রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে বিশেষ সাক্ষাৎকার: জাভেদ কায়সার
বিশ্বজুড়ে ক্ষমতার লড়াই এবং প্রকৃতির বিরূপ আচরণ—এই দুইয়ের যাঁতাকলে মানুষ প্রতিনিয়ত এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তরিত হতে বাধ্য হচ্ছে। এটি কেবল মানবিক সংকটই নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে পরিবেশ, প্রতিবেশ এবং নৃ-তাত্ত্বিক জটিলতা। বিশেষ করে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সংকট এই পরিস্থিতিকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। কক্সবাজার থেকে ভাসানচরে স্থানান্তরের পর তাদের জীবন ও প্রকৃতির ওপর এর কী প্রভাব পড়ছে এবং এই সংকটের ভবিষ্যৎ কী—এসব বিষয় নিয়ে স্ট্রিমের সঙ্গে কথা বলেছেন শিক্ষক ও গবেষক জাভেদ কায়সার।
স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম: মানুষের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তরের বিষয়টিকে প্রাণ-প্রকৃতি এবং নৃ-তাত্ত্বিক জায়গা থেকে কীভাবে দেখেন?
জাভেদ কায়সার: ডিসপ্লেসমেন্টটাকে আসলে আমরা যারা স্থানচ্যুত মানুষদেরকে নিয়ে কাজ করি, সেখানে একটা বড় জায়গা দেখা যায় যে, পৃথিবীজুড়েই ক্ষমতার লড়াইয়ের একটা ফসল হচ্ছে ডিসপ্লেসমেন্ট। ক্ষমতার লড়াই বলতে রাজনৈতিক ক্ষমতার লড়াই, আরেকটা হচ্ছে প্রকৃতির সাথে ক্ষমতার লড়াই। মানুষ যে প্রকৃতির কাছে অনেক ক্ষমতাহীন, সেটা খুব স্পষ্টভাবে প্রকাশ পায় যখন কোনো নদী ভাঙন বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে একদল মানুষ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় চলে যেতে বাধ্য হয়।
প্রাকৃতিক কারণগুলোর বাইরে রাজনৈতিক কারণে যে ডিসপ্লেসমেন্ট হচ্ছে, সেখানে রাষ্ট্র ধারণাটা সামনে চলে আসে। রাষ্ট্রের সীমানার মধ্যে কে থাকতে পারবে বা কে থাকতে পারবে না, এটা নিয়ে বিভিন্ন দেশ নানান নীতিমালা তৈরি করে এবং সেগুলোর আলোকে একদল মানুষকে নানান কারণে অপ্রেশনের শিকার হতে হয়। কিন্তু যখন রাষ্ট্রের এই টেরিটোরিয়াল ধারণাটা ছিল না, তখন ভূমি মানুষের কাছে অন্য অর্থের মধ্য দিয়ে ধরা দিত।
রোহিঙ্গা প্রেক্ষাপটে যদি বলি, ভূমির সাথে তাদের অ্যাটাচমেন্ট অনেক আগে থেকে। রাখাইন অঞ্চলে কৃষির ব্যাপক প্রসারের ফলে অর্থনৈতিক বিপ্লব ঘটেছিল। কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষমতার পট পরিবর্তনের কারণে, তাদের ধর্মীয় এবং দৈহিক গড়নের ভিন্নতার কারণে একদল মানুষ তাদের স্বীকৃতি দিলো না।
এই ধরনের স্থানচ্যুতি আমরা আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে বা মধ্যপ্রাচ্যেও দেখতে পাই। একটি জনগোষ্ঠী যখন দীর্ঘ সময় এক জায়গায় থাকে, তখন সেই অঞ্চলের পরিবেশ-প্রতিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে তাদের এক ধরনের অভিযোজন ক্ষমতা তৈরি হয়। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে যখন তারা অন্য জায়গায় যেতে বাধ্য হয়, তখন সেই নতুন জায়গার সঙ্গে আগন্তুক হিসেবে তাদের কোনো পরিচয় থাকে না। সেখানকার ক্ষমতাধর গোষ্ঠী তাদের কীভাবে দেখছে, তার ওপর তাদের টিকে থাকা নির্ভর করে।
আমার কাছে মনে হয়, পৃথিবী যত সামনের দিকে যাচ্ছে, আমরা প্রযুক্তিগতভাবে যত উন্নত হচ্ছি, মানবিকতার দিক থেকে ততটা অগ্রসর হচ্ছি না। মানুষ অনেক বেশি তার নিজস্ব পরিসর তৈরি করতে ব্যস্ত এবং নিজস্ব পরিসর তৈরি করতে গিয়ে কাউকে না কাউকে বাদ দিতে হচ্ছে। আমার ধারণা, সামনের দিনগুলোতে ক্লাইমেট চেঞ্জের কারণে এই ডিসপ্লেসমেন্টের বিষয়টাকে আমরা আরও দেখতে পাবো। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো ব-দ্বীপ অঞ্চলে এর পরিণতি অনেক গভীর হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
স্ট্রিম: ২০১৭ সালে রাখাইনে সামরিক অভিযানের কারণে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে স্থানান্তরিত হয়ে আসে এবং পরবর্তীতে তাদের একটি অংশকে ভাসানচরে স্থানান্তর করা হয়। এই দ্বৈত স্থানান্তরের ফলে প্রাণ-প্রকৃতি ও জীবনযাপনের ওপর কী ধরনের প্রভাব পড়েছে?
জাভেদ কায়সার: ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের একটা বড় অংশ এলেও, ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশে অনেক বছর ধরেই তারা এসেছে। আগে রাখাইন এবং বাংলাদেশের কক্সবাজার অঞ্চলের মধ্যে এক ধরনের পারস্পরিক বিনিময় সম্পর্ক ছিল। কিন্তু যে মুহূর্তে শরণার্থীর সংখ্যা অনেক বেশি হয়ে গেল, তখন স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সাথে তাদের নানা সংঘাতের সৃষ্টি হলো।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিল যে, কক্সবাজারের পার্বত্য অঞ্চলে রোহিঙ্গাদের আগমনের কারণে সেখানকার সংরক্ষিত বনাঞ্চল ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে। এই বিপর্যয় রোধ এবং ভূমিধস বা অগ্নিকাণ্ডের মতো ঘটনা এড়াতে সরকার তাদের ভাসানচরে সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করে। কিন্তু এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তারা ইতিমধ্যে স্থানচ্যুত। সেই স্থানচ্যুত জনগোষ্ঠীকে যখন এমন একটি জায়গায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, যেখানকার সম্পর্কে তাদের কোনো ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা নেই, তখন বিষয়টি জটিল হয়ে ওঠে। একজন মানুষ যখন একটি অঞ্চলে দীর্ঘ সময় ধরে থাকে, সে জানে সেখানে কীভাবে থাকতে হবে, কীভাবে কৃষি কাজ করতে হবে বা মাছ ধরতে হবে। ভাসানচর এমন একটি চরাঞ্চল, যার মাটি বা পরিবেশ সম্পর্কে তাদের কোনো পূর্ব ধারণা ছিল না।
যদিও সরকার সেখানে ২১ ফুট উঁচু বেড়িবাঁধ, স্লুইস গেট এবং প্রায় এক লাখ মানুষের জন্য ক্লাস্টার হাউসসহ ব্যাপক অবকাঠামো তৈরি করেছে, কিন্তু রোহিঙ্গারা সেখানে এক ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে। তারা রেশন পেলেও তাদের অন্যান্য প্রয়োজন মেটানোর জন্য অর্থের দরকার। বিভিন্ন এনজিওর সহায়তায় সেখানে সবজি চাষ, পশুপালনসহ নানা জীবিকার সুযোগ তৈরির চেষ্টা চলছে। তারা নোনা মাটির সঙ্গে লড়াই করে কৃষিকাজ করার মাধ্যমে মাটির সঙ্গে এক ধরনের সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করছে।
সমস্যাটা ঠিক এখানেই। তারা যে সম্পর্কটা তৈরি করছে, সেটা কতদিনের জন্য, তা তারা জানে না। এই অপেক্ষার প্রহর বা ‘ওয়েটিং পিরিয়ড’ একজন শরণার্থীর জীবনকে সবচেয়ে বেশি অনিশ্চিত করে তোলে, যা তাকে কোনো দিকেই এগোতে সাহায্য করে না। রাষ্ট্র বলছে তাদের এই বসবাস অস্থায়ী। যেকোনো মুহূর্তে মিয়ানমারের সাথে চুক্তি হলে তাদের ফিরিয়ে নেওয়া হতে পারে। কিন্তু এই কাজটি কবে হবে, তা কেউ জানে না।
এর পরিবেশগত প্রভাবও আছে। যেমন, ভাসানচরে জীবিকার জন্য ছাগল পালনকে উৎসাহিত করা হয়েছে। কিন্তু ছাগলের প্রিয় খাবার হলো কেওড়া পাতা। ফলে অনেক রোহিঙ্গা তাদের ছাগলকে খাওয়াতে গিয়ে কেওড়া গাছ কেটে ফেলছে। কেওড়া গাছ নতুন চরের মাটিকে ধরে রাখতে সাহায্য করে এবং এর বংশবিস্তার অন্য গাছের মতো সহজ নয়। ফলে এই উদ্যোগটি অজান্তেই দ্বীপের পরিবেশগত সুরক্ষাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে। এই ছোট ছোট বিষয়গুলোই দীর্ঘমেয়াদে বড় সংকট তৈরি করতে পারে।
স্ট্রিম: পরিবেশে যখন আমরা কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ বা পরিবর্তন করি, তখন তার একটি প্রভাব তৈরি হয়। এই ধারাবাহিক এবং অপ্রত্যাশিত পরিণতিগুলো কমানো বা এগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা কি আমাদের পক্ষে আদৌ সম্ভব? এর সঙ্গেই যুক্ত করে জানতে চাই, রোহিঙ্গা সংকটের শেষ আসলে কোথায়?
জাভেদ কায়সার: এটা বলা খুবই কঠিন, কারণ এর সঙ্গে অনেক ভূ-রাজনৈতিক বিষয় জড়িত এবং এর সমাধান খুব অল্প সময়ে পাওয়া মুশকিল। তবে আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো অতীত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়া। আমাদের সমস্যা হলো, আমরা নতুন প্রকল্প শুরু করার সময় অতীতের ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিই না। ক্যামেলিয়া দেওয়ানের ‘মিসরিডিং দ্য বেঙ্গল ডেল্টা’ বইটিতে খুব সুন্দরভাবে দেখানো হয়েছে যে, বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনকে মাথায় রেখে অতীতে যেদসব উপকূলীয় বাঁধ বা উন্নয়ন প্রকল্প করা হয়েছে, সেগুলো কীভাবে মানুষের স্থানিক চাহিদা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
আমার বক্তব্য হলো, আমাদের অতীতের অভিজ্ঞতাগুলোকে মাথায় রেখে ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করতে হবে এবং সেই পরিকল্পনায় প্রকৃতিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। কারণ প্রকৃতি যদি রুদ্রমূর্তি ধারণ করে, তাহলে মানুষের পক্ষে তা সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। আমাদের এই সম্পদ আহরণের প্রকৃতি (extractive nature) আসলে কতটুকু হবে, তার একটা সীমা নির্ধারণ করতে হবে।
এই সিদ্ধান্তগুলো নেবেন রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারকেরা। আমরা কেবল জটিলতাগুলো ধরিয়ে দিতে পারি। কিন্তু নীতিনির্ধারকদের উচিত স্থানিক জনগোষ্ঠীর বাস্তবতা ও অভিজ্ঞতাকে মাথায় রেখে এবং স্থান-কালের পরিপ্রেক্ষিতে পলিসিগুলোকে সংশোধন করা। তাহলে হয়তো আমরা কোনো এক ধরনের সমাধানের পথে এগোতে পারি।
অনুলিখন: শতাব্দীকা ঊর্মি
স্ট্রিম: মানুষের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তরের বিষয়টিকে প্রাণ-প্রকৃতি এবং নৃ-তাত্ত্বিক জায়গা থেকে কীভাবে দেখেন?
জাভেদ কায়সার: ডিসপ্লেসমেন্টটাকে আসলে আমরা যারা স্থানচ্যুত মানুষদেরকে নিয়ে কাজ করি, সেখানে একটা বড় জায়গা দেখা যায় যে, পৃথিবীজুড়েই ক্ষমতার লড়াইয়ের একটা ফসল হচ্ছে ডিসপ্লেসমেন্ট। ক্ষমতার লড়াই বলতে রাজনৈতিক ক্ষমতার লড়াই, আরেকটা হচ্ছে প্রকৃতির সাথে ক্ষমতার লড়াই। মানুষ যে প্রকৃতির কাছে অনেক ক্ষমতাহীন, সেটা খুব স্পষ্টভাবে প্রকাশ পায় যখন কোনো নদী ভাঙন বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে একদল মানুষ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় চলে যেতে বাধ্য হয়।
প্রাকৃতিক কারণগুলোর বাইরে রাজনৈতিক কারণে যে ডিসপ্লেসমেন্ট হচ্ছে, সেখানে রাষ্ট্র ধারণাটা সামনে চলে আসে। রাষ্ট্রের সীমানার মধ্যে কে থাকতে পারবে বা কে থাকতে পারবে না, এটা নিয়ে বিভিন্ন দেশ নানান নীতিমালা তৈরি করে এবং সেগুলোর আলোকে একদল মানুষকে নানান কারণে অপ্রেশনের শিকার হতে হয়। কিন্তু যখন রাষ্ট্রের এই টেরিটোরিয়াল ধারণাটা ছিল না, তখন ভূমি মানুষের কাছে অন্য অর্থের মধ্য দিয়ে ধরা দিত।
রোহিঙ্গা প্রেক্ষাপটে যদি বলি, ভূমির সাথে তাদের অ্যাটাচমেন্ট অনেক আগে থেকে। রাখাইন অঞ্চলে কৃষির ব্যাপক প্রসারের ফলে অর্থনৈতিক বিপ্লব ঘটেছিল। কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষমতার পট পরিবর্তনের কারণে, তাদের ধর্মীয় এবং দৈহিক গড়নের ভিন্নতার কারণে একদল মানুষ তাদের স্বীকৃতি দিলো না।
এই ধরনের স্থানচ্যুতি আমরা আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে বা মধ্যপ্রাচ্যেও দেখতে পাই। একটি জনগোষ্ঠী যখন দীর্ঘ সময় এক জায়গায় থাকে, তখন সেই অঞ্চলের পরিবেশ-প্রতিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে তাদের এক ধরনের অভিযোজন ক্ষমতা তৈরি হয়। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে যখন তারা অন্য জায়গায় যেতে বাধ্য হয়, তখন সেই নতুন জায়গার সঙ্গে আগন্তুক হিসেবে তাদের কোনো পরিচয় থাকে না। সেখানকার ক্ষমতাধর গোষ্ঠী তাদের কীভাবে দেখছে, তার ওপর তাদের টিকে থাকা নির্ভর করে।
আমার কাছে মনে হয়, পৃথিবী যত সামনের দিকে যাচ্ছে, আমরা প্রযুক্তিগতভাবে যত উন্নত হচ্ছি, মানবিকতার দিক থেকে ততটা অগ্রসর হচ্ছি না। মানুষ অনেক বেশি তার নিজস্ব পরিসর তৈরি করতে ব্যস্ত এবং নিজস্ব পরিসর তৈরি করতে গিয়ে কাউকে না কাউকে বাদ দিতে হচ্ছে। আমার ধারণা, সামনের দিনগুলোতে ক্লাইমেট চেঞ্জের কারণে এই ডিসপ্লেসমেন্টের বিষয়টাকে আমরা আরও দেখতে পাবো। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো ব-দ্বীপ অঞ্চলে এর পরিণতি অনেক গভীর হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
স্ট্রিম: ২০১৭ সালে রাখাইনে সামরিক অভিযানের কারণে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে স্থানান্তরিত হয়ে আসে এবং পরবর্তীতে তাদের একটি অংশকে ভাসানচরে স্থানান্তর করা হয়। এই দ্বৈত স্থানান্তরের ফলে প্রাণ-প্রকৃতি ও জীবনযাপনের ওপর কী ধরনের প্রভাব পড়েছে?
জাভেদ কায়সার: ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের একটা বড় অংশ এলেও, ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশে অনেক বছর ধরেই তারা এসেছে। আগে রাখাইন এবং বাংলাদেশের কক্সবাজার অঞ্চলের মধ্যে এক ধরনের পারস্পরিক বিনিময় সম্পর্ক ছিল। কিন্তু যে মুহূর্তে শরণার্থীর সংখ্যা অনেক বেশি হয়ে গেল, তখন স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সাথে তাদের নানা সংঘাতের সৃষ্টি হলো।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিল যে, কক্সবাজারের পার্বত্য অঞ্চলে রোহিঙ্গাদের আগমনের কারণে সেখানকার সংরক্ষিত বনাঞ্চল ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে। এই বিপর্যয় রোধ এবং ভূমিধস বা অগ্নিকাণ্ডের মতো ঘটনা এড়াতে সরকার তাদের ভাসানচরে সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করে। কিন্তু এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তারা ইতিমধ্যে স্থানচ্যুত। সেই স্থানচ্যুত জনগোষ্ঠীকে যখন এমন একটি জায়গায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, যেখানকার সম্পর্কে তাদের কোনো ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা নেই, তখন বিষয়টি জটিল হয়ে ওঠে। একজন মানুষ যখন একটি অঞ্চলে দীর্ঘ সময় ধরে থাকে, সে জানে সেখানে কীভাবে থাকতে হবে, কীভাবে কৃষি কাজ করতে হবে বা মাছ ধরতে হবে। ভাসানচর এমন একটি চরাঞ্চল, যার মাটি বা পরিবেশ সম্পর্কে তাদের কোনো পূর্ব ধারণা ছিল না।
যদিও সরকার সেখানে ২১ ফুট উঁচু বেড়িবাঁধ, স্লুইস গেট এবং প্রায় এক লাখ মানুষের জন্য ক্লাস্টার হাউসসহ ব্যাপক অবকাঠামো তৈরি করেছে, কিন্তু রোহিঙ্গারা সেখানে এক ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে। তারা রেশন পেলেও তাদের অন্যান্য প্রয়োজন মেটানোর জন্য অর্থের দরকার। বিভিন্ন এনজিওর সহায়তায় সেখানে সবজি চাষ, পশুপালনসহ নানা জীবিকার সুযোগ তৈরির চেষ্টা চলছে। তারা নোনা মাটির সঙ্গে লড়াই করে কৃষিকাজ করার মাধ্যমে মাটির সঙ্গে এক ধরনের সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করছে।
সমস্যাটা ঠিক এখানেই। তারা যে সম্পর্কটা তৈরি করছে, সেটা কতদিনের জন্য, তা তারা জানে না। এই অপেক্ষার প্রহর বা ‘ওয়েটিং পিরিয়ড’ একজন শরণার্থীর জীবনকে সবচেয়ে বেশি অনিশ্চিত করে তোলে, যা তাকে কোনো দিকেই এগোতে সাহায্য করে না। রাষ্ট্র বলছে তাদের এই বসবাস অস্থায়ী। যেকোনো মুহূর্তে মিয়ানমারের সাথে চুক্তি হলে তাদের ফিরিয়ে নেওয়া হতে পারে। কিন্তু এই কাজটি কবে হবে, তা কেউ জানে না।
এর পরিবেশগত প্রভাবও আছে। যেমন, ভাসানচরে জীবিকার জন্য ছাগল পালনকে উৎসাহিত করা হয়েছে। কিন্তু ছাগলের প্রিয় খাবার হলো কেওড়া পাতা। ফলে অনেক রোহিঙ্গা তাদের ছাগলকে খাওয়াতে গিয়ে কেওড়া গাছ কেটে ফেলছে। কেওড়া গাছ নতুন চরের মাটিকে ধরে রাখতে সাহায্য করে এবং এর বংশবিস্তার অন্য গাছের মতো সহজ নয়। ফলে এই উদ্যোগটি অজান্তেই দ্বীপের পরিবেশগত সুরক্ষাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে। এই ছোট ছোট বিষয়গুলোই দীর্ঘমেয়াদে বড় সংকট তৈরি করতে পারে।
স্ট্রিম: পরিবেশে যখন আমরা কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ বা পরিবর্তন করি, তখন তার একটি প্রভাব তৈরি হয়। এই ধারাবাহিক এবং অপ্রত্যাশিত পরিণতিগুলো কমানো বা এগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা কি আমাদের পক্ষে আদৌ সম্ভব? এর সঙ্গেই যুক্ত করে জানতে চাই, রোহিঙ্গা সংকটের শেষ আসলে কোথায়?
জাভেদ কায়সার: এটা বলা খুবই কঠিন, কারণ এর সঙ্গে অনেক ভূ-রাজনৈতিক বিষয় জড়িত এবং এর সমাধান খুব অল্প সময়ে পাওয়া মুশকিল। তবে আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো অতীত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়া। আমাদের সমস্যা হলো, আমরা নতুন প্রকল্প শুরু করার সময় অতীতের ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিই না। ক্যামেলিয়া দেওয়ানের ‘মিসরিডিং দ্য বেঙ্গল ডেল্টা’ বইটিতে খুব সুন্দরভাবে দেখানো হয়েছে যে, বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনকে মাথায় রেখে অতীতে যেদসব উপকূলীয় বাঁধ বা উন্নয়ন প্রকল্প করা হয়েছে, সেগুলো কীভাবে মানুষের স্থানিক চাহিদা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
আমার বক্তব্য হলো, আমাদের অতীতের অভিজ্ঞতাগুলোকে মাথায় রেখে ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করতে হবে এবং সেই পরিকল্পনায় প্রকৃতিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। কারণ প্রকৃতি যদি রুদ্রমূর্তি ধারণ করে, তাহলে মানুষের পক্ষে তা সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। আমাদের এই সম্পদ আহরণের প্রকৃতি (extractive nature) আসলে কতটুকু হবে, তার একটা সীমা নির্ধারণ করতে হবে।
এই সিদ্ধান্তগুলো নেবেন রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারকেরা। আমরা কেবল জটিলতাগুলো ধরিয়ে দিতে পারি। কিন্তু নীতিনির্ধারকদের উচিত স্থানিক জনগোষ্ঠীর বাস্তবতা ও অভিজ্ঞতাকে মাথায় রেখে এবং স্থান-কালের পরিপ্রেক্ষিতে পলিসিগুলোকে সংশোধন করা। তাহলে হয়তো আমরা কোনো এক ধরনের সমাধানের পথে এগোতে পারি।
অনুলিখন: শতাব্দীকা ঊর্মি
আট বছর পেরিয়ে গেলেও রোহিঙ্গা সংকটের কার্যকর কোনও সমাধান হয়নি। ভবিষ্যতও অনিশ্চিত। এই সংকট এখন কার্যত ‘স্থবির অবস্থায়’ রয়েছে। কারণ সমাধান শুধু বাংলাদেশ–মিয়ানমারের উপর নির্ভর করছে না। বরং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সক্রিয় ভূমিকাও জরুরি।
৬ ঘণ্টা আগেআজ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশে আসার আট বছর। এদিনে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা আগমনের ইতিহাস, তাদের ফেরত পাঠানোর জটিলতা, আরাকান আর্মি, চীন ও ভারতের প্রভাব—এসব নিয়ে স্ট্রিমের সঙ্গে কথা বলেছেন লেখক ও দক্ষিণ এশিয়া-বিষয়ক গবেষক আলতাফ পারভেজ
১১ ঘণ্টা আগেবাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে প্রকাশিত হয়েছিল ‘মুজিবপিডিয়া’। প্রকাশের পরপরই বইটি নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। দুই খণ্ডে লেখা এই বইকে ‘জ্ঞানকোষ’ হিসেবে দাবি করে তাতে শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও স্বাধীনতা-পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের...
৩ দিন আগেপ্রতিবেদনে জয়নুল আবেদীন লিখেছেন, ‘কমিশন আন্তরিকভাবে জবানবন্দি নেওয়ার চেষ্টা করেছে, কিন্তু আওয়ামী লীগের শীর্ষ ও কেন্দ্রীয় নেতাদের ধারাবাহিক অস্বীকৃতির মুখে সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।’
৪ দিন আগে