রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে বিশেষ সাক্ষাৎকার: অধ্যাপক রাহমান নাসির উদ্দিন
আট বছর পেরিয়ে গেলেও রোহিঙ্গা সংকটের কার্যকর কোনও সমাধান হয়নি। ভবিষ্যতও অনিশ্চিত। এই সংকট এখন কার্যত ‘স্থবির অবস্থায়’ রয়েছে। কারণ সমাধান শুধু বাংলাদেশ–মিয়ানমারের উপর নির্ভর করছে না। বরং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সক্রিয় ভূমিকাও জরুরি। এ নিয়ে স্ট্রিমের সঙ্গে কথা বলেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক রাহমান নাসির উদ্দিন
স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম: আন্তর্জাতিক ও দেশীয়ভাবে রোহিঙ্গা ইস্যুটি এখন কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে?
রাহমান নাসির উদ্দিন: যদি আমরা রোহিঙ্গা ইস্যুকে ‘রোহিঙ্গা সংকট’ বা ‘রোহিঙ্গা সমস্যা’ হিসেবে দেখি, তাহলে এটি বর্তমানে একটি ‘স্ট্যান্ড স্টিল’ অর্থাৎ স্থবির অবস্থায় রয়েছে।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্টে প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এর আগে থেকে বাংলাদেশে প্রায় তিন থেকে চার লাখ রোহিঙ্গা অবস্থান করছিল। তারা ১৯৭৮, ১৯৯১-৯২, ২০১২ এবং ২০১৬ সালে প্রবেশ করেছিল। আট বছর পর ২০২৫ সালের এই মুহূর্তে সংখ্যাটি প্রায় ১৩ লাখের বেশি।
শরণার্থী সংকট সমাধানের তিনটি আন্তর্জাতিক মডেল এখানে অকার্যকর বলে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান স্থবির অবস্থায় রয়েছে। প্রথমটি হলো লোকাল ইন্টিগ্রেশন অর্থাৎ রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে সমাজে একীকরণ। কিন্তু বর্তমানে এর সম্ভাবনা খুবই সীমিত। দ্বিতীয়টি হলো থার্ড কান্ট্রি রিসেটেলমেন্ট বা রোহিঙ্গাদের তৃতীয় কোনো দেশে পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া। গত আট বছরে কোনো দেশ স্বেচ্ছায় রোহিঙ্গাদের গ্রহণের প্রস্তাব দেয়নি। শেষ বিকল্প হলো ভলেন্টারি রেপেট্রেশন, অর্থাৎ স্বেচ্ছায় রোহিঙ্গাদের রাখাইন রাজ্যে ফেরত পাঠানো। তবে এর সম্ভাবনাও খুব ক্ষীণ। কারণ মিয়ানমার এখন রাজনৈতিক ও নিরাপত্তাগত সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। রাখাইন রাজ্যের ওপর মিয়ানমার সরকারের কোনো কার্যকর কর্তৃত্ব নেই। আরাকান আর্মি রাজ্যের প্রায় ৯০ শতাংশ এলাকা দখল করে আছে।
বাংলাদেশের পক্ষে আরাকান আর্মির সঙ্গে ফরমাল ডায়লগ শুরু করাও সম্ভব নয়। কারণ আরাকান আর্মি একটি বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠী। তাদের সঙ্গে ডিপ্লোম্যাটিক নর্মস অনুসারে সশস্ত্র বিদ্রোহী সংগঠনের সঙ্গে সরাসরি আলাপ করা যায় না। ফলে রোহিঙ্গা সমস্যা এখন একটি স্ট্যান্ড স্টিল অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে।
স্ট্রিম: মিয়ানমারের আসন্ন নির্বাচনে নতুন সরকার ক্ষমতায় এলে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে নতুন করে আলাপ-আলোচনার সুযোগ তৈরি হবে কী?
রাহমান নাসির উদ্দিন: নির্বাচন ও নতুন সরকার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে প্রভাব ফেলতে পারে। যদি ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) নির্বাচিত হয়, তবে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর আলোচনার সম্ভাবনা কিছুটা বাড়তে পারে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্টেকহোল্ডার হলো আরাকান আর্মি। তারা রোহিঙ্গাদের প্রতি কতটা সংবেদনশীল তা এখনও অনিশ্চিত। নতুন সরকার আসলেও, রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো সম্ভব হবে কি না, তা মূলত আরাকান আর্মির দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভর করবে।
স্ট্রিম: সম্প্রতি বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে আবারও নতুন করে রোহিঙ্গারা প্রবেশ করছে। এই পরিস্থিতিতে আমাদের প্রস্তুতি কেমন?
রাহমান নাসির উদ্দিন: আসলে সংখ্যার বিচারে এটি বড় চ্যালেঞ্জ। ইতিমধ্যেই প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করছে। নতুন করে প্রায় দেড় লাখ রোহিঙ্গা আসছে। আন্তর্জাতিকভাবে শরণার্থী ব্যবস্থাপনার স্ট্যান্ডার্ড হলো—যখন মানুষ প্রাণ ও নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে থাকে, তারা নিকটবর্তী দেশে আশ্রয় নেয়।
২০১৭ সালের ঘটনা মনে করুন। তখন বাংলাদেশ সরকার বর্ডার খোলার জন্য প্রস্তুত ছিল না। কিন্তু হিউম্যানিটারিয়ান প্রেসারের কারণে সীমান্ত খোলা হয়। যখন মানুষ প্রাণহানির ঝুঁকিতে সীমান্তে আসে, তাদের জীবন রক্ষার জন্য আশ্রয় দিতে হয়। বর্তমানে, নতুন প্রবেশকারীদের জন্যও একই নীতিগত চিন্তাভাবনা প্রযোজ্য।
এটি শুধু বাংলাদেশের সমস্যা নয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেও বোঝাতে হবে যে, ১৫ লাখের বেশি রোহিঙ্গা এখানে বসবাস করলে দেশের অর্থনীতি, সামাজিক ব্যবস্থা, নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বড় প্রভাব পড়বে। এই বোঝাপড়া ছাড়া কোনো টেকসই সমাধান সম্ভব নয়।
স্ট্রিম: বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে অনেক সময়ই রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে আশার আলো দেখানোর চেষ্টা হয়েছে। সেই আলোগুলো আসলে কী রকম এবং কতটুকু প্রসারিত বা ক্ষীণ?
রাহমান নাসির উদ্দিন: বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে অনেক আলোচনা, কনফারেন্স, টকশো এবং নীতি নির্ধারণ চলছে। তবে বাস্তব পরিস্থিতি বা গ্রাউন্ড রিয়ালিটি বোঝা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। রোহিঙ্গারা যদি স্বেচ্ছায় তাদের দেশে ফিরতে না চায়, তাহলে আন্তর্জাতিক বিধি অনুযায়ী তাদের জোর করে ফেরত পাঠানো সম্ভব নয়। আন্তর্জাতিক কিংবা স্থানীয় কোনো স্টেকহোল্ডার এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা, নাগরিকত্ব, মানবিক মর্যাদা এবং ২০১৭ সালের নৃশংসতার বিচার—এই সব প্রশ্নের কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রতিশ্রুতি দিতে পারেনি ।
ফলে, রোহিঙ্গারা কেন ফেরত যাবে সেই বাস্তবতার ওপর কাজ করতে হবে। কেবল দ্বিপাক্ষিক চুক্তি বা বাংলাদেশ-মিয়ানমার আলোচনার মাধ্যমে সমাধান সম্ভব নয়। রাখাইন রাজ্যের প্রায় ৯০ শতাংশ এলাকা এখন আরাকান আর্মির দখলে, যেখানে মিয়ানমারের সরকার বা জান্তা প্রশাসনের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তাই একপাক্ষিক পদক্ষেপে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন কার্যকর করা অসম্ভব।
এই পরিস্থিতিতে সেমিনার, আলোচনা ও নীতি নির্ধারণের গুরুত্ব আছে, তবে সেটি অবশ্যই গ্রাউন্ড রিয়ালিটি এবং মিয়ানমারের আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বাংলাদেশের আন্তঃরাষ্ট্র সম্পর্ক এবং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পার্টনারদের সম্পৃক্ততার আলোকে হতে হবে। ন্যাশনাল ও রিজিওনাল একটিভ এক্টরদের যুক্ত করে একটি কালেক্টিভ ও কম্প্রিহেন্সিভ এপ্রোচ গড়ে তোলা ছাড়া রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান, বিশেষ করে ১৫ লাখের বেশি রোহিঙ্গার দ্রুত প্রত্যাবাসন, কোনো বাস্তব সম্ভাবনা রাখে না।
স্ট্রিম: এ সমস্যার সমাধানে কী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার?
রাহমান নাসির উদ্দিন: প্রথমত, স্বল্প-মেয়াদী, মধ্য-মেয়াদী ও দীর্ঘ-মেয়াদী পরিকল্পনা প্রয়োজন। রোহিঙ্গাদের হিউম্যান রাইটস, শিক্ষা ও মৌলিক সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। এটা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দেখাতে হবে যে, বাংলাদেশ মানবিক কারণে তাদের আশ্রয় দিচ্ছে, কিন্তু এটি স্থায়ী সমাধান নয়। দ্বিতীয়ত, তৃতীয় দেশের পুনর্বাসন ব্যবস্থা পুনরায় সক্রিয় করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, নির্দিষ্ট সংখ্যক রোহিঙ্গাকে তৃতীয় কোনো দেশে পাঠানো। তৃতীয়ত, রোহিঙ্গা যুবকদের জন্য ভোকেশনাল ট্রেনিং ও স্কিল ডেভেলপমেন্ট করা যেতে পারে। এটি তাদেরকে প্রোডাক্টিভ হিউম্যান রিসোর্সে রূপান্তরিত করবে, যা আন্তর্জাতিকভাবে কাজে লাগানো যেতে পারে। চতুর্থত, সেফ জোন তৈরি ও জাতিসংঘকে ইনভলভ করা গুরুত্বপূর্ণ। শুধুমাত্র সেমিনার বা কনফারেন্সের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। একটি কার্যকর, প্র্যাকটিক্যাল ও ধাপে ধাপে কার্যকর করা যায় এমন অ্যাকশন প্ল্যান প্রয়োজন।
স্ট্রিম: শেষ মুহূর্তে আর কিছু বলতে চান?
রাহমান নাসির উদ্দিন: শেষ মুহূর্তে আমি বলতে চাই, আমরা যে রোহিঙ্গা গণহত্যা দিবস পালন করছি, তা শুধুই স্মরণ বা শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য নয়। অনেকেই মনে করেন, ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে (আইসিজে) গাম্বিয়ার করা মামলা রোহিঙ্গা জেনোসাইডকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেবে। এই বিষয়ে প্রচুর আলোচনা হচ্ছে এবং আগামীকাল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বড় আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে আমরা এ নিয়ে বিস্তারিত ডায়লগের সুযোগ তৈরি করতে যাচ্ছি।
তবে ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের ওপর ঘটে যাওয়া নৃশংসতার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়া সমস্যার সমাধান নিশ্চিত করবে কিনা, তা নিয়ে আমি সন্দিহান। আমি সবসময় বলি, রোহিঙ্গাদের বিষয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি হতে হবে সহমর্মিতা ও মানবিকতার ভিত্তিতে। আমরা যে প্রত্যাবাসন বা নীতি প্রণয়ন করছি, তাতে রোহিঙ্গাদেরকেও অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তাদের নিরাপত্তা, অধিকার এবং চাহিদাকে বোঝার পরিপ্রেক্ষিতে পরিকল্পনা গঠন করা ছাড়া কোনো কার্যকর সমাধান সম্ভব নয়।
অনুলিখন: তুফায়েল আহমদ
স্ট্রিম: আন্তর্জাতিক ও দেশীয়ভাবে রোহিঙ্গা ইস্যুটি এখন কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে?
রাহমান নাসির উদ্দিন: যদি আমরা রোহিঙ্গা ইস্যুকে ‘রোহিঙ্গা সংকট’ বা ‘রোহিঙ্গা সমস্যা’ হিসেবে দেখি, তাহলে এটি বর্তমানে একটি ‘স্ট্যান্ড স্টিল’ অর্থাৎ স্থবির অবস্থায় রয়েছে।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্টে প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এর আগে থেকে বাংলাদেশে প্রায় তিন থেকে চার লাখ রোহিঙ্গা অবস্থান করছিল। তারা ১৯৭৮, ১৯৯১-৯২, ২০১২ এবং ২০১৬ সালে প্রবেশ করেছিল। আট বছর পর ২০২৫ সালের এই মুহূর্তে সংখ্যাটি প্রায় ১৩ লাখের বেশি।
শরণার্থী সংকট সমাধানের তিনটি আন্তর্জাতিক মডেল এখানে অকার্যকর বলে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান স্থবির অবস্থায় রয়েছে। প্রথমটি হলো লোকাল ইন্টিগ্রেশন অর্থাৎ রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে সমাজে একীকরণ। কিন্তু বর্তমানে এর সম্ভাবনা খুবই সীমিত। দ্বিতীয়টি হলো থার্ড কান্ট্রি রিসেটেলমেন্ট বা রোহিঙ্গাদের তৃতীয় কোনো দেশে পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া। গত আট বছরে কোনো দেশ স্বেচ্ছায় রোহিঙ্গাদের গ্রহণের প্রস্তাব দেয়নি। শেষ বিকল্প হলো ভলেন্টারি রেপেট্রেশন, অর্থাৎ স্বেচ্ছায় রোহিঙ্গাদের রাখাইন রাজ্যে ফেরত পাঠানো। তবে এর সম্ভাবনাও খুব ক্ষীণ। কারণ মিয়ানমার এখন রাজনৈতিক ও নিরাপত্তাগত সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। রাখাইন রাজ্যের ওপর মিয়ানমার সরকারের কোনো কার্যকর কর্তৃত্ব নেই। আরাকান আর্মি রাজ্যের প্রায় ৯০ শতাংশ এলাকা দখল করে আছে।
বাংলাদেশের পক্ষে আরাকান আর্মির সঙ্গে ফরমাল ডায়লগ শুরু করাও সম্ভব নয়। কারণ আরাকান আর্মি একটি বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠী। তাদের সঙ্গে ডিপ্লোম্যাটিক নর্মস অনুসারে সশস্ত্র বিদ্রোহী সংগঠনের সঙ্গে সরাসরি আলাপ করা যায় না। ফলে রোহিঙ্গা সমস্যা এখন একটি স্ট্যান্ড স্টিল অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে।
স্ট্রিম: মিয়ানমারের আসন্ন নির্বাচনে নতুন সরকার ক্ষমতায় এলে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে নতুন করে আলাপ-আলোচনার সুযোগ তৈরি হবে কী?
রাহমান নাসির উদ্দিন: নির্বাচন ও নতুন সরকার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে প্রভাব ফেলতে পারে। যদি ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) নির্বাচিত হয়, তবে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর আলোচনার সম্ভাবনা কিছুটা বাড়তে পারে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্টেকহোল্ডার হলো আরাকান আর্মি। তারা রোহিঙ্গাদের প্রতি কতটা সংবেদনশীল তা এখনও অনিশ্চিত। নতুন সরকার আসলেও, রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো সম্ভব হবে কি না, তা মূলত আরাকান আর্মির দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভর করবে।
স্ট্রিম: সম্প্রতি বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে আবারও নতুন করে রোহিঙ্গারা প্রবেশ করছে। এই পরিস্থিতিতে আমাদের প্রস্তুতি কেমন?
রাহমান নাসির উদ্দিন: আসলে সংখ্যার বিচারে এটি বড় চ্যালেঞ্জ। ইতিমধ্যেই প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করছে। নতুন করে প্রায় দেড় লাখ রোহিঙ্গা আসছে। আন্তর্জাতিকভাবে শরণার্থী ব্যবস্থাপনার স্ট্যান্ডার্ড হলো—যখন মানুষ প্রাণ ও নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে থাকে, তারা নিকটবর্তী দেশে আশ্রয় নেয়।
২০১৭ সালের ঘটনা মনে করুন। তখন বাংলাদেশ সরকার বর্ডার খোলার জন্য প্রস্তুত ছিল না। কিন্তু হিউম্যানিটারিয়ান প্রেসারের কারণে সীমান্ত খোলা হয়। যখন মানুষ প্রাণহানির ঝুঁকিতে সীমান্তে আসে, তাদের জীবন রক্ষার জন্য আশ্রয় দিতে হয়। বর্তমানে, নতুন প্রবেশকারীদের জন্যও একই নীতিগত চিন্তাভাবনা প্রযোজ্য।
এটি শুধু বাংলাদেশের সমস্যা নয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেও বোঝাতে হবে যে, ১৫ লাখের বেশি রোহিঙ্গা এখানে বসবাস করলে দেশের অর্থনীতি, সামাজিক ব্যবস্থা, নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বড় প্রভাব পড়বে। এই বোঝাপড়া ছাড়া কোনো টেকসই সমাধান সম্ভব নয়।
স্ট্রিম: বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে অনেক সময়ই রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে আশার আলো দেখানোর চেষ্টা হয়েছে। সেই আলোগুলো আসলে কী রকম এবং কতটুকু প্রসারিত বা ক্ষীণ?
রাহমান নাসির উদ্দিন: বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে অনেক আলোচনা, কনফারেন্স, টকশো এবং নীতি নির্ধারণ চলছে। তবে বাস্তব পরিস্থিতি বা গ্রাউন্ড রিয়ালিটি বোঝা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। রোহিঙ্গারা যদি স্বেচ্ছায় তাদের দেশে ফিরতে না চায়, তাহলে আন্তর্জাতিক বিধি অনুযায়ী তাদের জোর করে ফেরত পাঠানো সম্ভব নয়। আন্তর্জাতিক কিংবা স্থানীয় কোনো স্টেকহোল্ডার এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা, নাগরিকত্ব, মানবিক মর্যাদা এবং ২০১৭ সালের নৃশংসতার বিচার—এই সব প্রশ্নের কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রতিশ্রুতি দিতে পারেনি ।
ফলে, রোহিঙ্গারা কেন ফেরত যাবে সেই বাস্তবতার ওপর কাজ করতে হবে। কেবল দ্বিপাক্ষিক চুক্তি বা বাংলাদেশ-মিয়ানমার আলোচনার মাধ্যমে সমাধান সম্ভব নয়। রাখাইন রাজ্যের প্রায় ৯০ শতাংশ এলাকা এখন আরাকান আর্মির দখলে, যেখানে মিয়ানমারের সরকার বা জান্তা প্রশাসনের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তাই একপাক্ষিক পদক্ষেপে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন কার্যকর করা অসম্ভব।
এই পরিস্থিতিতে সেমিনার, আলোচনা ও নীতি নির্ধারণের গুরুত্ব আছে, তবে সেটি অবশ্যই গ্রাউন্ড রিয়ালিটি এবং মিয়ানমারের আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বাংলাদেশের আন্তঃরাষ্ট্র সম্পর্ক এবং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পার্টনারদের সম্পৃক্ততার আলোকে হতে হবে। ন্যাশনাল ও রিজিওনাল একটিভ এক্টরদের যুক্ত করে একটি কালেক্টিভ ও কম্প্রিহেন্সিভ এপ্রোচ গড়ে তোলা ছাড়া রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান, বিশেষ করে ১৫ লাখের বেশি রোহিঙ্গার দ্রুত প্রত্যাবাসন, কোনো বাস্তব সম্ভাবনা রাখে না।
স্ট্রিম: এ সমস্যার সমাধানে কী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার?
রাহমান নাসির উদ্দিন: প্রথমত, স্বল্প-মেয়াদী, মধ্য-মেয়াদী ও দীর্ঘ-মেয়াদী পরিকল্পনা প্রয়োজন। রোহিঙ্গাদের হিউম্যান রাইটস, শিক্ষা ও মৌলিক সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। এটা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দেখাতে হবে যে, বাংলাদেশ মানবিক কারণে তাদের আশ্রয় দিচ্ছে, কিন্তু এটি স্থায়ী সমাধান নয়। দ্বিতীয়ত, তৃতীয় দেশের পুনর্বাসন ব্যবস্থা পুনরায় সক্রিয় করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, নির্দিষ্ট সংখ্যক রোহিঙ্গাকে তৃতীয় কোনো দেশে পাঠানো। তৃতীয়ত, রোহিঙ্গা যুবকদের জন্য ভোকেশনাল ট্রেনিং ও স্কিল ডেভেলপমেন্ট করা যেতে পারে। এটি তাদেরকে প্রোডাক্টিভ হিউম্যান রিসোর্সে রূপান্তরিত করবে, যা আন্তর্জাতিকভাবে কাজে লাগানো যেতে পারে। চতুর্থত, সেফ জোন তৈরি ও জাতিসংঘকে ইনভলভ করা গুরুত্বপূর্ণ। শুধুমাত্র সেমিনার বা কনফারেন্সের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। একটি কার্যকর, প্র্যাকটিক্যাল ও ধাপে ধাপে কার্যকর করা যায় এমন অ্যাকশন প্ল্যান প্রয়োজন।
স্ট্রিম: শেষ মুহূর্তে আর কিছু বলতে চান?
রাহমান নাসির উদ্দিন: শেষ মুহূর্তে আমি বলতে চাই, আমরা যে রোহিঙ্গা গণহত্যা দিবস পালন করছি, তা শুধুই স্মরণ বা শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য নয়। অনেকেই মনে করেন, ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে (আইসিজে) গাম্বিয়ার করা মামলা রোহিঙ্গা জেনোসাইডকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেবে। এই বিষয়ে প্রচুর আলোচনা হচ্ছে এবং আগামীকাল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বড় আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে আমরা এ নিয়ে বিস্তারিত ডায়লগের সুযোগ তৈরি করতে যাচ্ছি।
তবে ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের ওপর ঘটে যাওয়া নৃশংসতার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়া সমস্যার সমাধান নিশ্চিত করবে কিনা, তা নিয়ে আমি সন্দিহান। আমি সবসময় বলি, রোহিঙ্গাদের বিষয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি হতে হবে সহমর্মিতা ও মানবিকতার ভিত্তিতে। আমরা যে প্রত্যাবাসন বা নীতি প্রণয়ন করছি, তাতে রোহিঙ্গাদেরকেও অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তাদের নিরাপত্তা, অধিকার এবং চাহিদাকে বোঝার পরিপ্রেক্ষিতে পরিকল্পনা গঠন করা ছাড়া কোনো কার্যকর সমাধান সম্ভব নয়।
অনুলিখন: তুফায়েল আহমদ
কক্সবাজার থেকে ভাসানচরে স্থানান্তরের পর তাদের জীবন ও প্রকৃতির ওপর এর কী প্রভাব পড়ছে এবং এই সংকটের ভবিষ্যৎ কী—এসব বিষয় নিয়ে স্ট্রিমের সঙ্গে কথা বলেছেন শিক্ষক ও গবেষক জাভেদ কায়সার।
৯ ঘণ্টা আগেআজ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশে আসার আট বছর। এদিনে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা আগমনের ইতিহাস, তাদের ফেরত পাঠানোর জটিলতা, আরাকান আর্মি, চীন ও ভারতের প্রভাব—এসব নিয়ে স্ট্রিমের সঙ্গে কথা বলেছেন লেখক ও দক্ষিণ এশিয়া-বিষয়ক গবেষক আলতাফ পারভেজ
১১ ঘণ্টা আগেবাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে প্রকাশিত হয়েছিল ‘মুজিবপিডিয়া’। প্রকাশের পরপরই বইটি নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। দুই খণ্ডে লেখা এই বইকে ‘জ্ঞানকোষ’ হিসেবে দাবি করে তাতে শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও স্বাধীনতা-পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের...
৩ দিন আগেপ্রতিবেদনে জয়নুল আবেদীন লিখেছেন, ‘কমিশন আন্তরিকভাবে জবানবন্দি নেওয়ার চেষ্টা করেছে, কিন্তু আওয়ামী লীগের শীর্ষ ও কেন্দ্রীয় নেতাদের ধারাবাহিক অস্বীকৃতির মুখে সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।’
৪ দিন আগে