নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সীমানা পুনর্নির্ধারণের সিদ্ধান্ত শেষ পর্যন্ত সর্বোচ্চ আদালতে টিকল না। বাগেরহাটের একটি আসন কমিয়ে গাজীপুরে যুক্ত করার যে সিদ্ধান্ত ইসি নিয়েছিল, তা চূড়ান্তভাবে বাতিল হয়েছে। আপিল বিভাগ আজ বুধবার (১০ ডিসেম্বর) হাইকোর্টের রায়ই বহাল রেখেছেন। এর ফলে বাগেরহাটের সংসদীয় আসন সংখ্যা চার এবং গাজীপুরের আসন সংখ্যা পাঁচে অপরিবর্তিত থাকল।
বুধবার (১০ ডিসেম্বর) প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ এই রায় দেন।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ইসি বাগেরহাটের চারটি আসন থেকে একটি কমিয়ে তিনটিতে নামিয়ে আনে এবং ওই কর্তনকৃত আসনটি গাজীপুরে যুক্ত করে সেখানে পাঁচটি থেকে বাড়িয়ে ছয়টি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ইসির এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট গত ১০ নভেম্বর যে রায় দিয়েছিলেন, আজ আপিল বিভাগ তা বহাল রাখলেন।
আজ আদালতে নির্বাচন কমিশনের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান। অন্যদিকে রিট আবেদনকারীদের পক্ষে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শেখ মোহাম্মদ জাকির হোসেন। গাজীপুর-৬ (প্রস্তাবিত) আসন থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী ও রাজনৈতিক নেতাদের পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এম বদরুদ্দোজা বাদল, মুস্তাফিজুর রহমান খান ও মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন।
আপিল বিভাগের এই রায়ের ফলে এখন নির্বাচন কমিশনকে বাগেরহাট ও গাজীপুরের সীমানা নিয়ে আগের অবস্থানে ফিরে যেতে হবে।
হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী, ২০২২ সালের জনশুমারি নয় বরং ১৯৭২ সাল থেকে চলে আসা কাঠামোর আলোকে বাগেরহাটের চারটি এবং গাজীপুরের পাঁচটি আসন পুনর্বহাল করে গেজেট প্রকাশ করতে হবে।
নির্বাচন কমিশন গত ৪ সেপ্টেম্বর যে চূড়ান্ত গেজেট প্রকাশ করেছিল, তাতে বাগেরহাট-৪ আসনটি বিলুপ্ত করে গাজীপুর-৬ নামে নতুন আসন সৃষ্টি করা হয়। এই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে বাগেরহাট প্রেস ক্লাব, জেলা বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, আইনজীবী সমিতিসহ বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তি রিট করেন।
রিটকারীদের মূল যুক্তি ছিল, সীমানা পুনর্নির্ধারণ আইনে প্রশাসনিক অখণ্ডতা ও যাতায়াত সুবিধাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ইসি কলমের খোঁচায় বাগেরহাটের মতো একটি উপকূলীয় ও নদীবহুল জেলার আসন কমিয়ে দেয়, যা অযৌক্তিক। হাইকোর্ট এই যুক্তি আমলে নিয়ে ইসির গেজেটের ওই অংশটিকে ‘অবৈধ’ ও ‘আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত’ ঘোষণা করেন।
ইসির এই সিদ্ধান্তের পক্ষে গাজীপুরের বিএনপি ও জামায়াতের স্থানীয় নেতারা (যারা নতুন আসনে প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন) আইনি লড়াইয়ে নেমেছিলেন। গাজীপুর-৬ আসন থেকে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী সরকার জাবেদ আহমেদ এবং জামায়াতের সম্ভাব্য প্রার্থী হাফিজুর রহমান পৃথক লিভ টু আপিল করেন। তবে বাগেরহাটের সর্বদলীয় মোর্চার আইনি যুক্তির কাছে ইসির প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত ও গাজীপুরের নেতাদের আকাঙ্ক্ষা ধোপে টেকেনি।
ইসির প্রাথমিক প্রস্তাবের (৩০ জুলাই) পর থেকেই বাগেরহাটে তুমুল আন্দোলন গড়ে ওঠে। দলমত নির্বিশেষে সর্বদলীয় সম্মিলিত কমিটি গঠন করে হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি পালন করা হয়।
আইনজ্ঞদের মতে, এই রায় ইসির জন্য একটি বড় বার্তা। নির্বাচন কমিশন চাইলেই যান্ত্রিকভাবে সীমানা পরিবর্তন করতে পারে না। সীমানা নির্ধারণে স্থানীয় ইতিহাস ও ভৌগোলিক বাস্তবতা যে সংখ্যার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তা এই রায়ে স্পষ্ট হলো।
হাইকোর্টের রায়ে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গেজেট প্রকাশের নির্দেশনা ছিল। আপিল বিভাগ সেই রায় বহাল রাখায় এখন ইসির সামনে কোনো বিকল্প নেই। তাদের অবিলম্বে বাগেরহাট-১ (চিতলমারী-মোল্লাহাট-ফকিরহাট), বাগেরহাট-২ (সদর-কচুয়া), বাগেরহাট-৩ (রামপাল-মোংলা) এবং বাগেরহাট-৪ (মোরেলগঞ্জ-শরণখোলা) এবং গাজীপুরের পূর্ববর্তী পাঁচটি আসন পুনর্বহাল করে নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করতে হবে।
আজকের রায়ের মধ্য দিয়ে আগামী নির্বাচনে বাগেরহাটের ভোটাররা তাদের পুরোনো চারটি আসনেই ভোট দেওয়ার সুযোগ পাবেন, যা তাদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল।