leadT1ad

‘ম্যাডম্যান’ থিওরি দিয়ে ট্রাম্প যেভাবে চমকে দিচ্ছেন শত্রু-মিত্র সবাইকে

প্রতিপক্ষকে ‘পাগল’ বলে সম্বোধন করা যেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক নিত্য অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। অথচ রাজনৈতিক মহলে বহু পর্যবেক্ষক মনে করেন ট্রাম্পই আসল ‘ম্যাডম্যান’। ট্রাম্প কি সত্যিই ম্যাডম্যান? বিশ্ব রাজনীতিতে এই তথাকথিত ম্যাডম্যানের প্রভাব কতটুকু?

তুফায়েল আহমদ
প্রকাশ : ০৭ জুলাই ২০২৫, ১৫: ৩০
আপডেট : ০৭ জুলাই ২০২৫, ১৫: ৩৯
স্ট্রিম গ্রাফিক

ডোনাল্ড ট্রাম্প কাকে পাগল বলেননি? ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জোহরান মামদানি, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট কামালা হ্যারিস কিংবা বিলিয়নিয়ার ইলন মাস্ক—কেউই বাদ যাননি ট্রাম্পের এই তির্যক উপাধি থেকে।

ইরানের ওপর ইসরায়েলের সঙ্গে যৌথভাবে হামলার পরিকল্পনা করছেন কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, ‘করতেও পারি, আবার নাও করতে পারি। কেউ জানে না আমি কী করব।’

ট্রাম্পের দাবি, ইরানকে আলোচনায় ফিরতে দুই সপ্তাহ সময় দেওয়া হয়েছিল। এরপর বোমা ফেলা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকেরা প্রেসিডেন্টের এমন দাবিকে ইতিমধ্যে বিশ্বাস করে ফেলেছে।

ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্পর্কে একমাত্র নিশ্চিত কথা হলো, ট্রাম্প বড্ড অনিশ্চিত। পাশাপাশি একটা ধরন (প্যাটার্ন) স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে ট্রাম্প তাঁর কথা ও আচরণে ধারাবাহিক নন। নিজেই নিজের কথার বিরোধিতা করেন ও কথাকে পাল্টে ফেলেন।

লন্ডন স্কুল অব ইকোনোমিকস-এর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক পিটার ট্রুবোউইটজ মতে, ‘রিচার্ড নিক্সনের পর ট্রাম্পই সবচেয়ে বেশি কেন্দ্রমুখী নীতিনির্ধারণী ব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন। ফলে ট্রাম্পের মেজাজ, পছন্দ-অপছন্দের ভিত্তিতে নীতি নির্ধারণ করা হচ্ছে।’

নিজের অস্থিরতা ও অনিশ্চিত আচরণকে ট্রাম্প রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে ব্যবহার করেন। ট্রাম্প এখন এই কৌশল নিয়ে এসেছেন নিজের সরকারি নীতি নির্ধারণী প্রক্রিয়া ও হোয়াইট হাউসে। ফলে এখনকার পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা-নীতিতেও ট্রাম্পের স্বভাবসুলভ অনিশ্চয়তা আর চমক দেখা যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে হয়তো নীতিগুলো নির্ধারণ করেছিলেন হোয়াইট হাউসের অন্য কর্মকর্তারা। ট্রাম্পের পাগলামির প্রভাবেই এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা এমন অবস্থাকেই ‘ম্যাডম্যান থিওরি’ (পাগলাটে নীতি) বলে অভিহিত করেন। এটি এমন এক নীতি যখন কোনো দেশের শীর্ষনেতা নিজেকে তাঁর প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যেকোনো ধরনের পদক্ষেপ নিতে সক্ষম বলে প্রমাণ করেন। ফলে প্রতিপক্ষ ছাড় দিতে বাধ্য হয়। আপাতদৃষ্টিতে শুনতে অবিশ্বাস্য লাগলেও এই কৌশল সফলভাবে প্রয়োগ করতে পারলে জোরজবরদস্তি ছাড়াই প্রতিপক্ষকে ভীতসন্ত্রস্ত করে নিজের পক্ষে রাখা যায়। ট্রাম্প সরকার যা খুব সফলভাবেই করছে।

ম্যাডম্যান থিওরি প্রথম আলোচনায় আসে ১৯৭০-এর দশকে। মূলত তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন বিশ্বজুড়ে এই ধারণা ছড়াতে চেয়েছিলেন যে তিনি সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ও অনিশ্চিত। যেকোনো সময় যেকোনো কিছু করে বসতে পারেন।

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের পররাষ্ট্রনীতির কৌশল হিসেবে ‘ম্যাডম্যান থিওরি’ প্রথম আলোচিত হয়। ছবি: ইন্টারনেট আর্কাইভ
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের পররাষ্ট্রনীতির কৌশল হিসেবে ‘ম্যাডম্যান থিওরি’ প্রথম আলোচিত হয়। ছবি: ইন্টারনেট আর্কাইভ

পরবর্তীকালে লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট মুয়াম্মর গাদ্দাফি, কিম জং উন, ভ্লাদিমির পুতিনসহ আরও অনেকেই নিজেদের পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ করেছেন এই তত্ত্বের আলোকে।

ডোনাল্ড ট্রাম্প সেই পুরনো তত্ত্বকেই নতুন রূপে ফিরিয়ে এনেছেন। তাঁর আচরণ, ভাষা, টুইট ও হঠাৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রবণতা—সবকিছু মিলিয়ে নিজেকে এক অনিশ্চিত, অবাক করে দেওয়া ও অসংলগ্ন নেতা হিসেবে বিশ্বের সামনে হাজির করেছেন।

আক্রমণ, অপমান ও আলিঙ্গন

দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসার পর ট্রাম্প সবাইকে অবাক করে দিয়ে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। পাশাপাশি আমেরিকার দীর্ঘদিনের মিত্রদের আক্রমণ করে কথা বলা শুরু করেন।

কানাডাকে অপমান করে ট্রাম্প বলেন, দেশটি যেন যুক্তরাষ্ট্রের ৫১তম রাজ্য হয়ে যায়।

ডেনমার্ক-শাসিত গ্রিনল্যান্ড দখল করার জন্য সামরিক শক্তি ব্যবহারের কথা বিবেচনা করছেন বলেও মন্তব্য করেন ট্রাম্প। আবার যুক্তরাষ্ট্রের উচিত পানামা খাল নিজেদের দখলে নিয়ে নেওয়া, এমন বিস্ফোরক মন্তব্য করতেও পিছপা হন না তিনি।

ফাঁস হওয়া একাধিক খুদে বার্তায় ইউরোপীয় মিত্রদের প্রতি ট্রাম্প প্রশাসনের তাচ্ছিল্যও প্রকাশ পেয়েছে। এক বার্তায় মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ তাঁর সহকর্মীদের বলেন, ‘ইউরোপীয় ফ্রিলোডারদের প্রতি তোমাদের ঘৃণাকে পুরোপুরি সমর্থন করি। এদের প্রতি করুণা হয়।’

ম্যাডম্যান থিওরি প্রথম আলোচনায় আসে ১৯৭০-এর দশকে। মূলত তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন সারা বিশ্বে এই ধারণা ছড়াতে চেয়েছিলেন যে তিনি সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ও অনিশ্চিত। যেকোনো সময় যেকোনো কিছু করে বসতে পারেন।

চলতি বছরের শুরুতে মিউনিখে ট্রাম্পের ভাইস-প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স ঘোষণা করেন, যুক্তরাষ্ট্র আর ইউরোপের নিরাপত্তা জামিনদার (গ্যারান্টার) হবে না।

ট্রাম্প প্রশাসনের এমন অবজ্ঞার ভাষায় কথা বলা নিয়ে অধ্যাপক ট্রুবোউইটজ বলেন, ‘ট্রাম্প প্রশাসনের অধিকাংশ মানুষ মনে করেন, অস্থিরতা ভালো জিনিস। এতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কাজে লাগিয়ে সর্বোচ্চ লাভ ঘরে তোলার সুযোগ পাওয়া যায়। এটা ট্রাম্পের রিয়েল এস্টেট দুনিয়ার দর-কষাকষির শিক্ষা।’

অধ্যাপক ট্রুবোউইটজ আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নিরাপত্তা, অর্থনীতি কিংবা অন্যান্য বিষয়ে চুক্তিবদ্ধ দেশগুলো এসব চুক্তি নিয়ে এখন পুনর্বিবেচনার মুখোমুখি হয়েছে।’

ট্রাম্পের এই পন্থা বাস্তব ফল এনেছে। চার মাস আগে, ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টার্মার সংসদে বলেন, প্রতিরক্ষা খাতে খরচ বাড়ানো হবে।

সুনিশ্চিত অনিশ্চয়তা

ট্রাম্পই প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট নন যিনি ‘পাগলাটে নীতি’ প্রয়োগ করেছেন। ১৯৬৮ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনও একই কৌশল প্রয়োগ করেন। নটরডেম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক মাইকেল ডেশ জানান, ‘এক সময় নিক্সন তাঁর জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জারকে বলেছিলেন, “তুমি উত্তর ভিয়েতনামীদের বোঝাও যে আমি পাগল। তারা যেন দ্রুত সমঝোতায় আসে, না হলে আমি পাগলাটে কিছু করে বসবো।’’ এটাই ম্যাডম্যান থিওরি।’

লন্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজের রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক জুলি নরম্যান ‘পাগলাটে নীতি’ প্রসঙ্গে বলেন, ‘সামনের দিনে কী হবে আন্দাজ করা খুব কঠিন। এটা সবসময়ই ট্রাম্পের কৌশলের অংশ।’

ট্রাম্প তাঁর অস্থিরতার সুনামকে কাজে লাগিয়ে ট্রান্স-আটলান্টিক প্রতিরক্ষা সম্পর্ক পাল্টে দিতেও সক্ষম হয়েছেন। ইউরোপীয় অনেক নেতাই এখন ট্রাম্পকে খুশি রাখতে তোষামোদে ব্যস্ত।

গত মাসে দ্য হেগ-এ অনুষ্ঠিত ন্যাটো সম্মেলন ছিল এক প্রকার আনুগত্য প্রদর্শনের মঞ্চ। ট্রাম্পকে পাঠানো ন্যাটো মহাসচিব মার্ক রুটের টেক্সট মেসেজ ট্রাম্প নিজেই ফাঁস করেন। মেসেজে লেখা ছিল, ‘ইরানে হামলার পদক্ষেপের জন্য অভিনন্দন। সত্যিই অসাধারণ কাজ করেছেন।’

তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, এটাই হয়তো ট্রাম্পের ‘পাগলাটে নীতির’ দুর্বল দিক। যদি ট্রাম্প প্রশংসা চান অথবা দীর্ঘ প্রক্রিয়ার বদলে স্বল্পমেয়াদি জয়ে আগ্রহী হন, তাহলে সহজেই অন্যরা তার আচরণ আন্দাজ করতে পারবে।

প্রতিপক্ষের ওপর প্রভাব কতটুকু?

এতকিছুর পরেও প্রশ্ন থেকে যায়, শত্রুদের ক্ষেত্রে ‘পাগলাটে নীতি’ বা ‘ম্যাডম্যান থিওরি’ আদৌ কাজ করে কি?

যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র হওয়া সত্ত্বেও নিয়মিত ট্রাম্প ও ভ্যান্সের কড়া কথার শিকার হন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। এমন আচরণের পরেও ইউক্রেনের খনিজ সম্পদ ব্যবহারের অধিকার পায় যুক্তরাষ্ট্র।

যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র হওয়া সত্ত্বেও নিয়মিত ট্রাম্পের কড়া কথার শিকার হন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। ছবি: দ্য গার্ডিয়ান।
যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র হওয়া সত্ত্বেও নিয়মিত ট্রাম্পের কড়া কথার শিকার হন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। ছবি: দ্য গার্ডিয়ান।

অন্যদিকে, ভ্লাদিমির পুতিন ট্রাম্পের এমন অনিশ্চিত আচরণে মোটেও প্রভাবিত হন না। বৃহস্পতিবার (৩ জুলাই) এক ফোনালাপের পর ট্রাম্প বলেন, ‘আমি হতাশ, ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ করতে পুতিন এখনো রাজি নন।’

ট্রাম্প তাঁর সমর্থকদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মধ্যপ্রাচ্যের ‘দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ’ থেকে আমেরিকাকে সরিয়ে নেবেন। কিন্তু ইরানের পরমাণু স্থাপনায় অপ্রত্যাশিত হামলা করে নিজের প্রতিশ্রুতিই ভঙ্গ করেন ট্রাম্প।

যুক্তরাজ্যের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম হেগ বলেছেন, এর ফল হবে উল্টো। পরমাণু অস্ত্র অর্জনে ইরান এখন আরও বেশি আগ্রহী হবে।

অধ্যাপক ডেশও মনে করেন, সাদ্দাম হোসেন ও মুয়াম্মর গাদ্দাফির পরিণতি থেকে ইরান শিক্ষা নিয়েছে। এখন যেকোনো মূল্যে ইরান পরমাণু অস্ত্র অর্জন করতে চাইবে।

যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিষয়ক অধ্যাপক ও লেখক মোহসেন মিলানি বলেন, সম্ভবত ইরানের ইসলামি প্রজাতন্ত্র এই ঘটনার মধ্য দিয়ে আরও শক্তিশালী হবে।

ট্রাম্পের পাগলাটে নীতির সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, অন্যরা মনে করে তারা যতই ছাড় দিক না কেন, কখনোই ট্রাম্পকে সন্তুষ্ট করা সম্ভব নয়।

আর হয়তো এটাই ট্রাম্পের সবচেয়ে দুঃসাহসী কৌশল। সবার সঙ্গে এই খেলা ট্রাম্প কতদিন চালিয়ে যেতে পারবেন সেটাও অনিশ্চিত। ভবিষ্যতই বলে দেবে এই পাগলাটে কৌশল সফল হবে কিনা।

(বিবিসি, দ্য গার্ডিয়ান ও ব্লুমবার্গ অবলম্বনে)

Ad 300x250

সম্পর্কিত