leadT1ad

রংপুরে ফকিরবাড়ি পল্লী জাদুঘর

সংগ্রহশালার উপকরণ ছুঁয়ে জীবন্ত অনুভূতি

জেলা শহর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে মিঠাপুকুর উপজেলার বালারহাট ইউনিয়নের এনায়েতপুর গ্রামের ফকিরপাড়া। নিভৃত পল্লীতে এক একর ২০ শতাংশ জায়গাজুড়ে গড়ে উঠেছে জাদুঘরটি। এর আশপাশের মনোরম পরিবেশ দেখলে সবার চোখ জুড়িয়ে যাবে।

প্রকাশ : ০৫ জুলাই ২০২৫, ১৫: ৫৩
আপডেট : ০৫ জুলাই ২০২৫, ১৭: ৪৩
রংপুরে ফকিরবাড়ি পল্লী জাদুঘর। স্ট্রিম ছবি

একটা শোকেসে শোভা পাচ্ছে শৌখিন কলের গান থেকে শুরু করে বিস্মৃত প্রায় রেডিও, টেপ, ক্যাসেট-ডিস্ক। আরেকটি শোকেসে সংরক্ষিত আছে কাচের কুপি থেকে কেরোসিনের বিচিত্র হারিকেন, হ্যাজাক। পাশেই রাখা কয়লার ইস্ত্রি। পিতলের পানের বাটা, হুঁকো রাখা একটু দূরে। এর কোনোটা অর্ধশত বছরের পুরোনো, কোনোটা আর পাওয়াই যায় না। কৃষি যন্ত্রপাতিসহ ১৫৫টি নিত্যপ্রয়োজনীয় ও সাংস্কৃতিক উপকরণ নিয়ে গড়ে উঠেছে ‘ফকিরবাড়ি পল্লী জাদুঘর’।

রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার এনায়েতপুর গ্রামে ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে উঠেছে এই ব্যতিক্রমধর্মী সংগ্রহশালা। এর মূল কারিগর আদিল ফকির। তিনি একজন সংস্কৃতিপ্রেমী ও ঐতিহ্য অনুসন্ধানী। নব্বইয়ের দশকের আগের গ্রামের প্রতিদিনের জীবনে ব্যবহৃত উপকরণগুলোর গুরুত্ব অনুধাবন করে তিনি সেগুলো সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নেন।

বছরের পর বছর ধরে আদিল সংগ্রহ করেছেন মাছ ধরার হাতে বোনা বাহারি জাল, বরশি, ঢেঁকি, কাঁথা, একতারা, তালপাতার হাতপাখা। গরুর গাড়ির যন্ত্রাংশ ছাড়াও আছে এক, দুই ও পাঁচ পয়সার কয়েন। এভাবেই ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে ‘পল্লী জাদুঘর’।

আদিল ফকির বলেন, ‘এখানে আসা দর্শনার্থীরা শুধু প্রদর্শনই নয়, চাইলে বিভিন্ন উপকরণ হাতে নিয়ে দেখতে পারেন, অনুভব করতে পারেন গ্রামের পুরোনো জীবনযাত্রার স্পর্শ। এটি একধরনের ইন্টার‌অ্যাক্টিভ জাদুঘর, যেখানে ইতিহাস শুধু দেয়ালে আটকে থাকে না, বরং দর্শনার্থীর স্পর্শে জীবন্ত হয়ে ওঠে।’

২০০৪ সালে এ জাদুঘর নির্মাণের পরিকল্পনা করেন আদিল ফকির। তবে পথটা সহজ ছিল না। নানা প্রতিকূলতা বাধা হয়ে দাঁড়ায় তাতে। এ সব উতরে গত বছরের শেষ দিকে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘ফকিরবাড়ি পল্লী জাদুঘর’। প্রথমে পরিবারে বাধা থাকলেও জাদুঘরটি সমৃদ্ধ হওয়ায় পর থেকে সবার সহযোগিতা পাচ্ছেন তিনি।

জেলা শহর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে মিঠাপুকুর উপজেলার বালারহাট ইউনিয়নের এনায়েতপুর গ্রামের ফকিরপাড়া। নিভৃত পল্লীতে এক একর ২০ শতাংশ জায়গাজুড়ে গড়ে উঠেছে জাদুঘরটি। এর আশপাশের মনোরম পরিবেশ দেখলে সবার চোখ জুড়িয়ে যাবে।

এখানে শিক্ষা সফরে আসে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। গ্রামীণ উপাদান ও লোকজ সংস্কৃতি সংগ্রহের পাশাপাশি এখানে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন তাঁদের পূর্বপুরুষের জীবনপদ্ধতি।

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জান্নাতুল ইসলাম বলেন, ‘বইয়ে পড়েছি লাঙল দিয়ে জমি চাষের কথা। কিন্তু এখানে হাতে তুলে দেখে বুঝতে পারলাম, কতটা কষ্টসাধ্য ছিল তা। এ অভিজ্ঞতা কেবল জ্ঞান অর্জনের জন্যই নয়, শিকড়ের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের এক বড় সুযোগও বটে।’

পল্লী জাদুঘর ঘুরে দর্শনার্থী সাব্বির হোসেন বলেন, ‘শহুরে জীবনে আমরা অনেক কিছু ভুলে গেছি। এখানে এসে মনে হলো যেন সময় কোথাও সংরক্ষিত আছে। গ্রামের সেই পুরনো দিনের ঘ্রাণ, শব্দ, ছোঁয়া–সবই যেন ফিরে পেলাম।’ আরেকজন দর্শনার্থী আবিদুর রহমান বলেন, ‘আমার সন্তানকে নিয়ে এসেছিলাম। সে প্রথমবারের মতো একতারা আর হারিকেন হাতে নিয়েছে। ওর চোখে যে বিস্ময় দেখেছি, তা বলে বোঝানো যাবে না।’

জাদুঘর ঘুরে ডাঙ্গীরহাট স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘পল্লী জাদুঘর কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া এক ঐতিহ্যের নাম। এটি একটা বেঁচে থাকার গল্প। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এমন আরও “জীবন্ত জাদুঘর” গড়ে উঠলে আমাদের ইতিহাসকে আগামী প্রজন্মের মনের গভীরে গেঁথে দেবে।’

রংপুর প্রত্নসম্পদ সংরক্ষণ কমিটির সদস্যসচিব জাকির আহমদ বলেন, ‘এখানকার প্রতিটি উপকরণ কেবল প্রদর্শনসামগ্রী নয়, বরং একেকটি জীবন্ত ইতিহাস। এগুলো বলে দেয় গ্রাম বাংলার মানুষের জীবনের কথা, সংগ্রামের কথা এবং সংস্কৃতির ধারাবাহিকতার কথা। এই ধরনের উদ্যোগ দেশে আরও বিস্তৃত হওয়া প্রয়োজন।’

মিঠাপুকুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মুলতামিস বিল্লাহ বলেন, ‘মিঠাপুকুরের গর্ব ফকিরবাড়ি পল্লী জাদুঘর। এখানে হারিয়ে যাওয়া গ্রামীণ জিনিস দেখতে আসে মানুষ। আমরা এটি নিয়ে ভবিষ্যতে কাজ করব।’

Ad 300x250

সম্পর্কিত