এক সময় বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের অন্যতম শীর্ষ খাত ছিল হিমায়িত চিংড়ি। কিন্তু গত দুই দশকে প্রতিযোগী দেশগুলো আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়ায় এগিয়ে গেলেও বাংলাদেশ সেই তুলনায় পিছিয়ে পড়েছে। বর্তমানে ভারতের তুলনায় বাংলাদেশে হেক্টর প্রতি চিংড়ি উৎপাদন ১৪ গুণ কম। এই ব্যর্থতার জন্য জমির অদক্ষ ব্যবহার, বড় শিল্পগোষ্ঠীগুলোর অনীহা এবং সনাতন পদ্ধতিকে দায়ী করেছেন নীতিনির্ধারকরা।
বুধবার (৩ ডিসেম্বর) রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) এবং বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএফইএ) যৌথ আয়োজনে ‘ট্রান্সফর্মিং পলিসি সাপোর্ট ফর রিভাইভিং বাংলাদেশ’স শ্রিম্প সেক্টর’ শীর্ষক নীতি সংলাপে এসব কথা উঠে আসে।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পিআরআইয়ের গবেষণা পরিচালক বজলুল হক খন্দকার। তিনি তথ্য-উপাত্ত দিয়ে দেখান, ২০০০ সালে বাংলাদেশ থেকে যে পরিমাণ চিংড়ি রপ্তানি হতো, তার হার অন্যান্য চিংড়ি রপ্তানিকারক দেশ—যেমন ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম ও ভারতের প্রায় সমান ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ওই দেশগুলো প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে এগিয়ে গেছে, আর বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়েছে।
বজলুল হক খন্দকার তাঁর গবেষণাপত্রে উল্লেখ করেন, বর্তমানে ভারতের হেক্টর প্রতি চিংড়ি উৎপাদন যেখানে ৭ টন, সেখানে বাংলাদেশে উৎপাদন হচ্ছে মাত্র শূন্য দশমিক ৫ টন।
মূল প্রবন্ধে উপস্থাপিত এই উৎপাদন ঘাটতির বিষয়টি সামনে এনে ক্ষোভ প্রকাশ করেন বিশেষ অতিথি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি প্রশ্ন তোলেন, ‘কেন এই ১৪ গুণের ব্যবধান?’
গভর্নর অভিযোগ করেন, অনেক বড় শিল্প গ্রুপ সরকারের কাছ থেকে ৯৯ বা ১০০ বছরের জন্য দীর্ঘমেয়াদি লিজ নেওয়া জমি ফেলে রেখেছে। তিনি বলেন, ‘তারা হয়তো সেখান থেকে বছরে ৫ কোটি টাকা আয় করে এবং তাতেই খুশি। কারণ তারা সেখানে একটি পয়সাও বিনিয়োগ করে না। তারা ওই জমি থেকে ৫০০ কোটি বা ১০০ কোটি টাকা আয়ের কথা চিন্তাও করে না।’
বড় শিল্পগোষ্ঠীগুলোকে হুঁশিয়ারি দিয়ে গভর্নর বলেন, ‘জমি কোনো “পারিবারিক অলংকার” (ফ্যামিলি জুয়েল) নয়, এটি জাতীয় সম্পদ। আমাদের চা বাগানগুলোকে পারিবারিক সম্পদ হিসেবে দেখার প্রবণতা ছিল, এখন মৎস্য খাতকেও সেভাবে দেখা হচ্ছে। কিন্তু এটাকে অবশ্যই উৎপাদনমুখী এন্টারপ্রাইজ হিসেবে ব্যবহার করতে হবে।’ তিনি পরামর্শ দেন, যারা উৎপাদন বাড়াতে ব্যর্থ হবে, তাদের লিজ বাতিল করে প্রকৃত উদ্যোক্তাদের জমি দেওয়া উচিত।
সবশেষে গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর ইতিবাচক সুরে বলেন, চিংড়ি খাতকে সহায়তা করতে বাংলাদেশ ব্যাংক অত্যন্ত উদার নীতি গ্রহণ করেছে। ঋণ পুনঃতফসিলীকরণের জন্য বিশেষ ছাড় দেওয়া হয়েছে, যেখানে নামমাত্র ডাউন পেমেন্ট এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিশোধের সুযোগ রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘ব্যাংক সাহায্য করবে। তবে শুধু টাকা দিলেই হবে না, আপনাদের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে এবং জমির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। পরিবেশ ও শিল্পের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে এগোলে এই খাত হারানো গৌরব ফিরে পাবে।’
খাতটির বিপণন দুর্বলতা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুর রহিম খান। তিনি বলেন, সরকার বিশ্বজুড়ে ৪৬টি মেলায় সহায়তা দিচ্ছে, অথচ চিংড়ি খাত মাত্র একটি মেলায় (বার্সেলোনা) অংশ নিচ্ছে। সম্প্রতি পূর্বাচলে অনুষ্ঠিত গ্লোবাল সোর্সিং এক্সপো এবং দুবাইয়ের আসন্ন ‘গালফ ফুড ২০২৬’-এ এই খাতের কোনো অংশগ্রহণ নেই। তিনি বলেন, ‘এটি একটি হারানো সুযোগ। নীতিনির্ধারক এবং শিল্প মালিকদের মধ্যে যোগাযোগের বড় অভাব রয়েছে।’
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার তার বক্তব্যে পরিবেশগত সতর্কতার পাশাপাশি নীতি সহায়তার ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, ‘চিংড়ি চাষ করতে হবে পরিবেশ রক্ষা করেই। চকরিয়ায় ম্যানগ্রোভ বন ধ্বংস করে চিংড়ি চাষের মতো ভুল আর করা যাবে না।’
অতীতের ভুল শোধরানোর আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘একসময় রপ্তানির লোভে দেশের মানুষ চিংড়ির মাথা খেত আর শরীরটা বিদেশে যেত। কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ীরা ওজন বাড়াতে চিংড়িতে জেলি পুশ করা এবং অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার করে বিদেশের বাজারে, বিশেষ করে ইউরোপে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে। এই জায়গা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘চকরিয়াতে ম্যানগ্রোভ বন কেটে চিংড়ি চাষ করা হয়েছে, যা পরিবেশের জন্য বড় বিপর্যয় ডেকে এনেছে।’
চিংড়ি খাতের দীর্ঘদিনের দাবির প্রেক্ষিতে তিনি বলেন, এই খাতকে কৃষি হিসেবে গণ্য করার দাবি দীর্ঘদিনের। সেই প্রেক্ষিতে খুব শীঘ্রই চিংড়ি খাতের জন্য বিদ্যুৎ বিলে ২০ শতাংশ রিবেট (ছাড়) কার্যকর হতে যাচ্ছে, যা চাষি ও ব্যবসায়ীদের উৎপাদন খরচ কমাতে বড় ভূমিকা রাখবে।