মেক্সিকোর কিংবদন্তি শিল্পী ফ্রিদা কাহলোর জন্মদিন আজ। ১৯০৭ সালের আজকের দিনে মেক্সিকো সিটির ঠিক বাইরে সুন্দর এক ‘নীল বাড়ি’তে জন্মেছিলেন তিনি। বেঁচে ছিলেন মাত্র ৪৭ বছর। 'ফ্রিদা কাহলোর জীবনের খণ্ড খণ্ড ছবি: ফ্রিদা কাহলোর শেষ সাক্ষাৎকার' শিরোনামে তাঁর সঙ্গে এই আলাপচারিতায় অংশ নিয়েছিলেন রাকেল তিবোল। 'নভেদাদেস: মেক্সিকো এন লা কালচারা' ম্যাগাজিনে ১৯৫৪ সালে কথোপকথনটি প্রকাশিত হয়। এখানে নিজেকে উজাড় করে প্রকাশ করেছিলেন ‘বিষাদের সন্তান’ হিসেবে খ্যাত এই চিত্রকর। অনুবাদ করেছেন শৈলী আখন্দ
স্ট্রিম ডেস্ক
ফ্রিদা কাহলো বারবার এঁকেছেন নিজেকেই। তিনি ছবি এঁকেছেন যতগুলো, তাঁর মধ্যে পঞ্চান্নটিই ছিল আত্মপ্রতিকৃতি। ‘ফ্রিদা কাহলোর জীবনের খণ্ড খণ্ড ছবি: ফ্রিদা কাহলোর শেষ সাক্ষাৎকার’ নিয়েছিলেন রাকেল তিবোল। ‘নভেদাদেস: মেক্সিকো এন লা কালচারা’ ম্যাগাজিনে ১৯৫৪ সালে এটি প্রকাশ করা হয়।
সাক্ষাৎকারের শুরুতেই ফ্রিদা বলেন, ‘আমি জন্মেছি কায়োয়াকানে। জায়গাটি ছিল লন্ড্রেস ও আলেন্দে নামের দুই রাস্তার মোড়ে। মা-বাবা বাড়িটি বানিয়েছিলেন এল ক্যারমেন ফার্মের জমির অংশ কিনে। আমি মা-বাবা দুজনের মতোই দেখতে হয়েছি। আমার চোখ যেন বাবার আর শরীরটা মায়ের।’
ফ্রিদার মা বাবার একটি ফটোগ্রাফি স্টুডিও ছিল। সেই স্টুডিওর কথা স্মরণে আসতেই উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন ফ্রিদা। তিনি বলেন, ‘আমার নানা ছিলেন আলোকচিত্র শিল্পী। তিনি বাবাকে একটি ক্যামেরা ধার দিয়েছিলেন। প্রথম ছবি তুলতে মা বাবা গেলেন রিপাবলিকে। তুললেন আদিবাসী ও উপনিবেশের কিছু ঘরবাড়ি ও স্থাপনার আলোকচিত্র। তাঁদের প্রথম অফিস নিয়ে বলতে গেলে কথা শেষ হবে না। তবে তখনকার দিনগুলো কঠিন ছিল আমাদের জন্য।’
মা বাবা সম্পর্কে ফ্রিদা বলেন, ‘আমার নানী ছিলেন স্প্যানিশ। মা ছিলেন ভীষণ মিশুক। তিনি কখনো অভাবে পড়েননি। ড্রেসারে তাঁর সব সময় পাঁচটি পেসো থাকত। তাঁর চোখ ছিল সুন্দর। ঠোঁট ছিল পাতলা। বাদামি চুলের ছোটখাটো একজন নারী ছিলেন আমার মা। প্রাণবন্ত মা তাঁর অভিজাত আঁটসাঁট কোমরবন্ধনী পরে ঝুড়িটি নিয়ে বাজার করতে যেতেন। সবার প্রিয়, চঞ্চল, বুদ্ধিমতী এক নারী। লিখতে পড়তে শেখেননি। শুধু টাকার হিসেবটা করতে জানতেন। মাত্র ৫৬ বছর বয়সে মা মারা গেছেন।’
বাবা সম্পর্কে ফ্রিদা বলেন, ‘বাবা ছিলেন একজন আকর্ষণীয় মানুষ। হাঁটাচলার ভঙ্গিটি ছিল বেশ অভিজাত। শান্ত, পরিশ্রমী, সাহসী বাবার বন্ধুবান্ধব ছিল হাতেগোনা দুইজন। বন্ধুদের একজন ছিলেন ভারী শরীরের ভুলোমনা এক বুড়ো মানুষ। ওয়ারড্রবের ওপর থেকে তাঁর টুপি নিতে ভুলে যেতেন। আমার বাবা ঘন্টার পর ঘন্টা বসে দাবা খেলতেন তাঁর সঙ্গে। কফিও পান করতেন একসঙ্গে।’
ফ্রিদার বাবার জন্ম জার্মানিতে। পড়াশোনা করেন নুরেমবার্গে। ফ্রিদা বলেন, ‘আট বছর বয়সে দাদী মারা যান। আমার দাদা ও সৎ দাদী তাঁকে পড়তে পাঠিয়ে দেন বাড়ি থেকে দূরে। উনিশ বছর বয়সে মৃগীরোগ ধরা পড়ে তাঁর।’
ফ্রিদার ভাষায়, ‘বাবা প্রথম বিয়ে করেন তেইশ বছর বয়সে। তাঁর প্রথম স্ত্রীর গর্ভ থেকে জন্ম নেয় দুই কন্যা সন্তান। মারিয়া লুইসা ও মার্গারিতা। প্রথম স্ত্রী মারা গিয়েছিলেন মার্গারিতার জন্মের মুহূর্তে। যে রাতে তাঁর স্ত্রী মারা গিয়েছিলেন, সেই রাতেই নানী আমার মাকে নিয়ে বাবার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। যদিও মাকে বাবা আগে থেকেই চিনতেন। কারণ তাঁরা একই স্টোরে কাজ করতেন। একে অন্যকে বেশ ভরসা করতেন তাঁরা। এরপর বাবা আমার মায়ের প্রেমে পড়েন ও পরে তাঁকে বিয়ে করেন।’
নিজের বড় সৎ বোনদের কথাও বলেছেন ফ্রিদা। তিনি বলেন, ‘ট্যাকুবা কনভেন্টে ভর্তি করা হয় মারিয়া লুইসা ও মার্গারিতাকে। তাঁদের বয়স ছিল যথাক্রমে সাত বছর ও তিন বছর। মার্গারিতা পরবর্তীকালে নান হয়েছিলেন। মারিয়া লুইসা তাঁর প্রেমিকের কাছে চিঠি পাঠাতেন নানদের মাধ্যমে। পরে তাঁকে বিয়ে করেন। মাত্র ৪৫ পেসো ভাড়া আসে, এমন একটি ঘরে থাকতেন।
ফ্রিদার জীবনের গল্প জুড়ে এসেছে তাঁর ছোট বোনের কথা। বড় মেয়ে মাতিলদা ও আদ্রিয়ানার পর জন্ম নেন তৃতীয় মেয়ে ফ্রিদা। তারও ১১ মাস পরে জন্ম নেন ছোট বোন ক্রিস্টিনা। সবার ছোট ক্রিস্টিনার যত্ন নিতেই ব্যস্ত থাকতেন মা। এ জন্য ওইসময় একজন নেটিভ আমেরিকান নার্স ‘দুধমা’ হিসেবে ছিলেন। তাঁকে নিয়ে একটি প্রিয় আত্মপ্রতিকৃতির ছবি এঁকেছিলেন ফ্রিদা, যার নাম ‘মাই নার্স অ্যান্ড আই’।
ক্রিস্টিনা ও ফ্রিদার বয়স যখন যথাক্রমে তিন ও চার, একসঙ্গে তাদের ভর্তি করা হলো নার্সারি ক্লাসে। শিক্ষক সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘স্কুলের কথা ভাবতে গেলে আমার যে স্মৃতি মনে পড়ে, তা হলো পরচুলা আর উদ্ভট কিছু সাজপোশাকের ভদ্রমহিলা, যিনি পুরোনো দিনের মানুষ।’
ফ্রিদা আরও বলেন, ‘একবার তিনি সেই শ্রেণিকক্ষে একহাতে মোমবাতি আর অন্য হাতে কমলা রেখে বোঝাচ্ছিলেন বিশ্বজগৎ, সূর্য, পৃথিবী আর চাঁদের কথা। আমি ওই দৃশ্য দেখে (ভয় পেয়ে) প্যান্ট ভিজিয়ে ফেললাম। পাশের বাড়ির একটি মেয়ের প্যান্ট আমাকে পরতে বাধ্য করা হয়েছিল সেই নার্সারিতে। এতে আমার ভেতর খুব ঘৃণাবোধ তৈরি হয়। একদিন সেই মেয়েটিকে নিজের বাড়িতে ডেকে এনে আমি তার গলা টিপে ধরি। এক বেকারিকর্মী আমাকে দেখে ফেলেন। তিনি আমার কাছ থেকে ওই মেয়েটিকে টেনে নেন।’
শৈশবে ফ্রিদা ছিলেন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান থেকে পালিয়ে থাকা শিশু। তিনি ছয় বছর বয়সে টানা একবছর ধর্মীয় ক্লাস করতে বাধ্য হয়েছিলেন। প্রায়ই ক্লাস পালিয়ে ক্রিস্টিনা ও ফ্রিদা পাশের বাগানে বসে টেজ্যোকোটে, মেমব্রিলতে ও ক্যাপুলাইন খেতেন। তাঁর ছিল ছেলেদের মতো খেলনা-স্কেট আর বাইসাইকেল।
একদিন ধাক্কা মেরে মারিয়া লুইসাকে ফেলে দিলে তিনি রাগ করে বলেন, ‘তুমি আমাদের বোন না। আমার বাবা মায়ের মেয়ে না। তোমাকে ময়লার গাদায় আমরা পেয়েছিলাম।’ এ কথায় তিনি এতই আঘাত পান, যে তিনি নিজের ভেতর গুটিয়ে যেতে শুরু করেন।
তারপর থেকে তিনি তৈরি করেছিলেন কল্পনার একজন বন্ধু। দোকানে দোকানে দাঁড়িয়ে ডিসপ্লে কাঁচের ওপর ফুঁ দিয়ে কুয়াশার বৃত্ত তৈরি করতেন ফ্রিদা। সেই বৃত্তকে দরজা ভেবে তিনি ডাকতেন বন্ধুকে। কল্পনার দরজার ওপাশে থাকা তাঁর বন্ধু এলে তাঁকে নিয়ে তিনি খেলতেন অন্য কোনো কল্পনার পৃথিবীতে। এই পৃথিবী শুধুই ফ্রিদার।
ফ্রিদা বলেন, ‘ছয় বছর বয়সে আমার পোলিও হয়। আমি তখন থেকেই সবকিছু পরিষ্কার মনে করতে পারি। বলা যায়, আমার স্মৃতি তৈরি হয়ছে ওই সময় থেকে। তখন বিছানায় শুয়ে ছিলাম ৯টি মাস। ডান উরু থেকে ব্যথা শুরু হয়। বিশ্রি সেই ব্যথা নামে ডান পা পর্যন্ত। এক সময় কাঠির মতো সরু হয়ে গেল আমার ডান পা। সাত বছর বয়স থেকে পায়ে দিই বুট জুতা। শুরুতে মনে করেছিলাম, আমাকে নিয়ে মজা করা হলে আমি পাত্তা দেব না। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছিল, তত আমি অশান্তিতে পড়লাম।
এই অশান্তির মধ্যে একদিন হঠাৎ প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়ে গেল তাঁর পনের বছর বয়সী বোন মাতিলদা। তাঁকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল সাত বছর বয়সের ফ্রিদা। তিনি বলেন, আমি বারান্দা খুলে তাঁকে পালিয়ে যেতে দিয়েছিলাম। তবে ওই ঘটনার পর আমাদের পুরো পরিবার এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল।
ফ্রিদা বলেন, ‘সে পালিয়েছে জেনে আমার মায়ের হিস্টিরিয়া শুরু হয়। আমার মা খুব বিরক্ত ছিলেন। তিনি তখন ইঁদুর খুঁজে বের করে পিপায় ডুবিয়ে সেগুলো মারতেন। আমি অস্থির হয়ে কান্না করতাম আর বলতাম, মা, তুমি এত নিষ্ঠুর!’
তবে বাবা ছিলেন শান্ত। ফ্রিদা বলেন, ‘মৃগীরোগ মাথা চাড়া দিলে আমি তাঁর খেয়াল রাখতাম। পথে এমন হলে, তাঁর ক্যামেরা যেন চুরি না হয় সেটিও দেখতাম।’
চার বছর পর মাতিলদাকে আবার খুঁজে পান তিনি। তখন ফ্রিদার বয়স ছিল বারো। মাত্রই হাইস্কুলে যাওয়া শুরু করেছেন। একটি কোর্টইয়ার্ডে ছিলেন তাঁর বোনটি। তখনও বিয়ে করেননি। বোনের সঙ্গে তাঁর দেখা হতে থাকে নিয়মিত। বাবা ও মাকে বলেন বোনের কথা। কিন্তু মা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাননি।
ফ্রিদা বলেন, ‘মা আর আমি ছিলাম খুব ভাল বন্ধু। শুধু ধর্মের রীতি-নীতির কারণে আমরা কখনও একমত হতে পারতাম না।’ বারো বছর পর্যন্ত নিরবে থাকলেও ফ্রিদা তেরোতে নিজেকে অবাধ্য করার কথা ভেবেছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমি তখনই একজন প্রতিবাদী বামপন্থীতে পরিণত হয়েছি।’
১৯২৬ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর। ষোল বছর বয়সের কিশোরী তিনি। ঘটলো মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনা। মেরুদণ্ডের হাড়, কলার বোন, এমনকি পাঁজরও ভেঙে গেল। ডান পায়ে ভাঙল এগারোটি হাড়, ডান পায়ের পাতাও গেল পিষে। কাঁধ দুমড়ে গেছে। একটা লোহার শিক এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিল শরীর। পেটে আর জরায়ুতে পেলেন প্রবল আঘাত।
ওই দুঃসহ স্মৃতি স্মরণ করে ফ্রিদা বলেন, ‘বাসের হ্যান্ড রেইল যেন মহিষের শিঙের মতো এফোঁড় ওফোঁড় করে দিল আমার শরীরটাকে।’
এরপরেও কিন্তু মানুষ উঠে দাঁড়ায়, বেঁচে থাকে। ফ্রিদাও তা-ই। তিনি বলেন, ‘আমি বিহ্বল ছিলাম। কিন্তু আমি কান্না করিনি। আমার চোখ ছিল শুকনো।’
সেই মর্মান্তিক বাস দুর্ঘটনার পরের জীবন থেকেই শুরু হয় তাঁর চিত্রশিল্পী হয়ে ওঠার জীবন। ‘বাস আমাকে ধাক্কা দেওয়ার আগে আমি হতে চেয়েছিলাম একজন ডাক্তার।’ বলেন ফ্রিদা।
ফ্রিদা বলেন, ‘আমি বয়সে ছোট, তবে বুদ্ধিমতী একজন মেয়ে ছিলাম। যথেষ্ট স্বাধীনতা আদায় করে নিতে পারলেও আমি খুব একটা বাস্তববাদী ছিলাম না। পরিস্থিতিটা কতটা কঠিন, বুঝতেই পারিনি৷ আমার বিশ্বাস ছিল এই আঘাত আমার জীবনে বড় কোনো পরিবর্তন আনবে না।’
বাসটিতে ফ্রিদার ওঠার কথা ছিল না। বিশেষ বাসটি আসার আগে অন্য বাসেও তিনি যেতে পারতেন। ভাগ্য যেন তাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল সেখানেই। সঙ্গে থাকা ছাতাটি হারিয়ে ফেলায় তিনি আগের বাসগুলোতে ওঠেননি।
অবশেষে একটি বাসে যখন উঠলেন, তার পরমুহূর্তেই স্যান জুয়ান মার্কেটের সামনে ঘটল ভয়ংকর এক সংঘর্ষ। রক্তারক্তি কাণ্ড। ফ্রিদা বলেন, ‘আমার ভয়ংকর রক্তক্ষরণ দেখে এক ব্যক্তি আমাকে একটি পুল টেবিলে তুলে রাখেন। রেডক্রস সেখানেই আমাকে পায়। আমি কোনো মতে বসে ছিলাম। রেডক্রসকে বললাম, খবরটা মা বাবাকে জানাতে। তবে সংবাদপত্রে খবর দেখে সবার আগে ছুটে এসেছিলেন বোন মাতিলদা।
রেডক্রসে তাঁদের থাকতে হয়েছিল তিন মাস। তাঁর ঠিকঠাক যত্ন কিংবা এক্সরে করানো হয়নি। রেডক্রসে তখন ছিলেন মাত্র একজন নার্স। ২৫ জন রোগীকে একটি নড়বড়ে ছাউনিতে রাখা হয়েছিল। তাদের দেওয়া হচ্ছিল বিস্বাদ খাবার। ফ্রিদা প্রায়ই খেতে পারতেন না।
বোন মাতিলদাকে নিয়ে ফ্রিদা বলেন, ‘তিনটি মাস এক মুহূর্তও তিনি আমাকে চোখের আড়াল হতে দেননি। সেই নিরানন্দ সময়ে আমার বোনের হাস্যরস আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল।’
মাতিলদা কুরুশ কাঁটায় বুনে চলতেন কিছু না কিছু। আর রোগীদের খেয়াল রাখতে সাহায্য করতেন নার্সকে। মজার সব কথা বলে কষ্ট ভুলিয়ে দিতেন রোগীদের। তাঁর হাইস্কুলের বন্ধুরাও ফুল দিয়ে তাঁকে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করতেন।
বন্ধুদের একজন সেই দিনগুলোতে তাকে একটি পুতুল উপহার দেয়। ‘পুতুলটা এখনো আমার কাছে আছে। আমি জিনিসপত্র রাখতে ভালোবাসি। জীবন ও মানুষ আমার প্রিয়। আমি চাই মানুষ কখনও মরবে না। মৃত্যুর ভয় করি না। কিন্তু আমি বাঁচতে চাই। অবশ্য আমি জীবনের যন্ত্রণা সহ্য করতেও পারি না।’
ওই দুর্ঘটনার আগে পর্যন্ত ফ্রিদা তাঁর পরিবারে কোনো মৃত্যু দেখেননি। বড় কোনো দুর্ঘটনাও দেখেননি। ফলে ফ্রিদার দুর্ঘটনাটি এলোমেলো করে দেয় বাকি সবাইকে। বোন আদ্রিয়ানা অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন। বাবা মা এতটাই ভেঙে পড়েছিলেন যে তারা পুরোপুরি নিরব হয়ে যান। দিন বিশেক পরে বাবা তাঁকে দেখতে আসেন প্রথমবার।
ফ্রিদা বলেন, মা যেদিন প্রথম এসেছিলেন, সেদিন তাকে দেখার সাথে সাথেই আমি বলি, ‘আমি মরে যাইনি মা। একটা কিছু আমার আছে। যা নিয়ে আমি বেঁচে থাকব।’
এরপর ফ্রিদা বলেন, ‘সেই “কিছু একটা” ছিল ছবি আঁকা। আমাকে বিছানাতেই শুয়ে থাকতে হতো। কলারবোন থেকে পেলভিস পর্যন্ত ছিল প্লাস্টার করা। মা কাগজকে ধরে রাখার জন্য কাঠ দিয়ে সুন্দর একটা যন্ত্র বানিয়ে দিলেন। বিছানা বরাবর একটি বড় আয়না রাখার বুদ্ধিটিও মা দিয়েছিলেন।’
এভাবেই ফ্রিদা নিজেকে নিজে দেখলেন। তাঁর মডেল হিসেবে ব্যবহার করলেন নিজের প্রতিবিম্বকে।
ফ্রিদা বলেন, তিনি বিভিন্ন কর্সেট পরে ঘরেই ছবি এঁকে কাটিয়েছিলেন একবছর। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে যান তারপর। ডিয়েগোর সঙ্গে তাঁর আলাপের শুরু সেখানেই।
ফ্রিদার ভাষায়, ‘আমার অসম্ভব ইচ্ছে ছিল যে আমি “আল ফ্রেস্কো পেইন্টিং” নিয়ে কাজ করব। তিনি ছিলেন তার “ম্যুরাল পেইন্টিং” নিয়ে ব্যস্ত।’
আমার কাজ দেখালে তিনি বলেছিলেন, ‘যে কথাই বলতে চাও, মনের সে বলার আগ্রহকে পুরোপুরি তুলে এনে রূপান্তর করো।’
ফ্রিদা বলেন, ‘ডিয়েগো আমার প্রশংসা করেন, ভালবাসেন। আমি শিল্প তৈরিতে তাঁকে সাহায্য করা শুরু করি। শুরুর দিকে আমার নিজের কিছু শিল্পকর্মে ডিয়েগোর অনুপ্রেরণা ছিল। তবে সেগুলো আমার বেশি ভালো লাগে না। আমার কাছে নিজের ‘মাই নার্স অ্যান্ড আই’, ‘দ্য লাভ এমব্রেস অফ দ্য ইউনিভার্স, ‘দ্য আর্থ, ‘মাইসেলফ অ্যান্ড ডিয়েগো’, ‘দ্য পোট্রেট অফ ইঞ্জিনিয়ার মরিল্লো সাফা’স মাদার’—এই ছবিগুলো বেশি ভালো লাগে।
নিজের সত্ত্বার ক্লান্তি থেকেই হয়ত ফ্রিদা কাহলো বলেন, ‘আমি ছবি এঁকেছি শুধু আমার যন্ত্রণার কথা জানানোর জন্য। তবুও অন্তত অল্প কয়েকজন মানুষকে আমি পেয়েছি, যারা আমার ছবি নিয়ে আগ্রহী। হয়ত অনেক কিছুই হারিয়েছি, যেসব দিয়েও সুন্দর করা যেত এই বীভৎস জীবনকে।’
ফ্রিদা তাঁর সাক্ষাৎকার শেষ করেছেন দ্বিধা দিয়ে। তিনি বলেন,‘আমার শিল্পকর্ম কোনো বৈপ্লবিক বিষয় না। কিন্তু তবুও কেন আমার ভুল হয়? কেন আমার শিল্পে আমি একটি সংগ্রামের পথ দেখতে পাই? তা আমার জানা নেই।’
নিজেকে উজাড় করে দিয়ে ফ্রিদা তাঁর কথাগুলো বলেছিলেন। পরে রাকেল তাঁর অভিজ্ঞতা জানিয়ে লেখেন, ‘ফ্রিদার যন্ত্রণা থেকেই তিনি জন্মেছেন।’
ফ্রিদা কাহলো বারবার এঁকেছেন নিজেকেই। তিনি ছবি এঁকেছেন যতগুলো, তাঁর মধ্যে পঞ্চান্নটিই ছিল আত্মপ্রতিকৃতি। ‘ফ্রিদা কাহলোর জীবনের খণ্ড খণ্ড ছবি: ফ্রিদা কাহলোর শেষ সাক্ষাৎকার’ নিয়েছিলেন রাকেল তিবোল। ‘নভেদাদেস: মেক্সিকো এন লা কালচারা’ ম্যাগাজিনে ১৯৫৪ সালে এটি প্রকাশ করা হয়।
সাক্ষাৎকারের শুরুতেই ফ্রিদা বলেন, ‘আমি জন্মেছি কায়োয়াকানে। জায়গাটি ছিল লন্ড্রেস ও আলেন্দে নামের দুই রাস্তার মোড়ে। মা-বাবা বাড়িটি বানিয়েছিলেন এল ক্যারমেন ফার্মের জমির অংশ কিনে। আমি মা-বাবা দুজনের মতোই দেখতে হয়েছি। আমার চোখ যেন বাবার আর শরীরটা মায়ের।’
ফ্রিদার মা বাবার একটি ফটোগ্রাফি স্টুডিও ছিল। সেই স্টুডিওর কথা স্মরণে আসতেই উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন ফ্রিদা। তিনি বলেন, ‘আমার নানা ছিলেন আলোকচিত্র শিল্পী। তিনি বাবাকে একটি ক্যামেরা ধার দিয়েছিলেন। প্রথম ছবি তুলতে মা বাবা গেলেন রিপাবলিকে। তুললেন আদিবাসী ও উপনিবেশের কিছু ঘরবাড়ি ও স্থাপনার আলোকচিত্র। তাঁদের প্রথম অফিস নিয়ে বলতে গেলে কথা শেষ হবে না। তবে তখনকার দিনগুলো কঠিন ছিল আমাদের জন্য।’
মা বাবা সম্পর্কে ফ্রিদা বলেন, ‘আমার নানী ছিলেন স্প্যানিশ। মা ছিলেন ভীষণ মিশুক। তিনি কখনো অভাবে পড়েননি। ড্রেসারে তাঁর সব সময় পাঁচটি পেসো থাকত। তাঁর চোখ ছিল সুন্দর। ঠোঁট ছিল পাতলা। বাদামি চুলের ছোটখাটো একজন নারী ছিলেন আমার মা। প্রাণবন্ত মা তাঁর অভিজাত আঁটসাঁট কোমরবন্ধনী পরে ঝুড়িটি নিয়ে বাজার করতে যেতেন। সবার প্রিয়, চঞ্চল, বুদ্ধিমতী এক নারী। লিখতে পড়তে শেখেননি। শুধু টাকার হিসেবটা করতে জানতেন। মাত্র ৫৬ বছর বয়সে মা মারা গেছেন।’
বাবা সম্পর্কে ফ্রিদা বলেন, ‘বাবা ছিলেন একজন আকর্ষণীয় মানুষ। হাঁটাচলার ভঙ্গিটি ছিল বেশ অভিজাত। শান্ত, পরিশ্রমী, সাহসী বাবার বন্ধুবান্ধব ছিল হাতেগোনা দুইজন। বন্ধুদের একজন ছিলেন ভারী শরীরের ভুলোমনা এক বুড়ো মানুষ। ওয়ারড্রবের ওপর থেকে তাঁর টুপি নিতে ভুলে যেতেন। আমার বাবা ঘন্টার পর ঘন্টা বসে দাবা খেলতেন তাঁর সঙ্গে। কফিও পান করতেন একসঙ্গে।’
ফ্রিদার বাবার জন্ম জার্মানিতে। পড়াশোনা করেন নুরেমবার্গে। ফ্রিদা বলেন, ‘আট বছর বয়সে দাদী মারা যান। আমার দাদা ও সৎ দাদী তাঁকে পড়তে পাঠিয়ে দেন বাড়ি থেকে দূরে। উনিশ বছর বয়সে মৃগীরোগ ধরা পড়ে তাঁর।’
ফ্রিদার ভাষায়, ‘বাবা প্রথম বিয়ে করেন তেইশ বছর বয়সে। তাঁর প্রথম স্ত্রীর গর্ভ থেকে জন্ম নেয় দুই কন্যা সন্তান। মারিয়া লুইসা ও মার্গারিতা। প্রথম স্ত্রী মারা গিয়েছিলেন মার্গারিতার জন্মের মুহূর্তে। যে রাতে তাঁর স্ত্রী মারা গিয়েছিলেন, সেই রাতেই নানী আমার মাকে নিয়ে বাবার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। যদিও মাকে বাবা আগে থেকেই চিনতেন। কারণ তাঁরা একই স্টোরে কাজ করতেন। একে অন্যকে বেশ ভরসা করতেন তাঁরা। এরপর বাবা আমার মায়ের প্রেমে পড়েন ও পরে তাঁকে বিয়ে করেন।’
নিজের বড় সৎ বোনদের কথাও বলেছেন ফ্রিদা। তিনি বলেন, ‘ট্যাকুবা কনভেন্টে ভর্তি করা হয় মারিয়া লুইসা ও মার্গারিতাকে। তাঁদের বয়স ছিল যথাক্রমে সাত বছর ও তিন বছর। মার্গারিতা পরবর্তীকালে নান হয়েছিলেন। মারিয়া লুইসা তাঁর প্রেমিকের কাছে চিঠি পাঠাতেন নানদের মাধ্যমে। পরে তাঁকে বিয়ে করেন। মাত্র ৪৫ পেসো ভাড়া আসে, এমন একটি ঘরে থাকতেন।
ফ্রিদার জীবনের গল্প জুড়ে এসেছে তাঁর ছোট বোনের কথা। বড় মেয়ে মাতিলদা ও আদ্রিয়ানার পর জন্ম নেন তৃতীয় মেয়ে ফ্রিদা। তারও ১১ মাস পরে জন্ম নেন ছোট বোন ক্রিস্টিনা। সবার ছোট ক্রিস্টিনার যত্ন নিতেই ব্যস্ত থাকতেন মা। এ জন্য ওইসময় একজন নেটিভ আমেরিকান নার্স ‘দুধমা’ হিসেবে ছিলেন। তাঁকে নিয়ে একটি প্রিয় আত্মপ্রতিকৃতির ছবি এঁকেছিলেন ফ্রিদা, যার নাম ‘মাই নার্স অ্যান্ড আই’।
ক্রিস্টিনা ও ফ্রিদার বয়স যখন যথাক্রমে তিন ও চার, একসঙ্গে তাদের ভর্তি করা হলো নার্সারি ক্লাসে। শিক্ষক সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘স্কুলের কথা ভাবতে গেলে আমার যে স্মৃতি মনে পড়ে, তা হলো পরচুলা আর উদ্ভট কিছু সাজপোশাকের ভদ্রমহিলা, যিনি পুরোনো দিনের মানুষ।’
ফ্রিদা আরও বলেন, ‘একবার তিনি সেই শ্রেণিকক্ষে একহাতে মোমবাতি আর অন্য হাতে কমলা রেখে বোঝাচ্ছিলেন বিশ্বজগৎ, সূর্য, পৃথিবী আর চাঁদের কথা। আমি ওই দৃশ্য দেখে (ভয় পেয়ে) প্যান্ট ভিজিয়ে ফেললাম। পাশের বাড়ির একটি মেয়ের প্যান্ট আমাকে পরতে বাধ্য করা হয়েছিল সেই নার্সারিতে। এতে আমার ভেতর খুব ঘৃণাবোধ তৈরি হয়। একদিন সেই মেয়েটিকে নিজের বাড়িতে ডেকে এনে আমি তার গলা টিপে ধরি। এক বেকারিকর্মী আমাকে দেখে ফেলেন। তিনি আমার কাছ থেকে ওই মেয়েটিকে টেনে নেন।’
শৈশবে ফ্রিদা ছিলেন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান থেকে পালিয়ে থাকা শিশু। তিনি ছয় বছর বয়সে টানা একবছর ধর্মীয় ক্লাস করতে বাধ্য হয়েছিলেন। প্রায়ই ক্লাস পালিয়ে ক্রিস্টিনা ও ফ্রিদা পাশের বাগানে বসে টেজ্যোকোটে, মেমব্রিলতে ও ক্যাপুলাইন খেতেন। তাঁর ছিল ছেলেদের মতো খেলনা-স্কেট আর বাইসাইকেল।
একদিন ধাক্কা মেরে মারিয়া লুইসাকে ফেলে দিলে তিনি রাগ করে বলেন, ‘তুমি আমাদের বোন না। আমার বাবা মায়ের মেয়ে না। তোমাকে ময়লার গাদায় আমরা পেয়েছিলাম।’ এ কথায় তিনি এতই আঘাত পান, যে তিনি নিজের ভেতর গুটিয়ে যেতে শুরু করেন।
তারপর থেকে তিনি তৈরি করেছিলেন কল্পনার একজন বন্ধু। দোকানে দোকানে দাঁড়িয়ে ডিসপ্লে কাঁচের ওপর ফুঁ দিয়ে কুয়াশার বৃত্ত তৈরি করতেন ফ্রিদা। সেই বৃত্তকে দরজা ভেবে তিনি ডাকতেন বন্ধুকে। কল্পনার দরজার ওপাশে থাকা তাঁর বন্ধু এলে তাঁকে নিয়ে তিনি খেলতেন অন্য কোনো কল্পনার পৃথিবীতে। এই পৃথিবী শুধুই ফ্রিদার।
ফ্রিদা বলেন, ‘ছয় বছর বয়সে আমার পোলিও হয়। আমি তখন থেকেই সবকিছু পরিষ্কার মনে করতে পারি। বলা যায়, আমার স্মৃতি তৈরি হয়ছে ওই সময় থেকে। তখন বিছানায় শুয়ে ছিলাম ৯টি মাস। ডান উরু থেকে ব্যথা শুরু হয়। বিশ্রি সেই ব্যথা নামে ডান পা পর্যন্ত। এক সময় কাঠির মতো সরু হয়ে গেল আমার ডান পা। সাত বছর বয়স থেকে পায়ে দিই বুট জুতা। শুরুতে মনে করেছিলাম, আমাকে নিয়ে মজা করা হলে আমি পাত্তা দেব না। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছিল, তত আমি অশান্তিতে পড়লাম।
এই অশান্তির মধ্যে একদিন হঠাৎ প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়ে গেল তাঁর পনের বছর বয়সী বোন মাতিলদা। তাঁকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল সাত বছর বয়সের ফ্রিদা। তিনি বলেন, আমি বারান্দা খুলে তাঁকে পালিয়ে যেতে দিয়েছিলাম। তবে ওই ঘটনার পর আমাদের পুরো পরিবার এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল।
ফ্রিদা বলেন, ‘সে পালিয়েছে জেনে আমার মায়ের হিস্টিরিয়া শুরু হয়। আমার মা খুব বিরক্ত ছিলেন। তিনি তখন ইঁদুর খুঁজে বের করে পিপায় ডুবিয়ে সেগুলো মারতেন। আমি অস্থির হয়ে কান্না করতাম আর বলতাম, মা, তুমি এত নিষ্ঠুর!’
তবে বাবা ছিলেন শান্ত। ফ্রিদা বলেন, ‘মৃগীরোগ মাথা চাড়া দিলে আমি তাঁর খেয়াল রাখতাম। পথে এমন হলে, তাঁর ক্যামেরা যেন চুরি না হয় সেটিও দেখতাম।’
চার বছর পর মাতিলদাকে আবার খুঁজে পান তিনি। তখন ফ্রিদার বয়স ছিল বারো। মাত্রই হাইস্কুলে যাওয়া শুরু করেছেন। একটি কোর্টইয়ার্ডে ছিলেন তাঁর বোনটি। তখনও বিয়ে করেননি। বোনের সঙ্গে তাঁর দেখা হতে থাকে নিয়মিত। বাবা ও মাকে বলেন বোনের কথা। কিন্তু মা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাননি।
ফ্রিদা বলেন, ‘মা আর আমি ছিলাম খুব ভাল বন্ধু। শুধু ধর্মের রীতি-নীতির কারণে আমরা কখনও একমত হতে পারতাম না।’ বারো বছর পর্যন্ত নিরবে থাকলেও ফ্রিদা তেরোতে নিজেকে অবাধ্য করার কথা ভেবেছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমি তখনই একজন প্রতিবাদী বামপন্থীতে পরিণত হয়েছি।’
১৯২৬ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর। ষোল বছর বয়সের কিশোরী তিনি। ঘটলো মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনা। মেরুদণ্ডের হাড়, কলার বোন, এমনকি পাঁজরও ভেঙে গেল। ডান পায়ে ভাঙল এগারোটি হাড়, ডান পায়ের পাতাও গেল পিষে। কাঁধ দুমড়ে গেছে। একটা লোহার শিক এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিল শরীর। পেটে আর জরায়ুতে পেলেন প্রবল আঘাত।
ওই দুঃসহ স্মৃতি স্মরণ করে ফ্রিদা বলেন, ‘বাসের হ্যান্ড রেইল যেন মহিষের শিঙের মতো এফোঁড় ওফোঁড় করে দিল আমার শরীরটাকে।’
এরপরেও কিন্তু মানুষ উঠে দাঁড়ায়, বেঁচে থাকে। ফ্রিদাও তা-ই। তিনি বলেন, ‘আমি বিহ্বল ছিলাম। কিন্তু আমি কান্না করিনি। আমার চোখ ছিল শুকনো।’
সেই মর্মান্তিক বাস দুর্ঘটনার পরের জীবন থেকেই শুরু হয় তাঁর চিত্রশিল্পী হয়ে ওঠার জীবন। ‘বাস আমাকে ধাক্কা দেওয়ার আগে আমি হতে চেয়েছিলাম একজন ডাক্তার।’ বলেন ফ্রিদা।
ফ্রিদা বলেন, ‘আমি বয়সে ছোট, তবে বুদ্ধিমতী একজন মেয়ে ছিলাম। যথেষ্ট স্বাধীনতা আদায় করে নিতে পারলেও আমি খুব একটা বাস্তববাদী ছিলাম না। পরিস্থিতিটা কতটা কঠিন, বুঝতেই পারিনি৷ আমার বিশ্বাস ছিল এই আঘাত আমার জীবনে বড় কোনো পরিবর্তন আনবে না।’
বাসটিতে ফ্রিদার ওঠার কথা ছিল না। বিশেষ বাসটি আসার আগে অন্য বাসেও তিনি যেতে পারতেন। ভাগ্য যেন তাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল সেখানেই। সঙ্গে থাকা ছাতাটি হারিয়ে ফেলায় তিনি আগের বাসগুলোতে ওঠেননি।
অবশেষে একটি বাসে যখন উঠলেন, তার পরমুহূর্তেই স্যান জুয়ান মার্কেটের সামনে ঘটল ভয়ংকর এক সংঘর্ষ। রক্তারক্তি কাণ্ড। ফ্রিদা বলেন, ‘আমার ভয়ংকর রক্তক্ষরণ দেখে এক ব্যক্তি আমাকে একটি পুল টেবিলে তুলে রাখেন। রেডক্রস সেখানেই আমাকে পায়। আমি কোনো মতে বসে ছিলাম। রেডক্রসকে বললাম, খবরটা মা বাবাকে জানাতে। তবে সংবাদপত্রে খবর দেখে সবার আগে ছুটে এসেছিলেন বোন মাতিলদা।
রেডক্রসে তাঁদের থাকতে হয়েছিল তিন মাস। তাঁর ঠিকঠাক যত্ন কিংবা এক্সরে করানো হয়নি। রেডক্রসে তখন ছিলেন মাত্র একজন নার্স। ২৫ জন রোগীকে একটি নড়বড়ে ছাউনিতে রাখা হয়েছিল। তাদের দেওয়া হচ্ছিল বিস্বাদ খাবার। ফ্রিদা প্রায়ই খেতে পারতেন না।
বোন মাতিলদাকে নিয়ে ফ্রিদা বলেন, ‘তিনটি মাস এক মুহূর্তও তিনি আমাকে চোখের আড়াল হতে দেননি। সেই নিরানন্দ সময়ে আমার বোনের হাস্যরস আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল।’
মাতিলদা কুরুশ কাঁটায় বুনে চলতেন কিছু না কিছু। আর রোগীদের খেয়াল রাখতে সাহায্য করতেন নার্সকে। মজার সব কথা বলে কষ্ট ভুলিয়ে দিতেন রোগীদের। তাঁর হাইস্কুলের বন্ধুরাও ফুল দিয়ে তাঁকে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করতেন।
বন্ধুদের একজন সেই দিনগুলোতে তাকে একটি পুতুল উপহার দেয়। ‘পুতুলটা এখনো আমার কাছে আছে। আমি জিনিসপত্র রাখতে ভালোবাসি। জীবন ও মানুষ আমার প্রিয়। আমি চাই মানুষ কখনও মরবে না। মৃত্যুর ভয় করি না। কিন্তু আমি বাঁচতে চাই। অবশ্য আমি জীবনের যন্ত্রণা সহ্য করতেও পারি না।’
ওই দুর্ঘটনার আগে পর্যন্ত ফ্রিদা তাঁর পরিবারে কোনো মৃত্যু দেখেননি। বড় কোনো দুর্ঘটনাও দেখেননি। ফলে ফ্রিদার দুর্ঘটনাটি এলোমেলো করে দেয় বাকি সবাইকে। বোন আদ্রিয়ানা অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন। বাবা মা এতটাই ভেঙে পড়েছিলেন যে তারা পুরোপুরি নিরব হয়ে যান। দিন বিশেক পরে বাবা তাঁকে দেখতে আসেন প্রথমবার।
ফ্রিদা বলেন, মা যেদিন প্রথম এসেছিলেন, সেদিন তাকে দেখার সাথে সাথেই আমি বলি, ‘আমি মরে যাইনি মা। একটা কিছু আমার আছে। যা নিয়ে আমি বেঁচে থাকব।’
এরপর ফ্রিদা বলেন, ‘সেই “কিছু একটা” ছিল ছবি আঁকা। আমাকে বিছানাতেই শুয়ে থাকতে হতো। কলারবোন থেকে পেলভিস পর্যন্ত ছিল প্লাস্টার করা। মা কাগজকে ধরে রাখার জন্য কাঠ দিয়ে সুন্দর একটা যন্ত্র বানিয়ে দিলেন। বিছানা বরাবর একটি বড় আয়না রাখার বুদ্ধিটিও মা দিয়েছিলেন।’
এভাবেই ফ্রিদা নিজেকে নিজে দেখলেন। তাঁর মডেল হিসেবে ব্যবহার করলেন নিজের প্রতিবিম্বকে।
ফ্রিদা বলেন, তিনি বিভিন্ন কর্সেট পরে ঘরেই ছবি এঁকে কাটিয়েছিলেন একবছর। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে যান তারপর। ডিয়েগোর সঙ্গে তাঁর আলাপের শুরু সেখানেই।
ফ্রিদার ভাষায়, ‘আমার অসম্ভব ইচ্ছে ছিল যে আমি “আল ফ্রেস্কো পেইন্টিং” নিয়ে কাজ করব। তিনি ছিলেন তার “ম্যুরাল পেইন্টিং” নিয়ে ব্যস্ত।’
আমার কাজ দেখালে তিনি বলেছিলেন, ‘যে কথাই বলতে চাও, মনের সে বলার আগ্রহকে পুরোপুরি তুলে এনে রূপান্তর করো।’
ফ্রিদা বলেন, ‘ডিয়েগো আমার প্রশংসা করেন, ভালবাসেন। আমি শিল্প তৈরিতে তাঁকে সাহায্য করা শুরু করি। শুরুর দিকে আমার নিজের কিছু শিল্পকর্মে ডিয়েগোর অনুপ্রেরণা ছিল। তবে সেগুলো আমার বেশি ভালো লাগে না। আমার কাছে নিজের ‘মাই নার্স অ্যান্ড আই’, ‘দ্য লাভ এমব্রেস অফ দ্য ইউনিভার্স, ‘দ্য আর্থ, ‘মাইসেলফ অ্যান্ড ডিয়েগো’, ‘দ্য পোট্রেট অফ ইঞ্জিনিয়ার মরিল্লো সাফা’স মাদার’—এই ছবিগুলো বেশি ভালো লাগে।
নিজের সত্ত্বার ক্লান্তি থেকেই হয়ত ফ্রিদা কাহলো বলেন, ‘আমি ছবি এঁকেছি শুধু আমার যন্ত্রণার কথা জানানোর জন্য। তবুও অন্তত অল্প কয়েকজন মানুষকে আমি পেয়েছি, যারা আমার ছবি নিয়ে আগ্রহী। হয়ত অনেক কিছুই হারিয়েছি, যেসব দিয়েও সুন্দর করা যেত এই বীভৎস জীবনকে।’
ফ্রিদা তাঁর সাক্ষাৎকার শেষ করেছেন দ্বিধা দিয়ে। তিনি বলেন,‘আমার শিল্পকর্ম কোনো বৈপ্লবিক বিষয় না। কিন্তু তবুও কেন আমার ভুল হয়? কেন আমার শিল্পে আমি একটি সংগ্রামের পথ দেখতে পাই? তা আমার জানা নেই।’
নিজেকে উজাড় করে দিয়ে ফ্রিদা তাঁর কথাগুলো বলেছিলেন। পরে রাকেল তাঁর অভিজ্ঞতা জানিয়ে লেখেন, ‘ফ্রিদার যন্ত্রণা থেকেই তিনি জন্মেছেন।’
আরব থেকে মর্সিয়ার এই ধারা গিয়ে পৌঁছায় পারস্যে। এরপর এর আঙ্গিক ও বিষয়বস্তুতে ঘটে যুগান্তকারী পরিবর্তন। বিশেষ করে ষোড়শ শতকে সাফাভি শাসনামলে ‘শিয়া ইসলাম’ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করার পর মর্সিয়া এক নতুন মাত্রা পায়।
৮ ঘণ্টা আগেআজ ৬ জুলাই। বাংলাদেশের কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী এন্ড্রু কিশোরের চলে যাওয়ার দিন। গান দিয়েই তিনি ছুঁয়ে গেছেন একের পর এক প্রজন্মের হৃদয়। আর হয়ে উঠেছিলেন সবার প্রিয় ‘প্লেব্যাক সম্রাট’। কিন্তু তিনি নিজেকে মনে করতেন একজন ‘কণ্ঠশ্রমিক’। আজ এন্ড্রু কিশোরের পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকীতে আমরা ফিরে তাকাব তাঁর বর্ণাঢ্য...
১২ ঘণ্টা আগে১৯৯৪ সালের ৫ জুলাই, জেফ বেজোস শুরু করেছিলেন তাঁর নতুন ব্যবসা। সিয়াটলে নিজের ভাড়া বাসার গ্যারেজে চালু হওয়া এই কোম্পানির নাম রেখেছিলেন, ‘অ্যামাজন’। তখন কেউ ভাবতেও পারেনি, এই ছোট অনলাইন দোকানটাই একদিন হয়ে উঠবে পুরো দুনিয়ার সবচেয়ে বড় অনলাইন মার্কেটপ্লেস।
১২ ঘণ্টা আগেবাংলার ফোকলোরের প্রবাদ, লোককাহিনি, ঘেটুগান, ভূতের গল্প—আবারও ফিরে এসেছে ডিজিটাল মাধ্যমে। ইউটিউব, ফেসবুক, ওয়েব সিরিজ আর কার্টুনে ভেসে বেড়াচ্ছে শিকড়ের গল্পগুলো। নতুন প্রজন্মকে শেকড়ের সঙ্গে যুক্ত রাখছে এই ডিজিটাল মাধ্যমে ফোকলরের আবার ফিরে আসা।
১৫ ঘণ্টা আগে