জামায়াতের সঙ্গে ইসলামি দলগুলোর জোট
নির্বাচনে আওয়ামী লীগ না থাকায় বিএনপির সঙ্গে আর জোট করার প্রয়োজন মনে করছে না ইসলামি দলগুলো। বরং তারা নিজেরা একসঙ্গে মিলে বিএনপির বিকল্প শক্তি হিসেবে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। এই ‘বিকল্প শক্তি’ হয়ে ওঠার মধ্য দিয়ে ক্ষমতার রাজনীতিতে নির্ণায়ক শক্তি হয়ে ওঠার চেষ্টা করছে জামায়াতে ইসলামী।
স্ট্রিম প্রতিবেদক
শনিবার ১৯ জুলাই জামায়াতে ইসলামী সারাদেশের নেতাকর্মীদের নিয়ে জাতীয় সমাবেশের ডাক দিয়েছে। দলটির দ্বিতীয় প্রধান নেতা মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, সড়ক, নৌ ও রেলপথে এদিন রাজধানীতে বিপুল পরিমাণ মানুষের সমাবেশ ঘটবে। সমাবেশটি জাতীয় নির্বাচনে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ নিশ্চিত করণসহ সাত দফা দাবিতে আয়োজন করা হয়েছে। যদিও পর্যবেক্ষকেরা মনে করছেন, জামায়াত মূলত বিপুল জনবল প্রদর্শন করতে চাইছে। এর মধ্যে দিয়ে পিআর পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচন এবং প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার দাবি আরো জোরালো করবে দলটি।
জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার সমাবেশ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তাদের সমাবেশে ২২০ ফিট লম্বা মঞ্চে উপস্থিত থাকবেন দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক ইসলামি দলের নেতারা, জুলাই শহীদ পরিবারের সদস্যরা ও জুলাই আহত ব্যক্তিরা। জানা গেছে, সমাবেশে বিভিন্ন ইসলামি দলের নেতৃবৃন্দ পরস্পর ঐক্য গড়ার গুরুত্ব তুলে ধরবেন। যেসব ইসলামপন্থী দল কখনো জামায়াতের সঙ্গে এক ছাতার নিচে আসেনি তারাও সমাবেশে আমন্ত্রণ পেয়েছে।
অতীতে নানা সময় ইসলামি দলগুলো বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করেছে। আবার তাদের কোনো কোনো দল আওয়ামী লীগের সঙ্গেও জোট বেঁধেছে। ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থাণে পটপরিবর্তনের পর রাজনীতিতে ঘটছে নতুন মেরুকরণ। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের নিবন্ধন সম্প্রতি স্থগিত করেছে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ না থাকায় বিএনপির সঙ্গে আর জোট করার প্রয়োজন মনে করছে না ইসলামি দলগুলো। বরং তারা নিজেরা একসঙ্গে মিলে বিএনপির বিকল্প শক্তি হিসেবে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে।
এই ‘বিকল্প শক্তি’ হয়ে ওঠার মধ্য দিয়ে ক্ষমতার রাজনীতিতে নির্ণায়ক শক্তি হয়ে ওঠার চেষ্টা করছে জামায়াতে ইসলামী।
শেখ হাসিনার পতনের পর থেকেই দেশের সক্রিয় ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি, নানা বিষয়ে ঐকমত্য তৈরির চেষ্টা করছে সবচেয়ে বড় ‘রাজনৈতিক ইসলামী দল’ জামায়াতে ইসলামী। কিন্তু তাদের স্বতন্ত্র এই ঐক্য চেষ্টার তোরজোরের মধ্যেই প্রভাবশালী ইসলামি গোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের আদর্শিক বিভেদ আবারও দৃশ্যমান হয়ে ওঠেছে। এতে দেখা দিয়েছে ঐক্য গঠনের আগেই ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা।
বিষয়টি স্বীকার করতে নারাজ জামায়াতে ইসলামীর নেতারা।
যদিও দেশের কওমি মাদ্রাসা ঘরানার সবচেয়ে বৃহৎ ও প্রভাবশালী সংগঠন হেফাজতে ইসলামের আমির মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী বলেছেন যে, জামায়াতে ইসলামী প্রকৃত ইসলামী দল নয়। হেফাজতে ইসলাম নিজেদের অরাজনৈতিক দাবি করলেও রাজনীতির ময়দানে তারা বেশ আলোচিত সংগঠন। এর নেতৃত্বে রয়েছেন কওমি ঘরানার বিভিন্ন রাজনৈতিক ইসলামী দলের নেতারা। অন্যদিকে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমির ও শায়খে চরমোনাই মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম বলেছেন, ‘ইসলাম ধ্বংস করতে জামায়াতই যথেষ্ট’—নিজের এমন পুরোনো বক্তব্য থেকে এক চুলও নড়েননি তিনি।
জুলাইয়ের পর ইসলামি দলগুলোর ঐক্যের চেষ্টা
৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সঙ্গে মতবিনিময় শুরু করে জামায়াতে ইসলামী। তবে চলতি বছরের শুরুতে হঠাৎ করেই জোরেসোরে এ তৎপরতা বৃদ্ধি পায়। এ সময় দেশের রাজনীতিতে ইসলামপন্থী দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মাঝে বিদ্যমান দূরত্ব ঘোচার আভাস পাওয়া যায়।
গত ১৬ জানুয়ারি সকালে ভোলায় একটি মাদরাসার ছাত্রদের হাদিসের দারস প্রদান শেষে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মামুনুল হক সাংবাদিকদের বলেন, ‘ইসলামি দলগুলোর ঐক্যের ব্যাপারে আন্তরিকভাবে চেষ্টা চালাচ্ছি। ইতিমধ্যে আমাদের আলোচনা অনেক দূর অগ্রসর হয়েছে। আশা করি, ইসলামি সংগঠনগুলো আগামী নির্বাচন যখনই হবে ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে আমরা নির্বাচনী যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে পারব। সেই সঙ্গে আগামীর বাংলাদেশে আরও বৃহত্তর ঐক্যের আশা করছি।’
মামুনুল হকের এই বক্তব্যের ৫ দিনের মাথায় ২১ জানুয়ারি দুপুরে বরিশালে চরমোনাই পীরের দরবারে ইসলামী আন্দোলনের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীমের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান। পরে তিনি চরমোনাই পীরের দেওয়া মধ্যাহ্নভোজে অংশ নেন। বিকেলে ইসলামী যুব আন্দোলনের বরিশাল জেলা শাখার সভাপতি এইচ এম সানাউল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, ‘রাজনীতিতে দুই দল এত দিন পরস্পরবিরোধী থাকলেও এখন অনেক বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করছে। এটা দুই দলের ঐক্যের সূচনা পর্ব বলতে পারেন। এরই ধারাবাহিকতায় এই প্রথম জামায়াতের কোনো আমির চরমোনাই পীরের দরবারে এলেন এবং দলীয় প্রধানের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ ও মধ্যাহ্নভোজে অংশ নিলেন।’
জামায়াত আমিরের সাক্ষাতের ছয় দিনের মাথায় ২৭ জানুয়ারি চরমোনাই পীরের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তবে এর কয়েক মাস পরেই জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের বিপক্ষে প্রকাশ্যে মন্তব্য করতে দেখা গেছে বিএনপি নেতাদের।
ইসলামপন্থী দলগুলোর জোট ও বিভক্তি
একাত্তর-পরবর্তী সময়ে দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৭৬ সালে এ নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। ওই বছর জুলাই মাসে রাজনৈতিক দল বিধির (পিপিআর) আওতায় আবেদন করেও জামায়াত অনুমোদন পায়নি। ডেমোক্রেটিক পার্টি, নেজামে ইসলাম পার্টি, খেলাফতে রাব্বানী পার্টির সঙ্গে মিলে জামায়াতে ইসলামীর নেতারা ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লিগ (আইডিএল) নামে একটি নতুন রাজনৈতিক জোট গঠন করেন এবং তাদের প্রতীকে নির্বাচন করেন। ১৯৭৯ সালের জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিয়ে জোটের প্রতীকে ৬টি আসন পান জামায়াতের ইসলামীর নেতারা। তবে বাংলাদেশে ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর এই প্রথম ঐক্য চেষ্টা খুব দ্রুত ভেঙে পড়ে।
১৯৭৯ সালের মে মাসে আব্বাস আলী খানের নেতৃত্বে জামায়াতে ইসলামী আবার তাদের দলীয় কার্যক্রম শুরু করে। ১৯৮০ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে বায়তুল মোকাররম মসজিদের সামনে প্রকাশ্যে প্রথম জনসভা করে দলটি। ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশ নিতে তওবার রাজনীতির ডাক দেন মুহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জি হুজুর। তাঁর এ ডাকে সাড়া দেন ইসলামী রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক দলের নেতা ও আলেমরা। জামায়াতে ইসলামীও এই ঐক্যে অংশগ্রহণ করতে আগ্রহ প্রকাশ করে। কিন্তু পত্রিকায় ঘোষণা দিয়ে দলটির প্রতিষ্ঠাতা মওলানা আবুল আলা মওদুদির বিতর্কিত মতবাদ সংশোধনের শর্ত দেন হাফেজ্জি হুজুর। শর্ত না মানায় এই ঐক্যের বাইরে থাকে জামায়াত।
নির্বাচনের পর ১৯৮১ সালের ২৯ নভেম্বর হাফেজ্জি হুজুর বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন নামে নতুন একটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেন। এই দলে শাইখুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক, চরমোনাই পীর মাওলানা সৈয়দ মো. ফজলুল করিম এবং মুফতি ফজলুল হক আমিনীকে নায়েবে আমীর নিযুক্ত করা হয়। তাঁরা তিনজনই ছিলেন হাফেজ্জী হুজুরের ছাত্র ও মুরিদ। হাফেজ্জি হুজুরের মৃত্যুর পর তাঁরা তিনজন যথাক্রমে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন (বর্তমানে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ) ও ইসলামী ঐক্যজোট (ছয়টি দলের সমন্বয়ে) নামের তিনটি আলাদা দল প্রতিষ্ঠা করেন। তিনটি দলই এখন প্রতিষ্ঠাতা নেতাদের সন্তান ও পরিবারের সদস্যরা পরিচালনা করছেন। বাংলাদেশে ইসলামী রাজনীতিতে এই তিনটি দল ধীরে ধীরে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
‘সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তাদের সমাবেশে ২২০ ফিট লম্বা মঞ্চে উপস্থিত থাকবেন দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক ইসলামি দলের নেতারা, জুলাই শহীদ পরিবারের সদস্যরা ও জুলাই আহত ব্যক্তিরা।’ - মিয়া গোলাম পরওয়ার, সেক্রেটারি জেনারেল, জামায়াতে ইসলামী
তবে ইসলামপন্থী দলগুলোর ভেতর ভোটের মাঠে সবসময় এগিয়ে ছিল জামায়াতে ইসলামী। ১৯৮৬ সালের তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে ৪.৬১ ভাগ ভোট পায় দলটি। ৩০০ আসনের মধ্যে ৭৬ টিতে প্রার্থী দিয়ে ১০টিতে জয় পায়। তাদের প্রাপ্ত ভোটের পরিমাণ ছিল ১৩ লাখ ১৪ হাজার। স্বাধীনতার পর নিজ নামে এটিই ছিল জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রথম অংশগ্রহণ। ১৯৮৮ সালের একতরফা নির্বাচনে দলটি অংশ নেয়নি। ওই সময় বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেয় তারা। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পর ১৯৯১ সালের নির্বাচনে ২২২ জন প্রার্থী দিয়ে ১৮টি আসনে জয়ী হন জামায়াতের প্রার্থীরা। ওই সময় সরকার গঠনে বিএনপিকে সমর্থন করে জামায়াত।
অন্যদিকে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত আন্দোলন, নেজামে ইসলামী পার্টি, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও ফরায়েজী আন্দোলন—এই ছয়টি ইসলামি দলের মোর্চা ইসলামী ঐক্যজোট নাম নেয়। তারা ৫৯ জন প্রার্থী দিয়ে ১৯৯১ সালের নির্বাচনে মাত্র ১টিতে জয় পায়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ১৯৯৪ সালে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে শরিক হয় জামায়াত। বিএনপিকে দেওয়া সমর্থনও প্রত্যাহার করে তারা। ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে অংশ নিয়ে মাত্র তিনটি আসন পায়। নির্বাচনের দুই বছর পর আবারও বিএনপির সঙ্গে জোট বাঁধে জামায়াত। জোট থেকে ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনে অংশ নিয়ে ১৭ আসন পেয়ে সরকারের অংশ হয়। পরে ২০০৮ সালের নির্বাচনে জামায়াত মাত্র দুইটি আসন পায়। ২০২২ সালে বিএনপি জোট ছেড়ে বেরিয়ে যায়।
এই পুরো সময়ে ইসলামি দলগুলো একাধিকবার নির্বাচনী ঐক্য গড়ে ভাঙনের মুখে পড়েছে। কিন্তু জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে তাদের কখনো স্বতন্ত্র জোট তৈরি হয়নি। গত বছরের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নতুন করে ঐক্যের চেষ্টা করছে এই দলগুলো। বড় দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এতে অগ্রণী ভূমিকা রাখছে। তাদের মূল বার্তা হলো—ইসলামী দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হলে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারবে এবং তাদের সম্মিলিত ভোটব্যাংক এক বাক্সে পড়লে নির্বাচনী ফলাফল বদলে দেওয়া সম্ভব।
কিন্তু যে কারণে আগে হাফেজ্জি হুজুরের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর জোট হয়নি সেই একই আদর্শিক বিভেদ এখনো কার্যকর রয়েছে। হেফাজতে ইসলামের আমির ও চরমোনাই পীরের সাম্প্রতিক মন্তব্যে সেই সম্ভাবনা নতুন করে দেখা দিয়েছে।
হেফাজত আমিরের সাম্প্রতিক মন্তব্য
১১ জুলাই হেফাজত আমিরের অসুস্থতার খবরে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক সরওয়ার আলমগীর তাঁকে দেখতে যান। ফটিকছড়ির বাবুনগর মাদ্রাসাসংলগ্ন তাঁর বাসভবনে উপস্থিত সাংবাদিকদের সামনেই ‘জামায়াতে ইসলামী মদিনার ইসলাম নয়’ বলে মন্তব্য করেন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির মাওলানা মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী। এ সময় তিনি বলেন, মদিনার ইসলাম আর জামায়াতে ইসলামী এক নয়।
এ ছাড়া গত ২৫ অক্টোবর ফেনী মিজান ময়দানে দেওয়া বক্তৃতায় মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী বলেন, ‘আমরা জামায়াতে ইসলামকে ইসলামী দল মনে করি না। জামায়াতে ইসলাম মদিনার ইসলাম চায় না, তারা মওদুদীর ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে চায়।’
আগে যা বলেছেন হেফাজত আমির
২০২১ সালের আগস্টে হেফাজতের আমির জুনায়েদ বাবুনগরীর মৃত্যুর পর চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসায় (দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম) একটি জরুরি বৈঠক হয়। বৈঠকে জুনায়েদ বাবুনগরীর জানাজার আগেই তাঁর মামা মুহিবুল্লাহ বাবুনগরীকে হেফাজতের নতুন আমির হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বাবুনগর মাদ্রাসার মহাপরিচালক মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী এর আগে হেফাজতের প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন।
চরমোনাইয়ের প্রয়াত পীর সৈয়দ মুহাম্মদ ফজলুল করিমের জীবদ্দশায় ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী। আমির নির্বাচিত হওয়ার পর ২০২১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর দুপুরে ফটিকছড়ির বাবুনগরের নিজ বাসভবনে প্রথমবারের মতো গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপ করেন তিনি। সেখানে তিনি হেফাজতে ইসলাম ও আওয়ামীলীগ সরকারের সম্পর্কের বিষয়ে বলেন, ‘কওমিদের নিয়ে বর্তমান সরকারের আন্তরিকতায় আমরা খুশি। সরকারের পতন কিংবা কাউকে গদিতে বসানো আমাদের আন্দোলনের উদ্দেশ্য নয়। আমরা মুসলিম, কোরআন এবং হাদিস মেনে চলতে হবে। কোরআন পরিপন্থী কোনো আইন চাপিয়ে দিলে আমরা বিরোধিতা করব। আন্দোলন করব। আওয়ামী লীগ সরকার ২০০ বছর ক্ষমতায় থাকলেও আমাদের কোনো সমস্যা নেই। আলেমরা গদি (ক্ষমতা) চায় না। গদিওয়ালাদের (ক্ষমতাসীনদের) আলেম বানাতে চায়।’
সেই সময় জামায়াতের সঙ্গে হেফাজতের আদর্শিক কোনো সম্পর্ক নেই বলেও জানান মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী। তিনি বলেছিলেন যে কওমি আলেমরা জামায়াতের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকে সব সময়। দেওবন্দের অন্যতম ব্যক্তিত্ব আল্লামা হোসাইন আহমদ মাদানি জামায়াতের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। হেফাজত তাদের অনুসারী হিসেবে এখনো জামায়াতের বিরুদ্ধে কথা বলে। সেই সূত্র ধরে তিনি স্পষ্টভাবে বলেছিলেন যে জামায়াতের সঙ্গে কওমিদের কোনো ঐক্য হতে পারে না। কারণ, তাঁর মতে—আদর্শিক কারণেই কওমিদের সঙ্গে জামায়াতের দূরত্ব ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত। রাজনৈতিক স্বার্থে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি জামায়াতের সঙ্গে ঐক্য করেছে। কিন্তু হেফাজতের সঙ্গে জামায়াতের এখনো কোনো জোট হয়নি।
পুরোনো বক্তব্যে অটল শায়েখে চরমোনাই
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করিম সম্প্রতি খালেদ মহিউদ্দীনের টক শোতে অংশ নিয়েছেন। সেখানে তিনি বলেন, ‘ইসলাম ধ্বংস করতে জামায়াতই যথেষ্ট’, নিজের এমন পুরোনো বক্তব্য থেকে একচুলও নড়েননি তিনি।
ইসলামী আন্দোলনের এই সিনিয়র নায়েবে আমির বলেন, ‘কোনো একটি বিষয়ের ওপর ঐকমত্য হলে একই মঞ্চে আসা যায়। তার মানে কেউ কারও আদর্শ বিসর্জন দেয়নি। আমি জামায়াত নিয়ে আমার পুরোনো বক্তব্য থেকে একচুলও সরিনি। তেমনি জামায়াত নেতারাও আমাদের বিরুদ্ধে অতীতে যেসব বক্তব্য দিয়েছে সেগুলো থেকে তারা পিছু হটেনি।’
শনিবার ১৯ জুলাই জামায়াতে ইসলামী সারাদেশের নেতাকর্মীদের নিয়ে জাতীয় সমাবেশের ডাক দিয়েছে। দলটির দ্বিতীয় প্রধান নেতা মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, সড়ক, নৌ ও রেলপথে এদিন রাজধানীতে বিপুল পরিমাণ মানুষের সমাবেশ ঘটবে। সমাবেশটি জাতীয় নির্বাচনে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ নিশ্চিত করণসহ সাত দফা দাবিতে আয়োজন করা হয়েছে। যদিও পর্যবেক্ষকেরা মনে করছেন, জামায়াত মূলত বিপুল জনবল প্রদর্শন করতে চাইছে। এর মধ্যে দিয়ে পিআর পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচন এবং প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার দাবি আরো জোরালো করবে দলটি।
জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার সমাবেশ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তাদের সমাবেশে ২২০ ফিট লম্বা মঞ্চে উপস্থিত থাকবেন দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক ইসলামি দলের নেতারা, জুলাই শহীদ পরিবারের সদস্যরা ও জুলাই আহত ব্যক্তিরা। জানা গেছে, সমাবেশে বিভিন্ন ইসলামি দলের নেতৃবৃন্দ পরস্পর ঐক্য গড়ার গুরুত্ব তুলে ধরবেন। যেসব ইসলামপন্থী দল কখনো জামায়াতের সঙ্গে এক ছাতার নিচে আসেনি তারাও সমাবেশে আমন্ত্রণ পেয়েছে।
অতীতে নানা সময় ইসলামি দলগুলো বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করেছে। আবার তাদের কোনো কোনো দল আওয়ামী লীগের সঙ্গেও জোট বেঁধেছে। ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থাণে পটপরিবর্তনের পর রাজনীতিতে ঘটছে নতুন মেরুকরণ। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের নিবন্ধন সম্প্রতি স্থগিত করেছে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ না থাকায় বিএনপির সঙ্গে আর জোট করার প্রয়োজন মনে করছে না ইসলামি দলগুলো। বরং তারা নিজেরা একসঙ্গে মিলে বিএনপির বিকল্প শক্তি হিসেবে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে।
এই ‘বিকল্প শক্তি’ হয়ে ওঠার মধ্য দিয়ে ক্ষমতার রাজনীতিতে নির্ণায়ক শক্তি হয়ে ওঠার চেষ্টা করছে জামায়াতে ইসলামী।
শেখ হাসিনার পতনের পর থেকেই দেশের সক্রিয় ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি, নানা বিষয়ে ঐকমত্য তৈরির চেষ্টা করছে সবচেয়ে বড় ‘রাজনৈতিক ইসলামী দল’ জামায়াতে ইসলামী। কিন্তু তাদের স্বতন্ত্র এই ঐক্য চেষ্টার তোরজোরের মধ্যেই প্রভাবশালী ইসলামি গোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের আদর্শিক বিভেদ আবারও দৃশ্যমান হয়ে ওঠেছে। এতে দেখা দিয়েছে ঐক্য গঠনের আগেই ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা।
বিষয়টি স্বীকার করতে নারাজ জামায়াতে ইসলামীর নেতারা।
যদিও দেশের কওমি মাদ্রাসা ঘরানার সবচেয়ে বৃহৎ ও প্রভাবশালী সংগঠন হেফাজতে ইসলামের আমির মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী বলেছেন যে, জামায়াতে ইসলামী প্রকৃত ইসলামী দল নয়। হেফাজতে ইসলাম নিজেদের অরাজনৈতিক দাবি করলেও রাজনীতির ময়দানে তারা বেশ আলোচিত সংগঠন। এর নেতৃত্বে রয়েছেন কওমি ঘরানার বিভিন্ন রাজনৈতিক ইসলামী দলের নেতারা। অন্যদিকে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমির ও শায়খে চরমোনাই মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম বলেছেন, ‘ইসলাম ধ্বংস করতে জামায়াতই যথেষ্ট’—নিজের এমন পুরোনো বক্তব্য থেকে এক চুলও নড়েননি তিনি।
জুলাইয়ের পর ইসলামি দলগুলোর ঐক্যের চেষ্টা
৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সঙ্গে মতবিনিময় শুরু করে জামায়াতে ইসলামী। তবে চলতি বছরের শুরুতে হঠাৎ করেই জোরেসোরে এ তৎপরতা বৃদ্ধি পায়। এ সময় দেশের রাজনীতিতে ইসলামপন্থী দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মাঝে বিদ্যমান দূরত্ব ঘোচার আভাস পাওয়া যায়।
গত ১৬ জানুয়ারি সকালে ভোলায় একটি মাদরাসার ছাত্রদের হাদিসের দারস প্রদান শেষে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মামুনুল হক সাংবাদিকদের বলেন, ‘ইসলামি দলগুলোর ঐক্যের ব্যাপারে আন্তরিকভাবে চেষ্টা চালাচ্ছি। ইতিমধ্যে আমাদের আলোচনা অনেক দূর অগ্রসর হয়েছে। আশা করি, ইসলামি সংগঠনগুলো আগামী নির্বাচন যখনই হবে ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে আমরা নির্বাচনী যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে পারব। সেই সঙ্গে আগামীর বাংলাদেশে আরও বৃহত্তর ঐক্যের আশা করছি।’
মামুনুল হকের এই বক্তব্যের ৫ দিনের মাথায় ২১ জানুয়ারি দুপুরে বরিশালে চরমোনাই পীরের দরবারে ইসলামী আন্দোলনের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীমের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান। পরে তিনি চরমোনাই পীরের দেওয়া মধ্যাহ্নভোজে অংশ নেন। বিকেলে ইসলামী যুব আন্দোলনের বরিশাল জেলা শাখার সভাপতি এইচ এম সানাউল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, ‘রাজনীতিতে দুই দল এত দিন পরস্পরবিরোধী থাকলেও এখন অনেক বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করছে। এটা দুই দলের ঐক্যের সূচনা পর্ব বলতে পারেন। এরই ধারাবাহিকতায় এই প্রথম জামায়াতের কোনো আমির চরমোনাই পীরের দরবারে এলেন এবং দলীয় প্রধানের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ ও মধ্যাহ্নভোজে অংশ নিলেন।’
জামায়াত আমিরের সাক্ষাতের ছয় দিনের মাথায় ২৭ জানুয়ারি চরমোনাই পীরের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তবে এর কয়েক মাস পরেই জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের বিপক্ষে প্রকাশ্যে মন্তব্য করতে দেখা গেছে বিএনপি নেতাদের।
ইসলামপন্থী দলগুলোর জোট ও বিভক্তি
একাত্তর-পরবর্তী সময়ে দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৭৬ সালে এ নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। ওই বছর জুলাই মাসে রাজনৈতিক দল বিধির (পিপিআর) আওতায় আবেদন করেও জামায়াত অনুমোদন পায়নি। ডেমোক্রেটিক পার্টি, নেজামে ইসলাম পার্টি, খেলাফতে রাব্বানী পার্টির সঙ্গে মিলে জামায়াতে ইসলামীর নেতারা ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লিগ (আইডিএল) নামে একটি নতুন রাজনৈতিক জোট গঠন করেন এবং তাদের প্রতীকে নির্বাচন করেন। ১৯৭৯ সালের জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিয়ে জোটের প্রতীকে ৬টি আসন পান জামায়াতের ইসলামীর নেতারা। তবে বাংলাদেশে ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর এই প্রথম ঐক্য চেষ্টা খুব দ্রুত ভেঙে পড়ে।
১৯৭৯ সালের মে মাসে আব্বাস আলী খানের নেতৃত্বে জামায়াতে ইসলামী আবার তাদের দলীয় কার্যক্রম শুরু করে। ১৯৮০ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে বায়তুল মোকাররম মসজিদের সামনে প্রকাশ্যে প্রথম জনসভা করে দলটি। ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশ নিতে তওবার রাজনীতির ডাক দেন মুহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জি হুজুর। তাঁর এ ডাকে সাড়া দেন ইসলামী রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক দলের নেতা ও আলেমরা। জামায়াতে ইসলামীও এই ঐক্যে অংশগ্রহণ করতে আগ্রহ প্রকাশ করে। কিন্তু পত্রিকায় ঘোষণা দিয়ে দলটির প্রতিষ্ঠাতা মওলানা আবুল আলা মওদুদির বিতর্কিত মতবাদ সংশোধনের শর্ত দেন হাফেজ্জি হুজুর। শর্ত না মানায় এই ঐক্যের বাইরে থাকে জামায়াত।
নির্বাচনের পর ১৯৮১ সালের ২৯ নভেম্বর হাফেজ্জি হুজুর বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন নামে নতুন একটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেন। এই দলে শাইখুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক, চরমোনাই পীর মাওলানা সৈয়দ মো. ফজলুল করিম এবং মুফতি ফজলুল হক আমিনীকে নায়েবে আমীর নিযুক্ত করা হয়। তাঁরা তিনজনই ছিলেন হাফেজ্জী হুজুরের ছাত্র ও মুরিদ। হাফেজ্জি হুজুরের মৃত্যুর পর তাঁরা তিনজন যথাক্রমে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন (বর্তমানে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ) ও ইসলামী ঐক্যজোট (ছয়টি দলের সমন্বয়ে) নামের তিনটি আলাদা দল প্রতিষ্ঠা করেন। তিনটি দলই এখন প্রতিষ্ঠাতা নেতাদের সন্তান ও পরিবারের সদস্যরা পরিচালনা করছেন। বাংলাদেশে ইসলামী রাজনীতিতে এই তিনটি দল ধীরে ধীরে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
‘সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তাদের সমাবেশে ২২০ ফিট লম্বা মঞ্চে উপস্থিত থাকবেন দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক ইসলামি দলের নেতারা, জুলাই শহীদ পরিবারের সদস্যরা ও জুলাই আহত ব্যক্তিরা।’ - মিয়া গোলাম পরওয়ার, সেক্রেটারি জেনারেল, জামায়াতে ইসলামী
তবে ইসলামপন্থী দলগুলোর ভেতর ভোটের মাঠে সবসময় এগিয়ে ছিল জামায়াতে ইসলামী। ১৯৮৬ সালের তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে ৪.৬১ ভাগ ভোট পায় দলটি। ৩০০ আসনের মধ্যে ৭৬ টিতে প্রার্থী দিয়ে ১০টিতে জয় পায়। তাদের প্রাপ্ত ভোটের পরিমাণ ছিল ১৩ লাখ ১৪ হাজার। স্বাধীনতার পর নিজ নামে এটিই ছিল জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রথম অংশগ্রহণ। ১৯৮৮ সালের একতরফা নির্বাচনে দলটি অংশ নেয়নি। ওই সময় বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেয় তারা। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পর ১৯৯১ সালের নির্বাচনে ২২২ জন প্রার্থী দিয়ে ১৮টি আসনে জয়ী হন জামায়াতের প্রার্থীরা। ওই সময় সরকার গঠনে বিএনপিকে সমর্থন করে জামায়াত।
অন্যদিকে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত আন্দোলন, নেজামে ইসলামী পার্টি, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও ফরায়েজী আন্দোলন—এই ছয়টি ইসলামি দলের মোর্চা ইসলামী ঐক্যজোট নাম নেয়। তারা ৫৯ জন প্রার্থী দিয়ে ১৯৯১ সালের নির্বাচনে মাত্র ১টিতে জয় পায়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ১৯৯৪ সালে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে শরিক হয় জামায়াত। বিএনপিকে দেওয়া সমর্থনও প্রত্যাহার করে তারা। ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে অংশ নিয়ে মাত্র তিনটি আসন পায়। নির্বাচনের দুই বছর পর আবারও বিএনপির সঙ্গে জোট বাঁধে জামায়াত। জোট থেকে ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনে অংশ নিয়ে ১৭ আসন পেয়ে সরকারের অংশ হয়। পরে ২০০৮ সালের নির্বাচনে জামায়াত মাত্র দুইটি আসন পায়। ২০২২ সালে বিএনপি জোট ছেড়ে বেরিয়ে যায়।
এই পুরো সময়ে ইসলামি দলগুলো একাধিকবার নির্বাচনী ঐক্য গড়ে ভাঙনের মুখে পড়েছে। কিন্তু জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে তাদের কখনো স্বতন্ত্র জোট তৈরি হয়নি। গত বছরের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নতুন করে ঐক্যের চেষ্টা করছে এই দলগুলো। বড় দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এতে অগ্রণী ভূমিকা রাখছে। তাদের মূল বার্তা হলো—ইসলামী দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হলে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারবে এবং তাদের সম্মিলিত ভোটব্যাংক এক বাক্সে পড়লে নির্বাচনী ফলাফল বদলে দেওয়া সম্ভব।
কিন্তু যে কারণে আগে হাফেজ্জি হুজুরের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর জোট হয়নি সেই একই আদর্শিক বিভেদ এখনো কার্যকর রয়েছে। হেফাজতে ইসলামের আমির ও চরমোনাই পীরের সাম্প্রতিক মন্তব্যে সেই সম্ভাবনা নতুন করে দেখা দিয়েছে।
হেফাজত আমিরের সাম্প্রতিক মন্তব্য
১১ জুলাই হেফাজত আমিরের অসুস্থতার খবরে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক সরওয়ার আলমগীর তাঁকে দেখতে যান। ফটিকছড়ির বাবুনগর মাদ্রাসাসংলগ্ন তাঁর বাসভবনে উপস্থিত সাংবাদিকদের সামনেই ‘জামায়াতে ইসলামী মদিনার ইসলাম নয়’ বলে মন্তব্য করেন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির মাওলানা মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী। এ সময় তিনি বলেন, মদিনার ইসলাম আর জামায়াতে ইসলামী এক নয়।
এ ছাড়া গত ২৫ অক্টোবর ফেনী মিজান ময়দানে দেওয়া বক্তৃতায় মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী বলেন, ‘আমরা জামায়াতে ইসলামকে ইসলামী দল মনে করি না। জামায়াতে ইসলাম মদিনার ইসলাম চায় না, তারা মওদুদীর ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে চায়।’
আগে যা বলেছেন হেফাজত আমির
২০২১ সালের আগস্টে হেফাজতের আমির জুনায়েদ বাবুনগরীর মৃত্যুর পর চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসায় (দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম) একটি জরুরি বৈঠক হয়। বৈঠকে জুনায়েদ বাবুনগরীর জানাজার আগেই তাঁর মামা মুহিবুল্লাহ বাবুনগরীকে হেফাজতের নতুন আমির হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বাবুনগর মাদ্রাসার মহাপরিচালক মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী এর আগে হেফাজতের প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন।
চরমোনাইয়ের প্রয়াত পীর সৈয়দ মুহাম্মদ ফজলুল করিমের জীবদ্দশায় ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী। আমির নির্বাচিত হওয়ার পর ২০২১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর দুপুরে ফটিকছড়ির বাবুনগরের নিজ বাসভবনে প্রথমবারের মতো গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপ করেন তিনি। সেখানে তিনি হেফাজতে ইসলাম ও আওয়ামীলীগ সরকারের সম্পর্কের বিষয়ে বলেন, ‘কওমিদের নিয়ে বর্তমান সরকারের আন্তরিকতায় আমরা খুশি। সরকারের পতন কিংবা কাউকে গদিতে বসানো আমাদের আন্দোলনের উদ্দেশ্য নয়। আমরা মুসলিম, কোরআন এবং হাদিস মেনে চলতে হবে। কোরআন পরিপন্থী কোনো আইন চাপিয়ে দিলে আমরা বিরোধিতা করব। আন্দোলন করব। আওয়ামী লীগ সরকার ২০০ বছর ক্ষমতায় থাকলেও আমাদের কোনো সমস্যা নেই। আলেমরা গদি (ক্ষমতা) চায় না। গদিওয়ালাদের (ক্ষমতাসীনদের) আলেম বানাতে চায়।’
সেই সময় জামায়াতের সঙ্গে হেফাজতের আদর্শিক কোনো সম্পর্ক নেই বলেও জানান মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী। তিনি বলেছিলেন যে কওমি আলেমরা জামায়াতের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকে সব সময়। দেওবন্দের অন্যতম ব্যক্তিত্ব আল্লামা হোসাইন আহমদ মাদানি জামায়াতের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। হেফাজত তাদের অনুসারী হিসেবে এখনো জামায়াতের বিরুদ্ধে কথা বলে। সেই সূত্র ধরে তিনি স্পষ্টভাবে বলেছিলেন যে জামায়াতের সঙ্গে কওমিদের কোনো ঐক্য হতে পারে না। কারণ, তাঁর মতে—আদর্শিক কারণেই কওমিদের সঙ্গে জামায়াতের দূরত্ব ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত। রাজনৈতিক স্বার্থে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি জামায়াতের সঙ্গে ঐক্য করেছে। কিন্তু হেফাজতের সঙ্গে জামায়াতের এখনো কোনো জোট হয়নি।
পুরোনো বক্তব্যে অটল শায়েখে চরমোনাই
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করিম সম্প্রতি খালেদ মহিউদ্দীনের টক শোতে অংশ নিয়েছেন। সেখানে তিনি বলেন, ‘ইসলাম ধ্বংস করতে জামায়াতই যথেষ্ট’, নিজের এমন পুরোনো বক্তব্য থেকে একচুলও নড়েননি তিনি।
ইসলামী আন্দোলনের এই সিনিয়র নায়েবে আমির বলেন, ‘কোনো একটি বিষয়ের ওপর ঐকমত্য হলে একই মঞ্চে আসা যায়। তার মানে কেউ কারও আদর্শ বিসর্জন দেয়নি। আমি জামায়াত নিয়ে আমার পুরোনো বক্তব্য থেকে একচুলও সরিনি। তেমনি জামায়াত নেতারাও আমাদের বিরুদ্ধে অতীতে যেসব বক্তব্য দিয়েছে সেগুলো থেকে তারা পিছু হটেনি।’
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল দ্বিকক্ষ সংসদের প্রস্তাবে সমর্থন দিয়েছে। তবে সংসদের উচ্চকক্ষের গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে তাদের মধ্যে মতপার্থক্য বেশি। নারী আসন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার মতো কয়েকটি বিষয় সংস্কারেও দলগুলো একমত।
১ দিন আগে১৭ জুলাই আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার দিবস। এই দিবসকে বিশ্বব্যাপী আইন ও মানবাধিকারের প্রতি দায়বদ্ধতার প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। প্রশ্ন ওঠে, বাংলাদেশে ন্যায়বিচার কতটা দৃশ্যমান? ওয়ালিদের মতো শিশুহত্যায় বিচারহীনতা ও বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা—আমাদের ন্যায়বিচারের বর্তমান অবস্থা নিয়ে ভাবিয়ে তোলে।
১ দিন আগে২০১২ সালের কথা। চট্টগ্রামে একজন নারী স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। অভিযোগ ছিল যৌতুকের জন্য নির্যাতন। বিচার শেষে আদালত ওই নারীর স্বামীকে তিন বছরের কারাদণ্ড ও জরিমানা করার রায় দেন। রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন স্বামী। তবে সেই আপিলের ফলাফলের আগেই বাদী ও বিবাদীর আপস হয়ে যায়।
৩ দিন আগেবাংলাদেশে জরুরি অবস্থা জারির সাংবিধানিক পদ্ধতি পরিবর্তনের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছেছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সাম্প্রতিক আলোচনায় সিদ্ধান্ত হয়েছে, রাষ্ট্রপতি এখন থেকে একক ক্ষমতায় নয় বরং মন্ত্রিসভার সম্মতিতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করবেন।
৩ দিন আগে