leadT1ad

১৫ জুলাই, সশস্ত্র ছাত্রলীগের হামলা

রক্তমাখা মুখ নিয়ে এগিয়ে যাওয়া তন্বীর ছবি থেকে জ্বলল বিক্ষোভের স্ফুলিঙ্গ

১৫ জুলাই ২০২৪। কোটা সংস্কারের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে চলছিল আন্দোলনকারীদের স্লোগান। পরে তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের দিকে গেলে তাদের ওপর বেধড়কভাবে আক্রমণ করে ছাত্রলীগের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা। এর পরের অধ্যায়ে আছে নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের রক্তাক্ত হওয়ার কাহিনি। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের রুদ্ধশ্বাস দিনগুলোয় ব্যক্তিগত ও সামষ্টিকভাবে জন্ম নিয়েছে কত না সত্য গল্প। সেসব দিন ফিরে দেখা।

স্ট্রিম প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১৫ জুলাই ২০২৫, ১১: ৫৯
তন্বীর এই রক্তমাখা ছবি থেকেই ছড়িয়ে পড়ে বিক্ষোভের স্ফুলিঙ্গ। ছবি: সংগৃহীত

‘কোটা না মেধা, মেধা মেধা’— ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশ স্লোগান মুখরিত। এই জনস্রোতেই দাঁড়িয়ে ছিলেন রবিউল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ছাত্র তিনি। ‘প্রথমে আমি স্লোগান দিইনি, পরে কখন যে ভীড়ের মধ্যে গলা মিলিয়েছি, মনে নেই।’ রবিউল স্মৃতিচারণ করছিলেন সেই রক্তাক্ত দিনের। একসময় তিনি শুনতে পেলেন, বিজয় একাত্তর হলে একদল শিক্ষার্থীকে আটকে রাখা হয়েছে। আন্দোলনে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। ‘এ সময় ততক্ষণাৎ মাইকে ঘোষণা করা হলো, আমরা মিছিল নিয়ে আমাদের ভাইদের ছাড়িয়ে আনব।’

১৫ জুলাই ২০২৪। ছাত্রলীগের হামলার ঠিক আগমুহূর্তে এমনই ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি। সেদিন ছাত্রলীগের হামলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পসে প্রায় ৩০০ জন আহত হন।

রক্তপাত যে ঘটবে, তার আভাস মিলেছিল আগের রাতেই। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ বলার প্রতিবাদে ১৪ জুলাই রাতে বিক্ষোভ দেখিয়েছিলেন শিক্ষার্থীরা। সে সময় শাহবাগ মোড়ে ছিল আইন–শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যারিকেড। ওই পথে কাউকেই যাতায়াত করতে দেওয়া হচ্ছিল না। এ পরিস্থিতিতে ব্যারিকেডের একপাশে জটলা বেঁধেছিলেন রিকশাচালকেরা। তাঁদের আশঙ্কা ছিল, রাতে রক্তের বন্যা বয়ে যাবে।

হ্যাঁ, রক্তপাত হয়েছিল ঠিকই। সেদিন রাতে নয়, পরদিন দুপুরে।

যেভাবে হামলা শুরু হয়

১৫ জুলাই দুপুর ১২টার পর থেকে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে শান্তিপূর্ণভাবে শুরু হয় বিক্ষোভ। আগের রাতের ‘রাজাকার’ সম্বোধনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের রেশ এদিনও ছিল। ‘তুমি কে, আমি কে? রাজাকার রাজাকার; কে বলেছে, কে বলেছে? স্বৈরাচার স্বৈরাচার’, ‘চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’, ‘কে বলে রে রাজাকার, ধিক্কার ধিক্কার’, ‘কে রাজাকার, কে রাজাকার? তুই রাজাকার, তুই রাজাকার’—স্লোগানে স্লোগোনে রাজু ভাষ্কর্য আশপাশ তখন প্রকম্পিত। আন্দোলনকারীদের কণ্ঠে ছিল কোটা সংস্কারের দাবিও।

১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হলের গেটে ছাত্রলীগের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ। ছবি: আশরাফুল আলম
১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হলের গেটে ছাত্রলীগের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ। ছবি: আশরাফুল আলম

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ইডেন মহিলা কলেজ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ঢাকা কলেজ, বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা অংশ নিয়েছিলেন রাজু ভাস্কর্যের সেই বিক্ষোভে।

এই বিক্ষোভ থেকেই একসময় মাইকে জানানো হলো মিছিলের আহ্বান। আটক ছাত্রদের উদ্ধার করতে যেতে হবে হলের দিকে। এরপর ব্যানারকে ঢাল বানিয়ে বিক্ষুদ্ধ শিক্ষার্থীদের যাত্রা চলল হলের দিকে।

সেই মিছিলে একেকজন পালা করে রিকশায় দাঁড়িয়ে স্লোগান দিতে থাকেন। সঙ্গে গলা মেলান অন্যরা। পায়ে পায়ে মিছিল এগিয়ে চলে। মিছিলের স্বর যেন তখন আকাশ ছুঁয়েছে।

তবে এই কোলাহল, হট্টগোল, পায়ে পা মিলিয়ে চলা—সবই থেমে যায় সূর্যসেন হলের সামনে গিয়ে। সেখানে অস্ত্র হাতে মিছিল ঠেকানোর জন্য দলবদ্ধভাবে অবস্থান নিয়েছে ছাত্রলীগ।

দুই পক্ষের কিছুদূর এগোনো, আবার পিছিয়ে আসা, স্লোগান চালাচালি, দুই-একটি ঢিল। তারপরই শুরু হয়ে যায় হামলা। আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের সশস্ত্র হামলা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যা ঘটেছিল

ছাত্রলীগ তখন মাথায় হেলমেট ও হাতে লাঠি নিয়ে প্রস্তুত। শিক্ষার্থীরা ততটা নয়। ফলাফল যা হওয়ার তাই হলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা যেতে লাগল আহত আন্দোলনকারীদের। ছেলে-মেয়ে কোনো ভেদাভেদ নেই। ইটের টুকরোর আঘাতে কারও মাথা ফেটেছে, কারও হাত কেটেছে। কাউকে আবার হাতের কাছে পেয়ে মাটিতে ফেলে বেদম পিটিয়েছে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা। লাঠি হাতে রক্তমাখা মুখে মাথা নিচু করে এগোনো তন্বীর ছবি আজও সেই বর্বরতার সাক্ষ্য দেয়।

ছাত্রলীগের হামলায় মিছিলটি ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। আন্দোলনকারীরা পিছিয়ে ভিসি চত্বরে চলে আসেন। কিন্তু ছাত্রলীগ সেদিন পুরো প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিল। বিশ্ববিদ্যালয় শাখা তো বটেই, বাইরে থেকেও লোক নিয়ে আসা হয় আন্দোলনকারীদের ঠেকাতে।

এদিন বিকেলে সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের মন্তব্য করেন, ‘আত্মস্বীকৃত রাজাকারদের’ ঠেকাতে ছাত্রলীগই যথেষ্ট। তাঁর এই বক্তব্য মেনেই যেন রণসাজে সেদিন মাঠে নেমেছিল ছাত্রলীগ।

১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে এক আন্দোলনকারীকে পেটাচ্ছে ছাত্রলীগ। ছবি: আশরাফুল আলম
১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে এক আন্দোলনকারীকে পেটাচ্ছে ছাত্রলীগ। ছবি: আশরাফুল আলম

শুধু ক্যাম্পাস নয়, সন্ধ্যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভেতর ঢুকেও আন্দোলনকারীদের পেটায় সন্ত্রাসীরা। চিকিৎসা নিতে আসা অনেকেই তখন ফের হামলার শিকার হন।

সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি মাজহারুল কবির শয়ন মন্তব্য করেন, ‘এই ঘটনার যদি পুনরাবৃত্তি ঘটে, আজকে পাঁচ মিনিটে আমরা বের করে দিয়েছি। এর পরের দিন কিন্তু ঘরের থেকে আমরা ধরে নিয়ে আসব।’

রাতে নারকীয় জাবি

ফেসবুক লাইভের দর্শকসংখ্যা কোনোভাবেই হাজারের নিচে নামছে না। অথচ তখন মাঝরাত পেরিয়ে গেছে। ওই রাতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নারকীয় হামলার একমাত্র বিশ্বাসযোগ্য সাক্ষী ফেসবুক। মধ্যরাতে হওয়া সে হামলা মূলধারার সংবাদমাধ্যমে তেমনভাবে না এলেও ফেসবুকের মাধ্যমে সবাই ঠিকই বর্বরতার সাক্ষী হয়েছেন।

তখন রাত ১০টা পেরিয়েছে। উপাচার্যের বাসভবনের সামনে বিক্ষোভ করছেন আন্দোলনকারীরা। তাঁদের দাবি, সন্ধ্যায় হওয়া ছাত্রলীগের হামলার বিচার করতে হবে। কিছুক্ষণ পর উপাচার্যসহ অন্যরা এসে কথা বললেও, সে আলোচনা সন্তোষজনক মনে হয়নি আন্দোলনকারীদের কাছে। তাঁরা তাই বিক্ষোভ চালিয়ে যান।

কিছুক্ষণ পর খবর আসে, ফের আক্রমণ চালাতে পারে ছাত্রলীগ। আন্দোলনকারীরা তখন উপাচার্যের বাসভবন প্রাঙ্গণে আশ্রয় নেন। চরম উৎকণ্ঠা ও উদ্বেগের এই মুহূর্তের সাক্ষী পুরো দেশবাসী। ফেসবুকের বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট থেকে তখন লাইভে আসেন শিক্ষার্থীরা। সবাইকে দেখান, কী পরিস্থিতিতে তাঁরা রয়েছেন।

খানিক বাদেই ছাত্রলীগের কর্মীরা বহিরাগতদের সঙ্গে নিয়ে ইট-পাটকেল, কাচের বোতল ছুড়তে থাকেন বাসভবন প্রাঙ্গণে। এ সময় পুলিশ এলে ছাত্রলীগ ফটক ছেড়ে রাস্তায় চলে আসে। তবে নারকীয় রাতের এটিই সমাপ্তি নয়। রাত দুইটায় আবার হামলা চালায় সংগঠনটি। এবার উপাচার্য বাসভবনের ফটক ভেঙে ভেতরে ঢুকে আন্দোলনকারীদের মারধোর করে তারা। ছোড়া হয় পেট্রলবোমাও। এই পুরোটা সময় নিজ বাসভবনের ভেতরেই বসে ছিলেন তৎকালীন উপাচার্য নূরুল আলম।

শেষে রাত সোয়া দুইটার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে আনুমানিক ৫০০ শিক্ষার্থী উপাচার্য বাসভবনের দিকে অগ্রসর হন। তাঁদের ধাওয়ায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা পালিয়ে যান। এ সময় পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে।

এ রাতেই পুলিশের ছোড়া ছররা গুলির আঘাতে আহত হন ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ লুৎফুল এলাহী। গুলির আঘাতে তাঁর ডান চোখ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

এদিন ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের হামলার শিকার হন আন্দোলনকারীরা।

কোটা সংস্কারের দাবি, প্রধানমন্ত্রীর ‘রাজাকার’ বক্তব্য প্রত্যাহার ও শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে পরদিন (১৬ জুলাই) বিকেল ৩টা থেকে দেশজুড়ে সব ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশের ডাক দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তৎকালীন সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম।

শেখ হাসিনাকে বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবি জানালেও তাতে সাড়া মেলেনি। বরং এক অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা বলেন, ‘পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও রাজাকার বাহিনী কীভাবে দেশে অত্যাচার চালিয়েছে তা তারা জানে না। এসব অত্যাচার, রাস্তায় রাস্তায় লাশ পড়ে থাকা এরা দেখেনি। তাই নিজেদের রাজাকার বলতে তাদের লজ্জাবোধ হয়নি।’

Ad 300x250

সম্পর্কিত