এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিকাশে বিশ্বে শীর্ষে রয়েছে চীন। দেশটি অর্থনীতির প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে এআই যুক্ত করার উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য ঘোষণা করেছে। ‘এআই প্লাস’ পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২৭ সালের মধ্যে অন্তত ৭০ শতাংশ এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে এআই ব্যবহারের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। ধীরগতির প্রবৃদ্ধি ও জনসংখ্যাগত চ্যালেঞ্জের প্রেক্ষাপটে এআইকে উৎপাদনশীলতা বাড়ানো ও উদ্ভাবনের প্রধান চালিকা শক্তি হিসেবে দেখা হচ্ছে।
তবে এত দ্রুত এআই গ্রহণের ফলে ব্যাপক বেকারত্বের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে এমন এক দেশে, যেখানে তরুণ বেকারত্ব আগেই উদ্বেগজনক। ২০২৫ সালের আগস্টে ১৬ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণদের বেকারত্বের হার বেড়ে দাঁড়ায় ১৮.৯ শতাংশে। একই সঙ্গে দেশের শ্রমবাজারও ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, এআই নতুন চাকরি সৃষ্টির চেয়ে বেশি দ্রুত হারে বিদ্যমান চাকরি প্রতিস্থাপন করতে পারে। এতে বেকারত্ব আরও বাড়তে পারে এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হতে পারে। চীনা কমিউনিস্ট পার্টি (সিসিপি) এআই প্রযুক্তিকে পুরো অর্থনীতিতে ছড়িয়ে দিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। অন্যদিকে, তারা সামাজিক স্থিতিকেও সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়। তাই এআই–সম্পর্কিত সম্ভাব্য অস্থিরতা নীতিনির্ধারকদের জন্য বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে।
ফরেইন পলিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, সাংহাইয়ের অনেক তরুণ পেশাজীবী বর্তমানে প্রতিদিন পাঁচ ডলার দিয়ে ‘প্রিটেন্ড টু ওয়ার্ক কোম্পানি’ নামের কৃত্রিম অফিসে বসে থাকেন। সেখানে শুধু আলো, ইন্টারনেট ও কফি পাওয়া যায়, কিন্তু প্রকৃত চাকরি নেই। কেবল কাজ করার ভান থাকে। একই সময়ে শহরের কিছু দূরে গ্রামাঞ্চল থেকে আসা শ্রমিকেরা একই ঘরে পালা করে ঘুমান এবং একই চাকরিতে শিফট ভাগাভাগি করে কাজ করেন।
এই দুই শ্রেণির মানুষের অবস্থা আলাদা মনে হলেও সমস্যা একই। চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি ধীর হয়ে এসেছে। রিয়েল এস্টেট খাত পতনের মুখে এবং প্রযুক্তি খাতে সরকারি কঠোর নজরদারি চালু হয়েছে। ফলে নতুন চাকরির সুযোগ কমে গেছে। এর পাশাপাশি সামনে আরও বড় চ্যালেঞ্জ উপস্থিত—ব্যাপক হারে এআই প্রযুক্তির বিস্তার।
দ্রুত এআই গ্রহণ: জনসংখ্যা ও অর্থনৈতিক চাপে বদলে যাচ্ছে চীন
চীনে প্রতি বছর কর্মক্ষম জনসংখ্যা লাখ লাখ কমছে। একই সঙ্গে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, যার ফলে বিভিন্ন খাতে শ্রমিক সংকট তৈরি হয়েছে। এর পরিপূরক হিসেবে অটোমেশন ও এআই-এর ওপর নির্ভরতা বেড়েছে।
চীনের ৯০ শতাংশেরও বেশি প্রতিষ্ঠান মনে করে, এআই ও রোবটিক্স ব্যবসায়িক রূপান্তরের জন্য অপরিহার্য। দেশটি বিশ্বে স্থাপিত মোট শিল্প রোবটের অর্ধেকেরও বেশি স্থাপন করেছে। তবে এই পরিবর্তন সম্ভাব্য বেকারত্ব নিয়ে উদ্বেগও বাড়িয়েছে।
চীনের অর্থনৈতিক শক্তি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিতর্ক রয়েছে। সরকারি তথ্য স্বচ্ছ না হওয়ায় প্রকৃত চিত্র নির্ধারণ কঠিন। তবুও দুটি প্রবণতা স্পষ্ট। প্রথমটি হলো, তরুণ বেকারত্বের হার দ্রুত বাড়ছে। ১৬ থেকে ২৪ বছর বয়সী যারা পড়াশোনার বাইরে, তাদের বেকারত্বের হার ২০২৫ সালের আগস্টে ১৮ দশমিক ৯ শতাংশে পৌঁছায়।
এই সংখ্যার পেছনে রয়েছে দক্ষতার সঙ্গে বাজারের চাহিদার অমিল। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রেকর্ড পরিমাণ শিক্ষার্থী পাশ করে বের হচ্ছে। কিন্তু যেসব খাত আগে তাদেরকে গ্রহণ করত—রিয়েল এস্টেট, ফিন্যান্স ও প্রযুক্তি—সেগুলো সংকুচিত হয়ে পড়েছে। সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক নীতি ও বাজার পতন এসব খাতকে দুর্বল করে দিয়েছে।
দ্বিতীয় প্রবণতা হলো, স্বল্পদক্ষ শ্রমিকদের অবস্থান আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়া। গ্রামাঞ্চলের কোটি কোটি মানুষ শহরে এসে কম দক্ষতার কাজ করতেন। কিন্তু আবাসন খাত ধসে পড়ায় এবং স্বল্পদক্ষ উৎপাদন বিদেশে সরে যাওয়ায় অনেকের চাকরি হারিয়ে গেছে। তারা এখন রাইড-শেয়ার, ডেলিভারি ইত্যাদি ফ্রিল্যান্স কাজ করছেন, যেখানে সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধা নেই। কেউ কেউ আবার গ্রামে ফিরে কৃষিকাজ শুরু করেছেন।
এই দুই শ্রেণি—নতুন গ্রাজুয়েট ও স্বল্পদক্ষ শ্রমিকরা—সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছেন। কারণ এআই প্রথম ধাক্কা দেবে প্রাথমিক স্তরের অফিস-ভিত্তিক কাজ এবং রুটিন শ্রমে। যুক্তরাষ্ট্রে গবেষণায় দেখা গেছে, চ্যাটজিপিটি চালুর পর থেকে এআই-প্রবণ খাতে তরুণদের কর্মসংস্থান প্রায় ১৩ শতাংশ কমেছে।
চীনা অ্যাকাডেমি অব ম্যাক্রোইকোনমিক রিসার্চের সভাপতি ড. হুয়াং হানচুয়ান এআইকে দ্বিমুখী শক্তি হিসেবে দেখান। তাঁর মতে, চীন ডিজিটালাইজেশন, বুদ্ধিবৃত্তিক স্বয়ংক্রিয়করণ এবং সবুজ রূপান্তরের মধ্য দিয়ে দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। এই পরিবর্তন কর্মসংস্থানের কাঠামোকে নতুনভাবে গড়ছে। একই সঙ্গে তা ডিজিটাল প্রযুক্তি, এআই অ্যাপ্লিকেশন, টেকসই উন্নয়ন ও উন্নত ম্যানুফ্যাকচারিং-এ বহুমুখী দক্ষতার চাহিদা বাড়াচ্ছে।
তিনি বলেন, এই পরিবর্তন দক্ষতার মেয়াদ দ্রুত শেষ করছে এবং ভবিষ্যত কর্মী হিসেবে টিকে থাকতে অভিযোজন ক্ষমতা, শেখার দক্ষতা ও বহুক্ষেত্রের দক্ষতা ও জ্ঞান অপরিহার্য হয়ে উঠছে। তবে এ পরিবর্তনের ফলে প্রচলিত শ্রমবাহিনীর জন্য রূপান্তরজনিত চ্যালেঞ্জও তৈরি হচ্ছে।
বিশ্লেষকরা তরুণদের বেকারত্বকে সম্ভাব্য অস্থিরতার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে দেখছেন। ২০২৫ সালের প্রথম প্রান্তিকে সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা শিক্ষার্থীদের জন্য চাকরির বিজ্ঞাপন ২২ শতাংশ কম ছিল।
চীনের স্বল্পদক্ষ শ্রমিকদের ভবিষ্যৎও অনিশ্চিত। গবেষণা বলছে, রোবট, স্বচালিত গাড়ি এবং অন্যান্য ‘এম্বডেড এআই’ রুটিন শ্রমকেন্দ্রিক কাজগুলো দখল করবে। এতে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠী সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বড় বড় চীনা শহরে ইতিমধ্যে ডেলিভারি ড্রোন ও চালকবিহীন ট্যাক্সি চালু হয়েছে। কতজন ফ্রিল্যান্স শ্রমিক এর ফলে আয় হারাচ্ছেন, তা এখনো নির্ণীত হয়নি। তবে জনমনে উদ্বেগ বাড়ছে। উহানে গত বছর চালকদের বিক্ষোভ এবং বাইদুর চালকবিহীন ট্যাক্সিবিরোধী আন্দোলন বিষয়টি স্পষ্ট করেছে।
চাকরিচ্যুতি, বৈষম্য ও প্রধান ক্ষতিগ্রস্ত খাত
এআই সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলবে প্রাথমিক স্তরের অফিস-কাজ ও রুটিন শ্রমে। এতে উৎপাদন, সেবা ও কৃষি খাতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে। পিডাব্লিউসি-র এক মূল্যায়নে বলা হয়েছে, আগামী দুই দশকে এআই চীনের মোট চাকরির ২৬ শতাংশ—অর্থাৎ প্রায় ২০ কোটি ২০ লাখ কর্মসংস্থান প্রতিস্থাপন করতে পারে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, উদ্ভাবন চীনের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল চালিকা শক্তি। তবে প্রযুক্তির এই ধারা দ্বিমুখী। এটি নতুন চাকরি সৃষ্টি করতে পারে, আবার বিদ্যমান চাকরি বিলুপ্তও করতে পারে। প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন দীর্ঘমেয়াদে ইতিবাচক হলেও এআই মানুষের মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতাকে অতিক্রম করলে চাকরি বিলুপ্তির দিকটাই প্রবল হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
একই প্রতিবেদন বলছে, এআই সামগ্রিকভাবে ১২ শতাংশ নিট কর্মসংস্থান বাড়াতে পারে। এতে ২০৩৭ সালের মধ্যে প্রায় ৯ কোটি ৩০ লাখ নতুন চাকরি সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। তবে কৃষিতে ১০ শতাংশ নিট চাকরি হারানোর ঝুঁকি আছে। শিল্প খাতে লাভ–ক্ষতি সমান থাকতে পারে। তবে রূপান্তরের ঝাঁকুনি বড় হবে।
চীনা সমাজবিজ্ঞান একাডেমির অর্থনীতিবিদ সাই ফাং মনে করেন, এআই একসময় সব ধরনের চাকরি প্রতিস্থাপন করতে পারে। তিনি সতর্ক করেন, সাধারণ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এজিআই) তৈরি হলে কোনো কাজই নিরাপদ থাকবে না। তাঁর ভাষায়, ‘এটি উন্নয়নের একটি বৈপরীত্য। এআই প্রতিযোগিতা বাড়ায়, উৎপাদনশীলতা বাড়াতে শ্রম কমানো হয়, কিন্তু চাকরি সৃষ্টি ও চাকরি বিলুপ্তির মধ্যে ফাঁক বাড়তে থাকে এবং কম–উৎপাদনশীল খাতে চাকরির মান কমে যায়।’
অর্থনৈতিক ঝুঁকি: মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস ও স্থবির মজুরি
চাকরি হারানো ছাড়াও এআই চীনের অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতি–হ্রাস (ডিফ্লেশন) ও মজুরি স্থবিরতা বাড়াতে পারে। শ্রমবাজার দুর্বল হলে নিয়োগ কমে এবং বেতন বৃদ্ধিও ধীর হতে পারে। মরগান স্ট্যানলি বিশ্লেষকদের মতে, এআই–এর প্রভাব চীনে আরও তীব্র হতে পারে। কারণ চীন আগে থেকেই উচ্চ তরুণ বেকারত্ব ও ডিফ্লেশনের মুখোমুখি। তারা সতর্ক করে যে এআই জুনিয়র স্তরের জ্ঞানভিত্তিক কাজ দ্রুত দখল করতে পারে। এতে মজুরি বৃদ্ধি আরও মন্থর হবে।
তবে সবাই এই মতের সঙ্গে একমত নন। স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড–এর ডিং শুয়াং মনে করেন, এআই চীনের ডিফ্লেশনের প্রধান কারণ নয়। তার মতে, ডিফ্লেশন হচ্ছে অতিরিক্ত উৎপাদন এবং কম চাহিদার ফল। তিনি বলেন, এআইকে ভয় না পেয়ে প্রযুক্তির উন্নয়ন অব্যাহত রাখা উচিত।
সরকারের প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ
ঝুঁকি কমাতে বেইজিং এআই নীতিতে বিভিন্ন সুরক্ষা অন্তর্ভুক্ত করছে। এতে কর–ছাড়, মজুরি ভর্তুকি, পুনঃপ্রশিক্ষণ কর্মসূচি এবং নির্দিষ্ট চাকরিতে এআই ব্যবহারে সীমাবদ্ধতার মতো পদক্ষেপ আলোচনায় রয়েছে। ‘এআই প্লাস কর্মসংস্থান’ কাঠামো ২০২৫ সালের টু সেশন্স বৈঠকে উত্থাপন করা হয়। এতে এআই–এর চাকরিতে প্রভাব কমানোর আহ্বান জানানো হয়।
সাই ফাং প্রস্তাব করেন, এআই–সৃষ্ট ‘চাকরি ধ্বংসের’ ফল মোকাবিলায় সার্বজনীন নীতির ভিত্তিতে সামাজিক সুরক্ষা জোরদার করতে হবে। তিনি প্রাক–প্রাথমিক পর্যন্ত বাধ্যতামূলক শিক্ষা চালুর কথা বলেন, যাতে শিশুদের বাস্তব দক্ষতা গড়ে ওঠে। পাশাপাশি অভিবাসী শ্রমিক পরিবারের জন্য গৃহ নিবন্ধন নীতি সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার কথাও তিনি উল্লেখ করেন। তাঁর মতে, যখন এআই–এর চাকরি বিলুপ্তির হার চাকরি সৃষ্টির তুলনায় দ্রুত বাড়তে থাকবে, তখন এই নীতি আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।
সব মিলিয়ে উদ্বেগের মূল কারণ হলো— চীনের অর্থনীতি এখনও নাজুক, কিন্তু এআই কর্মসংস্থান হারানোর গতি বাড়াতে পারে। তাই সমাজে অস্থিরতা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পিডাব্লিউসি-র মতে, পুনঃপ্রশিক্ষণ ও দক্ষতা বিকাশ সফল হলে এআই শেষ পর্যন্ত বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু রূপান্তরের এই সময়ে তরুণ এবং স্বল্পদক্ষ শ্রমিকদের জন্য ঝুঁকি অনেক বেশি। তাই সাই ফাং মনে করেন, এআই–এর সুবিধা নিশ্চিত করতে হলে আগাম নীতি, প্রস্তুতি ও সুরক্ষা ব্যবস্থা অপরিহার্য।