leadT1ad

হুমায়ূন আহমেদ আসলে কী ছিলেন

আগামীকাল (১৩ নভেম্বর) হুমায়ূন আহমেদের ৭৭তম জন্মদিন। হিমুর পাগলামি, মিসির আলীর যুক্তিবাদ আর শুভ্রর নীরবতায় আমরা তাঁকে চিনি। কিন্তু তাঁর ভেতরে ছিল আরও অনেক অচেনা রূপ। আজ আমরা খুঁজব সেই অচেনা হুমায়ূনকে।

প্রকাশ : ১২ নভেম্বর ২০২৫, ১৭: ৩৬
স্ট্রিম গ্রাফিক

বাংলাদেশের সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক কে? এ প্রশ্নে নির্দ্বিধায় বলা যাবে হুমায়ূন আহমেদের নাম। হিমুর পাগলামি, মিসির আলীর যুক্তিবাদ আর শুভ্রর নীরবতায় আমরা তাঁকে চিনি। কিন্তু তাঁর ভেতরে ছিল আরও অনেক অচেনা রূপ। আজ আমরা খুঁজব সেই অচেনা হুমায়ূনকে।

জাদুকর হুমায়ূন

হুমায়ূন আহমেদ শুধু সাহিত্যের জাদুকর নন, তিনি ছিলেন সত্যিকারের জাদুকর, মানে ম্যাজিশিয়ানও। ছোটবেলা থেকেই ম্যাজিক ছিল তাঁর নেশা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসিন হলের ৫৬৪ নম্বর রুম তখন ছিল এক রহস্যঘেরা ঘর। সেখানে হঠাৎ হঠাৎ ম্যাজিক দেখিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিতেন হুমায়ূন।

ছাত্রাবস্থায় হুমায়ূন আহমেদ কামরাঙ্গীরচরে টিউশন করতে যেতেন। রাস্তার মোড়ে, চায়ের দোকানে, সুযোগ পেলেই ম্যাজিকের ট্রিকস দেখাতেন। লোকজন ভিড় করত, হাততালিতে মেতে উঠত।

হিমু ও রূপা। স্ট্রিম গ্রাফিক
হিমু ও রূপা। স্ট্রিম গ্রাফিক

একবার হুমায়ূন আহমেদ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সামনে ম্যাজিক দেখিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। সুনীল সারারাত তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘এটা কীভাবে সম্ভব?’ বিশ্বখ্যাত জাদুকর জুয়েল আইচ পর্যন্ত বলেছেন, ‘ক্লোজআপ ম্যাজিকে হুমায়ূন ছিলেন রাজার ভান্ডার।’

১৯৬৮ সালে টেলিভিশনে প্রথম ম্যাজিক দেখান তিনি, তৎকালীন পাকিস্তান টেলিভিশনে। ছিলেন আন্তর্জাতিক ম্যাজিশিয়ান সংগঠনের সদস্যও। আড্ডাপ্রিয় এই কথাশিল্পীর ব্যক্তিত্বও ছিল ম্যাজিকের মতো, সবাইকে আকর্ষণ করত।

চেনার বাইরে অচেনা হুমায়ূন

হুমায়ূন আহমেদ শুধু ম্যাজিকেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না। বিশ্ববিদ্যালয়জীবন থেকেই তাঁর আরেকটি বিশেষ ক্ষমতা ছিল—হাত দেখে মানুষের ভাগ্য বলার। একবার মহসিন হলে গুঞ্জন ছড়ায়, হুমায়ূন হাত দেখে ভবিষ্যৎ বলে দিচ্ছেন। বন্ধুদের চোখে তখন তিনি এক অলৌকিক চরিত্র হয়ে ওঠেন। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই আগ্রহ আরও বেড়ে যায়।

সিনেমা বানাতে গিয়েও হুমায়ূন আহমেদের অভিজ্ঞতা জমজমাট। এফডিসিতে পরিচালক সমিতির করা প্রশ্নে বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, ‘ছবি পরিচালকের মূল কাজ হচ্ছে ক্রিকেট খেলার আম্পায়ারের মতো, একটা সাদা টুপি পরে হাসি মুখে চেয়ারে বসে নায়িকাদের সাথে ফষ্টি নষ্টি করা।’

একবার গায়ক এস আই টুটুল জানালেন, কুষ্টিয়ায় দুজন জিন দেখার মানুষ আছেন, যারা হাত দেখে সব বলে দিতে পারে। হুমায়ূন সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘ওদের নিয়ে আসো।’ নুহাশপল্লীতে আয়োজন করা হলো, অতিথি প্রায় পঞ্চাশজন। গণকরা প্রথমে নায়ক রিয়াজের হাত দেখে বলেন, ‘আপনার মা মারা গেছেন।’ রিয়াজ হতবাক—মা তো পাশেই বসে আছেন।

মুহূর্তটি আরও রহস্যময় হয়ে উঠল। শেষ পর্যন্ত হুমায়ূন বলেন, বাটপারি করছ? গণকেরা পালিয়ে যায়। পরে তারা এস আই টুটুলকে জানায়, ‘স্যারের ঘরে এমন জোরালো জিন ছিল, আমাদের জিন ঢুকতেই পারেনি!’

ভূতেও বিশ্বাস করতেন হুমায়ূন আহমেদ। তাঁর কাছে জীবন ছিল এক কুহক, রহস্যময় এক বাস্তবতা, যার অনেকটুকু আমাদের চোখে পড়ে না। তাঁর যুক্তি ছিল, ‘জিন যদি থাকতে পারে, ভূত থাকলে আমাদের সমস্যা কী?’ যুক্তি ও রহস্যের মাঝে নিখুঁত ভারসাম্য বাংলা সাহিত্যে খুব কম লেখকই রক্ষা করতে পেরেছেন। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদে এই কাজটি খুব ভালোমতই করেছেন বলে মন্তব্য করেছেন তাঁর পাঠক ও বিশ্লেষকেরা।

হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে জুয়েল আইচ। সংগৃহীত ছবি
হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে জুয়েল আইচ। সংগৃহীত ছবি

ক্রিকেট, নাটক আর সিনেমা

বাংলাদেশ দলের ক্রিকেট খেলা হলে উত্তেজনায় মেতে উঠতেন নন্দিত নরকের রচয়িতা এই কথাকার। যদিও খেলা যে খুব বুঝতেন, এমন নয়। নিজেই বলতেন, ‘আমি গল্পকার। তাই ক্রিকেট ভালোবাসি। এখানে প্রতিটা বল মানে একটা সম্ভাবনা, একটা গল্প। উইকেট পড়তে পারে, ছক্কা হতে পারে, রানআউট, ডট, কিছুই না—তবু একটা গল্প থাকে। ছয়টা বল মানে ছয়টা ভিন্ন গল্পের সম্ভাবনা।’

‘এইসব দিনরাত্রি’ নাটক প্রচারের পর ব্যাপক জনপ্রিয়তা পান হুমায়ূন আহমেদ। কিন্তু মাঝপথে নাটকটি হঠাৎ বন্ধ করে দেন। কারণ? তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, একটি রঙিন টেলিভিশন কিনবেন। প্রতি এপিসোডের টাকা হিসাব করে নাটক লিখেছিলেন। তাই টিভি কেনার টাকা হয়ে গেলেই নাটক লেখা বন্ধ করে দেন।

সিনেমা বানাতে গিয়েও হুমায়ূন আহমেদের অভিজ্ঞতা জমজমাট। এফডিসিতে পরিচালক সমিতির করা প্রশ্নে বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, ‘ছবি পরিচালকের মূল কাজ হচ্ছে ক্রিকেট খেলার আম্পায়ারের মতো, একটা সাদা টুপি পরে হাসি মুখে চেয়ারে বসে নায়িকাদের সাথে ফষ্টি নষ্টি করা।’ তিনি ছিলেন দারুণ রসিক মানুষ। কখনোবা রসবোধ এতটাই সীমা ছাড়াত যে কোনো কথাই মুখে আটকাত না।

একবার হুমায়ূন আহমেদ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সামনে ম্যাজিক দেখিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। সুনীল সারারাত তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘এটা কীভাবে সম্ভব?’ বিশ্বখ্যাত জাদুকর জুয়েল আইচ পর্যন্ত বলেছেন, ‘ক্লোজআপ ম্যাজিকে হুমায়ূন ছিলেন রাজার ভান্ডার।’

হুমায়ূন আহমেদ আসলে কী ছিলেন?

হুমায়ূনের সৃষ্ট চরিত্রগুলো আসলে কেউই নিখুঁত নয়। তাঁরা যেন বাস্তবের মানুষের মতো—সবাই-ই পাশের মহল্লার মানুষ। কেউই পরিপাটি নয়, কেউই সেই অর্থে নায়ক নয়।

হিমু বাংলা সাহিত্যের ‘আউটসাইডার’ নায়কদের একজন। যুক্তির ধার না ধারা এই বোহেমিয়ান চরিত্র সবসময় হলুদ পাঞ্জাবি পরে ঘুরে বেড়ায়। রূপা তো সেই নীল শাড়ি পরা মেয়ে। অন্যদিকে মিসির আলী, যুক্তির সীমার মধ্যে দাঁড়িয়ে রহস্যের পেছনে ছোটে। এই চরিত্রগুলোই হুমায়ূন আহমেদের জাদু।

হুমায়ূন আহমেদ আসলে কী ছিলেন? এর উত্তর আসলে দেওয়া খুব কঠিন। তিনি ছিলেন এক জাদুকর। কাগজে-কলমে, সাহিত্যে, কথায়, কৌতুক ও গল্পে বারবার তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন জাদু।

আজও কোনো যুবক যখন হলুদ পাঞ্জাবি পরে হিমু হতে চায়, তখন মনে হয় হুমায়ূন আহমেদ কত বড় জাদুকর ছিলেন—মৃত্যুর পরও আমাদের মুগ্ধ করে রেখেছেন।

Ad 300x250

সম্পর্কিত