leadT1ad

‘প্যারাসাইট’ যে কারণে ‘শতাব্দীর সেরা’ সিনেমা

চলতি শতাব্দীতে যে বিশ্বব্যাপী যে সব সিনেমা মুক্তি পেয়েছে, তার মধ্যে সেরা ১০০ সিনেমার তালিকা করেছে মার্কিন গণমাধ্যম দ্য নিউইয়র্ক টাইমস। গণমাধ্যমটির বিচারে সেরা ১০০ সিনেমার তালিকায় প্রথম স্থান অর্জন করেছে ২০১৯ সালে মুক্তি পাওয়া দক্ষিণ কোরিয়ার ছবি ‘প্যারাসাইট’।

কেন এই সিনেমাকেই বলা হচ্ছে শতাব্দীর সেরা সিনেমা? এমন কী আছে এতে, যা একে নিয়ে গেছে সব সিনেমার উর্ধ্বে?

গৌতম কে শুভ
প্রকাশ : ০৫ জুলাই ২০২৫, ১৭: ৩৯
‘প্যারাসাইট’ যে কারণে ‘শতাব্দীর সেরা’ সিনেমা। স্ট্রিম গ্রাফিক

গত ২৫ বছরে বিশ্বব্যাপী সিনেমায় নানা পরিবর্তন এসেছে। একসময় সুপারহিরোদের নিয়ে তৈরি বড় বাজেটের সিনেমা হলগুলোতে দাপিয়ে বেড়াত । এরপর স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম আসায় বদলেছে দর্শকের সিনেমা দেখার অভ্যাস। বড় পর্দা থেকে সিনেমা চলে এসেছে মোবাইলের স্ক্রিনে। বদলে গেছে সিনেমায় গল্প বলার ধরণও।

চলতি শতকে এমন অনেক সিনেমা তৈরি হয়েছে, যেগুলো শুধু ‘হিট’-ই হয়নি, বরং প্রবল প্রতাপের সাথে গেঁথে আছে দর্শকদের মনে। এমনই ১০০ সিনেমার তালিকা করেছে মার্কিন গণমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমস।

সম্প্রতি তারা প্রকাশ করেছে ২০০০ সাল থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে সারা বিশ্বে মুক্তিপ্রাপ্ত সেরা ১০০ সিনেমার তালিকা। আর সেই তালিকায় শীর্ষস্থান দখল করেছে ২০১৯ সালে মুক্তি পাওয়া দক্ষিণ কোরিয়ার চলচ্চিত্র ‘প্যারাসাইট’।

কেন এই সিনেমাকে বলা হচ্ছে শতাব্দীর সেরা সিনেমা? এমন কী আছে এতে, যা একে নিয়ে গেছে সব সিনেমার উর্ধ্বে?

কী দেখিয়েছিল প্যারাসাইট

দক্ষিণ কোরিয়ান চলচ্চিত্র নির্মাতা বং জুন-হো পরিচালিত ‘প্যারাসাইট’ মুক্তি পায় ২০১৯ সালে। রহস্য, রোমাঞ্চ আর হালকা কমেডির মিশ্রণে বানানো এই সিনেমাটি তখনই বিশ্বজুড়ে আলোচনায় চলে আসে।

মুক্তির কিছুদিন পরই ‘প্যারাসাইট’ কান চলচ্চিত্র উৎসবে সবচেয়ে বড় পুরস্কার ‘স্বর্ণপাম’ জিতে নেয়। এরপর ইংরেজি ভাষার সিনেমার বাইরে প্রথম সিনেমা হিসেবে ইতিহাস গড়ে অস্কারেও পায় সেরা চলচ্চিত্রের পুরস্কার।

সিনেমাটি এমন এক গল্পের, যা শেষ হলেও মনে হয়, শেষ হয়নি। প্যারসাইটে দেখা যায়, কিম কি-তায়েক তার স্ত্রী, ছেলে আর মেয়েকে নিয়ে খুব কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। চারজনই বেকার, কাজের খোঁজে ঘুরে বেড়াচ্ছেন হন্যে হয়ে। তারা থাকেন বেজমেন্টের এক ছোট্ট স্যাঁতসেঁতে ঘরে।

‘প্যারাসাইট’ সিনেমার পোস্টার। ছবি: দি পোস্টার ডিপোট
‘প্যারাসাইট’ সিনেমার পোস্টার। ছবি: দি পোস্টার ডিপোট

একদিন কিমের ছেলের এক বন্ধু আসে তাদের ঘরে। সে বলে, ধনী পরিবারের এক মেয়েকে ইংরেজি পড়াতে হবে। কিমের ছেলে কাজটি পেয়েও যায়। এরপর একে একে সে নিজের মা, বাবা বোন—সবাইকেই ওই বাড়িতে কাজের সুযোগ তৈরি করে দেয়। ধীরে ধীরে তারা পুরো পরিবার নিয়ে ঢুকে পড়ে ধনী ‘পার্ক পরিবার’-এর রাজপ্রাসাদে।

সেখানে গিয়ে তারা বুঝতে পারে, বাইরে থেকে নিখুঁত মনে হলেও পার্ক পরিবারের ভেতরে আছে নানা ফাঁক-ফোকর। ছোট ছেলেটা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত, মা একটু বোকাসোকা আর মেয়েটা আত্মবিশ্বাসহীন। কিম পরিবারের মনে প্রশ্ন জাগে, টাকা থাকলেই কি সব ঠিকঠাক চলে?

সিনেমার এক পর্যায়ে ঘটে যায় এমন কিছু ঘটনা, যা পুরো গল্পটাকেই পালটে দেয়। কিম পরিবার, পার্ক পরিবার আর বাড়ির পুরোনো কাজের লোক মুন গোয়াং। তিনটি ভিন্ন শ্রেণির মানুষ এক অদ্ভুত পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যায়। কে কার উপর নির্ভর করছে, আর কে আসলে প্যারাসাইট (পরজীবী), এই প্রশ্নগুলো তখন সবার সামনে চলে আসে।

এই সিনেমার সবচেয়ে বড় শক্তি হলো গল্প বলার ধরন। একদিকে রসিকতা, আরেকদিকে হঠাৎ গা ছমছমে টান টান উত্তেজনা। এক মুহূর্তে আপনি হেসে উঠবেন, আর পরমুহূর্তেই বুক ধড়ফড় করতে থাকবে। সিনেমার মাধ্যমে ধনী-গরিবের পার্থক্য চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন নির্মাতা বং জুন-হো। পার্ক পরিবার বাড়ির কাজের লোকেদের শরীরের গন্ধ নিয়ে আপত্তি জানায়, অথচ তাদের ছাড়া একটা দিনও চলে না।

এই ছবিকে কোনো একটা নির্দিষ্ট জনরায় ফেলা যাবে না। এটা একসঙ্গে হাসির আবার শ্রেণী-রাজনীতির গল্পও। অন্যদিকে মাঝখানে হাজির হয় ট্র্যাজেডি। এখানে কেউ পুরোপুরি ভালো না, আবার কেউ পুরোপুরি খারাপও না। এমন অদ্ভুত দ্বন্দ্ব নিয়েই শেষ হয় প্যারাসাইট।

প্যারাসাইটকে যে কারণে শতাব্দীর সেরা সিনেমা হিসেবে বেছে নেওয়া হলো

‘প্যারাসাইট’ শুধু সমালোচকদের রায়ে প্রথম স্থান অর্জন করেনি। কারণ, এই জরিপে অংশ নিয়েছিলেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের ৫০০-এর বেশি পরিচালক, অভিনয়শিল্পী আর সিনেমাপ্রেমী। সবাই তাঁদের প্রিয় ১০টি সিনেমার তালিকা জমা দিয়েছিল। সেই তালিকা থেকেই মতামতের ভিত্তিতে বাছাই করা হয় সেরা ১০০ সিনেমা। পেড্রো আলমোদোভার, সোফিয়া কপোলা, ব্যারি জেনকিন্স আর গুইলারমো দেল তোরোর মতো অস্কারজয়ী নামি নির্মাতারাও এখানে ভোট দিয়েছেন।

‘প্যারাসাইট’ সিনেমার একটি দৃশ্য। ছবি: ফার আউট ম্যাগাজিন
‘প্যারাসাইট’ সিনেমার একটি দৃশ্য। ছবি: ফার আউট ম্যাগাজিন

অন্যদিকে, নিউইয়র্ক টাইমসও পাঠক জরিপ চালিয়েছে। সেখানে প্রায় দুই লাখ দর্শকের মধ্যেও সবচেয়ে বেশি ভোট পড়েছে এই ছবির পক্ষেই। অর্থাৎ এটি সাধারণ দর্শকের কাছেও প্রিয়।

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, এত ভাষা, এত দেশ, এত গল্প পেরিয়ে এই সিনেমা কেন সবাই পছন্দ করল? এর উত্তর খুঁজতে হলে যেতে হবে সিনেমার গভীরে। দেখতে হবে কীভাবে একটা গল্প একইসঙ্গে শিল্প, সমাজ, শ্রেণীবিভাজন, রাজনীতি, থ্রিলার, হাস্যরস আর মানবতাবোধকে একসুতায় গেঁথে ফেলতে পারে।

ঠিক এই জায়গাতেই ‘প্যারাসাইট’ শুধু দক্ষিণ কোরিয়ার সিনেমা হিসেবে কোনো গণ্ডিতে আটকে থাকে না। এটা হয়ে যায় বৈশ্বিক গল্পও। প্রশ্ন তোলে, আমরা সবাই কি কোনো না কোনোভাবে পরজীবী?

‘প্যারাসাইট’ মুক্তি পেয়েছিল এমন এক সময়ে, যখন দুনিয়া জুড়ে ধনী-গরিবের ব্যবধান আরও স্পষ্ট হচ্ছিল। পুঁজিবাদী অর্থনীতি ধনীদের আরও ধনী আর গরিবদের আরও কোণঠাসা করে তুলছিল। এই সিনেমা ঠিক সেই কথাই গল্পের ভেতর দিয়ে বলেছে, কিন্তু অন্য উপায়ে।

সিনেমাটির আরেকটি বড় শক্তি এর ভাষা বা সংস্কৃতি নয়, বরং অন্তর্নিহিত মর্ম। প্যারাসাইটের গল্পের প্লট ঢাকাও হতে পারে, নিউইয়র্ক বা লন্ডনও হতে পারে। সিনেমার শেষে জি-উ যখন স্বপ্ন দেখে, সে বড় হয়ে অনেক টাকা আয় করবে। আর সেই দালানবাড়ি কিনে বাবাকে বের করে আনবে বেজমেন্ট থেকে। এটা হয়ত বাস্তবে খুব একটা সম্ভব নয়। ঠিক এখানেই ‘প্যারাসাইট’ আবারো প্রশ্ন তুলে দেয়, পৃথিবীতে স্বপ্ন আর বাস্তবতার মাঝের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কি আমরা শুধু কল্পনাই করতে পারি?

Ad 300x250

সম্পর্কিত