মাহবুবুল আলম তারেক
ইতিহাসে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভূমিকা কীভাবে মূল্যায়িত হবে তা নিয়ে মতভেদ আজও গভীর। তার দ্বিতীয় মেয়াদের সাহসী পররাষ্ট্রনীতির দাবিগুলো এই বিতর্ককে আরও তীব্র করেছে। ট্রাম্প দাবি করছেন, তিনি ‘সাতটি অনন্ত যুদ্ধ’ থামিয়েছেন এবং গাজায় যুদ্ধবিরতি এনেছেন। সমর্থকদের কাছে তিনি এক শান্তিদূত, কিন্তু সমালোচকদের চোখে তার এসব সাফল্য অতিরঞ্জিত ও অস্থায়ী। ফলে তার উত্তরাধিকার নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়—তিনি কি আমেরিকার স্বার্থে বিশ্বকে বাঁকানো এক নায়ক, গণতন্ত্রকে দুর্বল করা এক খলনায়ক, নাকি নাটকীয় কৌতুকের আড়ালে বিশৃঙ্খলা তৈরি করা এক ভাঁড়?
ইতিহাসে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে এককভাবে খলনায়ক, ভাঁড়, নায়ক হিসেবে চিহ্নিত করা কঠিন হবে। এমন সরল বর্ণনা তার মতো বিভাজনসৃষ্টিকারী ও প্রভাবশালী নেতার জন্য যথেষ্ট নয়। ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ গবেষক ও জনমতের মূল্যায়নে দেখা যাচ্ছে, ট্রাম্পকে সম্ভবত ‘গণতন্ত্রের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত সৃষ্টিকারী’ হিসেবেই মনে রাখা হবে। তিনি প্রচলিত রাজনৈতিক রীতি ভেঙে দিয়েছেন, জনতুষ্টিবাদী রাজনীতির উত্থান ত্বরান্বিত করেছেন এবং আমেরিকার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর গভীর ছাপ ফেলেছেন—যা ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুদিকই আছে।
তার উত্তরাধিকার এখনো গড়ে উঠছে দ্বিতীয় মেয়াদের মধ্যে, তবে প্রাথমিক ইঙ্গিত বলছে—তিনি এমন এক জটিল ব্যক্তিত্ব, যাকে সহজে কোনো শ্রেণিতে ফেলা সম্ভব নয়। ইতিহাসবিদদের সাম্প্রতিক মূল্যায়ন বলছে, তিনি সম্ভবত এ তিনটির মিশ্র প্রতিচ্ছবি—এক বিভাজনসৃষ্টিকারী নেতা, যিনি দেশ ও বিশ্বের রাজনৈতিক মানদণ্ড বদলে দিয়েছেন। গবেষকদের সাম্প্রতিক জরিপ ও বিশ্লেষণ আরও দেখায় তিনি একজন ‘অত্যন্ত ফলপ্রসূ’ বিঘ্ন সৃষ্টিকারী। অর্থাৎ, তার প্রভাব গভীর এবং যুগান্তকারীভাবে ছড়িয়ে পড়েছে।
‘নায়ক’ ধারণা: শান্তির দূত ও চুক্তিকারী নেতা
ট্রাম্পের সমর্থকদের মতে, তিনি স্থিতিশীলতার একক শক্তি। তার ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ কূটনীতি এমন সাফল্য এনে দিয়েছে, যা তাঁর পূর্বসূরিদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। গত ২৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে দেওয়া ভাষণে ট্রাম্প দাবি করেন, তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদে তিনি ৭ মাসে ৭টি যুদ্ধ বন্ধ করেছেন—এর সঙ্গে আগের মেয়াদের একটিও রয়েছে।
যদিও তথ্য যাচাইকারীরা বলছেন, এসব যুদ্ধ পুরোপুরি শেষ হয়নি এবং অনেক অগ্রগতি ট্রাম্পের আগে থেকেই শুরু হয়েছিল, তবুও তার সরকারের সক্রিয় কূটনীতি কয়েকটি সংঘাত শীতল করেছে। ভয় দেখানো, প্রণোদনা দেওয়া এবং গোপন সমঝোতা—এই সব কৌশলের মিশ্র প্রয়োগ তাকে কিছু বাস্তব সাফল্য এনে দিয়েছে। বাস্তববাদী কূটনীতিকরা তাকে মতাদর্শী নয়, বরং ফলমুখী মধ্যস্থতাকারী হিসেবে দেখছেন।
তাঁর সমর্থকদের ও কিছু বিশ্লেষকের কাছে ডোনাল্ড ট্রাম্প এক নেতা, যিনি শ্রমজীবী শ্রেণি ও জাতীয় সার্বভৌমত্বের রক্ষক হিসেবে ইতিহাসে টিকে থাকবেন। তাদের মতে, কোভিড-১৯ মহামারীর আগেই তিনি করছাড় ও ব্যবসাবান্ধব নীতির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি পুনরুজ্জীবিত করেন। মধ্যপ্রাচ্যে আব্রাহাম চুক্তি সম্পাদন এবং বৈশ্বিক বাণিজ্যচুক্তিগুলোর বিরুদ্ধে অবস্থান—যেগুলোকে অনেকে আমেরিকান শ্রমিকদের জন্য ক্ষতিকর মনে করতেন—তাকেও বড় কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সাফল্য হিসেবে দেখা হয়।
২০২৪ সালে তার অবিশ্বাস্য রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তন—বিচারিক মামলা ও গণমাধ্যমের তীব্র সমালোচনার মধ্যেও পুনর্নির্বাচিত হওয়া—ইতিমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে অন্যতম বড় পুনরুত্থান হিসেবে বিবেচিত। সমর্থকদের কাছে এটি ‘ডিপ স্টেট’ বা প্রতিষ্ঠিত অভিজাত মহলের বিরুদ্ধে এক দৃঢ় প্রতিরোধের প্রতীক।
ট্রাম্পপন্থীদের দাবি, তিনি ইতিহাসে আব্রাহাম লিংকনের সমকক্ষ হয়ে উঠবেন। তাদের মতে, ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির আওতায় সীমান্ত নিরাপত্তা ও জ্বালানি স্বনির্ভরতার মতো পদক্ষেপ জাতীয় গৌরব ও অর্থনৈতিক শক্তি ফিরিয়ে এনেছে।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে ২০২৫ সালে তার প্রশাসনিক পদক্ষেপ—ফেডারেল সংস্থাগুলো পুনর্গঠন ও ইতিহাস-ভিত্তিক সাংস্কৃতিক আখ্যান পুনর্লিখনের প্রচেষ্টা—তাকে এক সংস্কারক হিসেবে উপস্থাপন করে, যিনি দীর্ঘদিনের আমলাতান্ত্রিক কাঠামো ভেঙে নতুন ধারা তৈরি করছেন।
ট্রাম্পের ভাবমূর্তি আরও শক্ত হয় গাজা যুদ্ধবিরতির পর। ট্রাম্প একে ‘পূর্ণ বিজয়’ বলে ঘোষণা দেন এবং দাবি করেন, এটি বৃহত্তর আঞ্চলিক যুদ্ধ ঠেকিয়েছে। সমর্থকরা, এমনকি কিছু মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষকও, তার কঠোর ভাষা ও সমঝোতার কৌশলকে প্রশংসা করছেন। তারা মনে করেন, এ চুক্তিই হয়তো তাকে বহুদিনের আকাঙ্ক্ষিত নোবেল শান্তি পুরস্কারের দৌড়ে তুলতে পারে।
প্রথম মেয়াদের আব্রাহাম চুক্তি ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন যুক্ত হলে ‘নায়ক’ বর্ণনাটি আরও স্পষ্ট হয়—শক্তির মাধ্যমে শান্তি আনা এক নেতা, যিনি বুশ বা ওবামার মতো ‘অন্তহীন যুদ্ধ’-র উত্তরাধিকার ভেঙে দিয়েছেন।
‘খলনায়ক’ দৃষ্টিভঙ্গি: অতিরঞ্জন ও বিভাজনের প্রতীক
সমালোচকরা, বিশেষ করে ইতিহাসবিদ ও বিশ্লেষকরা, ট্রাম্পকে এক অন্ধকার চিত্রে দেখেন। তাঁদের মতে, ট্রাম্প এমন একজন জনতুষ্টিবাদী নেতা, যার আত্মকেন্দ্রিক নেতৃত্ব গণতন্ত্রের নিরাপত্তাব্যূহ দুর্বল করেছে এবং দেশকে গভীর বিভাজনের দিকে ঠেলে দিয়েছে। ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারির ক্যাপিটল দাঙ্গা তার নির্বাচনী প্রক্রিয়া দুর্বল করার প্রবণতার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক ইতিহাসবিদের মতে, ভবিষ্যতের বইগুলোতে ট্রাম্পকে হয়তো এমন এক প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখা হবে, যিনি আমেরিকার গণতন্ত্রকে অস্তিত্ব সংকটে ফেলেছিলেন। এমনকি কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, যদি স্বৈরশাসনের ধারা চলতে থাকে, তিনি হতে পারেন গণতান্ত্রিক যুক্তরাষ্ট্রের ‘শেষ প্রেসিডেন্ট’।
তার বিরুদ্ধে আইনি দণ্ড, বর্ণবাদী ও অভিবাসন নিয়ে উস্কানিমূলক বক্তব্য, এবং করোনা মহামারীতে ব্যর্থতা—সবকিছু মিলিয়ে সমালোচকরা তাকে অদক্ষ ও বিদ্বেষপূর্ণ নেতা হিসেবে দেখেন। তাদের মতে, তার শাসনামল ছিল ‘অরাজকতার প্রদর্শনী।’ বিরোধীদের মতে, ট্রাম্পের নামে কোনো স্মৃতিসৌধ বা বিদ্যালয় গড়ে উঠবে না। তার উত্তরাধিকার হবে ‘অচল গলি ও আবর্জনার স্তূপের মতো’—এক সতর্কবার্তা, যা জানিয়ে দেবে কীভাবে এক ব্যক্তিপূজার রাজনীতি দুর্নীতি ও বিশৃঙ্খলার প্রতীক হতে পারে।
সমালোচকরা আরও বলেন, ট্রাম্পের বড়াই করা কথাগুলোও আসলে অসম্পূর্ণ বা অস্থায়ী সাফল্যকে আড়াল করার জন্য। তার আচরণ যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব ও প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আস্থা নষ্ট করেছে। যুদ্ধ বন্ধের দাবি নিয়ে সংবাদমাধ্যমগুলো, যেমন এপি ও নিউইয়র্ক টাইমস, ট্রাম্পের বক্তব্যকে ‘ভুল’ বলে উল্লেখ করেছে। তারা বলে, এটি ট্রাম্পের স্বভাবসিদ্ধ অতিরঞ্জন—নিজেকে বড় করে দেখানো, কিন্তু টেকসই কূটনীতি উপেক্ষা করা। এতে ভবিষ্যতে চুক্তিগুলো ভেঙে পড়লে যুক্তরাষ্ট্রই ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
গাজার চুক্তিও এই ঝুঁকির প্রতিফলন। প্রথম ধাপ কার্যকর হলেও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, হামাস আবার অস্ত্র নিলে অভিযান শুরু হবে। দীর্ঘমেয়াদে নিরস্ত্রীকরণের বিষয়টি এখনো অনির্দিষ্ট। বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, এটি হয়তো কাগজে-কলমে থাকা এক ‘ভঙ্গুর শান্তি’।
২০২৫ সালের মার্চে কার্নেগি প্যানেলে ইতিহাসবিদরা ট্রাম্পের মেয়াদকে বিভেদমূলক বলে আখ্যা দেন। তারা তার সংকট-ব্যবস্থাপনাকে আব্রাহাম লিংকনের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রু জনসনের ব্যর্থতার সঙ্গে তুলনা করেন। দ্য গার্ডিয়ানের এক মতামতে বলা হয়, ট্রাম্পের উত্তরাধিকার ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সতর্ক করবে—এক নেতার গল্প হিসেবে, যিনি বিভাজন উসকে দিয়েছেন এবং গণতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন। এ দৃষ্টিভঙ্গিতে, তিনি নায়ক নন—গণতন্ত্রের বিনিময়ে অর্জিত এক খলনায়ক।
নিউইয়র্ক টাইমসের ইতিহাসবিদ জরিপে একজন বিশেষজ্ঞ মন্তব্য করেছেন, ট্রাম্পের ‘সাফল্য’ শুধু স্বৈরতন্ত্রের ছদ্মবেশ। নিউ রিপাবলিকের মাইকেল টোমাসকি সতর্ক করেছেন, ‘এটি ফ্যাসিবাদ এবং কোটি মানুষ এটি দেখছেন’, যা ‘প্রকল্প ২০২৫’ গ্রহণ এবং মিডিয়ায় আক্রমণের সঙ্গে যুক্ত।
‘ভাঁড়’ চিত্র: নেতা নয়, কৃতিত্ব জাহিরকারী
ট্রাম্পকে আরও একভাবে দেখা হয়—বিনোদনমূলক রাজনীতির ভাঁড় হিসেবে। রিয়ালিটি-টিভি শো-এর মতো তার বড়াই ও টুইটগুলো ওভাল অফিসকে একটি সার্কাসে পরিণত করেছে। এর ফলে পদটির গুরুত্ব হ্রাস পেয়েছে, কিন্তু সাধারণ মানুষ তাকে আগ্রহের সঙ্গে দেখেছে। প্রেসিডেন্টদের মধ্যে তার ‘ইতিহাসে নিজের স্থান’ নিয়ে আগ্রহ অনন্য। এটি প্রায়শই আত্মগৌরবপূর্ণ প্রদর্শন হিসেবে প্রকাশ পায়, যা নীতিনির্ধারণের বিষয়কে ছাপিয়ে যায়।
২০২৫ সালের কিছু পদক্ষেপের সমালোচনাতেও এই ‘ভাঁড়’ চিত্র দেখা যায়—সাংস্কৃতিক যুদ্ধ নিয়ে নির্বাহী আদেশগুলোকে অনেকেই নাটকীয় বিশৃঙ্খলা বলে উপেক্ষা করেছেন। তবে তার মিডিয়া কৌশল অকেজো ছিল না। ট্রাম্প তার প্রতি সমালোচনাকে নিজের নির্বাচনী সাফল্যে রূপান্তর করতে পেরেছেন, যা তার রাজনৈতিক দক্ষতার প্রমাণ।
সমালোচকরাও স্বীকার করেন, ট্রাম্পের নাটকীয়তা প্রভাব ফেলেছিল। ২০২৫ সালের জুনে আমেরিকান হেরিটেজ সাময়িকীর এক জরিপে দশজন ইতিহাসবিদ তার সংবাদমাধ্যমবিরোধী লড়াইকে ‘বিপরীত ফলদায়ক’ বলেছেন।
জাতিসংঘে নিজেকে শান্তির দূত হিসেবে উপস্থাপন ছিল এক প্রকার নাটক, যেখানে তিনি ওবামাকে কটাক্ষ করে নিজেকে আলোচনায় আনেন। ট্রাম্পের ট্রুথ সোশ্যালের মন্তব্য এবং নোবেল শান্তি পুরস্কার নিয়ে তার ব্যঙ্গাত্মক উক্তি তাকে একজন স্বভাবজাত শোম্যান হিসেবে তুলে ধরে। তিনি আলোচনায় থাকতে ভালোবাসেন এবং কূটনীতিক কর্মকাণ্ডকেও নাটকীয় প্রদর্শনীতে পরিণত করেন।
তবে কেউ কেউ মনে করেন, তার অস্বাভাবিক ভঙ্গিতেও ফল এসেছে। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারির এক গবেষণায় বলা হয়, কার্যকারিতার দিক থেকে তিনি সাম্প্রতিক প্রেসিডেন্টদের চেয়ে এগিয়ে, যদিও তার কৌশল ছিল বিতর্কিত।
ইতিহাসবিদ নিকোল হেমার কার্নেগি ফোরামে এক বক্তৃতায় বলেন, ‘সব প্রেসিডেন্টই ব্লাইন্ড ডেট ছিল, কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প হয়তো একমাত্র ব্যতিক্রম।’ তার এ কথার অর্থ, আমেরিকানরা আগেই জানতেন তারা কেমন বিশৃঙ্খলায় প্রবেশ করছেন।
এই দৃষ্টিতে ট্রাম্পের রাজনৈতিক নাটক কেবল বিশৃঙ্খলা প্রকাশ করেনি, বরং সেটিকে বাড়িয়ে তুলেছে এবং স্থায়ী করেছে। তাই তার প্রেসিডেন্সি—যতই বিতর্কিত হোক—আধুনিক আমেরিকান ইতিহাসে অন্যতম নাটকীয় ও প্রভাবশালী অধ্যায় হিসেবে থেকে যাবে।
প্রভাবশালী কিন্তু বিশৃঙ্খল নেতা
২০২৫ সালের এপ্রিলে নিউইয়র্ক টাইমস-এর এক জরিপে ৩৫ জন ইতিহাসবিদের মতামত তুলে ধরা হয়। তাদের মতে, ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে ‘অভূতপূর্ব’ ছাপ রেখে যাবেন। তার অন্তত ২২টি পদক্ষেপ—যেমন যুদ্ধবিষয়ক বক্তৃতা বা সরকারি সংস্থার কাঠামোগত পরিবর্তন—পূর্ববর্তী কোনো প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তুলনীয় নয়। ফলে তাকে ‘অত্যন্ত প্রভাবশালী’, তবে গভীরভাবে বিভাজন সৃষ্টিকারী নেতা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
সামাজিক মাধ্যমের রাজনৈতিক ফোরামগুলোতেও এই ধারণা প্রতিফলিত হয়—পঞ্চাশ বছর পর ট্রাম্পকে হয়তো অ্যান্ড্রু জ্যাকসন ও রিচার্ড নিকসনের সংমিশ্রণ হিসেবে দেখা হবে। একদিকে তিনি জনগণমুখী সংস্কারক, যিনি এলিট শ্রেণিকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন; অন্যদিকে এমন নেতা, যিনি রাষ্ট্রীয় নিয়ম-কানুনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেন। তার পররাষ্ট্রনীতি, বিশেষত গাজা চুক্তির মতো পদক্ষেপগুলো টিকে থাকলে, তা তার ভাবমূর্তি আরও শক্তিশালী করতে পারে।
তাকে ইতিহাসে দেখা হবে এক পরিবর্তনের অনুঘটক হিসেবে—যিনি রিপাবলিকান পার্টিকে রূপান্তরিত করেছেন এক জনতুষ্টিবাদী শক্তিতে, উন্মোচন করেছেন মূলধারার গণমাধ্যমের পক্ষপাত এবং বাণিজ্য ও অভিবাসন ইস্যুতে জন্ম দিয়েছেন নতুন বিতর্কের। তবে এই রূপান্তরের মূল্যও ছিল বড়—রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি জনআস্থা গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
পঞ্চাশ বছর পর পাঠ্যপুস্তকে হয়তো ট্রাম্পকে কোনো একক চরিত্রে—নায়ক, খলনায়ক বা ভাঁড়—বেঁধে দেখা হবে না। বরং তিনি উপস্থাপিত হবেন একুশ শতকের আমেরিকার সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্বের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে—এমন এক মানুষ হিসেবে, যার ‘সব ভেঙে ফেলো’ মানসিকতা জাতির অর্ধেককে উচ্ছ্বসিত করেছিল, আর বাকি অর্ধেককে আতঙ্কিত করেছিল।
পিবিএস-এর ইতিহাসবিদ টিম নাফটালি এক পর্যালোচনায় ট্রাম্পের নেতৃত্বকে ‘আমেরিকার সহনশীলতার পরীক্ষা’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিষয়ক সাময়িকী আইআইএসএস-এর এক বিশ্লেষণে তার শাসনধারায় কর্তৃত্ববাদী প্রবণতার ইঙ্গিত পাওয়া গেলেও, সমালোচকরাও স্বীকার করেন—তার নীতিগত অস্থিরতা বাণিজ্য, অভিবাসন ও দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ নিয়ে নতুন ভাবনার সূচনা করেছে।
সার্বিকভাবে, ট্রাম্পের ইতিহাসকে একক কোনো কাঠামোয় ফেলা সম্ভব নয়। যদি গাজা শান্তি স্থায়ী হয় এবং তথাকথিত ‘সাত যুদ্ধ’ দীর্ঘস্থায়ী অস্ত্রবিরতিতে রূপ নেয়, তবে তিনি হয়তো নায়ক হিসেবে স্মরণীয় হবেন। আর যদি তা ভেঙে পড়ে অভ্যন্তরীণ সংকটে, তবে ‘দুষ্ট’ বা ‘বিদূষক’ ভাবমূর্তি প্রাধান্য পাবে।
আপাতত তিনি এই যুগের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু—কেউ তার সাহসের জন্য তাকে প্রশংসা করেন, কেউ আবার অহংকারের জন্য নিন্দা করেন। কিন্তু যেভাবেই হোক, তার গল্প প্রজন্মের পর প্রজন্ম ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তকে আলোচিত থাকবে। ইতিহাস তাদের পক্ষেই থাকে, যারা সময়ের ধারা বদলে দেয়—আর ট্রাম্প তা প্রবলভাবে করেছেন। এটি নায়কোচিত পুনর্গঠন, খলনায়কীয় ধ্বংসযজ্ঞ, নাকি এক ভাঁড়সুলভ প্রহসন—তা নির্ভর করবে গল্পটি কে লেখে তার ওপর।
তথ্যসূত্র: আল-জাজিরা, দ্য গার্ডিয়ান, নিউ ইয়র্ক টাইমস, দ্য কনভারসেশন, ফ্রি থিঙ্ক, হিস্টোরি নিউজ নেটওয়ার্ক
ইতিহাসে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভূমিকা কীভাবে মূল্যায়িত হবে তা নিয়ে মতভেদ আজও গভীর। তার দ্বিতীয় মেয়াদের সাহসী পররাষ্ট্রনীতির দাবিগুলো এই বিতর্ককে আরও তীব্র করেছে। ট্রাম্প দাবি করছেন, তিনি ‘সাতটি অনন্ত যুদ্ধ’ থামিয়েছেন এবং গাজায় যুদ্ধবিরতি এনেছেন। সমর্থকদের কাছে তিনি এক শান্তিদূত, কিন্তু সমালোচকদের চোখে তার এসব সাফল্য অতিরঞ্জিত ও অস্থায়ী। ফলে তার উত্তরাধিকার নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়—তিনি কি আমেরিকার স্বার্থে বিশ্বকে বাঁকানো এক নায়ক, গণতন্ত্রকে দুর্বল করা এক খলনায়ক, নাকি নাটকীয় কৌতুকের আড়ালে বিশৃঙ্খলা তৈরি করা এক ভাঁড়?
ইতিহাসে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে এককভাবে খলনায়ক, ভাঁড়, নায়ক হিসেবে চিহ্নিত করা কঠিন হবে। এমন সরল বর্ণনা তার মতো বিভাজনসৃষ্টিকারী ও প্রভাবশালী নেতার জন্য যথেষ্ট নয়। ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ গবেষক ও জনমতের মূল্যায়নে দেখা যাচ্ছে, ট্রাম্পকে সম্ভবত ‘গণতন্ত্রের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত সৃষ্টিকারী’ হিসেবেই মনে রাখা হবে। তিনি প্রচলিত রাজনৈতিক রীতি ভেঙে দিয়েছেন, জনতুষ্টিবাদী রাজনীতির উত্থান ত্বরান্বিত করেছেন এবং আমেরিকার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর গভীর ছাপ ফেলেছেন—যা ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুদিকই আছে।
তার উত্তরাধিকার এখনো গড়ে উঠছে দ্বিতীয় মেয়াদের মধ্যে, তবে প্রাথমিক ইঙ্গিত বলছে—তিনি এমন এক জটিল ব্যক্তিত্ব, যাকে সহজে কোনো শ্রেণিতে ফেলা সম্ভব নয়। ইতিহাসবিদদের সাম্প্রতিক মূল্যায়ন বলছে, তিনি সম্ভবত এ তিনটির মিশ্র প্রতিচ্ছবি—এক বিভাজনসৃষ্টিকারী নেতা, যিনি দেশ ও বিশ্বের রাজনৈতিক মানদণ্ড বদলে দিয়েছেন। গবেষকদের সাম্প্রতিক জরিপ ও বিশ্লেষণ আরও দেখায় তিনি একজন ‘অত্যন্ত ফলপ্রসূ’ বিঘ্ন সৃষ্টিকারী। অর্থাৎ, তার প্রভাব গভীর এবং যুগান্তকারীভাবে ছড়িয়ে পড়েছে।
‘নায়ক’ ধারণা: শান্তির দূত ও চুক্তিকারী নেতা
ট্রাম্পের সমর্থকদের মতে, তিনি স্থিতিশীলতার একক শক্তি। তার ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ কূটনীতি এমন সাফল্য এনে দিয়েছে, যা তাঁর পূর্বসূরিদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। গত ২৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে দেওয়া ভাষণে ট্রাম্প দাবি করেন, তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদে তিনি ৭ মাসে ৭টি যুদ্ধ বন্ধ করেছেন—এর সঙ্গে আগের মেয়াদের একটিও রয়েছে।
যদিও তথ্য যাচাইকারীরা বলছেন, এসব যুদ্ধ পুরোপুরি শেষ হয়নি এবং অনেক অগ্রগতি ট্রাম্পের আগে থেকেই শুরু হয়েছিল, তবুও তার সরকারের সক্রিয় কূটনীতি কয়েকটি সংঘাত শীতল করেছে। ভয় দেখানো, প্রণোদনা দেওয়া এবং গোপন সমঝোতা—এই সব কৌশলের মিশ্র প্রয়োগ তাকে কিছু বাস্তব সাফল্য এনে দিয়েছে। বাস্তববাদী কূটনীতিকরা তাকে মতাদর্শী নয়, বরং ফলমুখী মধ্যস্থতাকারী হিসেবে দেখছেন।
তাঁর সমর্থকদের ও কিছু বিশ্লেষকের কাছে ডোনাল্ড ট্রাম্প এক নেতা, যিনি শ্রমজীবী শ্রেণি ও জাতীয় সার্বভৌমত্বের রক্ষক হিসেবে ইতিহাসে টিকে থাকবেন। তাদের মতে, কোভিড-১৯ মহামারীর আগেই তিনি করছাড় ও ব্যবসাবান্ধব নীতির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি পুনরুজ্জীবিত করেন। মধ্যপ্রাচ্যে আব্রাহাম চুক্তি সম্পাদন এবং বৈশ্বিক বাণিজ্যচুক্তিগুলোর বিরুদ্ধে অবস্থান—যেগুলোকে অনেকে আমেরিকান শ্রমিকদের জন্য ক্ষতিকর মনে করতেন—তাকেও বড় কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সাফল্য হিসেবে দেখা হয়।
২০২৪ সালে তার অবিশ্বাস্য রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তন—বিচারিক মামলা ও গণমাধ্যমের তীব্র সমালোচনার মধ্যেও পুনর্নির্বাচিত হওয়া—ইতিমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে অন্যতম বড় পুনরুত্থান হিসেবে বিবেচিত। সমর্থকদের কাছে এটি ‘ডিপ স্টেট’ বা প্রতিষ্ঠিত অভিজাত মহলের বিরুদ্ধে এক দৃঢ় প্রতিরোধের প্রতীক।
ট্রাম্পপন্থীদের দাবি, তিনি ইতিহাসে আব্রাহাম লিংকনের সমকক্ষ হয়ে উঠবেন। তাদের মতে, ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির আওতায় সীমান্ত নিরাপত্তা ও জ্বালানি স্বনির্ভরতার মতো পদক্ষেপ জাতীয় গৌরব ও অর্থনৈতিক শক্তি ফিরিয়ে এনেছে।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে ২০২৫ সালে তার প্রশাসনিক পদক্ষেপ—ফেডারেল সংস্থাগুলো পুনর্গঠন ও ইতিহাস-ভিত্তিক সাংস্কৃতিক আখ্যান পুনর্লিখনের প্রচেষ্টা—তাকে এক সংস্কারক হিসেবে উপস্থাপন করে, যিনি দীর্ঘদিনের আমলাতান্ত্রিক কাঠামো ভেঙে নতুন ধারা তৈরি করছেন।
ট্রাম্পের ভাবমূর্তি আরও শক্ত হয় গাজা যুদ্ধবিরতির পর। ট্রাম্প একে ‘পূর্ণ বিজয়’ বলে ঘোষণা দেন এবং দাবি করেন, এটি বৃহত্তর আঞ্চলিক যুদ্ধ ঠেকিয়েছে। সমর্থকরা, এমনকি কিছু মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষকও, তার কঠোর ভাষা ও সমঝোতার কৌশলকে প্রশংসা করছেন। তারা মনে করেন, এ চুক্তিই হয়তো তাকে বহুদিনের আকাঙ্ক্ষিত নোবেল শান্তি পুরস্কারের দৌড়ে তুলতে পারে।
প্রথম মেয়াদের আব্রাহাম চুক্তি ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন যুক্ত হলে ‘নায়ক’ বর্ণনাটি আরও স্পষ্ট হয়—শক্তির মাধ্যমে শান্তি আনা এক নেতা, যিনি বুশ বা ওবামার মতো ‘অন্তহীন যুদ্ধ’-র উত্তরাধিকার ভেঙে দিয়েছেন।
‘খলনায়ক’ দৃষ্টিভঙ্গি: অতিরঞ্জন ও বিভাজনের প্রতীক
সমালোচকরা, বিশেষ করে ইতিহাসবিদ ও বিশ্লেষকরা, ট্রাম্পকে এক অন্ধকার চিত্রে দেখেন। তাঁদের মতে, ট্রাম্প এমন একজন জনতুষ্টিবাদী নেতা, যার আত্মকেন্দ্রিক নেতৃত্ব গণতন্ত্রের নিরাপত্তাব্যূহ দুর্বল করেছে এবং দেশকে গভীর বিভাজনের দিকে ঠেলে দিয়েছে। ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারির ক্যাপিটল দাঙ্গা তার নির্বাচনী প্রক্রিয়া দুর্বল করার প্রবণতার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক ইতিহাসবিদের মতে, ভবিষ্যতের বইগুলোতে ট্রাম্পকে হয়তো এমন এক প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখা হবে, যিনি আমেরিকার গণতন্ত্রকে অস্তিত্ব সংকটে ফেলেছিলেন। এমনকি কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, যদি স্বৈরশাসনের ধারা চলতে থাকে, তিনি হতে পারেন গণতান্ত্রিক যুক্তরাষ্ট্রের ‘শেষ প্রেসিডেন্ট’।
তার বিরুদ্ধে আইনি দণ্ড, বর্ণবাদী ও অভিবাসন নিয়ে উস্কানিমূলক বক্তব্য, এবং করোনা মহামারীতে ব্যর্থতা—সবকিছু মিলিয়ে সমালোচকরা তাকে অদক্ষ ও বিদ্বেষপূর্ণ নেতা হিসেবে দেখেন। তাদের মতে, তার শাসনামল ছিল ‘অরাজকতার প্রদর্শনী।’ বিরোধীদের মতে, ট্রাম্পের নামে কোনো স্মৃতিসৌধ বা বিদ্যালয় গড়ে উঠবে না। তার উত্তরাধিকার হবে ‘অচল গলি ও আবর্জনার স্তূপের মতো’—এক সতর্কবার্তা, যা জানিয়ে দেবে কীভাবে এক ব্যক্তিপূজার রাজনীতি দুর্নীতি ও বিশৃঙ্খলার প্রতীক হতে পারে।
সমালোচকরা আরও বলেন, ট্রাম্পের বড়াই করা কথাগুলোও আসলে অসম্পূর্ণ বা অস্থায়ী সাফল্যকে আড়াল করার জন্য। তার আচরণ যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব ও প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আস্থা নষ্ট করেছে। যুদ্ধ বন্ধের দাবি নিয়ে সংবাদমাধ্যমগুলো, যেমন এপি ও নিউইয়র্ক টাইমস, ট্রাম্পের বক্তব্যকে ‘ভুল’ বলে উল্লেখ করেছে। তারা বলে, এটি ট্রাম্পের স্বভাবসিদ্ধ অতিরঞ্জন—নিজেকে বড় করে দেখানো, কিন্তু টেকসই কূটনীতি উপেক্ষা করা। এতে ভবিষ্যতে চুক্তিগুলো ভেঙে পড়লে যুক্তরাষ্ট্রই ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
গাজার চুক্তিও এই ঝুঁকির প্রতিফলন। প্রথম ধাপ কার্যকর হলেও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, হামাস আবার অস্ত্র নিলে অভিযান শুরু হবে। দীর্ঘমেয়াদে নিরস্ত্রীকরণের বিষয়টি এখনো অনির্দিষ্ট। বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, এটি হয়তো কাগজে-কলমে থাকা এক ‘ভঙ্গুর শান্তি’।
২০২৫ সালের মার্চে কার্নেগি প্যানেলে ইতিহাসবিদরা ট্রাম্পের মেয়াদকে বিভেদমূলক বলে আখ্যা দেন। তারা তার সংকট-ব্যবস্থাপনাকে আব্রাহাম লিংকনের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রু জনসনের ব্যর্থতার সঙ্গে তুলনা করেন। দ্য গার্ডিয়ানের এক মতামতে বলা হয়, ট্রাম্পের উত্তরাধিকার ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সতর্ক করবে—এক নেতার গল্প হিসেবে, যিনি বিভাজন উসকে দিয়েছেন এবং গণতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন। এ দৃষ্টিভঙ্গিতে, তিনি নায়ক নন—গণতন্ত্রের বিনিময়ে অর্জিত এক খলনায়ক।
নিউইয়র্ক টাইমসের ইতিহাসবিদ জরিপে একজন বিশেষজ্ঞ মন্তব্য করেছেন, ট্রাম্পের ‘সাফল্য’ শুধু স্বৈরতন্ত্রের ছদ্মবেশ। নিউ রিপাবলিকের মাইকেল টোমাসকি সতর্ক করেছেন, ‘এটি ফ্যাসিবাদ এবং কোটি মানুষ এটি দেখছেন’, যা ‘প্রকল্প ২০২৫’ গ্রহণ এবং মিডিয়ায় আক্রমণের সঙ্গে যুক্ত।
‘ভাঁড়’ চিত্র: নেতা নয়, কৃতিত্ব জাহিরকারী
ট্রাম্পকে আরও একভাবে দেখা হয়—বিনোদনমূলক রাজনীতির ভাঁড় হিসেবে। রিয়ালিটি-টিভি শো-এর মতো তার বড়াই ও টুইটগুলো ওভাল অফিসকে একটি সার্কাসে পরিণত করেছে। এর ফলে পদটির গুরুত্ব হ্রাস পেয়েছে, কিন্তু সাধারণ মানুষ তাকে আগ্রহের সঙ্গে দেখেছে। প্রেসিডেন্টদের মধ্যে তার ‘ইতিহাসে নিজের স্থান’ নিয়ে আগ্রহ অনন্য। এটি প্রায়শই আত্মগৌরবপূর্ণ প্রদর্শন হিসেবে প্রকাশ পায়, যা নীতিনির্ধারণের বিষয়কে ছাপিয়ে যায়।
২০২৫ সালের কিছু পদক্ষেপের সমালোচনাতেও এই ‘ভাঁড়’ চিত্র দেখা যায়—সাংস্কৃতিক যুদ্ধ নিয়ে নির্বাহী আদেশগুলোকে অনেকেই নাটকীয় বিশৃঙ্খলা বলে উপেক্ষা করেছেন। তবে তার মিডিয়া কৌশল অকেজো ছিল না। ট্রাম্প তার প্রতি সমালোচনাকে নিজের নির্বাচনী সাফল্যে রূপান্তর করতে পেরেছেন, যা তার রাজনৈতিক দক্ষতার প্রমাণ।
সমালোচকরাও স্বীকার করেন, ট্রাম্পের নাটকীয়তা প্রভাব ফেলেছিল। ২০২৫ সালের জুনে আমেরিকান হেরিটেজ সাময়িকীর এক জরিপে দশজন ইতিহাসবিদ তার সংবাদমাধ্যমবিরোধী লড়াইকে ‘বিপরীত ফলদায়ক’ বলেছেন।
জাতিসংঘে নিজেকে শান্তির দূত হিসেবে উপস্থাপন ছিল এক প্রকার নাটক, যেখানে তিনি ওবামাকে কটাক্ষ করে নিজেকে আলোচনায় আনেন। ট্রাম্পের ট্রুথ সোশ্যালের মন্তব্য এবং নোবেল শান্তি পুরস্কার নিয়ে তার ব্যঙ্গাত্মক উক্তি তাকে একজন স্বভাবজাত শোম্যান হিসেবে তুলে ধরে। তিনি আলোচনায় থাকতে ভালোবাসেন এবং কূটনীতিক কর্মকাণ্ডকেও নাটকীয় প্রদর্শনীতে পরিণত করেন।
তবে কেউ কেউ মনে করেন, তার অস্বাভাবিক ভঙ্গিতেও ফল এসেছে। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারির এক গবেষণায় বলা হয়, কার্যকারিতার দিক থেকে তিনি সাম্প্রতিক প্রেসিডেন্টদের চেয়ে এগিয়ে, যদিও তার কৌশল ছিল বিতর্কিত।
ইতিহাসবিদ নিকোল হেমার কার্নেগি ফোরামে এক বক্তৃতায় বলেন, ‘সব প্রেসিডেন্টই ব্লাইন্ড ডেট ছিল, কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প হয়তো একমাত্র ব্যতিক্রম।’ তার এ কথার অর্থ, আমেরিকানরা আগেই জানতেন তারা কেমন বিশৃঙ্খলায় প্রবেশ করছেন।
এই দৃষ্টিতে ট্রাম্পের রাজনৈতিক নাটক কেবল বিশৃঙ্খলা প্রকাশ করেনি, বরং সেটিকে বাড়িয়ে তুলেছে এবং স্থায়ী করেছে। তাই তার প্রেসিডেন্সি—যতই বিতর্কিত হোক—আধুনিক আমেরিকান ইতিহাসে অন্যতম নাটকীয় ও প্রভাবশালী অধ্যায় হিসেবে থেকে যাবে।
প্রভাবশালী কিন্তু বিশৃঙ্খল নেতা
২০২৫ সালের এপ্রিলে নিউইয়র্ক টাইমস-এর এক জরিপে ৩৫ জন ইতিহাসবিদের মতামত তুলে ধরা হয়। তাদের মতে, ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে ‘অভূতপূর্ব’ ছাপ রেখে যাবেন। তার অন্তত ২২টি পদক্ষেপ—যেমন যুদ্ধবিষয়ক বক্তৃতা বা সরকারি সংস্থার কাঠামোগত পরিবর্তন—পূর্ববর্তী কোনো প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তুলনীয় নয়। ফলে তাকে ‘অত্যন্ত প্রভাবশালী’, তবে গভীরভাবে বিভাজন সৃষ্টিকারী নেতা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
সামাজিক মাধ্যমের রাজনৈতিক ফোরামগুলোতেও এই ধারণা প্রতিফলিত হয়—পঞ্চাশ বছর পর ট্রাম্পকে হয়তো অ্যান্ড্রু জ্যাকসন ও রিচার্ড নিকসনের সংমিশ্রণ হিসেবে দেখা হবে। একদিকে তিনি জনগণমুখী সংস্কারক, যিনি এলিট শ্রেণিকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন; অন্যদিকে এমন নেতা, যিনি রাষ্ট্রীয় নিয়ম-কানুনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেন। তার পররাষ্ট্রনীতি, বিশেষত গাজা চুক্তির মতো পদক্ষেপগুলো টিকে থাকলে, তা তার ভাবমূর্তি আরও শক্তিশালী করতে পারে।
তাকে ইতিহাসে দেখা হবে এক পরিবর্তনের অনুঘটক হিসেবে—যিনি রিপাবলিকান পার্টিকে রূপান্তরিত করেছেন এক জনতুষ্টিবাদী শক্তিতে, উন্মোচন করেছেন মূলধারার গণমাধ্যমের পক্ষপাত এবং বাণিজ্য ও অভিবাসন ইস্যুতে জন্ম দিয়েছেন নতুন বিতর্কের। তবে এই রূপান্তরের মূল্যও ছিল বড়—রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি জনআস্থা গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
পঞ্চাশ বছর পর পাঠ্যপুস্তকে হয়তো ট্রাম্পকে কোনো একক চরিত্রে—নায়ক, খলনায়ক বা ভাঁড়—বেঁধে দেখা হবে না। বরং তিনি উপস্থাপিত হবেন একুশ শতকের আমেরিকার সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্বের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে—এমন এক মানুষ হিসেবে, যার ‘সব ভেঙে ফেলো’ মানসিকতা জাতির অর্ধেককে উচ্ছ্বসিত করেছিল, আর বাকি অর্ধেককে আতঙ্কিত করেছিল।
পিবিএস-এর ইতিহাসবিদ টিম নাফটালি এক পর্যালোচনায় ট্রাম্পের নেতৃত্বকে ‘আমেরিকার সহনশীলতার পরীক্ষা’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিষয়ক সাময়িকী আইআইএসএস-এর এক বিশ্লেষণে তার শাসনধারায় কর্তৃত্ববাদী প্রবণতার ইঙ্গিত পাওয়া গেলেও, সমালোচকরাও স্বীকার করেন—তার নীতিগত অস্থিরতা বাণিজ্য, অভিবাসন ও দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ নিয়ে নতুন ভাবনার সূচনা করেছে।
সার্বিকভাবে, ট্রাম্পের ইতিহাসকে একক কোনো কাঠামোয় ফেলা সম্ভব নয়। যদি গাজা শান্তি স্থায়ী হয় এবং তথাকথিত ‘সাত যুদ্ধ’ দীর্ঘস্থায়ী অস্ত্রবিরতিতে রূপ নেয়, তবে তিনি হয়তো নায়ক হিসেবে স্মরণীয় হবেন। আর যদি তা ভেঙে পড়ে অভ্যন্তরীণ সংকটে, তবে ‘দুষ্ট’ বা ‘বিদূষক’ ভাবমূর্তি প্রাধান্য পাবে।
আপাতত তিনি এই যুগের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু—কেউ তার সাহসের জন্য তাকে প্রশংসা করেন, কেউ আবার অহংকারের জন্য নিন্দা করেন। কিন্তু যেভাবেই হোক, তার গল্প প্রজন্মের পর প্রজন্ম ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তকে আলোচিত থাকবে। ইতিহাস তাদের পক্ষেই থাকে, যারা সময়ের ধারা বদলে দেয়—আর ট্রাম্প তা প্রবলভাবে করেছেন। এটি নায়কোচিত পুনর্গঠন, খলনায়কীয় ধ্বংসযজ্ঞ, নাকি এক ভাঁড়সুলভ প্রহসন—তা নির্ভর করবে গল্পটি কে লেখে তার ওপর।
তথ্যসূত্র: আল-জাজিরা, দ্য গার্ডিয়ান, নিউ ইয়র্ক টাইমস, দ্য কনভারসেশন, ফ্রি থিঙ্ক, হিস্টোরি নিউজ নেটওয়ার্ক
মতানৈক্যের কারণে রাজনৈতিক দলের জুলাই সনদে স্বাক্ষর না করার বিষয়টি দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য সংকট তৈরি করতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
১৬ ঘণ্টা আগেইংল্যান্ডের ম্যাগনা কার্টা থেকে শুরু করে নেপালের শান্তি প্রক্রিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকার ফ্রিডম চার্টার, স্পেনের মোনক্লোয়া চুক্তি ও চিলির কনসারটাসিওন—প্রতিটিই নিজ নিজ প্রেক্ষাপটে ঐক্যের প্রতীক হয়ে উঠেছিল। তবে এই চুক্তিগুলো যেমন ঐকমত্যের নজির স্থাপন করেছে, তেমনি বিভেদ ও আপত্তির ইতিহাসও কম নয়।
১৭ ঘণ্টা আগে২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত ও রাষ্ট্র সংস্কারের আকাঙ্ক্ষা থেকে জন্ম নেয় ‘জুলাই সনদ’।
১ দিন আগে১৯৩৮ সালে মহাত্মা গান্ধী লিখেছিলেন, ‘ফিলিস্তিন ফিলিস্তিনিদেরই ভূমি; ইহুদিদের সেখানে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কোনো নৈতিক অধিকার নেই।’ সাত দশক পর, সেই একই ভূমিতে দাঁড়িয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুকে আলিঙ্গন করে বলেছিলেন, ‘ইসরায়েল আমাদের সত্যিকারের বন্ধু।
২ দিন আগে