leadT1ad

ঢাকা–মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে

মরণফাঁদ মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে, ছয় মাসে নিহত ২৯

বিশ্বের অন্যতম ব্যয়বহুল মহাসড়ক মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে (হাঁসাড়া হাইওয়ে) আজ শনিবার মারা গেলেন আরও চারজন । এই মহাসড়কটি যেন ক্রমেই মরণফাঁদ হয়ে উঠছে। গত পাঁচ বছরে ৬৪৬টি দুর্ঘটনায় অন্তত ৩৭২ জন প্রাণ হারিয়েছেন এখানে।

মো. ইসতিয়াক
প্রকাশ : ২৮ জুন ২০২৫, ১৯: ৩২
আপডেট : ২৯ জুন ২০২৫, ১৯: ৫৬
স্ট্রিম গ্রাফিক

দেশের প্রথম এক্সপ্রেসওয়ে ঢাকা-মাওয়া মহাসড়ক। এই এক্সপ্রেসওয়েটি যোগাযোগের নতুনমাত্রা যুক্ত করলেও ক্রমেই দুর্ঘটনাপ্রবণ হয়ে উঠছে। ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত ৫৫ কিলোমিটার এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১১ হাজার কোটি টাকা। কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় হয়েছে ২০০ কোটি টাকার বেশি।

২০২০ সালের মার্চ মাসে এটি উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধনের পর থেকে মহাসড়কটিতে ঘটছে একের পর এক দুর্ঘটনা। এক্সপ্রেসওয়ে পরিণত হয়েছে মরণফাঁদে।

উদ্বোধনের পর মাত্র এক বছরে (২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত) এক্সপ্রেসওয়েতে ৭৯টি দুর্ঘটনার তথ্য নথিভুক্ত হয়। এসব দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৬৫ জন, গুরুতর আহত হয়েছেন ৬৭ জন।

২০২১ সালের মার্চ থেকে ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত ১৯৬টি দুর্ঘটনার তথ্য নথিভুক্ত হয়। এর মধ্যে ৭৪ জন নিহত এবং ২৬৫ জন গুরতর আহত হন।

২০২২ সালের মার্চ থেকে ২০২৩ সালের মার্চ মাসে দুর্ঘটনার তথ্য নথিভুক্ত হয় ১৩৫টি, যেখানে ১৩১ জন নিহত ও দেড় হাজার জন গুরুতর আহত হয়েছেন। ২০২৪ সালে ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৩৬টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় ৮৫ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ২১৫ জন।

২০২৫ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২৮ জুন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য হারে এই এক্সপ্রেসওয়েতে দুর্ঘটনা বেড়েছে। গত ৬ মাসেই দুর্ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে ১০০টি, এতে ২৯ জন নিহত ও ১৯৩ জন আহত হয়েছেন। এদের মধ্যে জুন মাসের ২৮ দিনেই ২১টি দূর্ঘটনায় ৪৭জন আহত ১২জন নিহত হয়েছেন।

হাইওয়ে পুলিশ জানিয়েছে, গত সপ্তাহে এই এক্সপ্রেসওয়েতে অন্তত তিনটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। কেউ কেউ বলছেন, কিছু ঘটনা রিপোর্ট করা হয়নি। ফলে প্রকৃত নিহতের সংখ্যা আরও বেশি হবে।

এ বিষয়ে জানার জন্য যোগাযোগ করা হলে হাঁসাড়া হাইওয়ে থানার ওসি আবদুল কাদের জিলানী বলেন, ‘ঢাকার যানজট পার হয়ে যখন ড্রাইভাররা এক্সপ্রেসওয়েতে আসেন, তখন তাদের গতিসীমা বেড়ে যায়। এ ছাড়াও যাত্রীরা ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার না করে সড়ক দিয়ে যাতায়াত করে। এতেই ঘটে বিপত্তি।’

মহাসড়কে দুর্ঘটনা কমানোর জন্য তিনি আরও বলেন, ‘মহাসড়কে দুর্ঘটনা ও অপরাধ কমানোর জন্য এক্সপ্রেসওয়েতে গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণে যেসব সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে, সেগুলো সচল করতে হবে। সেই সঙ্গে সন্ধ্যা ৬টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে মোটরসাইকেল চলাচল নিষিদ্ধসহ আব্দুল্লাহপুর, ছনবাড়ী টোলপ্লাজা চালু করতে হবে।’

স্ট্রিম গ্রাফিক
স্ট্রিম গ্রাফিক

শ্রীনগর ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপ-পরিচালক দেওয়ান আজাদ হোসেন জানান, সার্ভিস লেনে গাড়ি চলাচলের জন্য সড়ক বিভাগ গতিসীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে। স্বাভাবিকভাবে এক্সপ্রেসওয়েতে কার, বাস, মিনিবাস ও মাইক্রোবাসের সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও মিনি ট্রাকসহ সকল মালবাহী যানের সর্বোচ্চ গতিসীমা ঘণ্টায় ৫০ কিলোমিটার এবং মোটরসাইকেলের সর্বোচ্চ গতিসীমা ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দূরপাল্লার যাত্রীবাহী বাস ও ট্রাকের চালকরা এ নীতিমালা মানছেন না।

উপ-পরিচালক দেওয়ান আজাদ হোসেন আরো জানান, পুলিশ বিভিন্ন স্থানে চেকপোষ্ট বসিয়ে, মাইকিং করে ও লিফলেট বিতরণ করেও ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নতিতে সফল হচ্ছে না। গাড়ির চালক পুলিশের সামনে গতি কমালেও, পরে আবার গতি বাড়িয়ে দেয়। বৈরী আবহাওয়ায় কিংবা ঘন কুয়াশার সময় যানবাহন চলাচল বন্ধ বা গতি নিয়ন্ত্রণ সীমার মধ্যে রেখে চলাচল করতে বলা হলেও তা মানা হচ্ছে না।

দেওয়ান আজাদ হোসেন বলেন, ‘গাড়ি চলাচলের নিয়ম বেঁধে দেওয়া সত্ত্বেও ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে যেন মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছে। দুর্ঘটনা রোধে ও সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে সরকারি কোনো পদক্ষেপই কাজে আসছে না।’

এ বিষয়ে হাঁসাড়া হাইওয়ে থানার ওসি আবদুল কাদের জিলানী আরো বলেন, ‘পদ্মাসেতু উদ্বোধনের পর যানবাহনের জন্য খুলে দিলে প্রথম কয়েকদিনেই প্রাণ যায় ৩ মোটরসাইকেল আরোহীর। পরে মোটরসাইকেল চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। সহজ ও নিরাপদ সড়ক যাতায়াত নিশ্চিত করতে আট লেনের এক্সপ্রেসওয়েটি নির্মিত হলেও এখানে শুরু থেকেই যানবাহনের বেপরোয়া গতির কারণে একের পর এক সড়ক দুর্ঘটনায় যাত্রীদের প্রাণ ঝরছে।’

পুলিশের এই কর্মকর্তা আরো জানান, গাড়ির চালকদের কাছে ড্রাইভিং লাইসেন্সের মূল কপি না থাকায় (তারা ফটোকপি সঙ্গে রাখেন), তা পরীক্ষা করতে অনেক সময় লাগে। ফলে রাস্তার সব গাড়ি চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষা করা যায় না। বিআরটিএ দ্রুততম সময়ের মধ্যে চালককে মূল লাইসেন্স নবায়নসহ ফেরত দিলে লাইসেন্স পরীক্ষা করা সহজ হবে। ট্রাফিক আইন অমান্য কারীদের বিরুদ্ধে গত এক বছরে ৪ শতাধিক মামলা হয়েছে।

যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এক্সপ্রেসওয়েটির নির্মাণকাজ চলার সময়ে ২০১৯ সালের ১১ নভেম্বর বাস-মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে ৯ জন নিহত হন। ঘটনার পর বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) একটি দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে একটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়।

প্রতিবেদনে দুর্ঘটনার জন্য অনেকগুলো কারণ চিহ্নিত করা হয়। এর একটি ছিল সড়ক বিভাজকের ব্যারিয়ার সঠিকভাবে স্থাপন না করা। বুয়েটের বিশেষজ্ঞ দল বলছে, গাড়ি চালানোর সময় স্টিলের ব্যারিয়ার আর কংক্রিটের বিভাজকের ১০ ইঞ্চি পার্থক্য সব সময় চালকের পক্ষে লক্ষ্য করা সম্ভব নয়। এতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেড়ে যায়।

এই ত্রুটির দায় সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী, তদারককারী ও বাস্তবায়নকারী সংস্থার ওপর চাপাচ্ছে এআরআই। এ বিষয়ে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের ঢাকা জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী শোয়েব আহমেদ স্ট্রিমকে বলেন, ‘এক্সপ্রেসওয়েটিতে নতুন করে আরো ১৬টি ফুটওভারব্রিজ (পদচারী সেতু) নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যেসব জায়গায় বাস স্টপেজ রয়েছে, তার সবগুলোতেই ফুটওভারব্রিজ দেওয়া হবে বলে মন্তব্য করেন শোয়েব আহমেদ। এছাড়াও তিনি বলেন, এক্সপ্রেসওয়ের নকশার ত্রুটির জন্য এই দুর্ঘটনা বাড়ছে এটা পুরোপুরি সত্য না। দুর্ঘটনার পেছনে অন্যতম কারণ হচ্ছে অদক্ষ চালক এবং সড়ক আইন সম্পর্কে তাদের যথাযথ ধারণা না থাকা।

তবে উপরের সমস্যাগুলোর সঙ্গে আরেকটি বড় সমস্যা যুক্ত করেছেন বুয়েটের এআরআইয়ের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান। সমস্যাটি হলো মহাসড়কের নকশাগত দুর্বলতা। এমনকি মহাসড়কটিকে এক্সপ্রেসওয়ে হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন এই বিশেষজ্ঞ। তাঁর ভাষায়, ‘যদি এক্সপ্রেসওয়ে আমরা বানাই, তাহলে এক্সপ্রেসওয়ের যেসব বৈশিষ্ট্য সেগুলো আমাদের রাখতে হবে। না হলে সেটা একটা সাধারণ মহাসড়কের মতো হয়ে যাবে। প্রথম কথা হচ্ছে, এক্সপ্রেসওয়েতে বাস-বে রাখা যাবে না। ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে এটি রাখা হয়েছে। ফলে বাসে উঠতে বা নামতে গিয়ে এক্সপ্রেসওয়ের ভেতরে চলে আসছে যাত্রী। ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হচ্ছে। তখনই দুর্ঘটনাগুলো ঘটছে।’

ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে যোগাযোগের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। তবে নির্মাণগত ত্রুটি, ট্রাফিক আইনের অবহেলা, যানবাহনের বেপরোয়া গতি এবং যাত্রী-চালকদের অসচেতনতার ফলে এটি ক্রমেই মৃত্যুফাঁদে রূপ নিয়েছে। একদিকে নকশাগত দুর্বলতা, অন্যদিকে অদক্ষ ও আইন অমান্যকারী চালকদের উদাসীনতা—এই দুইয়ের মারাত্মক সমন্বয় প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে নিরীহ যাত্রীদের।

Ad 300x250

সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনব্যবস্থায় জামায়াতের কী লাভ

ট্রাইব্যুনালে জমা পড়ল আবু সাঈদ হত্যা মামলার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ

পাকিস্তান-চীন উদ্যোগে নতুন আঞ্চলিক সংগঠন: সার্কের বিকল্প হতে পারবে

আহমদ ছফা কেন তরুণদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন

যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশিদের যাত্রা শুরু, অতঃপর মামদানি কেন তাঁদের আপনজন

সম্পর্কিত