leadT1ad

মৃত্যুর মিছিলে কেন ‘পাবলিসিটি পলিটিক্স’

নিহত শিশুদের পরিবার স্বপ্ন হারিয়েছে, শহরজুড়ে এক বিষাদ ছড়িয়ে পড়েছে। অথচ এই গভীর বেদনার সময়েও শুরু হলো একই পুরোনো নাটক—রাজনীতিবিদদের বহর, ক্যামেরা, বক্তব্য। এই আচরণ কি তাদের সহানূভুতির আন্তরিকতার প্রতিই মানুষের সন্দেহ প্রকট করে দেবে না?

প্রকাশ : ২২ জুলাই ২০২৫, ১৪: ৫৩
আপডেট : ২২ জুলাই ২০২৫, ১৫: ৩৬
মৃত্যুর মিছিলে কেন ‘পাবলিসিটি পলিটিক্স’। স্ট্রিম গ্রাফিক

ঢাকার উত্তরার দিয়াবাড়ির মাইলস্টোন স্কুলে বিমান বিধ্বস্ত হয়ে মৃত্যু ঘটল যাদের, তাদের অধিকাংশ শিশু। হাসপাতাল উদ্ধার করে আনা মানুষদের বাঁচানোর জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছে। পুরো দেশ শোকে আচ্ছন্ন। তখন কিছু রাজনীতিবিদের আচরণ এক ভয়ানক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে—আমাদের রাজনীতিবিদেরা কি কোনো দিন পরিপক্বতা ও প্রজ্ঞার প্রমাণ দিতে পারবে? না কি শোক ও সংকটেও তাঁরা কেবল নিজেদের প্রচার আর ক্যামেরাপ্রিয়তা নিয়ে ব্যস্ত থাকবে?

একটি যুদ্ধবিমান একটি স্কুলে বিধ্বস্ত হয়েছে—এমন ঘটনা তো কেউ দুঃস্বপ্নেও দেখে না। ক্লাস শেষে শিশুরা কেউ বাড়ি ফেরার জন্য তৈরি হচ্ছিল। কেউ হয়তো বন্ধুর অপেক্ষায়, কেউ ক্লাসরুমে গল্পে মশগুল। হঠাৎ যেন আকাশ থেকে মৃত্যুর ঘূর্ণি নামল। নিহত শিশুদের পরিবার স্বপ্ন হারিয়েছে, শহরজুড়ে এক বিষাদ ছড়িয়ে পড়েছে। অথচ এই গভীর বেদনার সময়েও শুরু হলো একই পুরোনো নাটক—রাজনীতিবিদদের বহর, ক্যামেরা, বক্তব্য। এই আচরণ কি তাদের সহানূভুতির আন্তরিকতার প্রতিই মানুষের সন্দেহ প্রকট করে দেবে না?

জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা সভ্য দেশগুলো—সবাই ইনসিডেন্ট কমান্ড সিস্টেম বা আইসিএস মেনে চলে। সেখানে থাকে তিনটি জোন—হট (কেবল প্রশিক্ষিত উদ্ধারকর্মীদের জন্য), ওয়ার্ম (লজিস্টিক), কোল্ড (গণমাধ্যমকর্মী ও সাধারণ মানুষ)। রাজনৈতিক নেতারা? তাঁরা দূরে থাকেন।

আমরা দেখেছি, কীভাবে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে নেতাদের আগমনে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে। চিকিৎসকদের অনুরোধ, রোগীর স্বজনদের কান্না—সব উপেক্ষা করে নেতারা দলে দলে হাসপাতালে প্রবেশ করেছেন। শতাধিক অনুসারী, প্রটোকলের গাড়ি, মিডিয়ার ফ্ল্যাশ, ইউটিউবারদের লাইভ—সব মিলিয়ে হাসপাতাল যেন পরিণত হয় ‘রাজনৈতিক ট্যুর স্পট’-এ।

প্রশ্ন হলো, এই সময়টায় তাঁদের সেখানে উপস্থিতি কি আদৌ প্রয়োজন ছিল? অথবা আদৌ সহানুভূতির প্রকাশ কি এমনটাই হয়? একজন শিশুর শরীর ৮০ শতাংশ পুড়ে গেলে, পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুললে কি তার যন্ত্রণার উপশম হয়? শিশুর স্বজন যখন দৌড়ে রক্তের সন্ধানে বেরিয়েছেন, তখন তাকে সরিয়ে দিয়ে নেতা-কর্মী ঢুকলে কি কোনো দায়িত্ববোধের পরিচয় পাওয়া যায়?

মাইলস্টোন কলেজে বিমান দুর্ঘটনায় উদ্ধারকাজ চালাচ্ছেন সেনাসদস্যরা। ছবি: ইউএনবি
মাইলস্টোন কলেজে বিমান দুর্ঘটনায় উদ্ধারকাজ চালাচ্ছেন সেনাসদস্যরা। ছবি: ইউএনবি

আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কী হতো?

এই প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইলে, একটু তাকাতে হয় বাইরের দেশে। ফ্রান্সে, জাপানে, এমনকি ভারতের রাজধানীতেও কেউ এতটুকু চিন্তাও করতে পারে না যে একটি দুর্ঘটনাস্থলে বা জরুরি চিকিৎসাসেবা চলার সময়ে রাজনৈতিক নেতারা ঢুকে পড়বেন। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা সভ্য দেশগুলো—সবাই ইনসিডেন্ট কমান্ড সিস্টেম বা আইসিএস মেনে চলে। সেখানে থাকে তিনটি জোন—হট (কেবল প্রশিক্ষিত উদ্ধারকর্মীদের জন্য), ওয়ার্ম (লজিস্টিক), কোল্ড (গণমাধ্যমকর্মী ও সাধারণ মানুষ)। রাজনৈতিক নেতারা? তাঁরা দূরে থাকেন। সময় হলে আসেন। তা-ও সমন্বিতভাবে, নির্দিষ্ট নিরাপত্তা ও বিধি মেনে।

যেখানে সরকারের লোকজন সাংবাদিকদের জানাচ্ছেন যে মানুষের ভিড়ে আহত ব্যক্তিদের মধ্যে সংক্রমণের ঝুঁকি প্রবলভাবে বেড়ে যায়, সেখানে রাজনীতিবিদদের ভিড়ে ব্যহত হচ্ছে মানুষকে বাঁচানোর কাজ! যিনি যত বড় নেতা, তাঁর গাড়ি তত আগে হাসপাতালের গেটে! তাঁর অনুসারীরা তত বেশি অ্যাম্বুলেন্স আটকে রাখে! তাঁর ফেসবুক পেজে তত দ্রুত পোস্ট!

তখন বাচ্চারা পুড়ে যাচ্ছে, ডাক্তারের গ্লাভস রক্তভেজা, তখন যেন মঞ্চে ঢোকার প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত আমাদের কিছু রাজনৈতিক নেতা!

নেতারা কী করতে পারতেন

হাসপাতালে ভিড় করে ঝামেলা না করে কী করতে পারতেন আমাদের নেতারা? তাঁরা একসঙ্গে যৌথ বিবৃতি দিতে পারতেন—দূর থেকে, ভার্চ্যুয়ালি। সবাই যদি একযোগে এমনকি একসঙ্গে যৌথ বিবৃতি দিয়ে শোক জানাতেন, তাহলে আমরা আশ্বস্ত হতাম যে অন্তত কোনো একটা জায়গায় আমাদের নেতারা দেশের মানুষের দুর্যোগে একমত হয়ে এক জায়গায় আসতে পেরেছেন।

আমরা নেতাদের কাছে থেকে দুর্গত পরিবারগুলোর প্রতি সমবেদনা, যে কোনো প্রয়োজনে তাঁদের সহযোগিতার ঘোষণা আশা করতে পারতাম। আমরা তাঁদের কাছ থেকে আশা করতে পারতাম, এই রকম দুর্ঘটনার কারণ বিশ্লেষণ আর তার প্রতিকারের অঙ্গীকার। তাঁরা নিজেরা সেখানে ভিড় না করে বরং নিজেদের কর্মীদের নিয়ে সেই ভিড় যাতে তৈরি না হয়, সেই কাজে হাত বাড়িয়ে দিতে পারতেন।

কিন্তু এগুলোর কোনোটিই হয়নি। বরং যেটি হলো, তা হলো ‘পাবলিসিটি পলিটিক্স’।

যিনি যত বড় নেতা, তাঁর গাড়ি তত আগে হাসপাতালের গেটে! তাঁর অনুসারীরা তত বেশি অ্যাম্বুলেন্স আটকে রাখে! তাঁর ফেসবুক পেজে তত দ্রুত পোস্ট!

এই রাজনৈতিক সংস্কৃতি কি কোনোদিন পাল্টাবে?

আমরা কি এমন কোনো রাজনৈতিক নেতৃত্ব পাব যারা বলবেন,‘আমি এখন যাব না, এখন বাচ্চাদের বাঁচানোর সময়?’ আমরা কি কখনো এমন নেতৃত্ব দেখব, কোনো দিন যাঁরা বলবেন, ‘জরুরি প্রাণ বাঁচানোর মুহূর্তে লোক দেখানো রাজনীতি ঢুকলে সেটি শোক নয়, শোষণ হয়ে যায়?’

বলা হয়, একজন প্রকৃত নেতা দূরে থেকেও সমীহ আদায় করেন। প্রজ্ঞা ও নৈতিক দৃঢ়তায় মানুষ তাঁর নাম নেয়। কিন্তু আমাদের এখানে শোকের মধ্যেও চলে রোড শো!

নির্বাচন সামনে। প্রতিশ্রুতি অনেক শোনা যাবে। কিন্তু আমরা যদি সত্যিই পরিবর্তন চাই, তবে প্রশ্ন রাখতে হবে—শোকের মুহূর্তে যাঁরা ক্যামেরা চান, তাঁরা কি সত্যিই দেশের দায়িত্ব নিতে পারবেন?

না হলে, এই রাজনৈতিক-প্রশাসনিক থিয়েটার চলতেই থাকবে। মৃত্যুর ভেতর দিয়ে।

জাভেদ হুসেন: লেখক ও অনুবাদক

Ad 300x250

ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে, সঙ্কটকে সংহতি নিয়ে মোকাবিলা করতে হবে: তারেক রহমান

ফ্যাসিবাদের প্রশ্নে সবাই ঐক্যবদ্ধ: প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে চার দলের বৈঠক শেষে আসিফ নজরুল

চার দলের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক শেষ: সাম্প্রতিক বিষয় ও আগামীর পথচলা নিয়ে আলোচনা

চার রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠকে বসেছেন প্রধান উপদেষ্টা

৯ ঘণ্টা পর মাইলস্টোন থেকে বের হতে পারলেন দুই উপদেষ্টা

সম্পর্কিত