leadT1ad

যেসব ভূমিকম্পে বদলে গেছে বাংলাদেশের নদীর গতিপথ

আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলে এক শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে। পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে বড় ভূমিকম্প হলে, এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়টি দেশ-বিদেশে আলোচনায় উঠে আসে। বাংলার ইতিহাসে বড় ভূমিকম্পগুলোর প্রভাব শুধু প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতিতে সীমাবদ্ধ ছিল না। ভূমিকম্পে নদীও তার পুরোনো পথ ছেড়ে নতুন পথ খুঁজে নিয়েছে।

অনন্ত রায়হান
প্রকাশ : ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২১: ৩৬
যেসব ভূমিকম্পে বদলে গেছে বাংলাদেশের নদীর গতিপথ

আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলে এক শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে। এই ভূমিকম্পে ইতিমধ্যেই ৮০০ জনের বেশি মানুষ মারা গেছেন। আফগানিস্তান ভূমিকম্পপ্রবণ দেশ। ২০২৩ সালের ভূমিকম্পে দেশটিতে দুই হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়। পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে বড় ভূমিকম্প হলে, দেশ-বিদেশে আলোচনায় উঠে আসে এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়।

আফগানিস্তানের মতো বাংলাদেশ ও এর আশেপাশের এলাকাতেও ভূমিকম্প নতুন কিছু নয়। বাংলার ইতিহাসে বড় ভূমিকম্পগুলোর প্রভাব শুধু প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতিতে সীমাবদ্ধ ছিল না। ভূমিকম্পে নদীও তার পুরোনো পথ ছেড়ে নতুন পথ খুঁজে নিয়েছে। ইতিহাস ও গবেষণা বলছে, শক্তিশালী ভূমিকম্প নদীর গতিপথ পাল্টে দিয়ে মানুষের জীবনযাত্রা ও বসতি স্থাপনায় সরাসরি প্রভাব ফেলেছে।

নাসা থেকে পাওয়া একটি স্যাটেলাইট চিত্র। কালো অংশগুলো সুন্দরবন। সংগৃহীত ছবি
নাসা থেকে পাওয়া একটি স্যাটেলাইট চিত্র। কালো অংশগুলো সুন্দরবন। সংগৃহীত ছবি

২৫০০ বছর আগের ভূমিকম্প

ভারতীয় উপমহাদেশের প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে শক্তিশালী এক ভূমিকম্পে বদলে গিয়েছিল পদ্মা নদীর গতিপথ। নেচার কমিউনিকেশন জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় বিজ্ঞানীরা এমনটাই জানিয়েছেন। সাম্প্রতিক সময়ে উপমহাদেশের বিভিন্ন নদ-নদীতে এ ধরনের পরিবর্তন লক্ষ্য করেছেন বিজ্ঞানীরা।

পদ্মার গতিপথের এই স্থানান্তর ঘটেছিল বদ্বীপ এলাকায়। নদীটি বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে যেখানে মিশেছে, সেখান থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরে। নদীর তলদেশে পলি জমার কারণে স্বাভাবিকভাবেই নদীর গতিপথ পরিবর্তন হতে পারে, তবে সাধারণত তা কয়েক বছর থেকে শতাব্দী পর্যন্ত ধীরে ধীরে ঘটে থাকে।

নেদারল্যান্ডসের ওয়াজেনিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-পদার্থবিদ এলিজাবেথ চেম্বারলেইনের মতে, ভূমিকম্পের কারণে নদী একদিন বা এক সপ্তাহেই চ্যানেল-জাম্পিং করে স্থানান্তরিত হতে পারে। নদীর পুরোনো জলপথ পলি দিয়ে ভরাট হলেও, তার প্রমাণ মাটির নমুনা ও চ্যানেল বিশ্লেষণে থেকে যায়।

নেচারের গবেষণায় বলা হয়েছে, প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের এই ভূমিকম্পটির রিখটার স্কেলে মাত্রা ছিল ৭ থেকে ৮ পর্যন্ত। ভূমিকম্পের ফলে কেন্দ্র থেকে পদ্মার অংশ দূরে সরে যায়। গবেষকরা মনে করেন, ভূমিকম্পে নদীর তলদেশের পলি বা বালি আগ্নেয়গিরির লাভার মতো উত্থাপিত হয়ে নদীর পথ পরিবর্তন হয়ে যায়।

বিশেষভাবে, এই ভূমিকম্পেই সেন্ট মার্টিন দ্বীপের ভূপৃষ্ঠে বড় পরিবর্তন আসে। এটি আগে একটি ডুবো দ্বীপ ছিল। কিন্তু ১৭৬২ সালের এই বড় ভূমিকম্পের সময় দ্বীপটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় তিন মিটার ওপরে উঠে আসে।

১৭৬২ সালের ‘আরাকান ভূমিকম্প’

১৭৬২ সালের ২ এপ্রিলের ঘটনা। সেদিন বঙ্গোপসাগরের আরাকান উপকূলে ৮ দশমিক ৮ মাত্রার একটি শক্তিশালী ভূমিকম্প হয়। এই ভূমিকম্পের ফলে সুনামি সৃষ্টি হয়, যার প্রভাব পড়ে পুরো বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায়। ভূমিকম্পের প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছিল চট্টগ্রাম উপকূল, সুন্দরবন এবং গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র মোহনায়।

মূল ভূমিকম্পের কেন্দ্র ছিল বর্তমান মিয়ানমারের আরাকান উপকূল, তবে ভূমিকম্পের কারণে অনেক এলাকায় ভূমি উঁচু-নিচু হয়ে যায়। কোথাও সমুদ্র থেকে কয়েক মিটার পর্যন্ত উঁচু হয়, আবার কোথাও জমি বসে গিয়ে নতুন জলাশয় তৈরি হয়। নদীর গতিপথও বদলে যায়; অনেক খাল হারায় এবং নতুন চর ও দ্বীপ জেগে ওঠে। সুন্দরবনের দক্ষিণাংশের নদীর চরিত্রও পরিবর্তিত হয়।

বিশেষভাবে, এই ভূমিকম্পেই সেন্ট মার্টিন দ্বীপের ভূপৃষ্ঠে বড় পরিবর্তন আসে। এটি আগে একটি ডুবো দ্বীপ ছিল। কিন্তু ১৭৬২ সালের এই বড় ভূমিকম্পের সময় দ্বীপটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় তিন মিটার ওপরে উঠে আসে।

চট্টগ্রামের ব্রিটিশ গভর্নর হ্যারি ভেরেলস্ট এই দুর্যোগ নিজের চোখে দেখেছিলেন। হ্যারি ভেরেলস্ট বর্ণনা থেকে জানা যায়, এই ভূমিকম্পের ফলে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অঞ্চলের মানুষের জীবনও পরিবর্তিত হয়। অনেক পরিবার নদী, খাল ও উপকূল হারিয়ে অন্য স্থানে বসতি গড়তে বাধ্য হয়। নদীর চর ও দ্বীপের উঁচু-নিচু হওয়া এবং নতুন জলাশয় তৈরি হওয়ায় কৃষি, মাছ ধরা ও স্থানীয় জীবিকায় বদল আসে। গবেষকরা মনে করেন, সুন্দরবনের কিছু চরের ভৌগোলিক গঠন মূলত তখনকার আরাকান ভূমিকম্প ও সুনামির প্রভাবের ফল।

ভারতীয় উপমহাদেশের প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে শক্তিশালী এক ভূমিকম্পে বদলে গিয়েছিল পদ্মা নদীর গতিপথ। সংগৃহীত ছবি
ভারতীয় উপমহাদেশের প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে শক্তিশালী এক ভূমিকম্পে বদলে গিয়েছিল পদ্মা নদীর গতিপথ। সংগৃহীত ছবি

১৭৮৭ সালের ‘ডাউকি ভূমিকম্প’

১৭৮৭ সালের ডাউকি ভূমিকম্প ব্রহ্মপুত্র নদের গতিপথ পাল্টে দিয়েছিল। আগে নদীটি ময়মনসিংহ দিয়ে প্রবাহিত হতো। কিন্তু ভূমিকম্পের কারণে এটি বর্তমানে যমুনা নদীর কাছ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

এছাড়া গবেষকদের মতে, মেঘনা নদীও এর আগে লালমাই পাহাড়ের পাদদেশ দিয়ে প্রবাহিত হতো। প্রায় এক হাজার থেকে এক হাজার দুইশো বছর আগে ঘটে যাওয়া শক্তিশালী ভূমিকম্পের প্রভাবে মেঘনা নদী ২০–৪০ কিলোমিটার পশ্চিম দিকে সরে যায়। এই ভূমিকম্প নদীর প্রবাহ, চর গঠন এবং স্থানীয় মানুষের জীবনধারায় দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে।

১৮৯৭ সালের ‘আসাম ভূমিকম্প’

১৮৯৭ সালের ১২ জুন ঘটে যায় উপমহাদেশের এক ভয়াবহ ভূমিকম্প। এর মাত্রা ছিল ৮.২। কয়েক মিনিটের মধ্যেই আসাম, সিলেট, মেঘালয় এবং পূর্ববঙ্গের কিছু অঞ্চল কেঁপে ওঠে।

এজিইউ পাবলিকেশন্সের গবেষণা থেকে জানা যায়, এই ভূমিকম্পে সিলেট অঞ্চলের নদী ও খালের তলদেশ উঁচু-নিচু হয়ে যায়। অনেক সমতল কৃষিজমি ডুবে গিয়ে স্থায়ী হাওরে রূপ নেয়। ব্রহ্মপুত্র, সুরমা ও কুশিয়ারার নদীর প্রবাহ পরিবর্তিত হয় বলে জানা যায়।

ভূমিকম্পের পর এই পরিবর্তন স্থানীয় মানুষের জীবনযাত্রায় বড় প্রভাব ফেলে। ধানচাষের জমি হারিয়ে যায়। জলাভূমি বেড়ে যাওয়ায় মাছ ধরা ও জলাভিত্তিক জীবিকা বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। একইসঙ্গে লালমাই পাহাড়ের ভূভাগেও কিছুটা পরিবর্তন ঘটে।

আরও কিছু গবেষণা

ভূমিকম্প যে নদীর পথ, স্রোত আর চ্যানেল বদলে দিতে পারে তা নিয়ে নিয়মিত গবেষণাও হচ্ছে। কোলমান (১৯৬৯) এবং সরকার (২০০৬) এর গবেষণা বলছে, ভূমিকম্প শুধু সাময়িক পরিবর্তনই আনে না, বরং নদীর দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তনের কারণও হয়।

নদীর পুরানো জলপথ পলি দিয়ে ভরাট হলেও, তার প্রমাণ মাটির নমুনা ও চ্যানেল বিশ্লেষণে থেকে যায়। সংগৃহীত ছবি
নদীর পুরানো জলপথ পলি দিয়ে ভরাট হলেও, তার প্রমাণ মাটির নমুনা ও চ্যানেল বিশ্লেষণে থেকে যায়। সংগৃহীত ছবি

কোলমান দেখিয়েছেন, ব্রহ্মপুত্র নদীর চ্যানেল আর পলি বয়ে আনার ধরণ ভূমিকম্পের কারণে অনেক বদলে গেছে। নদীর তলদেশ হঠাৎ কোথাও উঁচু হয়ে গেছে, কোথাও আবার বসে গেছে। এর ফলে নদী নতুন পথ বেছে নিয়েছে। আগে যে জায়গায় নদীর পানি বইত, সেগুলো অনেক জায়গায় শুকিয়ে গেছে।

সরকার দেখিয়েছেন, ভূমিকম্পের ফলে শুধু নদীর দিকই পাল্টায়নি বরং নদীর চ্যানেলের আকৃতি আর প্রস্থও বদলে গেছে। কোনো নদী আগে সরু বা বাঁকা পথে বইলেও ভূমিকম্পের পরে নতুন চ্যানেল তৈরি হয়েছে। আবার পুরোনো চ্যানেল হারিয়ে গেছে। এই পরিবর্তনের সঙ্গে নদীর পলি বহন করার ধরণও বদলেছে। নদ্যীর মোহনায় কোথাও বেশি পলি জমেছে, কোথাও আবার কমে গেছে।

ভূমিকম্পের কারণে কি ‘মাইগ্রেশন’ হয়?

ভূমিকম্পের ফলে নদীর পথ ও স্রোত বদলে যাওয়ায় সরাসরি প্রভাব পড়ে নদীর তীরবর্তী গ্রাম ও বসতিতে। যেখানে নদী আগে একদিকে বইত, হঠাৎ স্রোত অন্যদিকে চলে গেলে সেই এলাকায় বন্যা বা জলাবদ্ধতা দেখা দিত। এতে মানুষের জীবনযাত্রা, কৃষিকাজ, মাছ ধরা এবং নদীর পাশে বসতি গড়ে তোলার ধরণ; সবকিছুতেই দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তন আসে। গবেষকরা মনে করেন, ভূমিকম্প-জনিত নদীর দিক পরিবর্তন বাংলার নদী-হাওরের প্রবাহে প্রভাব ফেলেছে।

তবে ইতিহাসবিদরা মনে করিয়ে দেন, বাংলায় মানুষের স্থানান্তর বা মাইগ্রেশনে ভূমিকম্পের তেমন সরাসরি কোনো ভূমিকা নেই। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মধ্যে নদীর ভাঙন, বন্যা, পলি জমা, ঝড় ও জলোচ্ছ্বাস মাইগ্রেশনের বড় কারণ। ভূমিকম্প মাইগ্রেশন প্রক্রিয়ার ‘পুশ ফ্যাক্টর’ হিসেবেও কাজ করেছে কিছু ক্ষেত্রে।

গুডব্রেড ও তাঁর দল বাংলাদেশে নদী পরিবর্তন সম্পর্কিত প্রমাণ খুঁজতে গিয়ে সেডিমেন্ট নমুনা সংগ্রহ করেছেন। তাঁদের গবেষণায় ভূমিকম্পের কারণে নদীর গতিপথ পরিবর্তন এবং এর ফলে নতুন ভূমি সৃষ্টি ও মানুষের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন সম্পর্কে তথ্য পাওয়া গেছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, ব্রহ্মপুত্র ডেল্টা অঞ্চলে সেডিমেন্টের চলাচল ও জমি গঠনের প্রক্রিয়ায় ভূমিকম্পের সংক্ষিপ্ত ও দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব রয়েছে। নতুন ভূমি সৃষ্টি হওয়ায় কৃষি, বসতি এবং স্থানান্তরিত মানুষের জীবনযাত্রায় নতুন সুযোগ এসেছে। অন্যদিকে, নদীর গতি পরিবর্তনের কারণে অনেক সময় পূর্বের বসতি উপযুক্ত না থাকায় মানুষকে অন্যত্র স্থানান্তরিত হতে হয়েছে।

অন্য দেশের উদাহরণ টানলে এখানে আফগানিস্তানের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ভূমিকম্প বহুবার স্থানীয় বাসিন্দাদের স্থানান্তরের কারণ হিসেবে ওঠে এসেছে। এমনকি অনেকেই আশপাশের এলাকায় কিংবা অন্য দেশে গিয়ে বসতি গড়ে তুলেছে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত