leadT1ad

আনন্দ শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে কি নতুন প্রতীকের রাজনীতি শুরু হলো?

পহেলা বৈশাখের আনন্দ শোভাযাত্রায় এবার বাঘ, ইলিশ, তরমুজসহ বেশ কিছু নতুন প্রতীকের সমাবেশ ঘটেছে। এই প্রতীকগুলো আসলে কী বলছে? এর মধ্যে কি কোনো রাজনীতি আছে? বিশ্লেষণ করেছেন রাতুল আল আহমেদ

রাতুল আল আহমেদ
প্রকাশ : ০৮ জুন ২০২৫, ১৪: ১৮
আপডেট : ১২ জুন ২০২৫, ১১: ৩৩

২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে জাতীয় চেতনার নতুন ছক তৈরির প্রয়াস চলেছে বহু মাধ্যমে, রাজনীতি, ভাষা, শিক্ষা, এবং অবশ্যই সংস্কৃতির ভেতর দিয়ে। এই সাংস্কৃতিক পুনর্গঠনের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশ হয়ে উঠেছে বাংলা নববর্ষ উদ্‌যাপন। বিশেষত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে বের হওয়া বৈশাখের শোভাযাত্রা, নানান ঘটনা পেরিয়ে এ বছর যা ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ থেকে আবার ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’য় ফিরে এসেছে।

১৪৩২ বঙ্গাব্দে এসে আবার যখন এ শোভাযাত্রা ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’ নামে ফিরে আসে, এবং তাতে স্থান পায় নতুন নতুন মোটিফ—যেমন বাংলাদেশের জাতীয় প্রতীক বাঘ ও ইলিশ, ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি, পানির বোতল কিংবা তরমুজের ফালি তখন প্রশ্ন ওঠে, এই শোভাযাত্রার শোভা কি নিছকই সাংস্কৃতিক, নাকি এর ভেতরে রাষ্ট্রের কোনো বিশেষ দর্শনের প্রতিফলন ঘটছে? সেই দর্শন কি ভিন্নভাবে কোনো জাতীয়তাবাদী আকাঙ্ক্ষাই উন্মোচন করছে?

ইতিহাস বলছে, এই শোভাযাত্রার সূচনা হয়েছিল ১৯৮৯ সালে, স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলনের পটভূমিতে, যখন বাংলা নববর্ষকে ঘিরে একটি অসাম্প্রদায়িক ও লোকায়ত সংস্কৃতির উত্থান প্রয়োজন ছিল। সে সময় মূলত টেপা পুতুল, প্যাঁচার মুখ, সূর্য বা গাছপালা এমন সব উপাদান ছিল যা এক ধরনের ‘বাঙালিয়ানার’ রূপকে তুলে ধরেছিল। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এতে রাজনৈতিক চেতনার ছোঁয়া এসে লেগেছে বলে অনেকেই মন্তব্য করেন।

poyala

এই বাস্তবতার মধ্যেই জুলাই গণ–অভুত্থানের পটভূমিতে এবার পালিত হলো আনন্দ শোভাযাত্রা। এবারের শোভাযাত্রায় যে মোটিফগুলোয় দেখা গেল—জাতীয় পশু, মাছ, পানির বোতল, ফ্যাসিবাদের রূপ বা তরমুজ ফালি—আগের তুলনায় তা একেবারেই ভিন্ন এক সাংকেতিক অর্থ বহন করে। পানির বোতল যেমন জুলাইয়ের গণ–অভ্যুত্থানের প্রতীক, তেমনি তরমুজ বিশ্বজুড়ে ফিলিস্তিনের মজলুম মানুষদের সঙ্গে সংহতির একটি পরিচিত সাংকেতিক চিহ্ন।

আনন্দ শোভাযাত্রার এই নতুন মোড় নেওয়াকে কোনো কোনো বিশ্লেষক ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে মনে করছেন। তাদের অভিযোগ, সাংস্কৃতিক উত্সবকে ব্যবহার করে রাষ্ট্র তার মতো করে একটি নির্দিষ্ট জাতীয়তাবাদী দর্শন জারি করতে চাইছে। এই ‘জাতীয়তাবাদী’ দৃশ্যপটের মধ্যে ইলিশ ও বাঘকে স্থান দেওয়া যেমন রাষ্ট্রের প্রতীকায়নের বহিঃপ্রকাশ, তেমনি এর সঙ্গে পানির বোতল বা তরমুজের ফালির মতো সামাজিক প্রতিবাদের মোটিফ যুক্ত হওয়া নতুন এক বয়ান তৈরি করছে। এখানে এই প্রশ্নও উঠতে পারে যে এই বৈচিত্র্য কি আদতে অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র গঠনের দিকে ইঙ্গিত, নাকি এটিও একটি নতুন ‘প্রতীক রাজনীতি’র সূচনা? আনন্দ শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে কি নতুনভাবে প্রতীকের রাজনীতি শুরু হলো?

এবারের শোভাযাত্রায় গাজী-কালু-চম্পাবতীর পটচিত্র বা বনবিবির উপাখ্যানের অন্তর্ভুক্তি এক ধরণের ঐতিহাসিক পুনরুদ্ধারের চেষ্টা, যা বাংলার মুসলিম লোকঐতিহ্যকে তুলে ধরে। এটি এক অর্থে লোকজ ধর্মীয় চেতনার পাশাপাশি নৃতাত্ত্বিক বৈচিত্র্যকেও স্থান দেয়।

তা ছাড়া এবারের শোভাযাত্রায় বাংলাদেশের অন্যান্য জাতিগষ্ঠীর উপস্থিতি ছিল, যা নিঃসন্দেহে একটি আশাব্যঞ্জক দিক। তবে প্রতীক ব্যবহারে আদিবাসী সংস্কৃতির নিজস্ব চিহ্ন কতটা জায়গা পেয়েছে, তা নিয়ে আলোচনার অবকাশ থেকে যায়। কেননা প্রতীক যাঁরা তৈরি করেন, প্রতীকের রাজনীতি কেবল তাঁদের হাতেই সীমাবদ্ধ থাকলে একপর্যায়ে প্রান্তিক কণ্ঠ ঢেকে যাওয়ার সম্ভবনাও তৈরি হয়।

ইতিহাস বলে, সংস্কৃতি কখনোই রাজনীতি বিচ্ছিন্ন ব্যাপার নয়। অনেকের মতে, যেভাবে বাংলা নববর্ষ উদ্‌যাপন একসময় ‘ধর্মনিরোপেক্ষতা’র প্রতীক হয়ে উঠেছিল, তেমনি এবারের আনন্দ শোভাযাত্রার প্রতীকগুলো সবাইকে জানান দেয়, আমাদের এই সময়ের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এমনকি আন্তর্জাতিক অবস্থানও। আমাদের সাংস্কৃতিক কাঠামো যে ভেতরে–ভেতরে সম্প্রসারিত হচ্ছে, এই শোভাযাত্রায় তার চিহ্ন দৃশ্যমান।

তবে শোভাযাত্রাটি যদি শুধু দৃশ্যগত বৈচিত্র্যে সীমাবদ্ধ থাকে, তাহলে তা এক ধরণের সাংস্কৃতিক ‘কসমেটিক্স’ হয়ে উঠবে। অথচ, এই প্রতীকগুলো যদি নীতিনির্ধারণ, সমাজবীক্ষণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়ায় সক্রিয় ভূমিকা রাখে, তাহলেই এটি হয়ে উঠবে সত্যিকারের রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি।

যদি ফিলিস্তিনের নিপীড়িত মানুষের পক্ষে তরমুজ ওঠে শোভাযাত্রায়, তবে রোহিঙ্গা ইস্যু, পার্বত্য চট্টগ্রামের বৈষম্য বা আদিবাসী নারীদের নিপীড়নের বিরুদ্ধেও সমাজ–রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে স্পষ্ট অবস্থান থাকা উচিত। আসলে শোভাযাত্রার শোভা তখনই পূর্ণ হবে, যখন তা সবাইকে অর্ন্তভূক্ত করার মধ্য দিয়ে নতুন বাংলাদেশের দিকে ফিরে তাকাবে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত