leadT1ad

টাঙ্গাইল শাড়ির ঐতিহ্য বিশ্বমঞ্চে, ইউনেসকোর স্বীকৃতি কেন গুরুত্বপূর্ণ

ইউনেসকোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় এবার যুক্ত হলো বাংলাদেশের শতাব্দীপ্রাচীন টাঙ্গাইল শাড়ি বয়নশিল্প। ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ বা অপরিমেয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য কী? ইউনেসকো কবে থেকে এই স্বীকৃতি দিচ্ছে? এই স্বীকৃতি কেন গুরুত্বপূর্ণ? কীভাবে হয় ইউনেসকোর ঐতিহ্য তালিকাভুক্তি?

স্ট্রিম গ্রাফিক

ইউনেসকোর অপরিমেয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে বাংলাদেশের ‘ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইল শাড়ি বুনন শিল্প’। ভারতের নয়াদিল্লিতে ইউনেসকোর ২০তম আন্তঃরাষ্ট্রীয় পর্ষদের সভায় সর্বসম্মতিক্রমে এ সিদ্ধান্ত হয়। এখন পর্যন্ত ১৫০টি দেশের ৭৫০টি বহমান ঐতিহ্যকে এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ বছর মোট ৫৪টি আবেদন জমা দেওয়া হয়।

বাংলাদেশের ষষ্ঠ আইসিএইচ উপাদান হিসেবে টাঙ্গাইল বয়নশিল্প চূড়ান্তভাবে তালিকাভুক্ত হলো। এর আগে ২০০৮ সালে বাউল সঙ্গীত, ২০১৩ সালে জামদানি শাড়ি, ২০১৬ সালে মঙ্গল শোভাযাত্রা, ২০১৭ সালে শীতল পাটি এবং ২০২৩ সালে ঢাকার রিকশা ও রিকশা-চিত্রকে ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো।। ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর এই স্বীকৃতি দেওয়া হতো। এর পর থেকে দুই বছর অন্তর এই স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে

বাংলাদেশের তাঁত শিল্পীদের অভিনন্দন জানিয়ে ইউনেসকোর ফেসবুক পেজে বলা হয়েছে, আমরা অভিনন্দন জানাই সেসব তাঁতশিল্পী ও সম্প্রদায়কে, যারা এই ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছেন এবং আগামীর প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন। এই স্বীকৃতি কেবল একটি কাপড়ের স্বীকৃতি নয়, এটি দক্ষিণ এশিয়ার বস্ত্রশিল্পে বাংলাদেশের সুপ্রাচীন ঐতিহ্য ও সূক্ষ্ম কারুশৈলীর এক অনবদ্য দলিল।

ইউটিউব থেকে নেওয়া ছবি
ইউটিউব থেকে নেওয়া ছবি

ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ বা অপরিমেয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য কী

ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ বা অপরিমেয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে বলতে এমন সব সাংস্কৃতিক উপাদানকে বোঝায়, যেগুলো চোখে দেখা যায় না বা কোনো জাদুঘরে তুলে রাখা যায় না। বরং মানুষের জীবনযাপন, অভ্যাস, শিল্পকলা, রীতি, প্রথা ও সামাজিক চর্চার মাধ্যমে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বেঁচে থাকে।

এগুলো মূলত জীবন্ত ঐতিহ্য, যার মধ্যে রয়েছে লোকসংগীত, নৃত্য, নাট্যকলার ধারা, বয়ন ও কারুশিল্পের দক্ষতা, উৎসব-আচার, মৌখিক সাহিত্য, গল্প, লোককাহিনি, প্রথাগত কৃষি বা চিকিৎসা–চর্চা ইত্যাদি। অর্থাৎ, যে সব ঐতিহ্য মানুষের কাজে, দক্ষতায় এবং সামাজিক সম্পর্কের মধ্যে প্রতিদিন নতুন করে জীবিত হয়, যেগুলোর কোনো নির্দিষ্ট রূপ নেই, সেগুলোই অপরিমেয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে হিসেবে পরিচিত।

ইউনেসকোর অপরিমেয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় থাকা মানে একটি দেশ বা অঞ্চলের ঐতিহ্যকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়া। এটা বিশ্বমঞ্চে সে দেশের পরিচিতি ও গুরুত্ব বাড়ায়। এতে ঐতিহ্যটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে মূল্যায়িত হয়।

ইউনেসকো কবে থেকে এই স্বীকৃতি দিচ্ছে

ইউনেসকো আনুষ্ঠানিকভাবে ২০০৮ সাল থেকে ইনট্যানজিবল ঐতিহ্যকে স্বীকৃতি দেওয়া শুরু করে। তবে এর পেছনে রয়েছে আরও কয়েক বছরের প্রস্তুতি ও নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়া। ২০০৩ সালে ইউনেসকো এক ঐতিহাসিক কনভেনশনে বলা হয়, মানুষের চর্চা, রীতি, শিল্পকলা, লোকজ দক্ষতা, আচার-অনুষঙ্গ, মৌখিক ঐতিহ্যসহ যেসব সাংস্কৃতিক উপাদান প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বহমান, সেগুলোকে আনুষ্ঠানিকভাবে সংরক্ষণ ও নথিভুক্ত করা জরুরি।

এই কনভেনশনটি ২০০৬ সালে কার্যকর হয় এবং সদস্য দেশগুলোকে নিজেদের বহমান ঐতিহ্য সুরক্ষার পথে এগিয়ে যেতে উৎসাহিত করে। এরপর তিন বছরের প্রস্তুতি, কাঠামো তৈরি ও আন্তর্জাতিক পর্যালোচনা শেষে ২০০৮ সালে ইউনেসকো প্রথমবারের মতো ‘মানবজাতির অপরিমেয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্বমূলক তালিকা’ চালু করে।

এরও আগে, ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত ইউনেসকো ‘মাস্টারপিসেস’ নামে একটি বিশেষ প্রকল্পে কিছু ঐতিহ্যকে স্বীকৃতি দিত, যা পরে নতুন তালিকার সঙ্গে একীভূত করে পূর্ণাঙ্গ কাঠামো তৈরি করা হয়। অর্থাৎ, আজ যেভাবে বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দেওয়া হয়, তার মূল সূচনা ২০০৮ সালেই।

ইউনেসকোর এই স্বীকৃতি কেন গুরুত্বপূর্ণ

ইউনেসকোর অপরিমেয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় থাকা মানে একটি দেশ বা অঞ্চলের ঐতিহ্যকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়া। এটা বিশ্বমঞ্চে সে দেশের পরিচিতি ও গুরুত্ব বাড়ায়। এতে ঐতিহ্যটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে মূল্যায়িত হয়। এই স্বীকৃতি পাওয়ার ফলে সেই ঐতিহ্য হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি কমে, কারণ ইউনেসকোর স্বীকৃতি সাধারণত সরকার, প্রতিষ্ঠান ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ফলে গবেষণা, নথিভুক্তি, প্রশিক্ষণ, কারিগরদের সহায়তা, সংরক্ষণ ও প্রচারের কাজ বাড়ে।

ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ বা অপরিমেয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে বলতে এমন সব সাংস্কৃতিক উপাদানকে বোঝায়, যেগুলো চোখে দেখা যায় না বা কোনো জাদুঘরে তুলে রাখা যায় না। বরং মানুষের জীবনযাপন, অভ্যাস, শিল্পকলা, রীতি, প্রথা ও সামাজিক চর্চার মাধ্যমে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বেঁচে থাকে।

এ তালিকায় থাকা অর্থনৈতিকভাবেও গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সময় স্বীকৃতির পর ঐতিহ্যসম্পর্কিত পণ্য, পর্যটন, উৎসব বা কারুশিল্পের প্রতি মানুষের আগ্রহ বেড়ে যায়, স্থানীয় শিল্পীরা কাজ পান, বাজার বিস্তৃত হয়, এমনকি আন্তর্জাতিক সহযোগিতাও পাওয়া যায়। সবচেয়ে বড় কথা, একটি কমিউনিটির মানুষ তাঁদের নিজস্ব ঐতিহ্য নিয়ে গর্ববোধ ও আত্মপরিচয়ের শক্তি ফিরে পায়।

কীভাবে হয় ইউনেসকোর ঐতিহ্য তালিকাভুক্তি

ইউনেসকোর অপরিমেয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় কোনো উপাদান অন্তর্ভুক্ত হওয়া একটি আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়া। প্রথমে প্রত্যেক দেশ নিজস্বভাবে ঐতিহ্যটি শনাক্ত করে এবং তা জাতীয় পর্যায়ের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। এরপর ঐতিহ্যটির ইতিহাস, বৈশিষ্ট্য, সামাজিক ভূমিকা, কমিউনিটির অংশগ্রহণ ও ভবিষ্যৎ সংরক্ষণ পরিকল্পনা নিয়ে একটি বিস্তারিত মনোনয়ন ফাইল প্রস্তুত করা হয়। এই নথিতে ছবি, ভিডিও ও গবেষণাসহ প্রয়োজনীয় সব প্রমাণ যুক্ত থাকে।

মনোনয়ন প্রস্তুত হলে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তা ইউনেসকোতে জমা দেওয়া হয়, যেখানে আন্তর্জাতিক মূল্যায়ন কমিটি পুরো নথি পরীক্ষা করে দেখে ঐতিহ্যটি সত্যিই বহমান কি না, কমিউনিটি নিজেরা এটি টিকিয়ে রাখতে আগ্রহী কি না, এবং মনোনয়নকারী দেশ সংরক্ষণের বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা দিয়েছে কি না।

মূল্যায়ন শেষে কমিটি তালিকাভুক্তির সুপারিশ, সংশোধনের পর পুনরায় জমা দেওয়ার পরামর্শ, অথবা তালিকাভুক্ত না করার মতামত দিতে পারে। অবশেষে, প্রতি বছর ডিসেম্বরে ইউনেসকোর আন্তঃসরকার কমিটি বৈঠকে বসে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। এভাবেই কোনো ঐতিহ্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়ে মানবজাতির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্বমূলক তালিকায় জায়গা করে নেয়।

Ad 300x250

সম্পর্কিত