leadT1ad

স্বপ্না, সাগরিকা ও পোহাতিরা এখন জাতীয় দলের পরিচিত মুখ

রাঙ্গাটুঙ্গী থেকে এশিয়ার মঞ্চে

২০২৪ সালের সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল। ভারতের বিপক্ষে সেই ম্যাচে শেষ মুহূর্তে গোল করেন সাগরিকা। এই গোল ম্যাচে শুধু সমতাই ফেরায়নি, দেশের এক প্রত্যন্ত গ্রামের নামও পৌঁছে দিয়েছিল বিশ্ব মানচিত্রে। রানীশংকৈলের রাঙ্গাটুঙ্গী গ্রামের সাগরিকার সেই গোল আজও গর্ব নিয়ে মনে রেখেছে মানুষ।

সেই সাগরিকা, স্বপ্না রানী ও পোহাতি কিসকু–তিনজনই আজ মিয়ানমারে এএফসি নারী এশিয়ান কাপে তুর্কমেনিস্তানের বিপক্ষে দেশের জার্সি গায়ে মাঠে নেমেছেন।

মো. ইসতিয়াক
প্রকাশ : ০৫ জুলাই ২০২৫, ১৯: ৫৯
আপডেট : ০৫ জুলাই ২০২৫, ২১: ২৬
স্ট্রিম গ্রাফিক

২০২৪ সালের সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে হেরে যাওয়ার দ্বারপ্রান্তে ছিল বাংলাদেশ। ভারতের বিপক্ষে হার যখন অনেকটাই নিশ্চিত, তখন মুহূর্তে বদলে যায় দৃশ্যপট। গোল করেন মোসাম্মৎ সাগরিকা। তাঁর সেই গোলে সমতায় ফেরে বাংলাদেশ। এরপর টাইব্রেকারে দুই দলের ১১ জন করে ২২ জনই বল জালে জড়ান। শেষ পর্যন্ত যৌথ চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করা হয় ভারত ও বাংলাদেশকে।

সেই সাগরিকা এখন কেবল রানীশংকৈলের মেয়ে নন, তিনি বাংলাদেশের অহংকার। শুধু সাগরিকা নন, একই গ্রামের স্বপ্না রানী ও পোহাতি কিসকুও এখন জাতীয় দলের সদস্য। তিনজনই বর্তমানে মিয়ানমারে এএফসি নারী এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বে খেলছেন। বাংলাদেশের নারী ফুটবলের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এশিয়ান কাপের মূলপর্বে জায়গা করে নেওয়া এই দলের অংশ তাঁরা।

এই তিন ফুটবলারের গল্প হল হাজারো বাধা পেরিয়ে এগিয়ে চলার গল্প। এরা সবাই বেড়ে উঠেছে ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল উপজেলার রাঙ্গাটুঙ্গী গ্রামে। আর এই গ্রামের বুকেই গড়ে উঠেছে অখ্যাত অথচ অসাধারণ এক ফুটবল একাডেমি- ‘রাঙ্গাটুঙ্গী ইউনাইটেড ফুটবল একাডেমি’। যার স্বপ্নদ্রষ্টা একজন সাধারণ কলেজ শিক্ষক—তাজুল ইসলাম।

বদলে যাওয়া এক গ্রাম

ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল উপজেলার ছোট্ট এক গ্রাম রাঙ্গাটুঙ্গী। যেখানে এক সময় মেয়েদের ফুটবল খেলা ছিল ভাবনার বাইরে, সেখানে এখন গড়ে উঠেছে নারী ফুটবলার তৈরির অন্যতম কারখানা —রাঙ্গাটুঙ্গী ইউনাইটেড ফুটবল একাডেমি।

২০১৪ সালের কথা। গ্রামের মাঠে ফুটবল খেলছিলেন কিছু কিশোর। সেই মাঠেই ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কয়েকজন কিশোরীও ছিল, ফুটবল খেলছিল তাঁরাও। তাঁদের দেখে শিক্ষক তাজুল ইসলাম বুঝে যান, যদি সুযোগ পায়, এই মেয়েরা পারবে। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি একটি নারী ফুটবল দল গড়ার পরিকল্পনা করেন। তবে শুরুটা সহজ ছিল না।

কোচ তাজুল ইসলাম জানান তাঁকে এমন আপত্তির মুখেও পড়তে হয়েছে, যেখানে মানুষ বলেছে, ‘মেয়েরা হাফপ্যান্ট পরে খেলবে? ওদের তো বিয়ে হবে না!’

তবুও দমেননি তাজুল, পাশে ছিলেন সুগা মুর্মু, জয়নুল আবেদিন ও সেতাউর রহমান। অভিভাবকদের বুঝিয়ে, অনুরোধ করে একে একে কিশোরীদের মাঠে আনলেন। মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই ১৫ জন কিশোরী নিয়ে গড়ে উঠল একটি ফুটবল দল। নাম দেওয়া হল রাঙ্গাটুঙ্গী ইউনাইটেড ফুটবল একাডেমি। সেই শুরু, যা আজও থামেনি।

জার্সি নেই, বুট নেই তবু স্বপ্ন থেমে থাকেনি

প্রথমদিকে খেলোয়াড়দের জন্য ছিল না কোনো বুট, জার্সি কিংবা বল। খালি পায়ে, পুরোনো জামা পড়ে অনুশীলন হতো প্রতিদিন। নিজের বেতন দিয়ে এসব খরচ চালাতেন তাজুল ইসলাম। মাঠে মাটি সমান করে, কাঠের খুঁটি বসিয়ে গোলপোস্ট বানানো হতো। ধীরে ধীরে গ্রামের লোকেরা পাশে দাঁড়াতে শুরু করেন।

আজ এই একাডেমিতে বিভিন্ন বয়সের ৩৮ জন মেয়ে নিয়মিত অনুশীলন করে। শুধু অনুশীলনই নয়, একাডেমি থেকে উঠে আসা ১৮ জন খেলোয়াড় জাতীয় বা বয়সভিত্তিক দলে খেলেছেন। দেশের নারী লিগে বিভিন্ন ক্লাবে খেলেছেন ২২ জন।

স্বপ্না, পোহাতি জাতীয় দলের পরিচিত মুখ। ছবি: বাফুফে
স্বপ্না, পোহাতি জাতীয় দলের পরিচিত মুখ। ছবি: বাফুফে

দুই বছরেই ফল

২০১৬ সালে রাঙ্গাটুঙ্গী একাডেমির মেয়েদের নিয়েই গঠিত হয় ঠাকুরগাঁও জেলার অনূর্ধ্ব–১৪ দল। ওই বছর জেএফএ টুর্নামেন্টে দুর্দান্ত পারফর্ম করে তাঁরা। ২০১৭ সালে গাইবান্ধায় লালমনিরহাটকে ১৬–০, দিনাজপুরকে ৮–০ গোলে হারিয়ে ফাইনালে পৌঁছায় দলটি। ঢাকায় গিয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে ফাইনালেও ওঠে। যদিও শেষ ম্যাচে কলসিন্দুরের শক্তিশালী ময়মনসিংহ দলের কাছে হেরে যায় তাঁরা।

২০১৮ ও ২০১৯ সালে একাডেমির মেয়েদের নিয়েই ঠাকুরগাঁও দল দু’বার রানার্সআপ হয়।

স্বপ্না–সাগরিকা–পোহাতি এখন কোথায়

রাঙ্গাটুঙ্গী ইউনাইটেড ফুটবল একাডেমির সাফল্যের প্রধান তিন মুখ হলেন স্বপ্না রানী, মোসাম্মৎ সাগরিকা ও পোহাতি কিসকু। স্বপ্না রানী বর্তমানে জাতীয় নারী ফুটবল দলের সহ-অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করছেন। মোসাম্মৎ সাগরিকা জাতীয় দলের গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়, যিনি সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে ভারতের বিরুদ্ধে জয়ের নায়ক হিসেবে পরিচিত। অন্যদিকে পোহাতি কিসকু এবারের এএফসি এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বে গোল করে দলকে জিতিয়েছেন।

এ ছাড়াও রাঙ্গাটুঙ্গী একাডেমির আরও কয়েকজন খেলোয়াড় যেমন সোহাগী কিসকু, রেশমী বেগম, অনন্যা মুর্মু ও সুমি আক্তার জাতীয় এবং বয়সভিত্তিক দলগুলোতে নিয়মিত খেলছেন। পাশাপাশি কাকলী আক্তার ও ঈশরাত জাহান পর্তুগালে বিশেষ প্রশিক্ষণের অপেক্ষায় রয়েছেন। রাঙ্গাটুঙ্গী একাডেমি থেকে উঠে আসা এই খেলোয়াড়েরাই এখন দেশের নারী ফুটবলের ভবিষ্যৎ।

‘ওরা আমাদের মেয়ে’

সাগরিকার বাবা লিটন আলী বলেন, ‘একসময় মেয়েকে মাঠে যেতে দিইনি। এখন তাঁর জন্যই আমাদের বাড়িতে লোক আসে, ছবি তোলে, সাক্ষাৎকার নেয়। মেয়েটার জন্য আমি গর্বিত।’

স্বপ্নার বাবা নীরেন রায় বলেন, ‘যাঁরা একসময় বলতেন মেয়েরা ফুটবল খেলবে না, এখন তারাই বলেন, “আপনি স্বপ্নার বাবা?”— তখন গর্বে বুকটা ভরে যায়।’

একাডেমির পরিচালক তাজুল ইসলাম বলেন, ‘আজ নারী ফুটবল এগিয়ে যাচ্ছে। এই সাফল্য ধরে রাখতে হলে প্রত্যন্ত এলাকার একাডেমিগুলোর দিকে নজর দিতে হবে। সামান্য সহায়তা পেলে এখান থেকেই উঠে আসবে ভবিষ্যতের তারকারা।’

ঠাকুরগাঁও জেলার রাঙ্গাটুঙ্গীর মাঠে যখন মেঘলা, টুপুর, জবা কিংবা সুমাইয়া মাঠে বল নিয়ে ছুটে বেড়ায়, তখন তাঁদের চোখে থাকে বড় হওয়ার স্বপ্ন। তাঁদের কথা, ‘আমরা সাগরিকা আপুর মতো দেশের হয়ে খেলতে চাই।’

একদিন যেখানে মেয়েদের খেলা মানে ছিল সমাজের চোখ রাঙানি, সেই গ্রামে এখন ফুটবল ম্যাচ মানেই উৎসব। মাঠের চারপাশে থাকে উৎসুক জনতা। হাতে করে তাঁরা আনে বাড়ির তৈরি পিঠা। এই মেয়েরা এখন আর শুধু তাঁদের সন্তান নয়, ওঁরা এখন দেশের গৌরব।

Ad 300x250

সম্পর্কিত