leadT1ad

মজলুমের মন থেকে মোছা যায়নি যে মওলানার নাম

মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। সংগৃহীত ছবি

আজ এক ‘অগ্নিপুরুষ’-এর জন্মদিন। ইতিহাসের পাতায় যার নাম লেখা আছে ‘মজলুম জননেতা’ হিসেবে, কিন্তু শোষকের কলিজা কাঁপাতে তিনি ছিলেন সাক্ষাৎ দাবানল। তিনি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। ব্রিটিশ ভারত থেকে পাকিস্তান, পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ—তিনটি কালের সাক্ষী তিনি, তিনটি সাম্রাজ্যের ভিত নাড়িয়ে দেওয়া এক নিস্বার্থ লড়াকু।

একবার মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো, ‘হুজুর, আপনার বাড়িতে কেউ গেলেই সঙ্গে সঙ্গে আপনি তাকে কিছু খেতে দেন। নিজের হাড়ির খবর রাখেন না, বিলিয়ে দেন সব। কারণ কী?’

মওলানা মুচকি হেসে বললেন, ‘মানুষের খিদা কী জিনিস, তা আমি ছোটকালেই দেইখেছি। কচু, ঘেঁচু, জোয়ার, বাজরা খাইয়া মানুষকে বাঁচতে দেইখেছি। যে কৃষক জমিদার-জোতদারের ফসল ফলায় সেই কৃষকেরে আমি ভাত না খাইয়া মরতে দেইখেছি। দূরদারাজ থিকা মানুষজন আমার কাছে আসে, কোন সময় কী খাইয়া রওনা দিছে, তাদের পেটে দানাপানি আছে কি না, এই চিন্তা আমাকে স্থির থাকতে দেয় না।’

মওলানা উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমি সেই ইসলামে বিশ্বাস করি যা মানুষের পেট ভরাবার কথা বলে, ইনসাফের কথা বলে। আমার আল্লাহ রাব্বুল আলামিন, সমগ্র সৃষ্টির পালনকর্তা, তিনি শুধু রব্বুল মুসলিমিন মানে মুসলমানদের পালনকর্তা নন।’

আব্দুল হামিদ খান থেকে তিনি কীভাবে ‘ভাসানী’ হলেন, সেই ইতিহাসও বড় অদ্ভুত। ১৯২৯ সাল। আসামের ধুবড়ী জেলার ব্রহ্মপুত্র নদের ভাসান চরে তিনি আয়োজন করলেন আসামের ইতিহাসে বৃহত্তম এক কৃষক সম্মেলন। লাখো কৃষকের সেই সমাবেশে তিনি শোষকদের বিরুদ্ধে এমন বজ্রকণ্ঠ ছাড়লেন যে সাধারণ মানুষ ভালোবেসে তাকে নাম দিলো ‘ভাসান চরের মওলানা’ বা ‘মওলানা ভাসানী’।

আসামে তখন ‘লাইন প্রথা’র নামে বাঙালিদের ওপর চলছে অমানুষিক নির্যাতন। মওলানা রুখে দাঁড়ালেন। কুড়াল হাতে জঙ্গলের গাছ কেটে বললেন, ‘আল্লাহর জমিন, আল্লাহর জঙ্গল। এখানে বাস করতে কারো হুকুম লাগে না।’ সেই আন্দোলন তাকে আসামের অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত করে।

বিদেশিরা তাঁকে বলে ‘প্রফেট অব ভায়োলেন্স’ । টাইম ম্যাগাজিন তাকে নিয়ে প্রচ্ছদ করে। একবার চীনে মাও সে তুং-এর সঙ্গে তাঁর দেখা হলো। মাও সে তুং অবাক হয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আপনি ধর্মপ্রাণ মানুষ, আবার সমাজতন্ত্রের কথা বলেন, গরিবের অধিকারের কথা বলেন। এটা কীভাবে সম্ভব?’

মওলানা উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমি সেই ইসলামে বিশ্বাস করি যা মানুষের পেট ভরাবার কথা বলে, ইনসাফের কথা বলে। আমার আল্লাহ রাব্বুল আলামিন, সমগ্র সৃষ্টির পালনকর্তা, তিনি শুধু রব্বুল মুসলিমিন মানে মুসলমানদের পালনকর্তা নন।’

‘মওলানা সাহেবের সংসদ বা পার্লামেন্ট হচ্ছে ধানক্ষেত আর কল কারখানা। এই সংসদের সদস্যরা হচ্ছেন কৃষক শ্রমিক মেহনতি জনতা। আর শেখ সাহেবের লক্ষ্য হচ্ছে ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নেতা হওয়া। যে গণতন্ত্র নিয়ন্ত্রণ করবে ধনী পরিবার।’

প্রথম বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে অংশ গ্রহণ করে বিশ্ববাসীকে তিনি বলে এসেছিলেন, ‘আমার ধর্ম শান্তির ধর্ম, আমার রাজনীতি শান্তির, আমি শান্তির মাঝেই বাস করি এবং শান্তিই আমার অভিবাদন।’

পাকিস্তানের রাজনীতিতে তখন মাওলানা এক প্রবল শক্তি। জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কে তাঁর অবস্থান ছিল অত্যন্ত পরিষ্কার। তিনি বলেছিলেন, ‘নীল নদের পানি যেমন নীল নয়, জামায়াতের ইসলামও ইসলাম নয়। আসলেই এটা কোন ইসলাম নয় বরং এটা হল মওদূদীবাদ। কিন্তু সমস্যা হল আমাদের দেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ তারা ইসলামকে ভালোবাসে তাই ইসলাম শুনলেই যাচাই বাছাইয়ের মানসিকতা থাকে না।’

পাকিস্তানের মুলতানে প্রখ্যাত সাংবাদিক এরশাদ মজুমদার তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘হুজুর, মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবের মধ্যে পার্থক্য কোথায়?’

প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন এক ধ্রুব সত্য কথা, ‘মওলানা সাহেবের সংসদ বা পার্লামেন্ট হচ্ছে ধানক্ষেত আর কল কারখানা। এই সংসদের সদস্যরা হচ্ছেন কৃষক শ্রমিক মেহনতি জনতা। আর শেখ সাহেবের লক্ষ্য হচ্ছে ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নেতা হওয়া। যে গণতন্ত্র নিয়ন্ত্রণ করবে ধনী পরিবার।’

মওলানা ক্ষমতার রাজনীতি করেননি, করেছেন জনতার রাজনীতি। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ তাঁর হাত ধরেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। কিন্তু যখন দেখলেন দলের নীতি আদর্শ থেকে সরে যাচ্ছে, মন্ত্রিত্ব আর ক্ষমতার লোভে নেতারা ব্যস্ত, তখন তিনি মুহূর্তের মধ্যে সেই দল ত্যাগ করে নতুন দল (ন্যাপ) গঠন করলেন। ক্ষমতা তাঁকে বাঁধতে পারেনি।

মওলানা সাহেব ছিলেন একজন কালজয়ী দূরদর্শী নেতা। পঞ্চাশের দশকেই তিনি নিশ্চিত হয়েছিলেন যে পাকিস্তানের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ একটি অচল রাষ্ট্রকাঠামো। ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দের টাঙ্গাইলের কাগমারী সম্মেলনে তিনি পাকিস্তানের পশ্চিমা শাসকদের মুখের ওপর দাঁড়িয়ে বলেছিলেন ‘ওয়ালাইকুম আসসালাম’।

পশ্চিম পাকিস্তানকে বিদায় জানিয়ে তিনি সর্বপ্রথম পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতার ঐতিহাসিক ঘণ্টা বাজিয়েছিলেন। সেদিন অনেকেই তাকে ভুল বুঝেছিল, কিন্তু ১৯৭১ প্রমাণ করেছে মওলানা কতটা সঠিক ছিলেন।

এরপর এল ৭০-এর ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাস। লাখো মানুষ মারা গেল। ইয়াহিয়া খান তখনো মদে মগ্ন। মওলানা ভাসানী ছুটে গেলেন দুর্গত এলাকায়। লাশ আর কাদা মাড়িয়ে তিনি ঢাকায় ফিরে এসে পল্টনের জনসভায় ২৩ নভেম্বর স্লোগান দিলেন, ‘স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান জিন্দাবাদ’।

সেই জনসভার দৃশ্য দেখে কবি শামসুর রাহমান লিখলেন তার বিখ্যাত কবিতা ‘সফেদ পাঞ্জাবী’:

‘...সবাই এলেন ছুটে পল্টনের মাঠে, শুনবেন

দুর্গত এলাকা প্রত্যাগত বৃদ্ধ মৌলানা ভাসানী

কি বলেন। রৌদ্রালোকে দাঁড়ালেন তিনি, দৃঢ়, ঋজু,

যেন মহাপ্লাবনের পর নূহের গভীর মুখ।

...হায়! আজ একি মন্ত্র জপলেন মৌলানা ভাসানী।

বল্লমের মত ঝলসে ওঠে তাঁর হাত বারবার

অতিদ্রুত স্ফীত হয়; স্ফীত হয় মৌলানার সফেদ পাঞ্জাবী

যেন তিনি ধবধবে একটি পাঞ্জাবী দিয়ে সব

বিক্ষিপ্ত বেআব্রু লাশ কী ব্যাকুল ঢেকে দিতে চান।’

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এই নব্বইোর্ধ্ব বৃদ্ধ নেতা ঘরে বসে থাকেননি। তিনি ভারতে গিয়ে প্রবাসী সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। তার কলম থামেনি। ২৫ এপ্রিল মওলানা ভাসানী সোভিয়েত রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের কাছে চিঠি লেখেন। ৩১ মে এক বিবৃতিতে বলেন, ‘বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ দখলদার বাহিনীর সঙ্গে জীবনমরণ সংগ্রামে লিপ্ত... তারা এই সংগ্রামে জয়লাভ করবেই।’ চীনকেও তিনি কড়া চিঠি লিখেছিলেন পাকিস্তানের পক্ষ না নেওয়ার জন্য।

মওলানার দাড়ি-টুপি ও লেবাসের কারণে একদল লোক তাঁকে সাম্প্রদায়িক বানাতে চায়। কিন্তু ইতিহাস বলে ভিন্ন কথা। সেকালের বাংলার জমিদারদের ৮০ শতাংশ ছিলেন হিন্দুধর্মাবলম্বী। তিনি যখন তাদের শোষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন, তখন তার পাশে দাঁড়িয়েছিল নমশূদ্র ও সাধারণ হিন্দু প্রজারা। বাংলা ও আসামের বহু হিন্দু তাঁকে ‘অবতার’ জ্ঞান করতেন।

মওলানা ভাসানী বলতেন, ‘হিন্দুর ক্ষুধা, মুসলমানের ক্ষুধা, বৌদ্ধের ক্ষুধা, খ্রিষ্টানের ক্ষুধা একই রকম। পেটের আগুনের কোনো রং নাই, ধর্ম নাই। শোষক ও জালেমের কোনো ধর্ম নেই। মজলুমের কোনো ধর্ম নেই।’

স্বাধীনতার পর, ১৯৭৬ সাল। জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও তিনি থামেননি। ভারতের ফারাক্কা বাঁধের কারণে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল মরুভূমি হয়ে যাচ্ছে দেখে ৯৬ বছর বয়সে তিনি ডাক দিলেন ‘ফারাক্কা লং মার্চ’-এর। রাজশাহী থেকে কানসাট পর্যন্ত হাজার হাজার মানুষ তার পেছনে হাঁটল। সেই বৃদ্ধ বয়সে মাইক হাতে তার হুংকার শুনে মনে হয়েছিল, সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগারও হার মানবে।

আওয়ামী লীগ পাঠ্যবই থেকে, রাস্তার মোড় থেকে ভাসানীর নাম মুছে ফেলেছে। আবার আরেকপক্ষ তাঁকে হয়তো শুধুই একজন ‘হুজুর’ বানিয়ে রাখার পায়তারা করছে। কিন্তু ভাসানী ছিলেন মাটির কাছাকাছি থাকা মানুষ। তিনি টাঙ্গাইলের সন্তোষে এক ভাঙা কুঁড়েঘরে থাকতেন, অথচ তার ইশারায় সরকার পতন হতো।

ইতিহাসে কোনো জালিম কি কখনো মজলুমের মন থেকে তার নেতার নাম মুছে দিতে পেরেছে? না, পারেনি।

যতদিন এ দেশে খেটে খাওয়া মানুষ থাকবে, যতদিন ক্ষুধার কষ্ট থাকবে, যতদিন শোষণ থাকবে, ততদিন লাল মওলানা ভাসানী প্রাসঙ্গিক থাকবেন। তিনি আমাদের ইতিহাসের সেই ধ্রুবতারা, যাকে মেঘ দিয়ে আড়াল করা যায়, কিন্তু নিভিয়ে দেওয়া যায় না।

Ad 300x250

সম্পর্কিত