বর্তমানে মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্বের জন্য তিনটি প্রধান মডেল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। এগুলো হলো সৌদি, তুর্কি ও ইরানি মডেল। আরেকটি এশীয় মডেল রয়েছে— ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার। তবে সম্প্রতি ‘তুরস্ক যুগ’ কথাটি আলোচনায় গুরুত্ব পাচ্ছে। এর মাধ্যমে বোঝানো হচ্ছে প্রেসিডেন্ট রেসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের সেই ভিশন, যেখানে তুরস্ককে এক সভ্যতার নেতা হিসেবে দেখা হয়। তাঁর কৌশল তিনটি মূল উপাদানের মিশ্রণ— সুন্নি ইসলামপন্থা, জাতীয়তাবাদ ও অর্থনৈতিক বাস্তববাদ।
মাহবুবুল আলম তারেক
মুসলিম দেশগুলোর ভূরাজনীতি বলতে বোঝানো হয় আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনীতিতে দেশগুলোর শক্তির ভারসাম্য, জোট, দ্বন্দ্ব ও কৌশলগত সম্পর্কের সামগ্রিক কাঠামো। এ দেশগুলোতে ইসলাম প্রধান ধর্ম বা শাসনব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক। ইন্দোনেশিয়া থেকে মরোক্কো পর্যন্ত ৫০টির বেশি মুসলিম-অধ্যুষিত দেশ এর মধ্যে পড়ে। তবে এটিকে একক কোনো মডেল বলা যায় না। বরং মুসলিম দেশগুলোর ভূরাজনীতি ভাঙনের বৈশিষ্ট্যে গঠিত। রয়েছে ভাঙনের নানা কারণ। যেমন— সাম্প্রদায়িক বিভাজন, ইসলামি উম্মাহর নেতৃত্ব দখলের প্রতিযোগিতা, প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ন্ত্রণ ও বহিরাগত শক্তির হস্তক্ষেপ।
ইতিহাসের উত্তরাধিকারও এখানে প্রভাব ফেলেছে। সুন্নি-শিয়া বিভাজন এবং ঔপনিবেশিক শাসনের অভিজ্ঞতা আজও রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে। আধুনিক যুগে তেল সম্পদ, ধর্মীয় প্রভাবশক্তি ও জলবায়ু সংকটও এই ভূরাজনীতিকে গড়ে তোলে। ফলে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের পাশাপাশি এর বৈশ্বিক প্রভাবও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
বৈশ্বিক মুসলিম সমাজে কোনো একক শক্তির পূর্ণ আধিপত্য নেই। বরং এখানে প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা চলছে। সৌদি আরব ছড়াচ্ছে তার ওহাবি মডেল, ইরান প্রচার করছে শিয়া বিপ্লবী আদর্শ আর তুরস্ক এগিয়ে নিচ্ছে নব্য-উসমানীয় পুনর্জাগরণের ধারণা।
এই বিভক্ত প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি ‘তুরস্ক যুগ’ কথাটি আলোচনায় গুরুত্ব পাচ্ছে। এর মাধ্যমে বোঝানো হচ্ছে প্রেসিডেন্ট রেসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের সেই ভিশন, যেখানে তুরস্ককে এক সভ্যতার নেতা হিসেবে দেখা হয়। তাঁর কৌশল তিনটি মূল উপাদানের মিশ্রণ— সুন্নি ইসলামপন্থা, জাতীয়তাবাদ ও অর্থনৈতিক বাস্তববাদ। এই মডেলের লক্ষ্য হলো উসমানীয় আমলের বৈশ্বিক প্রভাব ফিরিয়ে আনা —শুধু মধ্যপ্রাচ্যেই নয়, মধ্য এশিয়া এবং এর বাইরেও। যেমন বাংলাদেশে।
ঐতিহাসিক পটভূমি
মুসলিম দেশগুলোর বর্তমান ভূরাজনীতির শিকড় ইসলামের শুরুর যুগে প্রোথিত। হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মৃত্যুর পর নেতৃত্ব নিয়ে বড় ধরনের বিরোধ দেখা দেয়। এই বিরোধ থেকেই সুন্নি-শিয়া বিভাজনের সূচনা হয়। সুন্নিরা (আজকের মুসলিম জনসংখ্যার প্রায় ৮৫–৯০ শতাংশ) নির্বাচিত খলিফাদের সমর্থন করে। তাঁদের মতে, আবু বকর ছিলেন সঠিক উত্তরসূরি। অন্যদিকে শিয়ারা মনে করে, নবীর রক্তসূত্র ধরে নেতৃত্ব আসা উচিত। তাই তারা নবীর চাচাতো ভাই এবং জামাতা হযরত আলীকে বৈধ উত্তরসূরি মনে করে। এই বিভাজন মুসলিম বিশ্বের প্রথম দিকেই গৃহযুদ্ধ সৃষ্টি করে। ৬৮০ খ্রিষ্টাব্দে কারবালার যুদ্ধ সেই দ্বন্দ্বকে গভীর করে তোলে।
পরবর্তী শতকগুলোতে মুসলিম সাম্রাজ্য দ্রুত বিস্তৃত হয়। আব্বাসীয় খিলাফত (৭৫০–১২৫৮) এবং উসমানীয় সাম্রাজ্য (১২৯৯–১৯২২) তিনটি মহাদেশজুড়ে বিস্তার লাভ করে। জয়যাত্রা, বাণিজ্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধি ইসলামি সভ্যতাকে শক্তিশালী করে তোলে। তবে একই সঙ্গে বিভক্তিও তৈরি হয়। আব্বাসীয়, উমাইয়া ও ফাতিমীয়দের মতো প্রতিদ্বন্দ্বী খেলাফতের উত্থান মুসলিম বিশ্বের অভ্যন্তরীণ প্রতিযোগিতাকে দীর্ঘস্থায়ী করে।
উনিশ ও বিশ শতকে ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো মুসলিম বিশ্বে নতুন সীমানা টেনে দেয়। এতে কৃত্রিম রাষ্ট্রের জন্ম হয়। দুর্বল হয়ে পড়ে বৈশ্বিক-ইসলামি ঐক্যের ধারণা। স্বাধীনতার পর অনেক নেতা আরব জাতীয়তাবাদ বা ধর্মনিরপেক্ষতাকে অগ্রাধিকার দেন। কিন্তু প্যান-অ্যারাবিজম বা আরব ঐক্যের মতো আদর্শ ভেঙে পড়লে আবারও রাজনীতিতে বৈশ্বিক ইসলামের প্রভাব বাড়তে থাকে।
১৯৭৯ সালের ইরানি বিপ্লব বিশাল এক মোড় ঘোরানো ঘটনা। এর মধ্য দিয়ে নতুন বিপ্লবী শিয়া ধর্মভিত্তিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি সুন্নি-প্রধান রাষ্ট্রগুলোর জন্য সরাসরি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। এর ফলে সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব আরও তীব্র হয়। ভূগোল ও পরিবেশও মুসলিম দেশগুলোর রাজনীতিতে বড় ভূমিকা রেখেছে। মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা ও মধ্য এশিয়ার বহু অঞ্চল শুষ্ক ও সম্পদ-স্বল্প। এতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সীমিত থাকে। তুলনায় ইউরোপের নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া অনেক সুবিধাজনক।
এই পরিবেশগত বৈষম্য মুসলিম বিশ্বের পতনকে ত্বরান্বিত করে। মধ্যযুগের পর ইউরোপীয় শক্তিগুলো সমুদ্রপথ আবিষ্কার করে মুসলিম বাণিজ্যপথ এড়িয়ে যায়। ভাস্কো দা গামার সমুদ্রপথ আবিষ্কার এর বড় উদাহরণ। ফলে মুসলিম বিশ্ব বাণিজ্য ও শিল্পায়নে পিছিয়ে পড়ে। পশ্চিমা ঔপনিবেশিক শাসনও এই অঞ্চলের অর্থনীতি দুর্বল করে দেয়। প্রাকৃতিক সম্পদ-স্বল্প অঞ্চলগুলোতে উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। আজ জলবায়ু পরিবর্তন নতুন করে সেই সংকটকে বাড়িয়ে তুলছে। বিশেষ করে শুষ্ক অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা আরও প্রকট হয়ে উঠছে।
মুসলিম বিশ্বে সুন্নি-শিয়া বিভাজন সবচেয়ে বড় ফাটল। এটি নানা প্রক্সি যুদ্ধ ও আঞ্চলিক জোটে প্রকাশ পায়। সৌদি আরব, তুরস্ক, মিশর ও পাকিস্তানের মতো দেশে সুন্নিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। অন্যদিকে ইরান, ইরাক, আজারবাইজান ও বাহরাইনে শিয়ারা প্রভাবশালী। ১৯৮০-র দশক থেকে এই বিভাজন আরও তীব্র হয়। সৌদি আরব ছড়িয়ে দেয় ওহাবি মতবাদ, যা এক ধরনের কট্টর সুন্নি ইসলাম। এর লক্ষ্য ছিল ইরানের শিয়া বিপ্লবী আদর্শের মোকাবিলা করা। কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ দেখা যাক।
সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ: ইরান সমর্থন করে শিয়াপন্থী আলাবি শিয়া নেতা বাশার আল-আসাদের সরকারকে। বিপরীতে সুন্নি বিদ্রোহীদের পাশে দাঁড়ায় সৌদি আরব, তুরস্ক ও কাতার। সুন্নিরা আসাদকে উৎখাত করে।
ইয়েমেন সংঘাত: সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট লড়ছে ইরান-সমর্থিত হুথি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে। হুথিরা হলো জায়েদি শিয়া সম্প্রদায়ের অনুসারী।
ইরাকের অস্থিতিশীলতা: ২০০৩ সালে মার্কিন আক্রমণের পর শিয়াদের শক্তি বেড়ে যায়। এতে অসন্তুষ্ট সুন্নিরা বিদ্রোহ শুরু করে। সেখান থেকেই উত্থান ঘটে আইএসআইএস-এর মতো সংগঠনের।
তবে বিভাজন শুধু সুন্নি-শিয়া পর্যায়েই সীমাবদ্ধ নয়। সুন্নিদের মধ্যেও মতভেদ আছে। উদাহরণস্বরূপ মধ্যপন্থী বনাম কট্টর ইসলামপন্থী গোষ্ঠী। কাতার ও তুরস্ক মুসলিম ব্রাদারহুডকে সমর্থন করে। কিন্তু সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত এই সংগঠনের বিরোধিতা করে। মুসলিম বিশ্বের আরেকটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো অভ্যন্তরীণ সহিংসতা। এখানে নাগরিক যুদ্ধ, অ-রাষ্ট্রীয় সংঘাত ও একতরফা হামলা বেশি ঘটে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এগুলো ইসলামের নামে বা ইসলামপন্থী দাবিতে পরিচালিত হয়। আইএসআইএস-এর মতো গোষ্ঠীগুলো বহু ফ্রন্টে যুদ্ধ করেছে। তারা এই বিভাজনগুলোকেই কাজে লাগিয়েছে নিজেদের বিস্তারের জন্য।
ইসলাম এমন এক পরিবেশ যেখানে নানা ধরনের রাজনৈতিক ধারণা, তত্ত্ব ও অনুশীলন গড়ে ওঠে। এই ধর্ম সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ধারাবাহিকভাবে সক্রিয় সৃজনশীলতার উৎস। এই সৃজনশীলতাই প্রতিযোগিতা তৈরি করে। বর্তমানে মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্বের জন্য তিনটি প্রধান মডেল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। এগুলো হলো সৌদি, তুর্কি ও ইরানি মডেল। আরেকটি এশীয় মডেল রয়েছে— ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার। তবে এর প্রভাব সরাসরি মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে নেই।
মধ্যপ্রাচ্যের চলমান সংকটকে এই প্রতিযোগিতার আলোকে দেখা হলে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়। তুর্কি মডেল ধীরে ধীরে সৌদি ও ইরানি মডেলের তুলনায় এগিয়ে যাচ্ছে। তারা আরব অঞ্চলসহ মুসলিম বিশ্বে প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় রয়েছে, তবে সরাসরি যুদ্ধে জড়ায়নি। সৌদি আরব ইরানের মোকাবিলায় তুরস্ককে মিত্র করতে চায়। কিন্তু তুরস্কের প্রভাবশালী অবস্থানও মেনে নিতে চায় না।
সৌদি মডেল (সুন্নি-ওহাবি): এর আদর্শ ওহাবি মতবাদ, কঠোর সুন্নি ইসলাম ও মক্কা-মদিনার অভিভাবকত্ব। কৌশল ও শক্তির জায়গা— তেলের অর্থব্যবহার করে ধর্ম প্রচার, জিসিসি-র মতো আঞ্চলিক জোট, বিদেশে বৃত্তি ও মসজিদের মাধ্যমে সফট পাওয়ার বিস্তার। ওআইসি-র নেতৃত্ব। চ্যালেঞ্জ ও দুর্বলতা— মোহাম্মদ বিন সালমানের সংস্কার ওহাবি মতাদর্শের আকর্ষণ কমিয়ে দিয়েছে। ইসরায়েলের সঙ্গে আব্রাহাম চুক্তিকে অনেক মুসলিম বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে দেখে। কাতারের সঙ্গেও তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা রয়েছে।
ইরানি মডেল (শিয়া-বিপ্লবী): আদর্শ— শিয়া ইসলাম, ‘ফকিহদের শাসন’ তত্ত্ব, সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতা। হিজবুল্লাহ ও হুথির মতো গোষ্ঠীকে সমর্থন। কৌশল ও শক্তি— প্রক্সির মাধ্যমে বিপ্লব ছড়ানো। ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে শিয়া-সুন্নি বিভাজনকে পেরোনোর চেষ্টা। চ্যালেঞ্জ ও দুর্বলতা— অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞায় বিচ্ছিন্ন। সিরিয়ায় আসাদ সরকারের পতন হলে প্রভাবও কমে যায়। সিরিয়ায় তুরস্ক শক্তিশালী হয়েছে। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ‘পবিত্র যুদ্ধ’ ধারণাকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে ব্যর্থ।
তুর্কি মডেল (নব্য-উসমানীয়/মডারেট সুন্নি ইসলামপন্থী): আদর্শ— সুন্নি ইসলাম ও জাতীয়তাবাদী পুনর্জাগরণ। মুসলিম পবিত্র স্থান রক্ষা ও নতুনভাবে গড়ে তোলা ইসলামপন্থা। কৌশল ও শক্তি— রাজনৈতিক ও তথ্যপ্রবাহে প্রভাব বিস্তার। মুসলিম ব্রাদারহুডকে সমর্থন। সিরিয়ায় আসাদের পতনের পর লাভবান হওয়া এবং সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার সমাধান হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন। দ্বৈত ইসলামি-জাতীয়তাবাদী কৌশল। চ্যালেঞ্জ ও দুর্বলতা— সম্প্রসারণবাদী বলে অভিযুক্ত। ইরাক ও সিরিয়া নিয়ে ইরানের সঙ্গে টানাপোড়েন। মধ্য এশিয়ায় অতিরিক্ত প্রভাব বিস্তারের ঝুঁকি।
যুক্তরাষ্ট্র: ঐতিহাসিকভাবে সৌদি আরবের মতো ওহাবি সুন্নি মিত্র ও ইসরায়েলকে সমর্থন করেছে। তবে ৯/১১-পরবর্তী হস্তক্ষেপ—যেমন ইরাক যুদ্ধ—মধ্যপ্রাচ্যের বিভাজনকে আরও গভীর করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুদ্ধক্লান্তির কারণে যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চল থেকে সরে আসছে।
রাশিয়া: রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বকে প্রাধান্য দেয়। সিরিয়ায় ইরান ও বাশার আল-আসাদের শাসনকে সমর্থন করেছে। কিন্তু শেষরক্ষা আর করতে পারেনি।
চীন: মূলত অর্থনৈতিক সম্পর্ককে কেন্দ্র করে সক্রিয়। জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পকে কাজে লাগাচ্ছে। তবে সরাসরি রাজনৈতিক বা সামরিক হস্তক্ষেপ এড়িয়ে চলছে।
ইসরায়েল: ইরানের মোকাবিলায় সক্রিয়। সৌদি আরবের সঙ্গে মিলে ইরান-বিরোধী লক্ষ্য বাস্তবায়ন করে।
তুরস্কের ভূরাজনৈতিক উত্থান
তুরস্কের ভূরাজনৈতিক প্রভাব বাড়ার পেছনে তার অনন্য অবস্থান কাজ করছে। এটি পশ্চিম সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্য দেশ, যার সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষ। তবে ২০০২ সালের পর থেকে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের নেতৃত্বে জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একেপি) রাজনৈতিক ইসলামকে কেন্দ্র করে দেশের নীতি পরিচালনা করছে। যা উসমানীয় সাম্রাজ্যের খেলাফতকালীন বৈশ্বিক ভূমিকাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। এই নীতি অনুযায়ী ইস্তাম্বুলকে এক ধরনের সেতু হিসেবে দেখা হয়—যা ইউরোপ, আরব বিশ্ব ও ইউরেশিয়ার মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে।
সৌদি আরবের তেল-সম্পদভিত্তিক কঠোর সুন্নি প্রথা বা ইরানের শিয়া ইসলামি বিপ্লবী গোষ্ঠীর মতো নয়, বরং তুরস্ক ‘পুনঃশিক্ষিত’ সুন্নি ইসলামকে গুরুত্ব দেয়। বাইরের দিক থেকে একে মধ্যপন্থী মনে হয়। তবে তুরস্ক মুসলিম ব্রাদারহুডের মতো গোষ্ঠীকেও সমর্থন করে। একই সঙ্গে নিজেকে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ ও ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে উপস্থাপন করে।
২০২৪ সালে তুরস্ক সমর্থিত ইসলামপন্থী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) সিরিয়ার বাশার আল-আসাদের সরকারকে উৎখাত করে। আসাদের পতনের ফলে ১৩ বছর ধরে চলা গৃহযুদ্ধ শেষ হয়। একই সঙ্গে ইরানের ‘শিয়া ক্রিসেন্ট’ (তেহরান থেকে বেইরুত পর্যন্ত) প্রভাববলয়ও ধ্বংস হয়। সিরিয়ার দরজা খুলে যায় তুরস্কের প্রভাবের জন্য।
সিরিয়ায় তুরস্কের ‘দীর্ঘমেয়াদি কৌশল’ মিশ্র ফল দিয়েছে। সব দিকেই সহজ সমাধান হয়নি। ২০২৫ সালের আগস্টের মধ্যে আঙ্কারা এইচটিএস-এর সংস্কার নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়। এতে গোষ্ঠীটি আল-কায়েদার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসনের প্রতিশ্রুতি দেয়। এর লক্ষ্য ছিল পশ্চিমা সহায়তা নিশ্চিত করা এবং সম্পর্ক স্বাভাবিক করা। ফলে তুরস্ক সিরিয়ার পুনর্গঠনের প্রধান স্থপতি হিসেবে আবির্ভূত হয়। তারা এখানে জ্বালানি পাইপলাইন ও বাণিজ্য পথের মাধ্যমে ইউরোপের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করছে।
তুরস্ক ও কাতারের একটি নতুন সুন্নি জোটেরও উত্থান ঘটছে। এটি মূলত মুসলিম ব্রাদারহুডের নেটওয়ার্কের আদর্শের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এই জোট ইয়েমেন ও লেবাননে ইসলামপন্থী শক্তিকেও সমর্থন করে। তারা এগুলোকে একই সঙ্গে শিয়া ইরান ও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ হিসেবে উপস্থাপন করে।
২০২৫ সালে ফেব্রুয়ারিতে এরদোয়ানের পাকিস্তান সফর এই জোটকে আরও শক্তিশালী করেছে। পাকিস্তানের সঙ্গে তুরস্কের প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর ফলে তুরস্ক পাকিস্তানের প্রধান মিত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়, বিশেষ করে ভারতের বিরুদ্ধে। চুক্তির আওতায় যৌথ ড্রোন উৎপাদন ও কাশ্মীর ইস্যুতে হিন্দুত্ববাদ-বিরোধী পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হয়।
কাতারের অর্থায়ন এই জোটকে আরও শক্তিশালী করছে। তুর্কি মিডিয়া এরদোয়ানকে উম্মাহর রক্ষক হিসেবে উপস্থাপন করছে। মুসলিম ব্রাদারহুডের পণ্ডিতরা কোরআনের উদ্ধৃতি দিয়ে এর সমর্থন করছে।
সৌদি আরবের ভিশন ২০৩০ ওহাবি মতাদর্শকে নরম করছে। এতে প্রচলিত কট্টর ধারার অনুসারীরা ক্ষিপ্ত। একই সঙ্গে আব্রাহাম চুক্তির মাধ্যমে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করায় সৌদিরা মডারেট সুন্নিদের কাছেও জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে। এই শূন্যস্থান তুরস্কের জন্য সুযোগ তৈরি করেছে। ২০২৫ সালের মার্চে এরদোয়ান ইস্তাস্বুলে ‘ইসলামিক ইউনিটি সামিট’ আয়োজন করেন। এতে ওআইসি সদস্য দেশগুলো অংশ নেয়। সেখানে তিনি সৌদি আরবের ‘সেকুলারাইজেশন’ প্রক্রিয়ার সমালোচনা করেন।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষমতায় ফেরা অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি আরও বাড়িয়েছে। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি গাজা নিয়ে একটি পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। এতে ফিলিস্তিনিদের পুনর্বাসনের প্রস্তাব ছিল। ওআইসি এই পরিকল্পনার তীব্র নিন্দা জানায়। তুরস্ক এই নিন্দায় নেতৃত্ব দেয়। এরদোয়ান রাশিয়া থেকে এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা সিস্টেম কেনায় তা নিয়েও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে।
চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পের মাধ্যমে তুরস্ক-পাকিস্তান করিডরে বিনিয়োগ বাড়ছে। এতে সৌদি আরবের প্রভাব কমছে। লেভান্ট অঞ্চলে খরা ও জলবায়ু সমস্যা অভিবাসন বাড়াচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে তুরস্ক শরণার্থী চুক্তির মাধ্যমে একটি ‘স্থিতিশীলতা স্থাপনকারী’ শক্তি হিসেবে দেখা দেয়।
লক্ষণগুলো তেমনই ইঙ্গিত দেয়, তবে কিছু শর্ত রয়েছে। ২০২৫ সালে তুরস্কের অর্জনগুলো—সিরিয়ায় প্রভাব, পাকিস্তানের সমর্থন ও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান— উসমানীয় সাম্রাজ্যের স্মৃতি মনে করায়। ফলে এরদোয়ানকে মুসলিম উম্মাহর সবচেয়ে গতিশীল নেতা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
বিশ্লেষকরা পূর্বাভাস দেন, তুর্কি ইসলাম রাশিয়ার তাতারস্তান ও মধ্য এশিয়া, এমনকি বাংলাদেশেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। এটি আরব বসন্তের ব্যর্থতার ফলে তৈরি শূন্যস্থান পূরণ করবে। জাতিসংঘের ‘অ্যালায়েন্স অফ সিভিলাইজেশনস’-এ অংশগ্রহণ তুরস্ককে ‘মধ্যপন্থী’ হিসেবে উপস্থাপন করছে। ইউরোপে এটি নতুন মুসলমান আকৃষ্ট করছে।
তবে ক্ষমতা সবসময় ধরে রাখা সহজ নয়। এরদোয়ানের ইসলামপন্থী পদক্ষেপ সেক্যুলার মিত্রদের অসন্তুষ্ট করছে। দেশটির ভেতরে মানুষের স্বাধীনতা কমছে। ২০২৫ সালে বিরোধীদের ওপর কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, যা ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞা ডেকে এনেছে।
আঞ্চলিক বিভ্রান্তিও আছে। তুরস্ক ইসরায়েলের সঙ্গে মিলে ইরানের বিরুদ্ধে সমন্বয় করে, কিন্তু একই সঙ্গে হামাসকেও সমর্থন দেয়। আবার ন্যাটো সদস্যপদের কারণে খুব বেশি বিপ্লবীও হতে পারে না। তাই ভূরাজনীতি বিশেষজ্ঞদের মতে, তুরস্কের প্রভাব জটিল। দীর্ঘমেয়াদি ক্ষমতা নিশ্চিত নয়।
সংক্ষেপে, ২০২৫ সালে একটি ‘তুরস্ক মুহূর্ত’ দেখা যাচ্ছে, তবে পুরো যুগ নয়। এটি একটি নতুন মোড় যেখানে নব্য-উসমানীয় পুনর্জাগরণ ইসলামের বহুধর্মী ভবিষ্যতকে পরীক্ষা করছে। স্থিতিশীলতা নির্ভর করছে এরদোয়ানের সমন্বয় কৌশলের ওপর। বিপ্লব রপ্তানি করতে পারতে হবে, তবে অতিরিক্ত প্রভাব বিস্তারে নয়।
মুসলিম বিশ্বের ঐক্যের প্রচেষ্টা প্রায়ই ব্যর্থ হয়। বিভিন্ন দেশে স্বৈরশাসন, সাম্প্রদায়িক, জাতিগত ও মতাদর্শগত সংঘাত—ইঙ্গিত দিচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি বিভাজনের। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অভিবাসনে বাধ্য হওয়া এবং সম্পদভিত্তিক সংঘাত আরও জটিলতা বাড়াতে পারে। মোটের ওপর বলা যায়, মুসলিম বিশ্বের ভূরাজনৈতিক মডেল এখনও অস্থির ও পরিবর্তনশীল। অভ্যন্তরীণ বিভাজন ও বাইরের চাপের কারণে শিগগিরই কোনো সর্বজনীন ইসলামি ঐক্য গড়ে ওঠার সম্ভাবনা নেই।
মুসলিম দেশগুলোর ভূরাজনীতি বলতে বোঝানো হয় আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনীতিতে দেশগুলোর শক্তির ভারসাম্য, জোট, দ্বন্দ্ব ও কৌশলগত সম্পর্কের সামগ্রিক কাঠামো। এ দেশগুলোতে ইসলাম প্রধান ধর্ম বা শাসনব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক। ইন্দোনেশিয়া থেকে মরোক্কো পর্যন্ত ৫০টির বেশি মুসলিম-অধ্যুষিত দেশ এর মধ্যে পড়ে। তবে এটিকে একক কোনো মডেল বলা যায় না। বরং মুসলিম দেশগুলোর ভূরাজনীতি ভাঙনের বৈশিষ্ট্যে গঠিত। রয়েছে ভাঙনের নানা কারণ। যেমন— সাম্প্রদায়িক বিভাজন, ইসলামি উম্মাহর নেতৃত্ব দখলের প্রতিযোগিতা, প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ন্ত্রণ ও বহিরাগত শক্তির হস্তক্ষেপ।
ইতিহাসের উত্তরাধিকারও এখানে প্রভাব ফেলেছে। সুন্নি-শিয়া বিভাজন এবং ঔপনিবেশিক শাসনের অভিজ্ঞতা আজও রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে। আধুনিক যুগে তেল সম্পদ, ধর্মীয় প্রভাবশক্তি ও জলবায়ু সংকটও এই ভূরাজনীতিকে গড়ে তোলে। ফলে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের পাশাপাশি এর বৈশ্বিক প্রভাবও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
বৈশ্বিক মুসলিম সমাজে কোনো একক শক্তির পূর্ণ আধিপত্য নেই। বরং এখানে প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা চলছে। সৌদি আরব ছড়াচ্ছে তার ওহাবি মডেল, ইরান প্রচার করছে শিয়া বিপ্লবী আদর্শ আর তুরস্ক এগিয়ে নিচ্ছে নব্য-উসমানীয় পুনর্জাগরণের ধারণা।
এই বিভক্ত প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি ‘তুরস্ক যুগ’ কথাটি আলোচনায় গুরুত্ব পাচ্ছে। এর মাধ্যমে বোঝানো হচ্ছে প্রেসিডেন্ট রেসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের সেই ভিশন, যেখানে তুরস্ককে এক সভ্যতার নেতা হিসেবে দেখা হয়। তাঁর কৌশল তিনটি মূল উপাদানের মিশ্রণ— সুন্নি ইসলামপন্থা, জাতীয়তাবাদ ও অর্থনৈতিক বাস্তববাদ। এই মডেলের লক্ষ্য হলো উসমানীয় আমলের বৈশ্বিক প্রভাব ফিরিয়ে আনা —শুধু মধ্যপ্রাচ্যেই নয়, মধ্য এশিয়া এবং এর বাইরেও। যেমন বাংলাদেশে।
ঐতিহাসিক পটভূমি
মুসলিম দেশগুলোর বর্তমান ভূরাজনীতির শিকড় ইসলামের শুরুর যুগে প্রোথিত। হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মৃত্যুর পর নেতৃত্ব নিয়ে বড় ধরনের বিরোধ দেখা দেয়। এই বিরোধ থেকেই সুন্নি-শিয়া বিভাজনের সূচনা হয়। সুন্নিরা (আজকের মুসলিম জনসংখ্যার প্রায় ৮৫–৯০ শতাংশ) নির্বাচিত খলিফাদের সমর্থন করে। তাঁদের মতে, আবু বকর ছিলেন সঠিক উত্তরসূরি। অন্যদিকে শিয়ারা মনে করে, নবীর রক্তসূত্র ধরে নেতৃত্ব আসা উচিত। তাই তারা নবীর চাচাতো ভাই এবং জামাতা হযরত আলীকে বৈধ উত্তরসূরি মনে করে। এই বিভাজন মুসলিম বিশ্বের প্রথম দিকেই গৃহযুদ্ধ সৃষ্টি করে। ৬৮০ খ্রিষ্টাব্দে কারবালার যুদ্ধ সেই দ্বন্দ্বকে গভীর করে তোলে।
পরবর্তী শতকগুলোতে মুসলিম সাম্রাজ্য দ্রুত বিস্তৃত হয়। আব্বাসীয় খিলাফত (৭৫০–১২৫৮) এবং উসমানীয় সাম্রাজ্য (১২৯৯–১৯২২) তিনটি মহাদেশজুড়ে বিস্তার লাভ করে। জয়যাত্রা, বাণিজ্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধি ইসলামি সভ্যতাকে শক্তিশালী করে তোলে। তবে একই সঙ্গে বিভক্তিও তৈরি হয়। আব্বাসীয়, উমাইয়া ও ফাতিমীয়দের মতো প্রতিদ্বন্দ্বী খেলাফতের উত্থান মুসলিম বিশ্বের অভ্যন্তরীণ প্রতিযোগিতাকে দীর্ঘস্থায়ী করে।
উনিশ ও বিশ শতকে ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো মুসলিম বিশ্বে নতুন সীমানা টেনে দেয়। এতে কৃত্রিম রাষ্ট্রের জন্ম হয়। দুর্বল হয়ে পড়ে বৈশ্বিক-ইসলামি ঐক্যের ধারণা। স্বাধীনতার পর অনেক নেতা আরব জাতীয়তাবাদ বা ধর্মনিরপেক্ষতাকে অগ্রাধিকার দেন। কিন্তু প্যান-অ্যারাবিজম বা আরব ঐক্যের মতো আদর্শ ভেঙে পড়লে আবারও রাজনীতিতে বৈশ্বিক ইসলামের প্রভাব বাড়তে থাকে।
১৯৭৯ সালের ইরানি বিপ্লব বিশাল এক মোড় ঘোরানো ঘটনা। এর মধ্য দিয়ে নতুন বিপ্লবী শিয়া ধর্মভিত্তিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি সুন্নি-প্রধান রাষ্ট্রগুলোর জন্য সরাসরি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। এর ফলে সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব আরও তীব্র হয়। ভূগোল ও পরিবেশও মুসলিম দেশগুলোর রাজনীতিতে বড় ভূমিকা রেখেছে। মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা ও মধ্য এশিয়ার বহু অঞ্চল শুষ্ক ও সম্পদ-স্বল্প। এতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সীমিত থাকে। তুলনায় ইউরোপের নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া অনেক সুবিধাজনক।
এই পরিবেশগত বৈষম্য মুসলিম বিশ্বের পতনকে ত্বরান্বিত করে। মধ্যযুগের পর ইউরোপীয় শক্তিগুলো সমুদ্রপথ আবিষ্কার করে মুসলিম বাণিজ্যপথ এড়িয়ে যায়। ভাস্কো দা গামার সমুদ্রপথ আবিষ্কার এর বড় উদাহরণ। ফলে মুসলিম বিশ্ব বাণিজ্য ও শিল্পায়নে পিছিয়ে পড়ে। পশ্চিমা ঔপনিবেশিক শাসনও এই অঞ্চলের অর্থনীতি দুর্বল করে দেয়। প্রাকৃতিক সম্পদ-স্বল্প অঞ্চলগুলোতে উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। আজ জলবায়ু পরিবর্তন নতুন করে সেই সংকটকে বাড়িয়ে তুলছে। বিশেষ করে শুষ্ক অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা আরও প্রকট হয়ে উঠছে।
মুসলিম বিশ্বে সুন্নি-শিয়া বিভাজন সবচেয়ে বড় ফাটল। এটি নানা প্রক্সি যুদ্ধ ও আঞ্চলিক জোটে প্রকাশ পায়। সৌদি আরব, তুরস্ক, মিশর ও পাকিস্তানের মতো দেশে সুন্নিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। অন্যদিকে ইরান, ইরাক, আজারবাইজান ও বাহরাইনে শিয়ারা প্রভাবশালী। ১৯৮০-র দশক থেকে এই বিভাজন আরও তীব্র হয়। সৌদি আরব ছড়িয়ে দেয় ওহাবি মতবাদ, যা এক ধরনের কট্টর সুন্নি ইসলাম। এর লক্ষ্য ছিল ইরানের শিয়া বিপ্লবী আদর্শের মোকাবিলা করা। কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ দেখা যাক।
সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ: ইরান সমর্থন করে শিয়াপন্থী আলাবি শিয়া নেতা বাশার আল-আসাদের সরকারকে। বিপরীতে সুন্নি বিদ্রোহীদের পাশে দাঁড়ায় সৌদি আরব, তুরস্ক ও কাতার। সুন্নিরা আসাদকে উৎখাত করে।
ইয়েমেন সংঘাত: সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট লড়ছে ইরান-সমর্থিত হুথি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে। হুথিরা হলো জায়েদি শিয়া সম্প্রদায়ের অনুসারী।
ইরাকের অস্থিতিশীলতা: ২০০৩ সালে মার্কিন আক্রমণের পর শিয়াদের শক্তি বেড়ে যায়। এতে অসন্তুষ্ট সুন্নিরা বিদ্রোহ শুরু করে। সেখান থেকেই উত্থান ঘটে আইএসআইএস-এর মতো সংগঠনের।
তবে বিভাজন শুধু সুন্নি-শিয়া পর্যায়েই সীমাবদ্ধ নয়। সুন্নিদের মধ্যেও মতভেদ আছে। উদাহরণস্বরূপ মধ্যপন্থী বনাম কট্টর ইসলামপন্থী গোষ্ঠী। কাতার ও তুরস্ক মুসলিম ব্রাদারহুডকে সমর্থন করে। কিন্তু সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত এই সংগঠনের বিরোধিতা করে। মুসলিম বিশ্বের আরেকটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো অভ্যন্তরীণ সহিংসতা। এখানে নাগরিক যুদ্ধ, অ-রাষ্ট্রীয় সংঘাত ও একতরফা হামলা বেশি ঘটে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এগুলো ইসলামের নামে বা ইসলামপন্থী দাবিতে পরিচালিত হয়। আইএসআইএস-এর মতো গোষ্ঠীগুলো বহু ফ্রন্টে যুদ্ধ করেছে। তারা এই বিভাজনগুলোকেই কাজে লাগিয়েছে নিজেদের বিস্তারের জন্য।
ইসলাম এমন এক পরিবেশ যেখানে নানা ধরনের রাজনৈতিক ধারণা, তত্ত্ব ও অনুশীলন গড়ে ওঠে। এই ধর্ম সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ধারাবাহিকভাবে সক্রিয় সৃজনশীলতার উৎস। এই সৃজনশীলতাই প্রতিযোগিতা তৈরি করে। বর্তমানে মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্বের জন্য তিনটি প্রধান মডেল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। এগুলো হলো সৌদি, তুর্কি ও ইরানি মডেল। আরেকটি এশীয় মডেল রয়েছে— ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার। তবে এর প্রভাব সরাসরি মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে নেই।
মধ্যপ্রাচ্যের চলমান সংকটকে এই প্রতিযোগিতার আলোকে দেখা হলে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়। তুর্কি মডেল ধীরে ধীরে সৌদি ও ইরানি মডেলের তুলনায় এগিয়ে যাচ্ছে। তারা আরব অঞ্চলসহ মুসলিম বিশ্বে প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় রয়েছে, তবে সরাসরি যুদ্ধে জড়ায়নি। সৌদি আরব ইরানের মোকাবিলায় তুরস্ককে মিত্র করতে চায়। কিন্তু তুরস্কের প্রভাবশালী অবস্থানও মেনে নিতে চায় না।
সৌদি মডেল (সুন্নি-ওহাবি): এর আদর্শ ওহাবি মতবাদ, কঠোর সুন্নি ইসলাম ও মক্কা-মদিনার অভিভাবকত্ব। কৌশল ও শক্তির জায়গা— তেলের অর্থব্যবহার করে ধর্ম প্রচার, জিসিসি-র মতো আঞ্চলিক জোট, বিদেশে বৃত্তি ও মসজিদের মাধ্যমে সফট পাওয়ার বিস্তার। ওআইসি-র নেতৃত্ব। চ্যালেঞ্জ ও দুর্বলতা— মোহাম্মদ বিন সালমানের সংস্কার ওহাবি মতাদর্শের আকর্ষণ কমিয়ে দিয়েছে। ইসরায়েলের সঙ্গে আব্রাহাম চুক্তিকে অনেক মুসলিম বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে দেখে। কাতারের সঙ্গেও তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা রয়েছে।
ইরানি মডেল (শিয়া-বিপ্লবী): আদর্শ— শিয়া ইসলাম, ‘ফকিহদের শাসন’ তত্ত্ব, সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতা। হিজবুল্লাহ ও হুথির মতো গোষ্ঠীকে সমর্থন। কৌশল ও শক্তি— প্রক্সির মাধ্যমে বিপ্লব ছড়ানো। ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে শিয়া-সুন্নি বিভাজনকে পেরোনোর চেষ্টা। চ্যালেঞ্জ ও দুর্বলতা— অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞায় বিচ্ছিন্ন। সিরিয়ায় আসাদ সরকারের পতন হলে প্রভাবও কমে যায়। সিরিয়ায় তুরস্ক শক্তিশালী হয়েছে। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ‘পবিত্র যুদ্ধ’ ধারণাকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে ব্যর্থ।
তুর্কি মডেল (নব্য-উসমানীয়/মডারেট সুন্নি ইসলামপন্থী): আদর্শ— সুন্নি ইসলাম ও জাতীয়তাবাদী পুনর্জাগরণ। মুসলিম পবিত্র স্থান রক্ষা ও নতুনভাবে গড়ে তোলা ইসলামপন্থা। কৌশল ও শক্তি— রাজনৈতিক ও তথ্যপ্রবাহে প্রভাব বিস্তার। মুসলিম ব্রাদারহুডকে সমর্থন। সিরিয়ায় আসাদের পতনের পর লাভবান হওয়া এবং সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার সমাধান হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন। দ্বৈত ইসলামি-জাতীয়তাবাদী কৌশল। চ্যালেঞ্জ ও দুর্বলতা— সম্প্রসারণবাদী বলে অভিযুক্ত। ইরাক ও সিরিয়া নিয়ে ইরানের সঙ্গে টানাপোড়েন। মধ্য এশিয়ায় অতিরিক্ত প্রভাব বিস্তারের ঝুঁকি।
যুক্তরাষ্ট্র: ঐতিহাসিকভাবে সৌদি আরবের মতো ওহাবি সুন্নি মিত্র ও ইসরায়েলকে সমর্থন করেছে। তবে ৯/১১-পরবর্তী হস্তক্ষেপ—যেমন ইরাক যুদ্ধ—মধ্যপ্রাচ্যের বিভাজনকে আরও গভীর করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুদ্ধক্লান্তির কারণে যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চল থেকে সরে আসছে।
রাশিয়া: রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বকে প্রাধান্য দেয়। সিরিয়ায় ইরান ও বাশার আল-আসাদের শাসনকে সমর্থন করেছে। কিন্তু শেষরক্ষা আর করতে পারেনি।
চীন: মূলত অর্থনৈতিক সম্পর্ককে কেন্দ্র করে সক্রিয়। জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পকে কাজে লাগাচ্ছে। তবে সরাসরি রাজনৈতিক বা সামরিক হস্তক্ষেপ এড়িয়ে চলছে।
ইসরায়েল: ইরানের মোকাবিলায় সক্রিয়। সৌদি আরবের সঙ্গে মিলে ইরান-বিরোধী লক্ষ্য বাস্তবায়ন করে।
তুরস্কের ভূরাজনৈতিক উত্থান
তুরস্কের ভূরাজনৈতিক প্রভাব বাড়ার পেছনে তার অনন্য অবস্থান কাজ করছে। এটি পশ্চিম সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্য দেশ, যার সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষ। তবে ২০০২ সালের পর থেকে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের নেতৃত্বে জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একেপি) রাজনৈতিক ইসলামকে কেন্দ্র করে দেশের নীতি পরিচালনা করছে। যা উসমানীয় সাম্রাজ্যের খেলাফতকালীন বৈশ্বিক ভূমিকাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। এই নীতি অনুযায়ী ইস্তাম্বুলকে এক ধরনের সেতু হিসেবে দেখা হয়—যা ইউরোপ, আরব বিশ্ব ও ইউরেশিয়ার মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে।
সৌদি আরবের তেল-সম্পদভিত্তিক কঠোর সুন্নি প্রথা বা ইরানের শিয়া ইসলামি বিপ্লবী গোষ্ঠীর মতো নয়, বরং তুরস্ক ‘পুনঃশিক্ষিত’ সুন্নি ইসলামকে গুরুত্ব দেয়। বাইরের দিক থেকে একে মধ্যপন্থী মনে হয়। তবে তুরস্ক মুসলিম ব্রাদারহুডের মতো গোষ্ঠীকেও সমর্থন করে। একই সঙ্গে নিজেকে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ ও ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে উপস্থাপন করে।
২০২৪ সালে তুরস্ক সমর্থিত ইসলামপন্থী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) সিরিয়ার বাশার আল-আসাদের সরকারকে উৎখাত করে। আসাদের পতনের ফলে ১৩ বছর ধরে চলা গৃহযুদ্ধ শেষ হয়। একই সঙ্গে ইরানের ‘শিয়া ক্রিসেন্ট’ (তেহরান থেকে বেইরুত পর্যন্ত) প্রভাববলয়ও ধ্বংস হয়। সিরিয়ার দরজা খুলে যায় তুরস্কের প্রভাবের জন্য।
সিরিয়ায় তুরস্কের ‘দীর্ঘমেয়াদি কৌশল’ মিশ্র ফল দিয়েছে। সব দিকেই সহজ সমাধান হয়নি। ২০২৫ সালের আগস্টের মধ্যে আঙ্কারা এইচটিএস-এর সংস্কার নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়। এতে গোষ্ঠীটি আল-কায়েদার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসনের প্রতিশ্রুতি দেয়। এর লক্ষ্য ছিল পশ্চিমা সহায়তা নিশ্চিত করা এবং সম্পর্ক স্বাভাবিক করা। ফলে তুরস্ক সিরিয়ার পুনর্গঠনের প্রধান স্থপতি হিসেবে আবির্ভূত হয়। তারা এখানে জ্বালানি পাইপলাইন ও বাণিজ্য পথের মাধ্যমে ইউরোপের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করছে।
তুরস্ক ও কাতারের একটি নতুন সুন্নি জোটেরও উত্থান ঘটছে। এটি মূলত মুসলিম ব্রাদারহুডের নেটওয়ার্কের আদর্শের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এই জোট ইয়েমেন ও লেবাননে ইসলামপন্থী শক্তিকেও সমর্থন করে। তারা এগুলোকে একই সঙ্গে শিয়া ইরান ও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ হিসেবে উপস্থাপন করে।
২০২৫ সালে ফেব্রুয়ারিতে এরদোয়ানের পাকিস্তান সফর এই জোটকে আরও শক্তিশালী করেছে। পাকিস্তানের সঙ্গে তুরস্কের প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর ফলে তুরস্ক পাকিস্তানের প্রধান মিত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়, বিশেষ করে ভারতের বিরুদ্ধে। চুক্তির আওতায় যৌথ ড্রোন উৎপাদন ও কাশ্মীর ইস্যুতে হিন্দুত্ববাদ-বিরোধী পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হয়।
কাতারের অর্থায়ন এই জোটকে আরও শক্তিশালী করছে। তুর্কি মিডিয়া এরদোয়ানকে উম্মাহর রক্ষক হিসেবে উপস্থাপন করছে। মুসলিম ব্রাদারহুডের পণ্ডিতরা কোরআনের উদ্ধৃতি দিয়ে এর সমর্থন করছে।
সৌদি আরবের ভিশন ২০৩০ ওহাবি মতাদর্শকে নরম করছে। এতে প্রচলিত কট্টর ধারার অনুসারীরা ক্ষিপ্ত। একই সঙ্গে আব্রাহাম চুক্তির মাধ্যমে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করায় সৌদিরা মডারেট সুন্নিদের কাছেও জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে। এই শূন্যস্থান তুরস্কের জন্য সুযোগ তৈরি করেছে। ২০২৫ সালের মার্চে এরদোয়ান ইস্তাস্বুলে ‘ইসলামিক ইউনিটি সামিট’ আয়োজন করেন। এতে ওআইসি সদস্য দেশগুলো অংশ নেয়। সেখানে তিনি সৌদি আরবের ‘সেকুলারাইজেশন’ প্রক্রিয়ার সমালোচনা করেন।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষমতায় ফেরা অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি আরও বাড়িয়েছে। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি গাজা নিয়ে একটি পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। এতে ফিলিস্তিনিদের পুনর্বাসনের প্রস্তাব ছিল। ওআইসি এই পরিকল্পনার তীব্র নিন্দা জানায়। তুরস্ক এই নিন্দায় নেতৃত্ব দেয়। এরদোয়ান রাশিয়া থেকে এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা সিস্টেম কেনায় তা নিয়েও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে।
চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পের মাধ্যমে তুরস্ক-পাকিস্তান করিডরে বিনিয়োগ বাড়ছে। এতে সৌদি আরবের প্রভাব কমছে। লেভান্ট অঞ্চলে খরা ও জলবায়ু সমস্যা অভিবাসন বাড়াচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে তুরস্ক শরণার্থী চুক্তির মাধ্যমে একটি ‘স্থিতিশীলতা স্থাপনকারী’ শক্তি হিসেবে দেখা দেয়।
লক্ষণগুলো তেমনই ইঙ্গিত দেয়, তবে কিছু শর্ত রয়েছে। ২০২৫ সালে তুরস্কের অর্জনগুলো—সিরিয়ায় প্রভাব, পাকিস্তানের সমর্থন ও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান— উসমানীয় সাম্রাজ্যের স্মৃতি মনে করায়। ফলে এরদোয়ানকে মুসলিম উম্মাহর সবচেয়ে গতিশীল নেতা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
বিশ্লেষকরা পূর্বাভাস দেন, তুর্কি ইসলাম রাশিয়ার তাতারস্তান ও মধ্য এশিয়া, এমনকি বাংলাদেশেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। এটি আরব বসন্তের ব্যর্থতার ফলে তৈরি শূন্যস্থান পূরণ করবে। জাতিসংঘের ‘অ্যালায়েন্স অফ সিভিলাইজেশনস’-এ অংশগ্রহণ তুরস্ককে ‘মধ্যপন্থী’ হিসেবে উপস্থাপন করছে। ইউরোপে এটি নতুন মুসলমান আকৃষ্ট করছে।
তবে ক্ষমতা সবসময় ধরে রাখা সহজ নয়। এরদোয়ানের ইসলামপন্থী পদক্ষেপ সেক্যুলার মিত্রদের অসন্তুষ্ট করছে। দেশটির ভেতরে মানুষের স্বাধীনতা কমছে। ২০২৫ সালে বিরোধীদের ওপর কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, যা ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞা ডেকে এনেছে।
আঞ্চলিক বিভ্রান্তিও আছে। তুরস্ক ইসরায়েলের সঙ্গে মিলে ইরানের বিরুদ্ধে সমন্বয় করে, কিন্তু একই সঙ্গে হামাসকেও সমর্থন দেয়। আবার ন্যাটো সদস্যপদের কারণে খুব বেশি বিপ্লবীও হতে পারে না। তাই ভূরাজনীতি বিশেষজ্ঞদের মতে, তুরস্কের প্রভাব জটিল। দীর্ঘমেয়াদি ক্ষমতা নিশ্চিত নয়।
সংক্ষেপে, ২০২৫ সালে একটি ‘তুরস্ক মুহূর্ত’ দেখা যাচ্ছে, তবে পুরো যুগ নয়। এটি একটি নতুন মোড় যেখানে নব্য-উসমানীয় পুনর্জাগরণ ইসলামের বহুধর্মী ভবিষ্যতকে পরীক্ষা করছে। স্থিতিশীলতা নির্ভর করছে এরদোয়ানের সমন্বয় কৌশলের ওপর। বিপ্লব রপ্তানি করতে পারতে হবে, তবে অতিরিক্ত প্রভাব বিস্তারে নয়।
মুসলিম বিশ্বের ঐক্যের প্রচেষ্টা প্রায়ই ব্যর্থ হয়। বিভিন্ন দেশে স্বৈরশাসন, সাম্প্রদায়িক, জাতিগত ও মতাদর্শগত সংঘাত—ইঙ্গিত দিচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি বিভাজনের। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অভিবাসনে বাধ্য হওয়া এবং সম্পদভিত্তিক সংঘাত আরও জটিলতা বাড়াতে পারে। মোটের ওপর বলা যায়, মুসলিম বিশ্বের ভূরাজনৈতিক মডেল এখনও অস্থির ও পরিবর্তনশীল। অভ্যন্তরীণ বিভাজন ও বাইরের চাপের কারণে শিগগিরই কোনো সর্বজনীন ইসলামি ঐক্য গড়ে ওঠার সম্ভাবনা নেই।
দক্ষিণ এশিয়ায় তরুণদের নেতৃত্বে একের পর এক আন্দোলন দেখা যাচ্ছে। এসব আন্দোলন প্রতিষ্ঠিত সরকারকেও ক্ষমতাচ্যুত করেছে। ফলে প্রশ্ন উঠছে— বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল এই অঞ্চল কি জেনারেশন জেড তথা জেন জি (১৯৯৭–২০১২ সালে জন্ম নেওয়া প্রজন্ম) বিপ্লবের কেন্দ্র হয়ে উঠছে?
১ দিন আগেঘণ্টার পর ঘণ্টা বিতর্কের পর সুপ্রিম কোর্টের সাবেক প্রধান বিচারপাতি সুশিলা কার্কি-কে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। বিতর্কের সময় বিক্ষোভের নেতাদের কঠিন কঠিন প্রশ্ন করা হয় এবং সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী প্রার্থীদের সঙ্গে রিয়েল টাইমে যোগাযোগও করা হয়।
২ দিন আগেভোটে প্রস্তাবের পক্ষে ১৪২টি দেশ সমর্থন দেয়। ১০টি দেশ বিরোধিতা করে। ১২টি দেশ ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকে। প্রস্তাবে বলা হয়, হামাসমুক্ত একটি স্বাধীন ও কার্যকর ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন করতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে হামাসের নিরস্ত্রীকরণ, ক্ষমতা ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের হাতে হস্তান্তর এবং ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের
৩ দিন আগেপ্রতিদিনই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিক্ষোভের ডাক ছড়িয়ে পড়ছে। শিক্ষার্থীরা শুরু থেকেই জনসাধারণের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য ব্যবহার করছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন গ্রুপ। সেখান থেকেই মানুষকে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন তাঁরা। বাংলাদেশের আন্দোলনেও আমরা দেখেছি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ভূমিকা।
৩ দিন আগে