তাহমীদ চৌধুরী
যদি প্রশ্ন করা হয়, সভ্যতার প্রধান স্তম্ভ কী? অনেকেই হয়তো বলবেন আইনের কথা। কিন্তু আমরা বলতে চাই, আইন নয়, বরং অভিযোগ ও রায়ের মাঝখানে থাকা সংক্ষিপ্ত অবকাশই সেই স্তম্ভ। যেটুকু সময়ে একটি সমাজ শ্বাস নেয়, প্রমাণ খোঁজে, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয় এবং সবশেষে সিদ্ধান্তে পৌঁছায়।
বাংলাদেশে যেন আজ সেই অবকাশটুকু বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এখানে ‘চোর’ শব্দটি এখন আর অভিযোগ নয়, মৃত্যুদণ্ডেরই সমার্থক হয়ে উঠেছে। কোনো আদালত নয়, উন্মত্ত একদল ‘মানুষ’ রাস্তায়, কারখানায় এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে পর্যন্ত কার্যকর করে চলেছে সেই দণ্ড।
এই বর্বরতার সাম্প্রতিকতম মুখ ১৯ বছরের মো. হৃদয়। যে বয়সে হৃদয়ের বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা কলেজে পড়ার কথা, সে বয়সে রুটি ও রুজির তাড়নায় হৃদয় ইলেক্ট্রিশিয়ান হিসেবে চাকরি করছিলেন পোশাক কারখানায়। ইলেকট্রিশিয়ানরা জানে তাঁদের কাজে মৃত্যুর ঝুঁকি আছে, কিন্তু সেই ঝুঁকি থাকে বিদ্যুতের তারে। ঘুম থেকে উঠে পৃথিবীর কোনো ইলেকট্রিশিয়ানই সম্ভবত ভাবে না, আজ তাকে বেধড়ক পিটুনিতে মরতে হতে পারে। কারণ বিদ্যুৎ আর তারের কাজে পিটুনির কোনো সংযোগ নেই।
তবে ব্যতিক্রম ঘটলো টাঙ্গাইলের ছেলে হৃদয়ের সাথে। গাজীপুরের এক কারখানায় চুরির অপবাদে তাকে বেঁধে ফেলা হয়। এরপর শুরু হয় ‘বীভৎসতার উন্মত্ত উৎসব’। সামাজিকমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, হৃদয়ের রক্তাক্ত, নিথর দেহটাকে টেনেহিঁচড়ে নেওয়া হচ্ছে, তাকে ঘিরে থাকা মানুষেরা হাসছে। ভিডিওতে এক পুরুষ কণ্ঠস্বরকে বলতে শোনা যায়, ‘অনেক পেটানো হয়েছে, তারপরও মরে যায়নি।’ এই একটি বাক্যই হয়তো বুঝিয়ে দেয়, আমরা কোন অতল গহ্বরে তলিয়ে গেছি। এখানে অভিযুক্তের মৃত্যু নিশ্চিত করাটাই যেন একমাত্র লক্ষ্য।
হৃদয়-হত্যাকান্ড কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বলা যায় এটি একটি প্যাটার্নের অংশ। গতবছর সেপ্টেম্বরে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত (আবাসনের দিক থেকে) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মানসিক ভারসাম্যহীন তোফাজ্জল হোসেনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল ক্রিকেট স্টাম্প দিয়ে। হত্যার আগে তার ক্ষুধার্ত পেটে খাবার তুলে দিয়েছিল ‘মেধাবী’ শিক্ষার্থীরা। যেন একদল শিকারি তাদের শিকারকে বধ করার আগে শেষ মুহূর্তের করুণা দেখাচ্ছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত (দশ মাসে) এমন হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ৩২৯ জন মানুষ।
প্রশ্ন হলো, এইসব হত্যাকারী কারা? তারা আমাদেরই প্রতিবেশী, সহকর্মী কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী। কোন অদৃশ্য শক্তি তাদের হাতে আইন তুলে নেওয়ার এই অমোঘ অধিকার দিচ্ছে? উত্তরটি সম্ভবত লুকিয়ে আছে বর্তমান বিচারিক নিষ্ক্রিয়তায়। যখন হৃদয়ের হত্যা মামলার এজাহারে ভিডিও ফুটেজ থাকা সত্বেও প্রধান অভিযুক্তদের নাম থাকে না, কিংবা তোফাজ্জলের হত্যা মামলার চার্জশিট থেকে যখন প্রভাবশালীদের নাম ‘প্রমাণের অভাবে’ বাদ পড়ে যায়, তখন ‘দুর্বল অভিযুক্তকে হত্যা করা জায়েজ’ এমন বার্তা সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়াই খুব স্বাভাবিক। কয়েক দশক ধরে চলতে থাকা এই বিচারহীনতা কোনো প্রশাসনিক ত্রুটি নয়, এটি সবসময়ই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত যা শক্তিশালীকে সুরক্ষা দেয় এবং দুর্বলের জীবনকে মূল্যহীন করে তোলে।
এই অন্ধকার বাস্তবতার বিপরীতে হুমায়ূন আহমেদের গল্প ‘চোর’-এর প্রধান চরিত্র মুবিনকে দাঁড় করানো যাক। রাস্তায় পাওয়া একটি ব্যাগ হাতে নিয়েও তার বুক কাঁপে, পুলিশ দেখে সে ঘামে, তার ভেতরে কাজ করে লজ্জা আর অপরাধবোধ। মুবিনের এই মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েনই হলো মনুষ্যত্ব।
বর্তমানে আমরা এমন এক সামাজিক চুক্তির অধীনে বেঁচে আছি, যা বহু আগেই ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। যে রাষ্ট্র আমাদের নিরাপত্তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সেই রাষ্ট্রই আজ হত্যাকারীদের বিভিন্নভাবে দায়মুক্তি দিচ্ছে। ফলে, প্রতিটি দুর্বল মানুষ, প্রতিটি প্রান্তিক নাগরিক আজ উন্মত্ত জনতার সামনে হয়ে উঠছে একেকজন সম্ভাব্য হৃদয় বা তোফাজ্জল। তাদের বিরুদ্ধে ওঠা যেকোনো ভিত্তিহীন অভিযোগই হয়ে উঠতে পারে মৃত্যুদণ্ডের পরোয়ানা।
এই রক্তে ভেজা পরোয়ানাগুলোতে আদতে সই করছে কে? আমাদের ‘হৃদয়’ বেধড়ক পিটুনিতে কেন বারবার মরে যাচ্ছে? এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া বাংলাদেশের জন্য আজ এক মৌলিক জরুরৎ।
যদি প্রশ্ন করা হয়, সভ্যতার প্রধান স্তম্ভ কী? অনেকেই হয়তো বলবেন আইনের কথা। কিন্তু আমরা বলতে চাই, আইন নয়, বরং অভিযোগ ও রায়ের মাঝখানে থাকা সংক্ষিপ্ত অবকাশই সেই স্তম্ভ। যেটুকু সময়ে একটি সমাজ শ্বাস নেয়, প্রমাণ খোঁজে, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয় এবং সবশেষে সিদ্ধান্তে পৌঁছায়।
বাংলাদেশে যেন আজ সেই অবকাশটুকু বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এখানে ‘চোর’ শব্দটি এখন আর অভিযোগ নয়, মৃত্যুদণ্ডেরই সমার্থক হয়ে উঠেছে। কোনো আদালত নয়, উন্মত্ত একদল ‘মানুষ’ রাস্তায়, কারখানায় এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে পর্যন্ত কার্যকর করে চলেছে সেই দণ্ড।
এই বর্বরতার সাম্প্রতিকতম মুখ ১৯ বছরের মো. হৃদয়। যে বয়সে হৃদয়ের বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা কলেজে পড়ার কথা, সে বয়সে রুটি ও রুজির তাড়নায় হৃদয় ইলেক্ট্রিশিয়ান হিসেবে চাকরি করছিলেন পোশাক কারখানায়। ইলেকট্রিশিয়ানরা জানে তাঁদের কাজে মৃত্যুর ঝুঁকি আছে, কিন্তু সেই ঝুঁকি থাকে বিদ্যুতের তারে। ঘুম থেকে উঠে পৃথিবীর কোনো ইলেকট্রিশিয়ানই সম্ভবত ভাবে না, আজ তাকে বেধড়ক পিটুনিতে মরতে হতে পারে। কারণ বিদ্যুৎ আর তারের কাজে পিটুনির কোনো সংযোগ নেই।
তবে ব্যতিক্রম ঘটলো টাঙ্গাইলের ছেলে হৃদয়ের সাথে। গাজীপুরের এক কারখানায় চুরির অপবাদে তাকে বেঁধে ফেলা হয়। এরপর শুরু হয় ‘বীভৎসতার উন্মত্ত উৎসব’। সামাজিকমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, হৃদয়ের রক্তাক্ত, নিথর দেহটাকে টেনেহিঁচড়ে নেওয়া হচ্ছে, তাকে ঘিরে থাকা মানুষেরা হাসছে। ভিডিওতে এক পুরুষ কণ্ঠস্বরকে বলতে শোনা যায়, ‘অনেক পেটানো হয়েছে, তারপরও মরে যায়নি।’ এই একটি বাক্যই হয়তো বুঝিয়ে দেয়, আমরা কোন অতল গহ্বরে তলিয়ে গেছি। এখানে অভিযুক্তের মৃত্যু নিশ্চিত করাটাই যেন একমাত্র লক্ষ্য।
হৃদয়-হত্যাকান্ড কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বলা যায় এটি একটি প্যাটার্নের অংশ। গতবছর সেপ্টেম্বরে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত (আবাসনের দিক থেকে) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মানসিক ভারসাম্যহীন তোফাজ্জল হোসেনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল ক্রিকেট স্টাম্প দিয়ে। হত্যার আগে তার ক্ষুধার্ত পেটে খাবার তুলে দিয়েছিল ‘মেধাবী’ শিক্ষার্থীরা। যেন একদল শিকারি তাদের শিকারকে বধ করার আগে শেষ মুহূর্তের করুণা দেখাচ্ছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত (দশ মাসে) এমন হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ৩২৯ জন মানুষ।
প্রশ্ন হলো, এইসব হত্যাকারী কারা? তারা আমাদেরই প্রতিবেশী, সহকর্মী কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী। কোন অদৃশ্য শক্তি তাদের হাতে আইন তুলে নেওয়ার এই অমোঘ অধিকার দিচ্ছে? উত্তরটি সম্ভবত লুকিয়ে আছে বর্তমান বিচারিক নিষ্ক্রিয়তায়। যখন হৃদয়ের হত্যা মামলার এজাহারে ভিডিও ফুটেজ থাকা সত্বেও প্রধান অভিযুক্তদের নাম থাকে না, কিংবা তোফাজ্জলের হত্যা মামলার চার্জশিট থেকে যখন প্রভাবশালীদের নাম ‘প্রমাণের অভাবে’ বাদ পড়ে যায়, তখন ‘দুর্বল অভিযুক্তকে হত্যা করা জায়েজ’ এমন বার্তা সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়াই খুব স্বাভাবিক। কয়েক দশক ধরে চলতে থাকা এই বিচারহীনতা কোনো প্রশাসনিক ত্রুটি নয়, এটি সবসময়ই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত যা শক্তিশালীকে সুরক্ষা দেয় এবং দুর্বলের জীবনকে মূল্যহীন করে তোলে।
এই অন্ধকার বাস্তবতার বিপরীতে হুমায়ূন আহমেদের গল্প ‘চোর’-এর প্রধান চরিত্র মুবিনকে দাঁড় করানো যাক। রাস্তায় পাওয়া একটি ব্যাগ হাতে নিয়েও তার বুক কাঁপে, পুলিশ দেখে সে ঘামে, তার ভেতরে কাজ করে লজ্জা আর অপরাধবোধ। মুবিনের এই মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েনই হলো মনুষ্যত্ব।
বর্তমানে আমরা এমন এক সামাজিক চুক্তির অধীনে বেঁচে আছি, যা বহু আগেই ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। যে রাষ্ট্র আমাদের নিরাপত্তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সেই রাষ্ট্রই আজ হত্যাকারীদের বিভিন্নভাবে দায়মুক্তি দিচ্ছে। ফলে, প্রতিটি দুর্বল মানুষ, প্রতিটি প্রান্তিক নাগরিক আজ উন্মত্ত জনতার সামনে হয়ে উঠছে একেকজন সম্ভাব্য হৃদয় বা তোফাজ্জল। তাদের বিরুদ্ধে ওঠা যেকোনো ভিত্তিহীন অভিযোগই হয়ে উঠতে পারে মৃত্যুদণ্ডের পরোয়ানা।
এই রক্তে ভেজা পরোয়ানাগুলোতে আদতে সই করছে কে? আমাদের ‘হৃদয়’ বেধড়ক পিটুনিতে কেন বারবার মরে যাচ্ছে? এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া বাংলাদেশের জন্য আজ এক মৌলিক জরুরৎ।
এই যে নানাজনের নানা মত, মুরাদনগর আটকে গেল পরকীয়া-ধর্ষণ-আওয়ামী লীগ-বিএনপির বৃত্তে, এর মধ্যে শীতের সূর্যের মতো টুপ করে আড়াল হয়ে গেল ‘ন্যায়বিচার’। কেউ বলছে না, কারও সঙ্গে কারও যদি পরকীয়া সম্পর্ক থাকেও, তবুও এভাবে ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছেড়ে দেওয়া যায় না।
১ দিন আগেজোহরান মামদানির জয়পরবর্তী ইসলামোফোবিয়ার মাত্রা উদ্বেগজনক। মার্কিন নেতারা ও মিডিয়া তাঁকে ইসলামি সন্ত্রাসের সঙ্গে যুক্ত করার চেষ্টা করছে। এই ঘটনা কি আমেরিকার ধর্মীয় ও জাতিগত বিদ্বেষের প্রকৃত ছবি তুলে ধরে?
২ দিন আগেএক সময়ের ‘হিন্দি-চীনি ভাই ভাই’ থেকে আজকের ‘চিরকালের বন্ধু’ চীন-পাকিস্তান! আকসাই চীন নিয়ে সংঘাত আর কাশ্মীর ইস্যুকে ঘিরে বদলে যায় দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক সমীকরণ। ১৯৬৩ সালের এক মধ্যরাতের চুক্তিতেই ভারতের বদলে চীনের ভাই হয়ে ওঠে পাকিস্তান—যে চুক্তি ইতিহাস ঘুরিয়ে দেয় এ অঞ্চলের। কী ছিল সেই চুক্তি?
৭ দিন আগেআত্মহত্যাকে এত ছি ছি চোখে দেখার কিছু নেই। যেকোনো আত্মহত্যার পেছনে অন্তত তিনটি কারণ থাকে। ১. জৈবিক ২. মনস্তাত্ত্বিক ও ৩. ভৌগলিক। কেউ একজন আত্মহত্যা করলেই আমরা ধরে নিই, সে মানসিক সমস্যায় ছিল। এমন ভাবনা সত্যিই হাস্যকর।মানসিক সমস্যা ছাড়াও মানুষের জীবনে আরও বহুবিধ সমস্যা থাকে। সেসব কারণেও
২২ দিন আগে