leadT1ad

গ্যারেজ থেকে ‘দ্য এভ্রিথিং স্টোর’: যেভাবে চালু হয়েছিল অ্যামাজন

বিশ্বের সবচেয়ে বড় অনলাইন মার্কেটপ্লেস ‘অ্যামাজন’। অথচ এর শুরু হয়েছিল ছোট একটা গ্যারেজ থেকে। কীভাবে জেফ বেজোসের মাথায় এসেছিল এই ভাবনা? শুরুটা-ই বা কেমন ছিল? জানা যাক সেই গল্প।

গৌতম কে শুভ
প্রকাশ : ০৬ জুলাই ২০২৫, ১৬: ৫১
আপডেট : ০৬ জুলাই ২০২৫, ১৮: ০৪
জেফ বেজোস। স্ট্রিম গ্রাফিক

১৯৯৪ সালের কথা। গরমের ছুটিতে জেফ বেজোস আর তাঁর স্ত্রী ম্যাকেঞ্জি গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিলেন নিউইয়র্ক থেকে সিয়াটলের দিকে। গাড়িতে বসেই বেজোসের মাথায় ঘুরছিল একটা ভাবনা, ইন্টারনেট দিয়ে কি ব্যবসা করা যায়?

এই ভাবনাটা কিন্তু বেজোসের মাথায় হুট করে আসেনি। তিনি খেয়াল করেছিলেন, প্রতিবছর ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় দশগুণ করে বাড়ছে! অথচ তখনো বেশিরভাগ মানুষ জানেই না, ইন্টারনেট দিয়ে ঠিক কী কী কাজ করা সম্ভব। তখনই বেজোস বুঝলেন, এই ইন্টারনেটই হতে পারে ভবিষ্যতে সবচেয়ে বড় ব্যবসার ক্ষেত্র।

বই দিয়েই শুরু

বেজোস সেদিন গাড়িতে বসেই ইন্টারনেট নির্ভর ব্যবসা চালুর ছক কষে ফেললেন। প্রথমেই তিনি ভাবলেন, অনলাইনে কী কী বিক্রি করা যেতে পারে। একটি তালিকাও তৈরি হলো। বই, সফটওয়্যার, সিডি থেকে শুরু করে অফিসের জিনিসপত্র—সবই ছিল সেখানে। সবশেষে ঠিক করলেন, বই-ই বিক্রি করবেন।

কিন্তু বইকেই কেন বেছে নিলেন? কারণ, সারা দুনিয়ায় তখন লাখ লাখ বই। কিন্তু কোনো দোকানে একসঙ্গে এত বই রাখা সম্ভব না। কেবল ইন্টারনেটে দোকান বানিয়েই সেটা সম্ভব। সেখানে বইয়ের তাক বা গুদামঘরের দরকার নেই, শুধু একটা ওয়েবসাইট থাকলেই চলবে। এই ভাবনা থেকেই জন্ম নিল অ্যামাজনের মূল আইডিয়া।

তখন বেজোস ওয়াল স্ট্রিটে একটি বড় কোম্পানিতে ভালো বেতনে চাকরি করতেন। এরপর নতুন কিছু করার স্বপ্ন নিয়ে সেই চাকরিটা ছেড়ে দিলেন। চালু করলেন ইন্টারনেটে বিশাল বইয়ের দোকান।

অ্যামাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোস। ছবি: এনপিআর
অ্যামাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোস। ছবি: এনপিআর

গ্যারেজ থেকেই বিশ্বজয়

১৯৯৪ সালের ৫ জুলাই, জেফ বেজোস শুরু করেছিলেন তাঁর নতুন ব্যবসা। সিয়াটলে নিজের ভাড়া বাসার গ্যারেজে চালু হওয়া এই কোম্পানির নাম রেখেছিলেন, ‘অ্যামাজন’। তখন কেউ ভাবতেও পারেনি, এই ছোট অনলাইন দোকানটাই একদিন হয়ে উঠবে পুরো দুনিয়ার সবচেয়ে বড় অনলাইন মার্কেটপ্লেস।

তবে শুরুতে কিন্তু নামটা ‘অ্যামাজন’ ছিল না। বেজোস প্রথমে নাম দিয়েছিলেন ‘ক্যাডাব্রা’। কিন্তু একদিন এক আইনজীবী সেটাকে ভুল করে শুনে ফেলেন ‘ক্যাডাভার’, ইংরেজিতে যার মানে ‘লাশ’। বেজোস বুঝলেন, এই নামে ঝামেলা হতে পারে। তাই সঙ্গে সঙ্গে বদলে ফেললেন নাম।

এখন প্রশ্ন আসতে পারে, নামটা অ্যামাজন-ই কেন? কারণ, বেজোস চেয়েছিলেন তাঁর ব্যবসাটাও হোক পৃথিবীর সবচেয়ে বিশাল নদী অ্যামাজনের মতো। আর নামটা যেহেতু ‘এ’ দিয়েই শুরু, তাই যেকোনো তালিকায় তাঁর কোম্পানির নামটা ওপরের দিকেই থাকবে।

অফিস বলতে গ্যারেজের ছোট্ট একটি ঘর। তাতে মাত্র তিনজন মানুষ। এর মধ্যে একজন ছিলেন বেজোস নিজেই। প্রথম দিকে কেউ অর্ডার করলে তিনিই বই কিনে আনতেন। তারপর সেটা প্যাকেট করে নিয়ে যেতেন পোস্ট অফিসে। এমনকি কাস্টমারের ই-মেইলের উত্তরও দিতেন নিজের হাতেই।

বেজোসের বানানো ওয়েবসাইটটাও ছিল বেশ আলাদা। সেখানে শুধু কেনাবেচাই নয়, পাঠকেরা নিজেদের মতামত আর বইয়ের রিভিউ লিখতে পারতেন।

অ্যামাজন চালু হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই বই বিক্রি শুরু হয়। আর কিছু দিন পরেই দেখা গেল, দিনে গড়ে ১০০টিরও বেশি বই বিক্রি হচ্ছে! মাত্র দুই মাসেই তারা বই পাঠাতে শুরু করল আমেরিকার বিভিন্ন শহরে।

অ্যামাজনের ওয়্যারহাউস। ছবি: ডিজিটাল কমার্স থ্রিসিক্সটি
অ্যামাজনের ওয়্যারহাউস। ছবি: ডিজিটাল কমার্স থ্রিসিক্সটি

প্রথম বিনিয়োগ আর শেয়ারবাজারে যাত্রা

অ্যামাজন শুরুতে শুধুই বই বিক্রি করত। ব্যবসা দ্রুত বাড়লে, বেজোসের দরকার ছিল বড় অঙ্কের বিনিয়োগ। বছরখানেকের মধ্যেই একজন ব্যবসায়ী অ্যামাজনে এক লাখ ডলার বিনিয়োগ করলেন। এরপর বেজোস ২২ জন বিনিয়োগকারীর কাছ থেকে মোট এক মিলিয়ন ডলার তুললেন। তিনি সবাইকে বলেও রেখেছিলেন, ব্যবসাটা সফল নাও হতে পারে। তবু ই-কমার্স নিয়ে বেজোসের আত্মবিশ্বাস বিনিয়োগকারীদের সাহস জুগিয়েছিল।

১৯৯৭ সালে অ্যামাজন প্রথম শেয়ারবাজারে আসে। প্রতিটি শেয়ারের দাম ছিল মাত্র ১৮ ডলার। কয়েক বছরের মধ্যেই শেয়ারের দাম ১১৩ ডলারে পৌঁছায়। ততদিনে অ্যামাজনে বইয়ের পাশাপাশি সিডি, ভিডিও, খেলনা, ইলেকট্রনিকসের মতো পণ্যগুলোর বিক্রিও শুরু হয়েছে। এভাবেই অ্যামাজন হয়ে ওঠে ‘সবকিছুর দোকান’।

এমন সাহসী উদ্যোগ আর বড় স্বপ্নের জন্য ১৯৯৯ সালে টাইম ম্যাগাজিন জেফ বেজোসকে নির্বাচিত করে ‘পারসন অব দ্যা ইয়ার’ হিসেবে। কারণ, তিনি প্রমাণ করে দিয়েছিলেন, ইন্টারনেট শুধু চ্যাট বা ই-মেইলের জায়গা নয়, চাইলে এখান থেকেই শুরু করা যায় দুনিয়া বদলে দেওয়ার মতো ব্যবসাও।

অ্যামাজনের প্রথম লাভ ও এগিয়ে যাওয়ায় নিশানা

অ্যামাজন চালুর পর থেকে ধীরে ধীরে বিক্রি বাড়লেও অ্যামাজন লাভের মুখ দেখছিল না। অনেকে আবার বলাবলি করছিল, এই ব্যবসা টিকবে না। আবার তখন অনেক অনলাইন কোম্পানি বন্ধও হয়ে যাচ্ছিল। বিনিয়োগকারীরাও সরে যাচ্ছিলেন ইন্টারনেট নির্ভর বেচাবিক্রির ব্যবসা থেকে।

তবে বেজোস হাল ছাড়েননি। তিনি বিশ্বাস করতেন, ইন্টারনেটই ভবিষ্যতের বড় সুযোগ। তাই ধৈর্য ধরে নতুন পরিকল্পনা সাজাচ্ছিলেন। সব সময় গ্রাহকদের খুশি রাখাই ছিল তাঁর মূল লক্ষ্য।

অবশেষে ২০০১ সালের শেষ দিকে বড়দিনের কেনাকাটায় অ্যামাজন প্রথমবার 'লাভ' করে। লাভের অঙ্ক প্রায় পাঁচ লাখ ডলার। তখনকার অ্যামাজনের জনপ্রিয়তার কথা চিন্তা করলে এই লাভ তেমন কিছু নয়। কিন্তু বেজোস জানতেন, তাঁকে আরও নতুন নতুন আইডিয়া নিয়ে বাজারে আসতে হবে।

এরপর ২০০২ সালে বেজোস চালু করলেন 'অ্যামাজন ওয়েব সার্ভিসেস'। এখন পর্যন্ত এই ক্লাউডভিত্তিক প্রযুক্তি সেবাই অ্যামাজনের সবচেয়ে বেশি আয় করা ব্যবসা।

এভাবেই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বড় হতে থাকে অ্যামাজনের পথচলা। আর এই বিশালত্বের পেছনে ছিলেন একজনই, জেফ বেজোস। ২০১৮ সালে তিনি হয়ে ওঠেন বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি। এখনো আছেন সেই তালিকার একেবারে ওপরের দিকে, ৩ নম্বরে।

ভাবতে আজও অবাক লাগে, সবকিছুর শুরু হয়েছিল ছোট এক ভাবনা থেকে। তখন কি কেউ জানত, বাড়ির গ্যারেজে শুরু হওয়া বেজোসের সেই উদ্যোগই একদিন গড়ে তুলবে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় অনলাইন দোকান?

Ad 300x250

সম্পর্কিত