মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে একটি সুনির্দিষ্ট শান্তি পরিকল্পনা প্রস্তাব করেছে, যা কিয়েভ এবং পশ্চিমা মিত্রদের মধ্যে তীব্র বিতর্ক ও গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। এই প্রস্তাবের মূল ভিত্তি হলো যুদ্ধবিরতির বিনিময়ে ইউক্রেনকে তার সার্বভৌম ভূখণ্ডের উল্লেখযোগ্য অংশ, বিশেষত খনিজসম্পদ সমৃদ্ধ ডোনবাস অঞ্চল এবং ২০১৪ সালে দখলকৃত ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার ভূখণ্ড হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দিতে হবে।
এটি ইউক্রেনের ভূখণ্ডগত অখণ্ডতা ও নিরাপত্তার ওপর সরাসরি আঘাত। বর্তমান ফ্রন্টলাইন বরাবর যুদ্ধ থামানোর শর্তে খেরসন ও জাপোরিঝিয়া অঞ্চলেরও বিশাল অংশ কার্যত রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে থেকে যাবে। এই শর্তগুলো মেনে নেওয়া হলে ইউক্রেনকে কেবল তার গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অঞ্চলই নয় বরং দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড স্বরূপ বিপুল পরিমাণ কয়লা, লিথিয়াম এবং অন্যান্য বিরল পৃথিবী খনিজ স্থায়ীভাবে হাতছাড়া করতে হবে। ফলস্বরূপ ইউক্রেনের ম্যাপে যে স্থায়ী পরিবর্তন আসবে তা দেশটির সামরিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য দীর্ঘমেয়াদী জটিলতা সৃষ্টি করবে।
ম্যাপে সম্ভাব্য ভূখণ্ডগত পরিবর্তন
ট্রাম্পের প্রস্তাবিত শান্তি পরিকল্পনাটি সরাসরি ইউক্রেনের ভূখণ্ডগত অখণ্ডতার ওপর আঘাত হানবে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে ইউক্রেনের ম্যাপে সুদূরপ্রসারী এবং স্থায়ী পরিবর্তন আসবে, যা রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসনকে আন্তর্জাতিক বৈধতা দেবে। কিয়েভকে আনুষ্ঠানিকভাবে তার পূর্বাঞ্চলীয় এবং দক্ষিণের কৌশলগত উপকূলীয় অঞ্চলের বিশাল অংশ ছেড়ে দিতে বাধ্য করা হবে। এই শর্তগুলো মেনে নেওয়া হলে আধুনিক ইতিহাসে বলপূর্বক সীমান্ত পরিবর্তনের একটা বড় দৃষ্টান্ত তৈরি হবে।
ক. রাশিয়ার ভূখণ্ড হিসেবে স্বীকৃতি
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ১৯-দফা শান্তি পরিকল্পনার সবচেয়ে বিতর্কিত এবং ইউক্রেনের জন্য ধ্বংসাত্মক শর্ত হলো দেশের সার্বভৌম ভূখণ্ড রাশিয়ার হাতে স্থায়ীভাবে তুলে দেওয়া। এই প্রস্তাব অনুযায়ী, ইউক্রেনকে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্রিমিয়া উপদ্বীপকে রাশিয়ার অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে, যা ২০১৪ সাল থেকে দখলীকৃত। এর পাশাপাশি ইউক্রেনকে ডোনবাস অঞ্চলের প্রধান অংশ, অর্থাৎ লুহানস্ক এবং দোনেৎস্ক অঞ্চলকেও রাশিয়ার ভূখণ্ড হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে মেনে নিতে হবে। এই শর্তগুলো বাস্তবায়িত হলে ইউক্রেনের মানচিত্র থেকে দেশের প্রায় ২০ শতাংশ এলাকা স্থায়ীভাবে বাদ পড়বে।
এই ভূখণ্ডগত ত্যাগ কেবল সামরিক পরাজয় হিসেবে নয়, বরং একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের উপর চাপানো জোরপূর্বক সীমান্ত পরিবর্তনকে আন্তর্জাতিক বৈধতা দেবে, যা ইউক্রেনের ভূখণ্ডগত অখণ্ডতার মূল নীতির সরাসরি লঙ্ঘন। এই পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে ইউক্রেন তার কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ও মূল্যবান খনিজ সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাবে, যা সামগ্রিকভাবে রাশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণে সহায়ক হবে এবং কিয়েভের জন্য স্থায়ী দুর্বলতা বয়ে আনবে।
খ. যুদ্ধ থামবে সম্মুখসারি বরাবর
ট্রাম্পের শান্তি প্রস্তাবের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ভূখণ্ডগত শর্ত হলো খেরসন এবং জাপোরিঝিয়া অঞ্চলের যুদ্ধকে বর্তমান ফ্রন্টলাইন বরাবর থামানো। এই শর্তের অন্তর্নিহিত অর্থ হলো, যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার মুহূর্তে রাশিয়ার সামরিক বাহিনী এই দুটি অঞ্চলের যতখানি ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণ করছে, তা কার্যত মস্কোর হাতেই থেকে যাবে। যদিও রাশিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে এই দুটি প্রদেশের পুরোটা নিজেদের অংশ বলে দাবি করেছে, বাস্তবে এই অঞ্চলের প্রধান শহরগুলোর কিছু অংশসহ ইউক্রেনীয় বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকাগুলো কিয়েভ পুনরুদ্ধারের সুযোগ হারাবে। বিশেষত জাপোরিঝিয়া পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো কৌশলগত স্থাপনাগুলি রাশিয়ার দখলে থাকা অংশে পড়ায়, এই যুদ্ধবিরতি ইউক্রেনের জ্বালানি নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের ওপর স্থায়ী প্রভাব ফেলবে। এর ফলে ইউক্রেনকে তার দক্ষিণের গুরুত্বপূর্ণ কৃষি ও উপকূলীয় অঞ্চল ছেড়ে দিতে হবে, যা দেশের অর্থনীতি এবং কৃষ্ণ সাগরে প্রবেশের পথে রাশিয়ার কৌশলগত সুবিধা বাড়িয়ে দেবে।
গ. বাফার জোন তৈরি
ট্রাম্পের শান্তি প্রস্তাবের একটি জটিল অংশ হলো ডোনবাসের ইউক্রেন-নিয়ন্ত্রিত অংশগুলোতে ‘বাফার জোন’ বা নিরপেক্ষ বেসামরিক এলাকা প্রতিষ্ঠা করা। এই শর্ত অনুযায়ী ইউক্রেনীয় বাহিনীকে এই এলাকাগুলো থেকে সেনা প্রত্যাহার করতে হবে। যদিও এই অঞ্চলগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে রাশিয়ার ভূখণ্ড হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাবে, তবুও সেখানে রুশ সামরিক বাহিনী প্রবেশ করবে না বলে শর্ত দেওয়া হয়েছে। তবে এই নিরাপত্তা নিশ্চয়তা নিয়ে আন্তর্জাতিক বিশ্বের গভীর সন্দেহ রয়েছে। এই কৌশলগত পদক্ষেপের মাধ্যমে ইউক্রেন তার পূর্বাঞ্চলীয় শিল্পাঞ্চলের অবশিষ্ট নিয়ন্ত্রণও হারাবে। সামগ্রিকভাবে ক্রিমিয়া, ডোনবাসের স্বীকৃত অংশ এবং বাফার জোন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইউক্রেন তার ভূখণ্ডের প্রায় ২০ শতাংশেরও বেশি এলাকা স্থায়ীভাবে হারাবে, যার মধ্যে দেশের গুরুত্বপূর্ণ শিল্পাঞ্চল ও কৌশলগত দক্ষিণের উপকূলীয় অঞ্চল অন্তর্ভুক্ত। এই বিপুল পরিমাণ ভূখণ্ড হারানোর অর্থ হলো, ইউক্রেনের সার্বভৌম ক্ষমতা ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হওয়া।
খনিজসমৃদ্ধ ডোনবাস অঞ্চলের ভবিষ্যৎ এবং অর্থনৈতিক পরিণতি
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনায় খনিজসমৃদ্ধ ডোনবাস অঞ্চলকে (দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক) রাশিয়ার হাতে স্থায়ীভাবে হস্তান্তরের শর্তটি ইউক্রেনের অর্থনীতির জন্য এক মৌলিক আঘাত হিসেবে গণ্য। এই অঞ্চলটি ঐতিহাসিকভাবে ইউক্রেনের শিল্প ও খনিজ সম্পদের ভান্ডার হিসেবে পরিচিত। ট্রাম্পের প্রস্তাব গৃহীত হলে ইউক্রেন তার অর্থনৈতিক মেরুদণ্ডের একটি বিশাল অংশ হারাবে, যা যুদ্ধ-পরবর্তী পুনরুদ্ধারকে মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত করবে। এই অঞ্চলের ভবিষ্যৎ এবং এর অর্থনৈতিক পরিণতি নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:
ক. কৌশলগত ও জ্বালানি খনিজ সম্পদের স্থায়ী ক্ষতি
ডোনবাস অঞ্চল ইউক্রেনের জ্বালানি নিরাপত্তা এবং ভবিষ্যৎ প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতির জন্য অপরিহার্য খনিজ সম্পদের কেন্দ্র। এই অঞ্চলে ইউক্রেনের বৃহত্তম কয়লা মজুদের (কোকিং কয়লা এবং অ্যানথ্রাসাইট) বিশাল অংশ রয়েছে, যা একসময় দেশের শিল্প উৎপাদন ও রপ্তানির একটি প্রধান উৎস ছিল। এই কয়লা মজুত হাতছাড়া হলে ইউক্রেনের ইস্পাত শিল্পের কাঁচামাল সরবরাহ এবং জ্বালানি নিরাপত্তা স্থায়ীভাবে সংকটের মুখে পড়বে। আরও গুরুতর হলো ডোনবাসে লিথিয়াম, গ্রাফাইট ও টাইটেনিয়াম সহ প্রায় ২২টি গুরুত্বপূর্ণ খনিজের বিশাল মজুদ রয়েছে। লিথিয়াম (ব্যাটারির মূল উপাদান), গ্রাফাইট (ইলেকট্রিক গাড়ির ব্যাটারি) এবং টাইটেনিয়াম (বিমান ও প্রতিরক্ষা শিল্পের জন্য) আধুনিক প্রযুক্তির ‘সবুজ অর্থনীতি’ এবং প্রতিরক্ষা সক্ষমতা গড়ে তোলার জন্য অত্যন্ত কৌশলগত সম্পদ। এই সম্পদগুলো রাশিয়ার হাতে চলে গেলে ইউক্রেন তার ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং শিল্পায়নের মূল চালিকাশক্তি হারাবে।
খ. শিল্প উৎপাদন ও জ্বালানি স্বাবলম্বিতা হ্রাসের ঝুঁকি
ডোনবাস শুধুমাত্র খনিজ সম্পদের ভান্ডার নয়; এটি দেশের ভারী শিল্প উৎপাদনেরও কেন্দ্র। এখানে লৌহ আকরিক ও ম্যাঙ্গানিজের বিশাল মজুত থাকায় এই অঞ্চল ইস্পাত শিল্পের ভিত্তি হিসেবে কাজ করত। এটি রাশিয়ার কাছে হস্তান্তরিত হলে ইউক্রেন তার শিল্প উৎপাদন ক্ষমতা থেকে স্থায়ীভাবে বঞ্চিত হবে। এর পাশাপাশি ইউক্রেনের শেল গ্যাস মজুদেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ডোনবাসে রয়েছে। কিয়েভ এই প্রাকৃতিক গ্যাস মজুতকে কাজে লাগিয়ে জ্বালানি আমদানির ওপর নির্ভরতা কমানোর এবং বিশেষ করে রাশিয়ার গ্যাসের ওপর নির্ভরশীলতা দূর করার পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু ডোনবাস হাতছাড়া হওয়ার অর্থ হলো সেই সুযোগ হারানো, যা দীর্ঘমেয়াদে ইউক্রেনকে জ্বালানি ক্ষেত্রে দুর্বল এবং রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক সুবিধার দিক থেকে নির্ভরশীল করে তুলবে।
গ. পুনরুদ্ধার ও পুনর্গঠনে দীর্ঘমেয়াদী বাধা
বর্তমানে ইউক্রেনের ৪০ শতাংশ গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সম্পদ রাশিয়ার নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে রয়েছে, যার প্রধান অংশই হলো ডোনবাস। ট্রাম্পের প্রস্তাবে ডোনবাসকে রাশিয়ার অংশ হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেওয়া হলে ইউক্রেন স্থায়ীভাবে এই বিশাল অর্থনৈতিক সম্পদ হারাবে। এই অর্থনৈতিক ক্ষতি দেশটির যুদ্ধ-পরবর্তী পুনর্গঠন ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের পথে সবচেয়ে বড় বাধা সৃষ্টি করবে। দেশ পুনর্গঠনের জন্য যে বিপুল অর্থের প্রয়োজন, তা মেটানোর জন্য এই অঞ্চলের খনিজ সম্পদ বিক্রি করে অর্থ উপার্জনের যে সম্ভাবনা ছিল তা সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হবে। সংক্ষেপে ডোনবাসের স্থায়ী হস্তান্তর ইউক্রেনকে কেবল ভূখণ্ডগতভাবে দুর্বল করবে না, এটি দেশটির অর্থনৈতিক সক্ষমতা ও জাতীয় সমৃদ্ধির পথকেও রুদ্ধ করে দেবে।
সামরিক ও রাজনৈতিক প্রভাব
ট্রাম্পের শান্তি প্রস্তাবে ইউক্রেনের ভূখণ্ডগত ক্ষতির পাশাপাশি যে সামরিক ও রাজনৈতিক ছাড়গুলো চাওয়া হয়েছে, তা কার্যকর হলে ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব এবং ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা মারাত্মকভাবে সীমিত হয়ে পড়বে। এই শর্তগুলো কেবল যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করে না বরং ইউক্রেনকে স্থায়ীভাবে দুর্বল ও নির্ভরশীল একটি রাষ্ট্রে পরিণত করার নীলনকশা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
ক. সামরিক বাহিনীর সক্ষমতা হ্রাসের প্রভাব
ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর সেনাসংখ্যা ৬ লাখের মধ্যে সীমিত করার শর্তটি দেশের প্রতিরক্ষাব্যবস্থার ওপর সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। ইউক্রেন বর্তমানে যে দীর্ঘ ও জটিল যুদ্ধের মোকাবিলা করছে, তাতে একটি বৃহৎ এবং সক্ষম সামরিক বাহিনী অপরিহার্য। এই সীমা আরোপ করা হলে যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে ইউক্রেন তার বিশাল ভূখণ্ড এবং নতুন করে সংজ্ঞায়িত সীমান্ত রক্ষা করার জন্য পর্যাপ্ত সামরিক জনবল বজায় রাখতে পারবে না। বিশেষ করে রাশিয়ার মতো একটি বৃহৎ এবং পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মোকাবিলায় এমন সামরিক সীমাবদ্ধতা ইউক্রেনের প্রতিরোধ ক্ষমতাকে হ্রাস করবে। সামরিক বিশ্লেষকদের মতে এই পদক্ষেপ ইউক্রেনকে এক প্রকার ‘সামরিক পঙ্গুত্বে’ ঠেলে দেবে, যা ভবিষ্যতে রাশিয়ার যেকোনো সামরিক চাপ বা আগ্রাসনের মুখে কিয়েভকে দুর্বল করে তুলবে।
খ. ন্যাটোতে যোগদানে স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা
ইউক্রেনকে তার সংবিধানে ন্যাটোতে যোগ না দেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করার শর্তটি দেশটির ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা জোটের স্বাধীনতা কেড়ে নেবে। ন্যাটোর সদস্যপদ ইউক্রেনের জন্য ছিল রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসন থেকে রক্ষা পাওয়ার চূড়ান্ত নিরাপত্তা নিশ্চয়তা। এই শর্ত মেনে নিলে ইউক্রেনকে আন্তর্জাতিকভাবে ঘোষণা করতে হবে যে তারা সামরিক জোটনিরপেক্ষ থাকবে। ন্যাটোও ইউক্রেনকে সদস্য না করার বিষয়ে নিশ্চয়তা দেবে। এর ফলস্বরূপ ইউক্রেন রাশিয়ার আক্রমণ বা হুমকি থেকে রক্ষা পেতে ন্যাটোর সম্মিলিত প্রতিরক্ষা ধারা (অনুচ্ছেদ ৫)-এর সুরক্ষা থেকে চিরতরে বঞ্চিত হবে। এটি ইউক্রেনকে একটি ‘বাফার রাষ্ট্র’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করবে, যেখানে তার নিজস্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থা হবে সীমিত এবং অন্য কোনো বৃহৎ শক্তির সামরিক ছাতার নিচে আসার সুযোগ থাকবে না, যা রাশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণে সহায়ক হবে।
গ. সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতার সীমাবদ্ধতা
এই সামরিক এবং রাজনৈতিক শর্তগুলো একসঙ্গে ইউক্রেনের আত্মরক্ষার ক্ষমতা এবং আন্তর্জাতিক স্বাধীনতার ওপর গুরুতর বিধিনিষেধ আরোপ করবে। ভূখণ্ড হারানোর পাশাপাশি সামরিক শক্তি সীমিত করা এবং প্রধান পশ্চিমা নিরাপত্তা জোটে যোগদানের পথ বন্ধ করে দেওয়া, এই তিনটি শর্ত ইউক্রেনের সার্বভৌম সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাকে খর্ব করে দেবে। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন এটি কেবল যুদ্ধবিরতি নয়, এটি কার্যত ইউক্রেনকে একটি আংশিক সার্বভৌম রাষ্ট্র বা রাশিয়ার প্রভাবে থাকা একটি নির্ভরশীল রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রচেষ্টা। এই চুক্তির ফলে ইউক্রেন তার নিরাপত্তা এবং পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নে রাশিয়ার শর্তাবলীর কাছে জিম্মি হয়ে পড়বে, যা দেশটির দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও স্থিতিশীলতার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি।
ট্রাম্পের প্রস্তাবিত শান্তি পরিকল্পনাটি ইউক্রেনের জন্য একটি অত্যন্ত কঠিন ভূ-রাজনৈতিক পরীক্ষার সম্মুখীন করেছে। এই প্রস্তাবে ইউক্রেনের ম্যাপে যে পরিবর্তন আনার কথা বলা হয়েছে- ক্রিমিয়া, ডোনবাসের স্থায়ী হস্তান্তর এবং ফ্রন্টলাইন বরাবর যুদ্ধবিরতি, তা কার্যত ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বের ওপর গুরুতর আপস এবং রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসনের স্বীকৃতি প্রদান করবে। বিশেষত খনিজসমৃদ্ধ ডোনবাস অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ স্থায়ীভাবে হারানো মানে ইউক্রেনের অর্থনৈতিক ও শিল্প পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ার ওপর এক স্থায়ী আঘাত। এর কারণ এই অঞ্চলে মজুত রয়েছে দেশের সবচেয়ে মূল্যবান কয়লা, লিথিয়াম এবং কৌশলগত খনিজ সম্পদ।
সামরিক বাহিনীর আকার সীমিত করার এবং ন্যাটো সদস্যপদ লাভের সম্ভাবনা বাতিল করার শর্তগুলো ইউক্রেনের দীর্ঘমেয়াদী নিরাপত্তা ও আত্মরক্ষার স্বাধীনতাকে মারাত্মকভাবে সীমিত করবে, যা দেশটিকে ভবিষ্যতে রাশিয়ার হুমকির মুখে আরও দুর্বল করে তুলবে। এজন্য যদিও যুদ্ধ বন্ধ করা জরুরি, তবে এই শর্তহীন আত্মসমর্পণ ইউক্রেনের জন্য স্থায়ী শান্তি নয়, বরং দুর্বলতা বয়ে আনবে।
এই পরিস্থিতিতে ইউক্রেনের জন্য প্রধান দিকনির্দেশনা হওয়া উচিত কূটনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক প্রতিরোধের ওপর মনোযোগ দেওয়া। ইউক্রেনকে তার পশ্চিমা মিত্রদের সাথে একযোগে কাজ করে এমন একটি বিকল্প শান্তি পরিকল্পনায় পৌঁছাতে হবে যা ভূখণ্ডগত অখণ্ডতার মূলনীতি থেকে সরে না গিয়েও সামরিক সংঘাত কমাতে সাহায্য করে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহায়তায় ইউক্রেনের পশ্চিমাঞ্চলীয় অঞ্চলগুলোতে নতুন শিল্প ও খনিজ আহরণ কেন্দ্র গড়ে তুলে অর্থনৈতিক বৈচিত্র্য নিশ্চিত করতে হবে, যাতে ডোনবাস হারানোর ক্ষতি পূরণ করা যায়। সর্বোপরি সামরিক সক্ষমতা ও প্রতিরক্ষা প্রস্তুততাকে ক্রমাগত শক্তিশালী করতে হবে যাতে আলোচনার টেবিলে ইউক্রেন তার অবস্থান দৃঢ় করতে পারে। শান্তি চুক্তি যেন স্থায়ী পরাধীনতা বা দুর্বলতার দলিল না হয়ে, ভবিষ্যতের পুনর্গঠন ও নিরাপত্তার ভিত্তি হয়- সেদিকেই কিয়েভকে লক্ষ্য রাখতে হবে।