leadT1ad

ভারতের নতুন নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের পাটশিল্পে মরার ওপর খাঁড়ার ঘা

সানীউজ্জামান পাভেলঢাকা
প্রকাশ : ২৫ আগস্ট ২০২৫, ২২: ২৮
আপডেট : ২৫ আগস্ট ২০২৫, ২৩: ২৫
স্ট্রিম গ্রাফিক

সম্প্রতি স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশের পাটপণ্য প্রবেশে নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে ভারত। নিষেধাজ্ঞার কারণে ইতিমধ্যে নানান সংকটে ভোগা পাটশিল্পের জন্য মরার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশের সোনালি আঁশ খ্যাত পাটের বড় বাজার ভারত। দেশটির নতুন নিষেধাজ্ঞায় আরও বড় ক্ষতির মুখে পড়তে পারে বাংলাদেশের পাটশিল্প।

আন্তর্জাতিক বাজারে পাট ও পাটপণ্যের শীর্ষ রপ্তানিকারক দেশ বাংলাদেশ। আর দীর্ঘদিন ধরেই ভারত বাংলাদেশের এসব পণ্যের অন্যতম প্রধান আমদানিকারক। কিন্তু গত ১১ আগস্ট ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নতুন এক সিদ্ধান্তে জানায়, এখন থেকে বাংলাদেশের পাটপণ্য শুধু মুম্বাইয়ের নাভে শেভা সমুদ্রবন্দর দিয়েই প্রবেশ করতে পারবে। এর আগে দুই দেশের শত শত কিলোমিটারজুড়ে বিস্তৃত সীমান্তের বিভিন্ন স্থলবন্দর দিয়েই মূলত এসব পণ্য ভারতে প্রবেশ করত।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি), বাংলাদেশ ব্যাংকের বার্ষিক ব্যালান্স অব পেমেন্টস (বিওপি) ও বাংলাদেশ ট্রেড পোর্টালের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট পাটপণ্যের প্রায় এক-চতুর্থাংশ রপ্তানি হয় ভারতে। কিন্তু নতুন নিষেধাজ্ঞার কারণে তা ব্যাপকভাবে ব্যাহত হতে পারে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্ট্রিমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জুট এক্সপোর্ট করপোরেশনের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ‘এতে আমাদের রপ্তানি ব্যয় মারাত্মকভাবে বেড়ে যাবে। ভারতের বাজারে আমাদের পণ্যের বিপুল চাহিদা থাকা সত্ত্বেও, এই নিষেধাজ্ঞা আসলে বাংলাদেশের পাট ও পাটপণ্য নিরুৎসাহিত করার কৌশল।’

নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়া পণ্যের মধ্যে রয়েছে—ব্লিচ করা ও না করা পাট বা অন্যান্য বাস্ট ফাইবারের বোনা কাপড়, পাটের সুতা, দড়ি, রশি ও কেবল, পাটের তৈরি বস্তা ও ব্যাগ।

এর আগে চলতি বছরের জুনেও একাধিক পাটজাত পণ্যের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল ভারত। এর মধ্যে ছিল কাঁচা বা রেটেড পাট ও অন্যান্য বাস্ট ফাইবার, পাট, একক ফ্ল্যাক্স সুতা, একক পাটের সুতা বা অন্যান্য বাস্ট ফাইবারের সুতা এবং ব্লিচ না করা পাট বা অন্যান্য বাস্ট ফাইবারের বোনা কাপড়।

পরিসংখ্যান কী বলছে

বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পাট উৎপাদক ও শীর্ষ রপ্তানিকারক দেশ। প্রধান বাজার ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতিবছর প্রায় এক বিলিয়ন ডলারের পাটপণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ।

যদিও সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানিতে ধারাবাহিক নিম্নমুখী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ইপিবির হিসাবে, ২০২৪–২৫ অর্থবছরে পাট রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ৮২০ দশমিক ১৬ মিলিয়ন ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার (৯৮০ মিলিয়ন ডলার) চেয়ে ১৬ দশমিক ৩১ শতাংশ কম। এই হিসাবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের (৮৫৫ দশমিক ২৩ মিলিয়ন ডলার) তুলনায় গত অর্থবছরে আয় কমেছে ৪ দশমিক ১ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যালান্স অব পেমেন্টস (বিওপি) তথ্যেও একই ইঙ্গিত মেলে। বিওপির তথ্যানুসারে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি থেকে আয় হয়েছিল ৯২৫ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলার। যা গত অর্থবছরে প্রায় ১ দশমিক ৭ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ৯০৯ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলার।

বাংলাদেশ ট্রেড পোর্টালের তথ্যানুসারে, ভারতের বাজারে রপ্তানিকৃত শীর্ষ ২০ পণ্যের মধ্যে রয়েছে কাঁচা বা রেটেড পাট ও অন্যান্য বাস্ট ফাইবার, ব্লিচ না করা পাটের কাপড়, একক পাটের সুতা এবং পাটের বস্তা ও ব্যাগ। শুধু ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এসব পণ্য রপ্তানি করে আয় হয়েছিল প্রায় ২১৬ মিলিয়ন ডলার।

ইপিবি ও ট্রেড পোর্টালে তথ্যানুযায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে স ভারতের বাজারে বাংলাদেশের মোট পাটজাত পণ্য রপ্তানির অংশ ছিল প্রায় ২৫ দশমিক ২৫ শতাংশ। আর বিওপি ও ট্রেড পোর্টালের তথ্যানুযায়ী একই অর্থবছরে রপ্তানির অংশ ছিল ২৩ দশমিক ৩৪ শতাংশ।

সামনে কী অপেক্ষা করছে

পাটজাত পণ্য রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান এআই ইন্টারন্যাশনালের মালিক এসএম শাহিদুল ইসলাম স্ট্রিমকে বলেন, ‘ভারতের বন্দরের উপর দিয়ে দেওয়া এ নিষেধাজ্ঞা পাট ব্যবসায়ীদের জন্য বাড়তি চাপ তৈরি করবে। তবে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজার বাংলাদেশের জন্য বিকল্প হতে পারে।’

এসএম শাহিদুল ইসলাম আরও বলেন, ‘বৈশ্বিক পাট বাজারে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছে। ভারত বিশ্বের সর্ববৃহৎ পাট উৎপাদক দেশ এবং তাদের সরকার পাট ও পাটজাত পণ্যের জন্য বাংলাদেশে চেয়ে বেশি ভর্তুকি দিচ্ছে।’

তবে জুট এক্সপোর্ট করপোরেশনের এক কর্মকর্তা সতর্ক করে বলেন, ‘ভারতের মতো লাভজনক বাজারের বিকল্প খুঁজে পাওয়া সহজ হবে না। যদি এই নিষেধাজ্ঞা দীর্ঘমেয়াদি ও স্থায়ী হয়, তবে বাংলাদেশের জন্য তা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।’

গবেষকরা মনে করেন, নতুন করে বিশ্বে বিভিন্ন দেশ এই বাজারে প্রবেশ করছে বলে বর্তমানে কাঁচা পাট ও পাটজাত পণ্যের বিপণন তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে পড়েছে।

২০২২ সালের শেষ দিকে ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব রিসার্চ পাবলিকেশন অ্যান্ড রিভিউস-এ প্রকাশিত ‘কমার্শিয়ালাইজেশন অব বাংলাদেশিয়ান জুট অ্যান্ড জুট গুডস: এ স্পেশাল কেস স্টাডি’ শীর্ষক প্রবন্ধে সরকারি ও বেসরকারি খাত মিলিয়ে পাটশিল্প নানা সমস্যার কথা উঠে এসেছে। প্রবন্ধে দাবি করা হয়, ভর্তুকির উপর নির্ভরশীলতা, উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি, অচল তাঁতের সংখ্যা বাড়া, নেতৃত্বের ঘাটতি, অদক্ষ পরিচালনা কৌশল, কাঁচা পাট সংগ্রহে মারাত্মক দুর্নীতি, সীমিত ক্রয় আদেশ, কাঠামোগত অসামঞ্জস্য এবং পুরোনো, জরাজীর্ণ যন্ত্রপাতির সমস্যায় জর্জরিত বাংলাদেশের পাটশিল্প।

স্ট্রিমের সঙ্গে আলাপকালে এসব সমস্যার কথা স্বীকার করে জুট এক্সপোর্ট করপোরেশন ও এআই ইন্টারন্যাশনালের কর্মকর্তারা বলেন, বাংলাদেশের অন্যতম অর্থনৈতিক খাত হিসেবে পাটশিল্পকে রক্ষা করা এখন সময়ের দাবি। এ খাতের সংকটগুলো নিয়ে গভীরভাবে গবেষণা, সঠিক নীতি প্রণয়ন এবং দ্রুত সমাধান বের করা জরুরি।

Ad 300x250

যে ছয় মাস আছি, প্রত্যেক জেলায় লিগ্যাল এইডের ব্যবস্থা করে যাব: আইন উপদেষ্টা

মুসলমানি-বাংলা থেকে বাংলাদেশি: ভাষার রাজনৈতিক বিভাজন

রোহিঙ্গারা অধিকার নিয়ে মিয়ানমারে ফিরতে প্রস্তুত: খলিলুর রহমান

ভারতের নতুন নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের পাটশিল্পে মরার ওপর খাঁড়ার ঘা

‘রোহিঙ্গা সংকট স্থবির হয়ে আছে, সমাধানে আঞ্চলিক-আন্তর্জাতিক সক্রিয়তা জরুরি’

সম্পর্কিত