leadT1ad

কোথায় হারিয়ে গেল মিমি চকলেটের দিনগুলো সেই?

একটা সময় ছিল, যখন মিমি চকলেট মানেই ছিল শৈশবের উচ্ছ্বাস। এখন সেটা শুধুই স্মৃতি। বিদেশি চকলেটের ভিড়ে হারিয়ে গেছে দেশি 'মিমি'। আজ বিশ্ব চকলেট দিবসে ফিরে দেখা যাক সেই মিমি চকলেটের গল্প। যেখানে জড়িয়ে আছে গোটা একটা প্রজন্মের নস্টালজিয়া, আর এক নির্মম শিল্প-বাস্তবতা।

শতাব্দীকা ঊর্মি
প্রকাশ : ০৭ জুলাই ২০২৫, ২০: ৩১
স্ট্রিম গ্রাফিক

‘বড় ভাইয়ার সঙ্গে প্রথম মারামারি করেছিলাম মিমি চকলেট নিয়ে। আম্মা একটা মিমি চকলেট কেনার টাকা দিয়েছিলেন। শর্ত ছিল দুজনে মিলে একটা চকলেট খেতে হবে। আহা, সেই শৈশব সেই মিমি চকলেট। এখন তো ইচ্ছা করলেও সেটা খাওয়া যায় না।’—বলছিলেন স্কুল শিক্ষক এহসান রহমান।

চোখেমুখে নস্টালজিয়া আর ছিল মিমি চকলেট খেতে না পারার আক্ষেপ। আজ বিশ্ব চকলেট দিবস। সত্তর ও আশির দশকে এদেশে জন্ম নেওয়া অনেকের শৈশবের স্মৃতির বড় অংশ জুড়ে আছে এই মিমি চকলেট।

দেশের চকলেট বাজারে তখনও বিদেশি চকলেটের আধিপত্য ছিল না। ফলে দেশে উৎপাদিত মিমি চকলেটই দীর্ঘকাল ছিল চাহিদার শীর্ষে।

কোথায় হারিয়ে গেল এই চকলেট?

মিমি চকলেটের জনপ্রিয়তা ধীরে ধীরে কমতে থাকে নব্বইয়ের দশকে। বিদেশি ব্র্যান্ডের প্রভাবে বাজারে প্রতিযোগিতায় হারতে শুরু করে মিমি চকলেট।

স্বাধীনতার পর তেজগাঁওয়ে অবস্থিত বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের কারখানা থেকে তৈরি করা হতো মিমি চকলেট।

মিমি চকলেটের উৎপাদন বন্ধ হওয়ার কারণ জানতে কথা হয় বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের বাণিজ্য ও উন্নয়ন বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক জামিল আহমেদের সঙ্গে। তিনি স্ট্রিমকে জানান, বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা যাচ্ছিল না। লোকসানের জন্যেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ফ্যাক্টরি।

মিমি চকলেটের উৎপাদন বন্ধ হওয়ার বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহবুবের রহমানের সঙ্গে দেখা করে বাংলাস্ট্রিম। তিনি বলেন, বিভিন্ন দেশের চকলেট আমদানির কারণে মিমি চকলেটের প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার অনেক ক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল। ব্যবসায় লোকসান তো ছিলই। সরকারি এই খাতে ইনোভেশন নেই, নেই কোনো মার্কেট স্টাডি। আমাদের গবেষণা ও উন্নয়ন খাত খুবই দুর্বল। অদক্ষতার কারণে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা যায়নি।

২০০৬ সালে কর্তৃপক্ষ কোম্পানি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে ইতিহাস তখনো মিমিকে পুরোপুরি বিদায় দেয়নি। ২০০৯ সালে সরকার মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের আওতাধীন কয়েকটি সংস্থাকে ১২৬ কোটি টাকার ঋণ দেওয়ার ঘোষণা দেয়। এই আর্থিক সহায়তার তালিকায় ছিল মিমি চকলেট কোম্পানিও। মনে হচ্ছিল, মিমি বুঝি আবারও ঘুরে দাঁড়াবে।

তবে কোম্পানির যন্ত্রপাতি এতটাই পুরোনো হয়ে পড়েছিল যে আধুনিক চাহিদার সঙ্গে তাল মেলানো সম্ভব হচ্ছিল না। উৎপাদন ছিল অস্বাভাবিক রকম ব্যয়বহুল, আর প্রতিযোগীরা তখন বাজারে নানা ধরনের বিদেশি চকলেট এনে ফেলেছে। ফলে মিমির প্রতি মানুষের আগ্রহ ক্রমেই হ্রাস পায়।

একসময় কোটি টাকা ব্যবসা করা মিমির ২০১৪ সাল নাগাদ বার্ষিক বিক্রি কমে দাঁড়ায় মাত্র ১৫-২০ লাখ টাকায়। সব দিক বিবেচনা করে কর্তৃপক্ষ শেষ পর্যন্ত কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়।

মিমি চকলেটের হারিয়ে যাওয়া ও ‘বড়লোকি’ চকলেট

২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বিদেশি চকলেটের শুল্কায়ন মূল্য ইউনিটপ্রতি ৪ ডলারের বদলে ১০ ডলার করা হয়েছে, যার ফলে বেড়েছে চকলেটের দাম। বিদেশি চকলেট খাওয়া সব সময়ই ছিল একটা বিলাসী ব্যাপার। দেশি চকলেটগুলোও গুণে-মানে হয়ে উঠতে পারেনি বিদেশি চকলেটের সমান। ফলে চকলেটের শখ পূরণ করতে ঘুরে-ফিরে যেতে হয় দামি বিদেশি চকলেটের কাছে। চকলেট খাওয়াও হয়ে উঠছে যেন এক ‘স্ট্যাটাস সিম্বল’।

মিমি চকলেটের হারিয়ে যাওয়া যেমন একটি প্রজন্মের নস্টালজিয়ার গল্প, তেমনি বিদেশি চকলেটের উত্থানও শ্রেণিবৈষম্য, বৈশ্বিক শোষণের ছবি। আজ চকলেট দিবসে ভাবা যেতে পারে, চকলেট উৎপাদনের পেছনে কারা হারিয়ে যায়, আর কারা চুপচাপ হারিয়ে যেতে দিতে থাকে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত