে। সরকারের এই পদক্ষেপকে তারা নিয়ন্ত্রণমূলক ও কর্তৃত্ববাদী বলে মনে করে। ফলে তারা প্রতিবাদে ফেটে পড়ে।
তবে আন্দোলনের উদ্দেশ্য কেবল ফেসবুক বা টিকটক নিষিদ্ধের বিরোধিতা নয়। এটি ছিল বহুদিনের জমে থাকা হতাশা ও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়া দুর্নীতি, রাজনৈতিক স্বচ্ছতার অভাব এবং তরুণদের কণ্ঠ রোধ করার চেষ্টার বিরুদ্ধে এক সম্মিলিত প্রতিবাদ।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করবার এই সিদ্ধান্ত আন্দোলনের মধ্যে তাৎক্ষণিক এক ঝড় সৃষ্টি করেছে এতে সন্দেহ নেই। তবে এই এই বিস্ফোরণের মূল অন্তর্নিহিত কারণ—একটি ভঙ্গুর, দুর্নীতিগ্রস্ত শাসনব্যবস্থার প্রতি তরুণ প্রজন্মের গভীর ক্ষোভ।

স্ট্রিম: সরকার কেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষিদ্ধ করল?
রমেশ ভুষাল: আসলে, নেপালের সর্বোচ্চ আদালত—সুপ্রিম কোর্ট—একটি রায় দিয়েছিল। সেখানে বলা হয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কোম্পানিগুলোকে নেপালে আনুষ্ঠানিকভাবে নিবন্ধন করতে হবে। এই রায়টি গত বছর দেওয়া হয়েছিল।
মানে, সরকার যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ করল তা তাৎক্ষণিক কোনো সিদ্ধান্ত ছিল না। সরকার সেই পুরানো রায়কে ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করে দাবি করে যে, এই কোম্পানিগুলো নেপালে অবৈধভাবে পরিচালিত হচ্ছে। তাদের নিবন্ধন করা বাধ্যতামূলক। এরপর সরকার তাদের মাত্র এক সপ্তাহের মতো সময় দেয়। কিন্তু সময়টা খুবই অল্প। এই সময়সীমা শেষ হওয়ার পরই সরকার এসব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করে দেয়।
স্ট্রিম: এই আন্দোলন বা উত্তাল পরিস্থিতি কি কোনো সংগঠিত গোষ্ঠী নেতৃত্ব দিচ্ছে?
রমেশ ভুষাল: সরাসরি কোনো স্বীকৃত নেতাদের অস্তিত্ব নেই এই আন্দোলনে। তবে আন্দোলনটি একটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম গ্রুপের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধভাবে এই আন্দোলনকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো কোনো একক গোষ্ঠী তৈরি হয়নি।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আসলে আন্দোলনের নেতা কে? এখন প্রায় সবাই তাদের ক্ষোভ ও রাগ প্রকাশ করছে। ফলে কোনো স্পষ্ট নেতৃত্ব না থাকার কারণে অবস্থা ক্রমশ বিশৃঙ্খল হয়ে উঠতে পারে। বিক্ষোভের সঙ্গে সহিংসতা বা ভাঙচুর আরও বেড়ে যেতে পারে।
মূল সমস্যাটা হলো সরকার এই আন্দোলনের সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না। আর যেই গোষ্ঠী আন্দোলনের সূচনা করেছিল, তাদের কোনো সুসংগঠিত নেতা বা প্রতিনিধি নেই যাদের সঙ্গে সরকার বা অন্য কেউ যোগাযোগ করতে পারে।
এই মুহূর্তে পরিস্থিতি এমন—যেখানে সবাই সবখানে রয়েছে, আবার কোথাও কেউ নেই। মানে, কোনো কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নেই। সবাই নিজের নিজের জায়গা থেকে প্রতিবাদ করছে।

স্ট্রিম: বাংলাদেশের জুলাই আন্দোলন ও গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে কি এই বিক্ষোভের কোনো মিল বা প্রভাব আছে? আপনি কীভাবে দেখছেন বিষয়টি?
রমেশ ভুষাল: আমার মনে হয়, নেপালের পরিস্থিতি বাংলাদেশের তুলনায় আলাদা। তবে কিছু মিল অবশ্যই আছে। দুই ক্ষেত্রেই আন্দোলনের সূচনা হয়েছে তরুণদের হাত ধরে। তরুণেরা হতাশ, ক্ষুব্ধ। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল অনেক বেশি কঠোর। সেখানে ছিল দীর্ঘদিন ধরে একজন ব্যক্তি ও একটি দল কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত শাসনব্যবস্থা। সেখানে শুধু সাধারণ মানুষ নয়, বিরোধী দলগুলোর মধ্যেও এক ধরনের তীব্র হতাশা ও ক্ষোভ জমে ছিল।
নেপালের রাজনৈতিক বাস্তবতা তুলনামূলকভাবে ভিন্ন। এখানে সরকার গঠন হয়েছে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত রাজনৈতিক দলগুলোর মাধ্যমে। হ্যাঁ, মাঝে মাঝে সরকারের পক্ষ থেকেও কিছু নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা দেখা গেছে। কিন্তু নেপালে সব মিলিয়ে একটি তুলনামূলকভাবে উদার রাজনৈতিক পরিবেশ ছিল।
এখানে মূলত যে ব্যাপারটি নিয়ে ক্ষোভ—তা হলো, বছরের পর বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা, বয়সে আশি পেরোনো, অভিজ্ঞ কিন্তু অকার্যকর নেতাদের ব্যর্থতা। তারা জনসাধারণের প্রত্যাশা পূরণে বারবার ব্যর্থ হচ্ছেন। কিন্তু তবুও ক্ষমতা ছাড়ছেন না। এই জায়গা থেকেই তরুণদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়েছে। শুধু তরুণ নয়—যারা আর তরুণ নন কিংবা যারা কোনো রাজনৈতিক দলে নেই, তারাও ক্ষুব্ধ।
সুতরাং, একে একটি দল বা একটি সরকারের বিরুদ্ধে সরাসরি আন্দোলন বলা যাবে না। এই আন্দোলন বরং পুরো ব্যবস্থার মধ্যে থাকা দীর্ঘদিনের স্থবিরতা ও ব্যর্থতার বিরুদ্ধে জনগণের সম্মিলিত হতাশা থেকে জন্ম নেওয়া একটি ক্ষোভ।
এই পরিস্থিতিতে একদম নতুন কিছু রাজনৈতিক শক্তির উত্থানও আমরা দেখছি। নতুন তরুণ নেতা উঠে আসছেন। স্বাধীন মতাদর্শের মানুষ রাজনীতিতে যুক্ত হচ্ছেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা পার্টির কথা। তারা আগের নির্বাচনে ভালো আসন পেয়েছে। এখন সংসদে শক্তিশালী অবস্থানে আছে। একদিকে রাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনার একটা হালকা দাবির সুরও আছে। আবার অন্যদিকে পুরানো দলগুলো তাদের জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে।
সব মিলিয়ে পরিস্থিতি জটিল। এই আন্দোলন শুধু একজন শাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলন নয়, যেমনটা বাংলাদেশে হয়েছিল। তবে হ্যাঁ, নেপালের বিক্ষোভও শুরু হয়েছে তরুণদের এক গভীর হতাশা থেকে। তারা সুযোগ চায়, পরিবর্তন চায়।

স্ট্রিম: আপনি বলছেন নেপালে একটি তুলনামূলকভাবে গণতান্ত্রিক ও সুষ্ঠুভাবে নির্বাচিত সরকার আছে। তাহলে কি এই চলমান সংকটের পেছনে কোনো বহিরাগত প্রভাব, অনুপ্রেরণা বা হস্তক্ষেপ কাজ করছে বলে আপনি মনে করেন?
রমেশ ভুষাল: হ্যাঁ, এমন সম্ভাবনা অবশ্যই রয়েছে। কারণ, নেপাল ভূ-রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত সংবেদনশীল এলাকা। এখানে নানা বৈশ্বিক শক্তির উপস্থিতি রয়েছে। তারা হয়তো এর পেছনে কোনো না কোনোভাবে ভূমিকা রেখেছে। আমরা এখনই নির্দিষ্ট করে বলতে পারছি না যে, তারা কী পরিমাণে প্রভাব ফেলেছে বা এখনো ফেলছে।
তবে এটা সত্য যে যেসব দাবি জনগণ তুলেছে, যেমন—সুশাসন, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন, এইসব চাওয়ার প্রতি জনগণের আবেগ ও প্রত্যাশাকে হয়তো কিছু বাহ্যিক শক্তি কাজে লাগাতে চেয়েছে। কিংবা তাদের আবেগকে পুঁজি করার চেষ্টা করেছে।
আমরা নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছি না। কারণ এখনো পর্যন্ত তাদের সরাসরি কোনো করপোরেট বা রাষ্ট্রীয় ভূমিকা চিহ্নিত করা যায়নি। কিন্তু এটাও সত্য যে ভারত ও চীনের মাঝখানে অবস্থিত হওয়ায় নেপালে এক ধরনের ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা সব সময়ই থাকে। পাশাপাশি নানা আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীরও এখানে আগ্রহ ও সক্রিয়তা রয়েছে। সুতরাং, এরা কেউ হয়তো এমন পরিস্থিতির জন্ম দিতে সাহায্য করেছে বা করছে বা করার চেষ্টা করছে।
নিরাপত্তা বাহিনী যেভাবে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করেছে, সেটি মোটেও একটি স্বাভাবিক ঘটনা নয়। নেপালে অতীতেও বহু গণতান্ত্রিক আন্দোলন হয়েছে। কিন্তু কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এমন ‘টার্গেটেড কিলিং’-এর নজির আগে দেখা যায়নি।
আমরা জানি না, এর পেছনে ভেতরে ভেতরে কী ঘটেছে। কিন্তু এটুকু পরিষ্কার— এটি স্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়। হয়তো ইচ্ছাকৃতভাবে একটি সহিংস পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে, যাতে আন্দোলন চরমে ওঠে। সরকার বা নিরাপত্তা বাহিনী যা করেছে, তা কোনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার আওতায় পড়ে না। এভাবে নির্বিচারে বলপ্রয়োগ, নাগরিক হত্যা—এটি বর্বরতা। সরকার মানুষের বিরুদ্ধে, নিজের দেশের নাগরিকদের বিরুদ্ধে এই ধরনের আচরণ করতে পারে না। বিশেষ করে যখন তারা শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করছিল।
এত কিছু করার কোনও দরকারই ছিল না। পরিস্থিতি যা ছিল তাকে খুব সহজভাবে সমাধান করা যেত। কিন্তু সরকার সেটা করেনি। বরং সরকার আরও সহিংস প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। এখন বিবিসির তথ্য অনুযায়ী, অন্তত ২২ জন নিহত হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন? কেন এমনটা করতে হলো?
আমি মনে করি, প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অত্যন্ত ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেছেন। তিনি বাস্তবতা বুঝতে পারেননি। তরুণ প্রজন্ম কী চাইছে, কী ভাবছে, তিনি সেটি অনুধাবন করতে পারেননি। তিনি একদিকে অযোগ্য, অন্যদিকে খুব অহংকারী। তিনি যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন। এই সংকট তাঁরই তৈরি করা।
এই অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব ছিল, যদি তিনি নম্র হতেন, আগে থেকেই জনগণের কথা শুনতেন। কিন্তু তিনি এসব কিছুই করলেন না। তিনি বহুদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে এসেছেন। তিনি পরিস্থিতি এমন জায়গায় নিয়ে এসেছেন, যেখানে তাঁকে এই সংকটের মুখোমুখি হতে হয়েছে।
সরকারকে বুঝতে হবে—মানুষ তাদের ওপর আর আস্থা রাখছে না। আবার, সাধারণ জনগণকেও বুঝতে হবে—সহিংসতা দিয়ে সমস্যার সমাধান আসবে না। আমরা যদি সত্যি উন্নত, সমৃদ্ধ ও স্থিতিশীল দেশ চাই, তবে আমাদের শান্তিপূর্ণভাবে কিন্তু দৃঢ়ভাবে নিজেদের বক্তব্য জানাতে হবে। ভবিষ্যতের জন্য এটাই সম্ভবত একমাত্র পথ।

স্ট্রিম: বিক্ষোভকারীদের মূল দাবিগুলো কী? তারা ঠিক কী চায়?
রমেশ ভুষাল: বিক্ষোভকারীদের সবচেয়ে বড় ও সরাসরি দাবি ছিলো—প্রধানমন্ত্রীর অবিলম্বে পদত্যাগ। তারা মনে করেন, এই সরকার আর জনগণের আস্থার যোগ্য নয়। তবে এখানেই থেমে নেই তাদের দাবি। শুধু একজন প্রধানমন্ত্রীর বিদায় নয়, তারা চাচ্ছে—এই ‘পুরানো, বয়স্ক, ব্যর্থ নেতৃত্বের বৃত্ত’ থেকে দেশকে বের করে আনা হোক।
বিক্ষোভকারীরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে তিনজন নেতা—মূলত নেপালের কমিউনিস্ট পার্টির কেপি শর্মা অলি (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী), পুষ্পকমল দাহাল প্রচণ্ড এবং আরেকজন প্রবীণ নেতা—ঘুরে ফিরে বারবার প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন। এঁরা সবাই বহুবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। এক ধরনের ‘গণতান্ত্রিক সিন্ডিকেট’ তৈরি করে রেখেছেন তাঁরা। এমন অবস্থায় সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ বা নবীন নেতৃত্বের উত্থান অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
এই ‘গণতন্ত্রের সিন্ডিকেটাইজেশন’ বা দলীয় শাসনের দুষ্টচক্রই এখন বিক্ষোভকারীদের অন্যতম প্রধান উদ্বেগ ও প্রতিবাদের কারণ। তারা বলছে, শুধু সরকার পরিবর্তন নয়, এই পরিবর্তনের অর্থ হতে হবে নতুন ও তরুণ নেতৃত্বের উত্থান। এমন নেতৃত্ব যারা সত্যিকারের সংস্কার আনতে পারবে।
তাদের আশা, একটি নতুন নেতৃত্ব। তারা হবে তরুণ, সাহসী ও দূরদর্শী। তাদের দাবি এমন সরকার গঠন করা যারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেবে, জনগণের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করবে আর তরুণ প্রজন্মের কণ্ঠস্বর শুনবে, তাতে গুরুত্ব দেবে।
তারা বলেছে— সেই পুরানো মানুষদের দিয়ে নতুন কিছু সম্ভব নয়। নেতৃত্বে পরিবর্তন শুধু মুখে নয়, আনতে হবে মানসিকতা ও প্রজন্মের দৃষ্টিভঙ্গিতে। তারা এই রকম একটি আশাব্যঞ্জক রূপান্তর আশা করছে। আমরাও আশাবাদী—এই আন্দোলন দেশের জন্য ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা হতে পারে।
স্ট্রিম: এই গণআন্দোলনের প্রেক্ষাপটে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান কী? তারা কি বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে আছে? তাদের দাবি-দাওয়ার মধ্যে কি মিল আছে?
রমেশ ভুষাল: হ্যাঁ, বিরোধী দলগুলোও প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ চেয়েছে। তাদের বক্তব্য হলো এই সরকার আর জনগণের আস্থা ধরে রাখতে পারেনি। তাই সরকারকে দ্রুত বিদায় নিতে হবে।
যদিও বিরোধী শিবির নিজেরাই বেশ দুর্বল অবস্থানে রয়েছে। কারণ, বর্তমান ক্ষমতাসীন জোট গঠিত হয়েছে দুটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল নিয়ে। তারা আগে বিরোধী অবস্থানে থাকলেও পরে মিলিতভাবে সরকার গঠন করে। ফলে বিরোধী পক্ষ অনেকটাই দুর্বল হয়ে গেছে।

প্রায় সব পক্ষের প্রাথমিক দাবি ছিল একটাই— এই সরকারকে সরে যেতে হবে। এরপর কী হবে, নতুন সরকার কীভাবে গঠিত হবে, সেই বিষয়ে এখনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা বা ঐকমত্য গড়ে ওঠেনি।
সোজা কথায়, আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বিরোধী দলগুলোর প্রথম ধাপে দাবি মিলে গেছে— আগে সরকার বিদায় হোক। তবে তাদের মধ্যে ভবিষ্যৎ কৌশল বা রূপরেখা নিয়ে এখনো কিছুটা ধোঁয়াশা রয়েছে।
স্ট্রিম: এই আন্দোলন কি নেপালের বিদ্যমান রাজনৈতিক কাঠামোর ব্যর্থতার ফল? নাকি পুরনো রাজতন্ত্রবিরোধী বিপ্লব ব্যর্থ হয়েছে বলেই নতুন করে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে? আপনি কী মনে করেন— নেপালের রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা তরুণদের শক্তিকে অবমূল্যায়ন করেছে?
রমেশ ভুষাল: আমি নিশ্চিতভাবে মনে করি, তরুণদের শক্তিকে রাজনৈতিক নেতৃত্ব যথেষ্টভাবে গুরুত্ব দেয়নি। বরং পুরোপুরি অবমূল্যায়ন করেছে। এটা স্পষ্ট যে, একটা অংশ নেপালে রাজতন্ত্র ফেরানোর চেষ্টা করছে। তারা হয়তো এই আন্দোলনের নেপথ্যে কিছু ভূমিকা রেখেছে।
কিন্তু আমার দৃষ্টিতে এই আন্দোলন সরাসরি রাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনার জন্য নয়। এটা কোনোভাবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরোধিতা নয়। আন্দোলন বরং তাদের বিরুদ্ধে যারা গণতন্ত্রের সুযোগ নিয়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছে, গণতন্ত্রকে অপব্যবহার করছে।
এই বিক্ষোভের মূল বার্তা গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে নয়। বরং যারা গণতন্ত্রকে বিকৃত করছে তাদের বিরুদ্ধে। জনগণের মধ্যে বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে এই উপলব্ধি গভীরভাবে তৈরি হয়েছে।
আমি মনে করি, নেপালের বেশিরভাগ মানুষই রাজতন্ত্র ফেরানোর পক্ষে নন এবং তারা তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার হারাতে চান না।
.png)

পাকিস্তানের পারমাণবিক বোমার রূপকার মনে করা হয় পাকিস্তানের পরমাণু বিজ্ঞানী আবদুল কাদির খানকে। সেই কাদির খানকে হত্যা করতে পারতো যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু সৌদি আরবের অনুরোধে তিনি বেঁচে যান।
৪ ঘণ্টা আগে
বিশ্ব বাজার থেকে রাশিয়ান ‘তেল ও গ্যাস সরানোর প্রতিশ্রুতি’ দিয়েছে বিশ্বের ২০টির বেশি দেশ। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে যুদ্ধ থামাতে চাপের অংশ হিসেবে ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন জানাতে এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছে দেশগুলো।
৬ ঘণ্টা আগে
যুক্তরাষ্ট্র হঠাৎ করেই ক্যারিবীয়ান সাগরে ভেনেজুয়েলার আশপাশে সামরিক উপস্থিতি বাড়াতে থাকে। সামরিক উপস্থিতি বাড়ানো মানে—বিশ্বের সর্ববৃহৎ রণতরী থেকে শুরু করে এফ-৩৫ যুদ্ধ বিমান, পরমাণু শক্তি চালিত সাবমেরিন এবং কয়েক হাজার সেনার উপস্থিতি।
৮ ঘণ্টা আগে
তুরস্কের পশ্চিমাঞ্চলীয় মুগলা প্রদেশের উপকূলে অভিবাসীদের বহনকারী রাবারের নৌকা ডুবে অন্তত ১৪ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। স্থানীয় গভর্নরের কার্যালয় জানিয়েছে, সম্ভাব্য জীবিতদের সন্ধানে ব্যাপক তল্লাশি ও উদ্ধার অভিযান চলছে।
২০ ঘণ্টা আগে