leadT1ad

আমেরিকাকে ছাড়া জাতিসংঘ কি চলতে পারবে

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক
প্রকাশ : ০৯ অক্টোবর ২০২৫, ০৮: ৫০
স্ট্রিম গ্রাফিক

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বে শান্তি স্থাপনের লক্ষ্যে গঠিত হয় জাতিসংঘ। আজকে তা এক মৌলিক প্রশ্নের মুখোমুখি—যুক্তরাষ্ট্র সরে গেলে সংস্থাটির কী হবে? সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের তীব্র সমালোচনামূলক বক্তব্য এই বিতর্ককে নতুন করে উসকে দিয়েছে।

গত সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ট্রাম্প বলেন, জাতিসংঘের অনেক সম্ভাবনা থাকলেও তা কাজে লাগানো হচ্ছে না। সংগঠনটি মূলত শক্ত ভাষায় চিঠি লিখতে পারে কিন্তু কোনো পদক্ষেপ নিতে পারে না। ফলে কোনো যুদ্ধ আর থামে না। এমনকি ট্রাম্প এটিকে ‘অকার্যকর’ সংস্থা আখ্যা দিয়ে বিলুপ্তির আহ্বানও জানাচ্ছেন।

ট্রাম্প জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়ন বন্ধেরও ঘোষণা দেন। এতে যুক্তরাষ্ট্রের ২ বিলিয়ন ডলারের বকেয়া পরিশোধ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে ফিলিস্তিনি নেতাদের ভিসা প্রত্যাখ্যানের ঘটনাও নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। সবমিলিয়ে জাতিসংঘের অস্তিত্ব নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন পরিসরে আলোচনা চলছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জাতিসংঘের সম্পর্ক গভীর

জাতিসংঘের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের গভীর সম্পর্ক তিনটি প্রধান স্তরে গড়ে উঠেছে—অর্থায়ন, প্রভাব ও অবস্থান। যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের নিয়মিত বাজেটের প্রায় ২২ শতাংশ (২০২৪ সালে ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার) এবং শান্তিরক্ষা তহবিলের প্রায় ২৫ শতাংশ যোগান দেয়। মানবিক কার্যক্রমের স্বেচ্ছা অনুদান পর্যন্ত ধরলে জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের অংশীদারত্ব ৪০ শতাংশ ছাড়ায়।

ফলে যুক্তরাষ্ট্র সরে গেলে জাতিসংঘের তাৎক্ষণিক আর্থিক সংকট দেখা দেবে। মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস সতর্ক করেছেন, এই কারণে জাতিসংঘের ২০ শতাংশ কর্মী ছাঁটাই করতে হতে পারে। চীন দ্বিতীয় বৃহত্তম দাতা হলেও বিলম্বে অনুদান দেয়। বহুমুখী অর্থায়ন না হলে কার্যক্রম ঝুঁকিতে পড়বে।

জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ১৯৪৬ সাল থেকে ৮৩টি প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছে। এগুলোর বেশিরভাগই ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংক্রান্ত। যুক্তরাষ্ট্র না থাকলে রাশিয়া ও চীনের প্রভাব বেড়ে যাবে।

১৯৫২ সাল থেকে জাতিসংঘের সদরদপ্তর নিউইয়র্কে। ১৯৪৭ সালের চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র এর নিরাপত্তা ও অবকাঠামোগত সহায়তা দেয়। তবে মাঝে মাঝে ভিসা প্রত্যাখ্যান (যেমন ১৯৮৮ সালে আরাফাতের ক্ষেত্রে) জাতিসংঘের কাজকে ব্যাহত করেছে। যুক্তরাষ্ট্র সম্পূর্ণভাবে সরে গেলে সদরদপ্তর সরাতে হলে সাধারণ পরিষদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের ভোট প্রয়োজন হবে।

যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া জাতিসংঘের বার্ষিক তিন বিলিয়ন ডলারের বাজেট মারাত্মকভাবে সংকুচিত হবে। শান্তিরক্ষা কার্যক্রম (১৭টি মিশন, ৭০ হাজার সৈন্য) এবং মানবিক সহায়তা (২৭ কোটি মানুষের জন্য) কার্যত স্থবির হয়ে পড়বে।

যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়া টিকে থাকতে পারবে, তবে…

জাতিসংঘের সমর্থকরা মনে করেন, সংস্কার ও অভিযোজনের মাধ্যমে সংস্থাটি টিকে থাকতে পারবে। সাবেক সুইডিশ প্রধানমন্ত্রী কার্ল বিল্ড ও সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ক্রিস লুর মতে, জাতিসংঘের ৮০ বছরের অভিজ্ঞতা এর স্থিতিশীলতার প্রমাণ। ২০২৪ সালের প্যাক্ট ফর দ্য ফিউচার গাজা ও ইউক্রেন ইস্যুতে বিভাজন সত্ত্বেও গৃহীত হয়, যা বহুপাক্ষিক সহযোগিতার ধারাবাহিকতা নির্দেশ করে। এতে টেকসই উন্নয়ন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবস্থাপনা ও জলবায়ু পদক্ষেপে অগ্রগতি হয়।

সমর্থকদের মতে, অপ্রয়োজনীয় সংস্থা কমানোসহ ব্যয় সংকোচন এবং ভারত-ব্রাজিলের মতো উদীয়মান অর্থনীতিকে নতুন দাতা হিসেবে যুক্ত করলে অর্থঘাটতি পূরণ সম্ভব। বেসরকারি খাতের সহযোগিতাও গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের শীর্ষ ৫০০ কোম্পানির আয়ের একটি অংশ ব্যবহার করলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও লজিস্টিকস খাতে বিশেষজ্ঞ সহায়তা পাওয়া যাবে, যা টেকসই উন্নয়নে ৮০ শতাংশ অগ্রগতি আনতে পারে। সাম্প্রতিক সাফল্যের মধ্যে রয়েছে ২০২৫ সালের ওশান কনফারেন্স (১৭০টি দেশ, ৮০০ প্রতিশ্রুতি) ও অর্থায়ন সম্মেলন—যা যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণ ছাড়াও সফল হয়।

ভেটো অচলাবস্থা কাটানোর উপায়ও আছে। যেমন, ১৯৫০ সালের কোরিয়া ইস্যুর মতো সাধারণ পরিষদের ‘ইউনাইটিং ফর পিস’ প্রস্তাব নিরাপত্তা পরিষদের অচলাবস্থা এড়াতে সক্ষম। সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে—অপরাধী রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে ভেটো স্থগিত রাখা বা পুরোপুরি বাতিল করা। ২০২৫ সালে ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট স্তুব মন্তব্য করেন, ‘কোনো একক দেশের হাতে ভেটো থাকা উচিত নয়।’

অনুদান নিয়েও ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত রয়েছে। ১৯৮০-র দশকে রিগ্যান আমলে যুক্তরাষ্ট্র অনুদান বন্ধ রাখায় জাতিসংঘ আর্থিক সংকটে পড়েছিল, কিন্তু সংস্থাটি ভেঙে যায়নি। ১৯৮৮ সালে ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাতকে ভিসা না দেওয়ায় সাধারণ পরিষদ জেনেভায় বৈঠক করে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের অনুপস্থিতিতে রাশিয়া ও চীনের প্রভাব বাড়বে, তবে জাতিসংঘ টিকে থাকবে।

সামাজিক মাধ্যমে অনেকেই সংস্থাটিকে ‘যুদ্ধের হাতিয়ার’ বলে সমালোচনা করেছেন, তবে বিলুপ্তির পরিবর্তে সংস্কারের পক্ষে মত দিয়েছেন। কেউ কেউ যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের ভেটোবিহীন নতুন আন্তর্জাতিক সংগঠনের আহ্বান জানিয়েছেন।

সন্দেহবাদীরা সতর্ক করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের অনুপস্থিতিতে ভয়াবহ পরিণতি ঘটতে পারে। কার্ল বিল্ডট যুক্তরাষ্ট্রের অবহেলাকে ‘মনোবলহীনতা সৃষ্টিকারী’ বলেছেন। তিনি সতর্ক করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়ন বন্ধ হলে গাজা, সুদান ও ইউক্রেনের মতো সংকটে বড় ধরনের কাটছাঁট অনিবার্য হবে। যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ও কূটনৈতিক প্রভাব না থাকলে শান্তিরক্ষা মিশন দুর্বল হয়ে পড়বে। ভেটো দেওয়া প্রস্তাবগুলোর কার্যকর বাস্তবায়নেরও কোনো উপায় থাকবে না।

রেডিট ও এক্সে অনেকেই সদরদপ্তর স্থানান্তরের ধারণাকে অবাস্তব বলেছেন। রেডিটে আলোচনায় অনেকেই বলেছেন, ভেটো সংস্কার ছাড়া সদরদপ্তর স্থানান্তর অর্থহীন। এক ব্যবহারকারী তির্যকভাবে লেখেন, ‘সদরদপ্তরকে নিকটতম ডাস্টবিনেই পাঠানো যেতে পারে।’

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক মনোভাব স্পষ্ট। একজন ব্যবহারকারী লিখেছেন, ‘জাতিসংঘ বিলুপ্ত করো—এটি অর্থহীন।’ অন্যজন মন্তব্য করেন, ‘আমেরিকার অর্থ সহায়তা না থাকলে জাতিসংঘ ভেঙে পড়বে।’ আরেকজন রসিকতা করে বলেন, ‘আমেরিকা না থাকলে জাতিসংঘ বলেও কিছু থাকতই না।’

সদরদপ্তর স্থানান্তর: কঠিন হলেও সম্ভব

বিল্ডটের প্রস্তাব—জাতিসংঘের সদরদপ্তর নিউইয়র্ক থেকে সরানোই ‘টিকে থাকার পথ’। যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা জটিলতা ও ব্যয় সাশ্রয়ের যুক্তিও তিনি দেন। ১৯৪৭ সালের সদরদপ্তর চুক্তি অনুযায়ী, আগাম নোটিশে স্থানান্তর সম্ভব হলেও এর জন্য সাধারণ পরিষদের দুই-তৃতীয়াংশের অনুমোদন ও নতুন স্বাগতিক দেশের সঙ্গে সমঝোতা দরকার। সম্ভাব্য বিকল্প স্থানগুলোর মধ্যে রয়েছে:

জেনেভা (সুইজারল্যান্ড): জাতিসংঘের মানবাধিকার ও স্বাস্থ্য সংস্থার কেন্দ্র। নিরপেক্ষ ও বহুভাষিক পরিবেশে উপযুক্ত, কিন্তু ব্যয়বহুল ও অতিরিক্ত ভিড় রয়েছে।

ভিয়েনা (অস্ট্রিয়া): এখানে মাদক ও পারমাণবিক শক্তি সংক্রান্ত জাতিসংঘ অফিস আছে। নিরাপদ হলেও পরিসর ছোট এবং ইউরোপকেন্দ্রিক পক্ষপাতের ঝুঁকি আছে।

নাইরোবি (কেনিয়া): এই শহরে পরিবেশ ও মানব বসতি সংস্থার কেন্দ্র আছে। ২০২৬ সালের মধ্যে আরও তিনটি সংস্থার সদরদপ্তর স্থাপনের পরিকল্পনা আছে। ব্যয় কম, তবে নিরাপত্তা ও অবকাঠামো দুর্বল।

অন্যান্য (দোহা, কিগালি, ভ্যালেন্সিয়া): এগুলো উদীয়মান, কম ব্যয়বহুল শহর হলেও রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে।

সদর দপ্তর স্থানান্তরে ব্যয় হবে এক বিলিয়ন ডলারের বেশি এবং ১৯৩টি প্রতিনিধিদলের কার্যক্রম সাময়িকভাবে ব্যাহত হবে। তবুও অনেক এক্সে দাবি তুলেছেন, ‘সদরদপ্তর নরওয়েতে সরিয়ে নাও, যুক্তরাষ্ট্রকে বাদ দাও।’

সংস্কার না হলে ধ্বংস

জাতিসংঘ যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া টিকে থাকতে পারে, তবে সেটি হবে আরও ছোট, সংস্কারকৃত ও কম আমেরিকাকেন্দ্রিক—যেখানে অগ্রাধিকার থাকবে মানবিক সহায়তা ও বৈশ্বিক মানদণ্ড রক্ষায়।

মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের ২০২৫ সালের ‘গ্লোবাল গভর্নেন্স’ ধারণা রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের ওপর বেশি প্রভাব ফেলার অভিযোগে সমালোচিত হলেও, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংক্রান্ত প্রস্তাবগুলো আশার আলো দেখিয়েছে।

কার্নেগি ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞরা নিরাপত্তা পরিষদে ন্যায্য প্রতিনিধিত্বের জন্য সংস্কারের আহ্বান জানিয়েছেন। বিল্ডটের ভাষায়, ‘শত্রুভাবাপন্ন আমেরিকায় থাকা মানে নরকে থাকা।’ অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র ত্যাগ করলে জাতিসংঘ নতুনভাবে বিকশিত হতে পারে—তবে এজন্য বৈশ্বিক ঐক্য অপরিহার্য।

এখন জাতিসংঘের সামনে দুটি পথ—সংস্কার ও অভিযোজন, অথবা ধীরে ধীরে বিলুপ্তি।

তথ্যসূত্র: আল-জাজিরা, দ্য গার্ডিয়ান, প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ডেমোক্রেসি নাও

Ad 300x250

সম্পর্কিত