সৈকত আমীন
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে পতনের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে শেখ হাসিনার টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনের। শেখ হাসিনার এই শাসনামলকে দেশের মানুষ ফ্যাসিবাদী শাসন এবং তাঁকে ফ্যাসিস্ট হিসেবে চিহ্নিত করে আসছে অনেকদিন ধরেই। কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্র কাঠামোতে এই ফ্যাসিবাদের শুরু হয়েছিল কীভাবে? আর কীইবা ছিল সেই ফ্যাসিবাদের পরিণতি! ইতিহাসের পথ ধরে চলুন তা জেনে নেওয়া যাক।
ফ্যাসিবাদ ইতিহাসের পাতা থেকে জানা কোনো দূরবর্তী ঘটনা নয়; এটি আধুনিক রাষ্ট্রের ভেতরে জন্ম নিয়েছিল অস্থির সময়, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব এবং সামাজিক সংকটের মধ্য দিয়ে। ইতালির উদাহরণ দেখায়, কীভাবে একজন তেজি নেতা বেনিতো মুসোলিনি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতাকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতা দখল করেন। তাঁর উত্থান থেকে আমরা দেখতে পাই যে ফ্যাসিবাদ কেবল রাজনৈতিক কৌশল নয়, বরং মানুষের আশঙ্কা, হতাশা এবং স্বার্থের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত একটি সামাজিক প্রক্রিয়া।
১৯১৮ সাল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তখন শেষ হয়েছে। যুদ্ধে ইতালি প্রথমে নিরপেক্ষ ছিল। পরে ১৯১৫ সালে মিত্রশক্তির সঙ্গে যুক্ত হয়। ইতালি ভেবেছিল, যুদ্ধে জয়ী হলে অনেক নতুন ভূখণ্ড পাবে। ভূ-রাজনীতিতে পাবে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান। মিত্র শক্তিতে যোগ দেওয়ার ফলে লন্ডনে এক চুক্তিতে ব্রিটেন ও ফ্রান্স এমনটাই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ইতালিকে। কিন্তু যুদ্ধ শেষ হলে প্রতিশ্রুতির কিছুই ইতালি পায়নি। এতে ইতালির মানুষ স্বাভাবিকভাবেই নিজেদের প্রতারিত মনে করল।
যুদ্ধে প্রায় ছয় লাখ ইতালীয় সৈন্য মারা যায়। দেশের অর্থনীতি নেমে এসেছিল তলানিতে। বাজারে বেড়ে গিয়েছিল পণ্যের দাম। ঘরে ঘরে বেকার যুবক আর যুদ্ধাহত সৈনিক নিয়ে কঠিন বাস্তবতার মুখে পড়েছিল ইতালির জনজীবন।
এরপর আসে আলোচিত ১৯১৯-১৯২০ সাল; যা ‘রেড বিয়েনিয়াম’ বা ‘লাল দুই বছর’ নামে পরিচিত। প্রশাসনের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওই সময় শ্রমিক ও কৃষকেরা নেমে পড়ে রাজপথে। ইতালিতে চলতে থাকে লাগাতার আন্দোলন ও ধর্মঘট। শ্রমিকরা কারখানার দখল নিতে শুরু করে, আর কৃষকেরা দখল নিতে শুরু করে আবাদি জমি। ধনী জমিদার ও শিল্পপতিদের সঙ্গে প্রায়ই তাদের সংঘর্ষ হতো। এভাবে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছিল ভীষণ বিশৃঙ্খলা।
এ সময়ে ইতালির সমাজতান্ত্রিক দল শক্তিশালী হয়ে ওঠে। অনেকে ভাবতে লাগল, রাশিয়ার মতো ইতালিতেও হয়তো কমিউনিস্ট বিপ্লব হবে। ইতালিতে তখন উদারপন্থী সরকার সমস্যার সমাধান করতে পারছিল না। একদিকে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন, অন্যদিকে অসন্তুষ্ট সাধারণ মানুষ। দুই পক্ষেরই ক্ষোভ সামলাতে গিয়ে সরকার দুর্বল হয়ে পড়েছিল।
এই অস্থির পরিস্থিতিই পরবর্তীতে ইতালিতে নতুন রাজনৈতিক শক্তির উত্থানের পথ তৈরি করে দেয়। আর সেই উত্থানের প্রথম সারিতে ছিলেন বেনিতো মুসোলিনি নামের এক যুবক।
বেনিতো মুসোলিনি জন্মেছিলেন ১৮৮৩ সালে। তরুণ বয়সে তিনি ইতালির সমাজতান্ত্রিক দলের সদস্য। তিনি ছিলেন খুবই তেজি বক্তা ও লেখক। পার্টির মুখপত্র ‘আভান্তি’ নামের সমাজতান্ত্রিক পত্রিকাটির সম্পাদনাও করতেন মুসলিনি।
সমাজতান্ত্রিক দল বিশ্বযুদ্ধে ইতালির যোগ দেওয়ার বিরোধিতা করছিল। তবে মুসোলিনি ছিল যুদ্ধের পক্ষে। তিনি মনে করতেন ইতালি যুদ্ধে যোগ দিলে দেশের সুবিধা হবে। মুসলিনির অবস্থানের কারণে ১৯১৪ সালে তাকে পার্টি থেকে বহিষ্কার করা হয়। পত্রিকা থেকেও তাঁকে সরিয়ে দেয়া হয়।
এরপর মুসলিনি নিজেই নতুন পত্রিকা চালু করেন। নাম ছিল ‘ইল পোপোলো দি ইতালিয়া’। অর্থ ‘ইতালির জনগণ’। এই পত্রিকা বিশ্বযুদ্ধ পক্ষে ও জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারার প্রচার চালাত। ধীরে ধীরে মুসোলিনি সমাজতন্ত্র থেকে সরে গিয়ে জাতীয়তাবাদী ও ডানপন্থী রাজনীতির দিকে চলে যান।
১৯১৯ সালে ইতালির মিলান শহরে মুসলিনি ‘ফাশি ইতালিয়ানি দি কোম্বাত্তিমেন্তো’ বা ‘ইতালীয় যুদ্ধসংগ্রামী সংঘ’ নামে সংগঠন গড়ে তোলেন। এটিই পরে রূপ নেয় জাতীয় ফ্যাসিস্ট পার্টিতে।
প্রথম দিকে তাঁর দলটার দাবি কর্মঘণ্টা কমানো, নারীদের ভোটাধিকার দেওয়া মতো কিছু উদারপন্থী দাবি। কিন্তু দ্রুত মুসোলিনি কৌশল বদলান। রাজনৈতিক অস্থিরতাকে কাজে লাগিয়ে যুদ্ধফেরত সৈনিক, জাতীয়তাবাদী তরুণ আর সমাজতন্ত্রী-বিরোধী ব্যবসায়ী শ্রেণির মনোযোগ আকর্ষণ করতে একের পর এক উগ্র জাতীয়তাবাদী দাবি সামনে নিয়ে আসতে থাকে তাঁর দল।
ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে দলটির সন্ত্রাসী বাহিনী ‘ব্ল্যাকশার্টস’। তারা শ্রমিক ধর্মঘট দমন করত, সমাজতন্ত্রী ও ইউনিয়ন নেতাদের আক্রমণ করত। স্থানীয় ধনী ও জমিদার শ্রেণি তাদের সমর্থন করত। কারণ দলটি তাঁদের সম্পত্তি ও ব্যবসা পাহাড়া দিত।
শুরুতে মুসোলিনি ফ্যাসিস্ট, উদারপন্থী ও ক্যাথলিকদের নিয়ে একটি জোট সরকার গঠন করেছিলেন। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি নিজের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করতে শুরু করেন। ১৯২২ সালে রাজা মুসোলিনিকে প্রধান মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন।
১৯২৩ সালে মুসলিনি ‘ভলান্টারি মিলিশিয়া ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি’ নামে একটি বাহিনী তৈরি করেন জাতীয় স্বার্থ রক্ষার নামে। দ্রুতই তা তাঁর ব্যক্তিগত সেনাবাহিনীতে রূপ নেয়।
পরের বছর, ১৯২৪ সালের নির্বাচনে ফ্যাসিস্টরা ব্যাপক সহিংসতা করে ভোট জালিয়াতি করে। নির্বাচনের পর সমাজতান্ত্রিক নেতা জিয়াকোমো মাত্তেওত্তি প্রকাশ্যে এই কারচুপির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান। কিছুদিনের মধ্যেই ফ্যাসিস্ট গুন্ডারা তাকে খুন করে ফেলে। এতে দেশজুড়ে তীব্র সংকট তৈরি হয়।
অনেক মানুষ রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করলেও মুসোলিনি পরিস্থিতিকে নিজের পক্ষে কাজে লাগান। ১৯২৫ সালে তিনি নিজেকে একনায়ক ঘোষণা করেন। এরপর তিনি অন্য সব রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করেন, সংবাদপত্রে চালু করেন সেন্সরশিপ এবং ‘ওভরা’ নামে গোপন পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলেন।
মানুষ তাঁদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা হারাতে শুরু করে। ১৯২৬ সালের মধ্যে ইতালি একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত হয়। বিরোধী নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়, নির্বাসনে পাঠানো হয় বা হত্যা করা হয়। মুসোলিনির শাসনে প্রায় ২,০০০ রাজনৈতিক বিরোধী নিহত হন। ১৯২৭ থেকে ১৯৩৭ সালের মধ্যে আদালত ৩,৫৯৬ জনকে মোট ১৫,০০০ বছরের বেশি কারাদণ্ড দেয়। অনেকেই বিদেশে পালিয়ে যান। সরকার মানুষকে প্রতিবেশীর ওপর নজরদারি করতে উৎসাহিত করতে শুরু করে। সর্বত্র ভয় ও সন্দেহের পরিবেশ তৈরি হয়।
মুসলিনি সরকার গঠনের পর অনেকেই ধারণা করেছিল স্বাধীনতা কিছুটা কমে গেলেও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ভালোর দিকে যেতে পারে। কিন্তু তেমন হয়নি। মুসোলিনি জলাভূমি শুকিয়ে জমি বানান, সড়ক নির্মাণ করেন এবং সরকারি প্রকল্প শুরু করেন। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এসব নীতি ব্যর্থ হয়। ধর্মঘট নিষিদ্ধ করা হয় এবং শ্রমিকদের মজুরিও কমিয়ে দেয়া হয়।
১৯৩০-এর ইতালিতে দেখা দেয় বিশাল অর্থনৈতিক মন্দা। কৃষকদের জোর করে শুধু গম উৎপাদন করানো হতো। এতে অন্য ফসলের উৎপাদন কমে যায়। ১৯৪০-এর দশকে এসে বহু ইতালীয় দারিদ্র্য আর খাদ্যসংকটে ভুগতে থাকে।
অর্থনৈতিক দিক ছাড়াও সামাজিক দিক থেকে মুসোলিনির শাসন মানুষের দৈনন্দিন জীবন নিয়ন্ত্রণ করত। স্কুলে শিশুদের ফ্যাসিবাদী মতবাদ শেখানো হতো। যুব সংগঠনের মাধ্যমে তরুণদের করা হতো মগজধোলাই। নারীদের বলা হতো ঘরে থাকতে এবং বেশি সন্তান জন্ম দিতে। তবে এসব কর্মসূচী দিয়ে তেমন লাভ হয়নি। জন্মহার ক্রমশ কমেই যাচ্ছিল।
দুর্ভিক্ষের গ্লানি কাটাতে মুসোলিনি বেছে নিয়েছিলেন বিরত্বগাথা তৈরির এক সহজ পথ। ১৯৩৫ সালে মুসলিনির ইতালি আক্রমণ করে বসে দুর্বল দেশ ইথিওপিয়াকে। সেখানে বিষাক্ত গ্যাস ব্যবহার করে হাজার হাজার নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করা হয়। এই ঘটনার পর ইতালি আন্তর্জাতিকভাবে একঘরে হয়ে পড়ে। একইসাথে লীগ অব নেশনসে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার কবলেও পড়ে দেশটি।
এসব গ্লানি থেকে উত্তরণের পথ খুঁজতে গিয়ে ১৯৩৯ সালে মুসোলিনি জোট বাঁধেন জার্মানির প্রশাসক ও নাৎসীদের প্রধান হিটলারের সঙ্গে । ১৯৪০ সালে ইতালি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেয়, কিন্তু তাদের সেনাবাহিনী ছিল দুর্বল। পুরো যুদ্ধে প্রায় সাড়ে ৪ লাখ ইতালীয় প্রাণ হারায়।
১৯৪৩ সালে মিত্রশক্তি ইতালির অধ্যুষিত সিসিলিতে আক্রমণ চালায়, আর সেখান থেকেই শুরু হয় মুসোলিনির পতন। এই সময়েই ইতালিতে গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাজা তৃতীয় ভিক্টর ইমানুয়েল গ্রেপ্তার করেন মুসোলিনিকে।
মুসোলিনির পতনের পর জার্মানি উত্তর ইতালি দখল করে। তারা মুসোলিনিকে মুক্ত করে ইতালিয়ান সোশ্যাল রিপাবলিক নামে জার্মানদের নিয়ন্ত্রণে থাকা একটি ‘পাপেট রাষ্ট্র’ চালানোর দায়িত্ব দেয়।
এই সময় বিভিন্ন প্রতিরোধী গ্রুপ জার্মান সেনা এবং ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে। অবশেষে ১৯৪৫ সালে প্রতিরোধ যোদ্ধারা মুসোলিনিকে ধরতে সক্ষম হয়। তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।
মুসোলিনির শাসনকাল ইতালির জন্য দীর্ঘ ২১ বছর অন্ধকারের মতো ছিল। একনায়কতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা, গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার নিঃশেষ, অর্থনৈতিক ব্যর্থতা এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিপর্যয়—সবই ফ্যাসিবাদের বিপজ্জনক প্রভাবের নিদর্শন। ইতিহাস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক বিভাজন এবং মানুষের হতাশা একসাথে মিললে সহজেই একনায়কতন্ত্র ও স্বৈরশাসনের পথ খুলে দেয়। এ থেকেই শিক্ষা নেওয়া যায় যে গণতন্ত্র, সামাজিক সংহতি এবং মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষায় সতর্ক থাকা জরুরি।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে পতনের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে শেখ হাসিনার টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনের। শেখ হাসিনার এই শাসনামলকে দেশের মানুষ ফ্যাসিবাদী শাসন এবং তাঁকে ফ্যাসিস্ট হিসেবে চিহ্নিত করে আসছে অনেকদিন ধরেই। কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্র কাঠামোতে এই ফ্যাসিবাদের শুরু হয়েছিল কীভাবে? আর কীইবা ছিল সেই ফ্যাসিবাদের পরিণতি! ইতিহাসের পথ ধরে চলুন তা জেনে নেওয়া যাক।
ফ্যাসিবাদ ইতিহাসের পাতা থেকে জানা কোনো দূরবর্তী ঘটনা নয়; এটি আধুনিক রাষ্ট্রের ভেতরে জন্ম নিয়েছিল অস্থির সময়, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব এবং সামাজিক সংকটের মধ্য দিয়ে। ইতালির উদাহরণ দেখায়, কীভাবে একজন তেজি নেতা বেনিতো মুসোলিনি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতাকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতা দখল করেন। তাঁর উত্থান থেকে আমরা দেখতে পাই যে ফ্যাসিবাদ কেবল রাজনৈতিক কৌশল নয়, বরং মানুষের আশঙ্কা, হতাশা এবং স্বার্থের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত একটি সামাজিক প্রক্রিয়া।
১৯১৮ সাল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তখন শেষ হয়েছে। যুদ্ধে ইতালি প্রথমে নিরপেক্ষ ছিল। পরে ১৯১৫ সালে মিত্রশক্তির সঙ্গে যুক্ত হয়। ইতালি ভেবেছিল, যুদ্ধে জয়ী হলে অনেক নতুন ভূখণ্ড পাবে। ভূ-রাজনীতিতে পাবে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান। মিত্র শক্তিতে যোগ দেওয়ার ফলে লন্ডনে এক চুক্তিতে ব্রিটেন ও ফ্রান্স এমনটাই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ইতালিকে। কিন্তু যুদ্ধ শেষ হলে প্রতিশ্রুতির কিছুই ইতালি পায়নি। এতে ইতালির মানুষ স্বাভাবিকভাবেই নিজেদের প্রতারিত মনে করল।
যুদ্ধে প্রায় ছয় লাখ ইতালীয় সৈন্য মারা যায়। দেশের অর্থনীতি নেমে এসেছিল তলানিতে। বাজারে বেড়ে গিয়েছিল পণ্যের দাম। ঘরে ঘরে বেকার যুবক আর যুদ্ধাহত সৈনিক নিয়ে কঠিন বাস্তবতার মুখে পড়েছিল ইতালির জনজীবন।
এরপর আসে আলোচিত ১৯১৯-১৯২০ সাল; যা ‘রেড বিয়েনিয়াম’ বা ‘লাল দুই বছর’ নামে পরিচিত। প্রশাসনের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওই সময় শ্রমিক ও কৃষকেরা নেমে পড়ে রাজপথে। ইতালিতে চলতে থাকে লাগাতার আন্দোলন ও ধর্মঘট। শ্রমিকরা কারখানার দখল নিতে শুরু করে, আর কৃষকেরা দখল নিতে শুরু করে আবাদি জমি। ধনী জমিদার ও শিল্পপতিদের সঙ্গে প্রায়ই তাদের সংঘর্ষ হতো। এভাবে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছিল ভীষণ বিশৃঙ্খলা।
এ সময়ে ইতালির সমাজতান্ত্রিক দল শক্তিশালী হয়ে ওঠে। অনেকে ভাবতে লাগল, রাশিয়ার মতো ইতালিতেও হয়তো কমিউনিস্ট বিপ্লব হবে। ইতালিতে তখন উদারপন্থী সরকার সমস্যার সমাধান করতে পারছিল না। একদিকে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন, অন্যদিকে অসন্তুষ্ট সাধারণ মানুষ। দুই পক্ষেরই ক্ষোভ সামলাতে গিয়ে সরকার দুর্বল হয়ে পড়েছিল।
এই অস্থির পরিস্থিতিই পরবর্তীতে ইতালিতে নতুন রাজনৈতিক শক্তির উত্থানের পথ তৈরি করে দেয়। আর সেই উত্থানের প্রথম সারিতে ছিলেন বেনিতো মুসোলিনি নামের এক যুবক।
বেনিতো মুসোলিনি জন্মেছিলেন ১৮৮৩ সালে। তরুণ বয়সে তিনি ইতালির সমাজতান্ত্রিক দলের সদস্য। তিনি ছিলেন খুবই তেজি বক্তা ও লেখক। পার্টির মুখপত্র ‘আভান্তি’ নামের সমাজতান্ত্রিক পত্রিকাটির সম্পাদনাও করতেন মুসলিনি।
সমাজতান্ত্রিক দল বিশ্বযুদ্ধে ইতালির যোগ দেওয়ার বিরোধিতা করছিল। তবে মুসোলিনি ছিল যুদ্ধের পক্ষে। তিনি মনে করতেন ইতালি যুদ্ধে যোগ দিলে দেশের সুবিধা হবে। মুসলিনির অবস্থানের কারণে ১৯১৪ সালে তাকে পার্টি থেকে বহিষ্কার করা হয়। পত্রিকা থেকেও তাঁকে সরিয়ে দেয়া হয়।
এরপর মুসলিনি নিজেই নতুন পত্রিকা চালু করেন। নাম ছিল ‘ইল পোপোলো দি ইতালিয়া’। অর্থ ‘ইতালির জনগণ’। এই পত্রিকা বিশ্বযুদ্ধ পক্ষে ও জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারার প্রচার চালাত। ধীরে ধীরে মুসোলিনি সমাজতন্ত্র থেকে সরে গিয়ে জাতীয়তাবাদী ও ডানপন্থী রাজনীতির দিকে চলে যান।
১৯১৯ সালে ইতালির মিলান শহরে মুসলিনি ‘ফাশি ইতালিয়ানি দি কোম্বাত্তিমেন্তো’ বা ‘ইতালীয় যুদ্ধসংগ্রামী সংঘ’ নামে সংগঠন গড়ে তোলেন। এটিই পরে রূপ নেয় জাতীয় ফ্যাসিস্ট পার্টিতে।
প্রথম দিকে তাঁর দলটার দাবি কর্মঘণ্টা কমানো, নারীদের ভোটাধিকার দেওয়া মতো কিছু উদারপন্থী দাবি। কিন্তু দ্রুত মুসোলিনি কৌশল বদলান। রাজনৈতিক অস্থিরতাকে কাজে লাগিয়ে যুদ্ধফেরত সৈনিক, জাতীয়তাবাদী তরুণ আর সমাজতন্ত্রী-বিরোধী ব্যবসায়ী শ্রেণির মনোযোগ আকর্ষণ করতে একের পর এক উগ্র জাতীয়তাবাদী দাবি সামনে নিয়ে আসতে থাকে তাঁর দল।
ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে দলটির সন্ত্রাসী বাহিনী ‘ব্ল্যাকশার্টস’। তারা শ্রমিক ধর্মঘট দমন করত, সমাজতন্ত্রী ও ইউনিয়ন নেতাদের আক্রমণ করত। স্থানীয় ধনী ও জমিদার শ্রেণি তাদের সমর্থন করত। কারণ দলটি তাঁদের সম্পত্তি ও ব্যবসা পাহাড়া দিত।
শুরুতে মুসোলিনি ফ্যাসিস্ট, উদারপন্থী ও ক্যাথলিকদের নিয়ে একটি জোট সরকার গঠন করেছিলেন। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি নিজের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করতে শুরু করেন। ১৯২২ সালে রাজা মুসোলিনিকে প্রধান মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন।
১৯২৩ সালে মুসলিনি ‘ভলান্টারি মিলিশিয়া ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি’ নামে একটি বাহিনী তৈরি করেন জাতীয় স্বার্থ রক্ষার নামে। দ্রুতই তা তাঁর ব্যক্তিগত সেনাবাহিনীতে রূপ নেয়।
পরের বছর, ১৯২৪ সালের নির্বাচনে ফ্যাসিস্টরা ব্যাপক সহিংসতা করে ভোট জালিয়াতি করে। নির্বাচনের পর সমাজতান্ত্রিক নেতা জিয়াকোমো মাত্তেওত্তি প্রকাশ্যে এই কারচুপির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান। কিছুদিনের মধ্যেই ফ্যাসিস্ট গুন্ডারা তাকে খুন করে ফেলে। এতে দেশজুড়ে তীব্র সংকট তৈরি হয়।
অনেক মানুষ রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করলেও মুসোলিনি পরিস্থিতিকে নিজের পক্ষে কাজে লাগান। ১৯২৫ সালে তিনি নিজেকে একনায়ক ঘোষণা করেন। এরপর তিনি অন্য সব রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করেন, সংবাদপত্রে চালু করেন সেন্সরশিপ এবং ‘ওভরা’ নামে গোপন পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলেন।
মানুষ তাঁদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা হারাতে শুরু করে। ১৯২৬ সালের মধ্যে ইতালি একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত হয়। বিরোধী নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়, নির্বাসনে পাঠানো হয় বা হত্যা করা হয়। মুসোলিনির শাসনে প্রায় ২,০০০ রাজনৈতিক বিরোধী নিহত হন। ১৯২৭ থেকে ১৯৩৭ সালের মধ্যে আদালত ৩,৫৯৬ জনকে মোট ১৫,০০০ বছরের বেশি কারাদণ্ড দেয়। অনেকেই বিদেশে পালিয়ে যান। সরকার মানুষকে প্রতিবেশীর ওপর নজরদারি করতে উৎসাহিত করতে শুরু করে। সর্বত্র ভয় ও সন্দেহের পরিবেশ তৈরি হয়।
মুসলিনি সরকার গঠনের পর অনেকেই ধারণা করেছিল স্বাধীনতা কিছুটা কমে গেলেও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ভালোর দিকে যেতে পারে। কিন্তু তেমন হয়নি। মুসোলিনি জলাভূমি শুকিয়ে জমি বানান, সড়ক নির্মাণ করেন এবং সরকারি প্রকল্প শুরু করেন। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এসব নীতি ব্যর্থ হয়। ধর্মঘট নিষিদ্ধ করা হয় এবং শ্রমিকদের মজুরিও কমিয়ে দেয়া হয়।
১৯৩০-এর ইতালিতে দেখা দেয় বিশাল অর্থনৈতিক মন্দা। কৃষকদের জোর করে শুধু গম উৎপাদন করানো হতো। এতে অন্য ফসলের উৎপাদন কমে যায়। ১৯৪০-এর দশকে এসে বহু ইতালীয় দারিদ্র্য আর খাদ্যসংকটে ভুগতে থাকে।
অর্থনৈতিক দিক ছাড়াও সামাজিক দিক থেকে মুসোলিনির শাসন মানুষের দৈনন্দিন জীবন নিয়ন্ত্রণ করত। স্কুলে শিশুদের ফ্যাসিবাদী মতবাদ শেখানো হতো। যুব সংগঠনের মাধ্যমে তরুণদের করা হতো মগজধোলাই। নারীদের বলা হতো ঘরে থাকতে এবং বেশি সন্তান জন্ম দিতে। তবে এসব কর্মসূচী দিয়ে তেমন লাভ হয়নি। জন্মহার ক্রমশ কমেই যাচ্ছিল।
দুর্ভিক্ষের গ্লানি কাটাতে মুসোলিনি বেছে নিয়েছিলেন বিরত্বগাথা তৈরির এক সহজ পথ। ১৯৩৫ সালে মুসলিনির ইতালি আক্রমণ করে বসে দুর্বল দেশ ইথিওপিয়াকে। সেখানে বিষাক্ত গ্যাস ব্যবহার করে হাজার হাজার নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করা হয়। এই ঘটনার পর ইতালি আন্তর্জাতিকভাবে একঘরে হয়ে পড়ে। একইসাথে লীগ অব নেশনসে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার কবলেও পড়ে দেশটি।
এসব গ্লানি থেকে উত্তরণের পথ খুঁজতে গিয়ে ১৯৩৯ সালে মুসোলিনি জোট বাঁধেন জার্মানির প্রশাসক ও নাৎসীদের প্রধান হিটলারের সঙ্গে । ১৯৪০ সালে ইতালি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেয়, কিন্তু তাদের সেনাবাহিনী ছিল দুর্বল। পুরো যুদ্ধে প্রায় সাড়ে ৪ লাখ ইতালীয় প্রাণ হারায়।
১৯৪৩ সালে মিত্রশক্তি ইতালির অধ্যুষিত সিসিলিতে আক্রমণ চালায়, আর সেখান থেকেই শুরু হয় মুসোলিনির পতন। এই সময়েই ইতালিতে গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাজা তৃতীয় ভিক্টর ইমানুয়েল গ্রেপ্তার করেন মুসোলিনিকে।
মুসোলিনির পতনের পর জার্মানি উত্তর ইতালি দখল করে। তারা মুসোলিনিকে মুক্ত করে ইতালিয়ান সোশ্যাল রিপাবলিক নামে জার্মানদের নিয়ন্ত্রণে থাকা একটি ‘পাপেট রাষ্ট্র’ চালানোর দায়িত্ব দেয়।
এই সময় বিভিন্ন প্রতিরোধী গ্রুপ জার্মান সেনা এবং ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে। অবশেষে ১৯৪৫ সালে প্রতিরোধ যোদ্ধারা মুসোলিনিকে ধরতে সক্ষম হয়। তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।
মুসোলিনির শাসনকাল ইতালির জন্য দীর্ঘ ২১ বছর অন্ধকারের মতো ছিল। একনায়কতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা, গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার নিঃশেষ, অর্থনৈতিক ব্যর্থতা এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিপর্যয়—সবই ফ্যাসিবাদের বিপজ্জনক প্রভাবের নিদর্শন। ইতিহাস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক বিভাজন এবং মানুষের হতাশা একসাথে মিললে সহজেই একনায়কতন্ত্র ও স্বৈরশাসনের পথ খুলে দেয়। এ থেকেই শিক্ষা নেওয়া যায় যে গণতন্ত্র, সামাজিক সংহতি এবং মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষায় সতর্ক থাকা জরুরি।
ঢাকায় আজ (৭ অক্টোবর, মঙ্গলবার) চতুর্থ বাংলাদেশ-তুরস্ক ফরেইন অফিস কনসালটেশন (এফওসি) বা পররাষ্ট্র দপ্তর পরামর্শ বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বৈঠকটি তুরস্কের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এ লক্ষ্যে তুরস্কের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ বেরিস একিনসি গতকাল সোমবার সকালে দুই দিনের সফরে ঢাকায় আসেন।
১ দিন আগেমার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগেই চীন তাদের প্রোটোটাইপ ‘গোল্ডেন ডোম’ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা চালু করেছে। এটি প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দেশের অস্ত্র প্রতিযোগিতার এমন একটি নতুন ধাপ দেখাচ্ছে, যেখানে নিরাপত্তার আকাঙ্ক্ষা পারমাণবিক ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
২ দিন আগেবৈশ্বিক চিত্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বাস্তবতার কোনো মিল নেই। এখানে ক্যানসার কেবল বাড়ছেই না, বরং এক নীরব মহামারির মতো কেড়ে নিচ্ছে বিপুল সংখ্যক প্রাণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, দেশে নতুন শনাক্ত হওয়া প্রতি তিনজন ক্যানসার রোগীর মধ্যে দুজনেরই মৃত্যু হচ্ছে।
২ দিন আগেপাকিস্তান বহু দশক ধরে নাগরিকদের ওপর নজরদারি করে আসছে। আর আধুনিক ডিজিটাল প্রযুক্তি এখন একে আরও সহজ করেছে।
৩ দিন আগে