leadT1ad

জীবনের ভার বইতে থাকা এক কৃষকের শেষ দৌড়

অলৌকিকভাবে বেঁচেও হয়নি শেষ রক্ষা, হৃদয় কাঁপানো ভিডিও ভাইরাল

স্ট্রিম সংবাদদাতা
স্ট্রিম সংবাদদাতা
গাজীপুর

প্রকাশ : ০৩ নভেম্বর ২০২৫, ১৬: ৫২
শ্রীপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রোববার রাতে চিকিৎসা নেন জালাল উদ্দীন। স্ট্রিম ছবি

গাজীপুরের শ্রীপুর রেলওয়ে স্টেশনে গত রবিবার (২ নভেম্বর) রাত পৌনে ৯টার সেই দৃশ্যটি এখন কেবল একটি দুর্ঘটনা নয়, এটি জীবনের অনিবার্য সংগ্রামের এক মর্মান্তিক দলিল। দিন শেষে সামান্য রোজগারের আশায় ঘরে ফেরার যে তাড়া ছিল কৃষক জালাল উদ্দীনের, সেই তাড়া-ই কেড়ে নিল তাঁর জীবন।

এগিয়ে আসছিল কমিউটার ট্রেনটি। চাদর মোড়ানো জালাল উদ্দীন (৪৫) সেই দিকেই ছুটে যান ট্রেনে উঠবেন বলে। ছিল বাড়ি ফেরার তাড়া। তিনি হয়তো জানতেন না, এই দৌড় তাঁর জীবনের শেষ দৌড় হতে চলেছে। সামনে থেকে চলন্ত ট্রেনে উঠতে গিয়ে পা পিছলে নিমেষেই চলে যান ট্রেনের নিচে। এরপর তাঁর ওপর দিয়ে দেড় মিনিট ধরে চলে যায় পুরো ট্রেন।

দেড় মিনিটের বিভীষিকা

পাশের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো মানুষজন এবং ট্রেনের ভেতরের যাত্রীরা স্তব্ধ হয়ে সেই দৃশ্য দেখতে থাকেন। ভিডিওতে দেখা যায়, ট্রেনের চাকা যখন ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন জানালা দিয়ে মুখ বাড়ানো প্রত্যেকটি যাত্রীর চোখে ছিল গভীর আফসোস। তারা চোখের সামনে একটি অসহায় জীবনের করুণ পরিণতি দেখছেন। ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর আরও বহু মানুষের হৃদয় কাঁপিয়ে দেয় এই দেড় মিনিটের সেই বিভীষিকা।

ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের নিধিরচর গ্রামের কৃষক মো. তৈয়ব উদ্দিনের ছেলে জালাল উদ্দীন পেশায় ছিলেন কৃষক। প্রতিদিন শ্রীপুর বাজারে শাকসবজি বিক্রি করে রাতে বাড়ি ফিরতেন। তাঁর গ্রামের বাড়ি থেকে শ্রীপুর বাজারের দূরত্ব কম নয়। জীবনধারণের অভাবের তাড়নায় প্রতিদিন এই যাতায়াতই ছিল তাঁর নিয়তি। রাতের ট্রেন ধরার এই তাড়া তাঁর জীবনের অনিবার্য রুটিন।

অলৌকিকতা স্থায়ী হলো না

পুরো ট্রেন তার ওপর দিয়ে গেলেও প্রায় অলৌকিকভাবে বেঁচে যান তিনি। স্থানীয় দোকানি মনির হোসেনের ভাষ্য, ‘স্টেশনে দুটি ট্রেন একই সঙ্গে ছাড়ছিল। জালাল উদ্দীন হঠাৎ করে এক নাম্বার লাইনে দৌড়ালেন, পা পিছলে চোখের পলকে চলে গেলেন ট্রেনের নিচে। ট্রেনটি তাঁর উপর দিয়ে চলে যাওয়ার পরও তিনি প্রায় অলৌকিকভাবে বেঁচে যান।’

পুরো ট্রেন ওপর দিয়ে গেলেও প্রায় অলৌকিকভাবে বেঁচে যান জালাল উদ্দীন। সংগৃহীত ছবি
পুরো ট্রেন ওপর দিয়ে গেলেও প্রায় অলৌকিকভাবে বেঁচে যান জালাল উদ্দীন। সংগৃহীত ছবি

ট্রেন চলে যাওয়ার পর স্থানীয় লোকজন তাঁকে উদ্ধার করে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে মৃত্যু হয় তাঁর।

গুরুতর আহত অবস্থায় শ্রীপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জালাল উদ্দীন স্বাভাবিকভাবেই নিজের নাম-ঠিকানা বলতে পারছিলেন। তিনি জানান, মোহনগঞ্জগামী ব্রহ্মপুত্র এক্সপ্রেস ট্রেন মনে করে তিনি ভুল করে এক নম্বর লাইনে থাকা দেওয়ানগঞ্জ কমিউটার ট্রেনে উঠতে দৌড় দিয়েছিলেন। ক্লান্তি ও তাড়াহুড়োয় তাঁর সেই ভুলটিই এমন করুণ পরিণতি ডেকে আনে।

শেষ রক্ষা হয়নি

জালাল উদ্দীনকে দ্রুত শ্রীপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হলেও তাঁর অবস্থা বিবেচনা করে চিকিৎসকরা ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দেন।

শ্রীপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক জান্নাতুল ফেরদৌস নিশ্চিত করেন, ‘তাঁর অবস্থা খুবই সংকটাপন্ন ছিল। আমরা প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তাঁকে ময়মনসিংহ মেডিকেলে পাঠাই।’

কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে, অলৌকিকভাবে বেঁচে থাকার সেই স্বস্তি স্থায়ী হলো না। ইউপি সদস্য শহিদুল ইসলাম দুলু নিশ্চিত করেন, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথেই তাঁর মৃত্যু হয়।

৩ নভেম্বর সোমবার বেলা ১১টায় জানাজা নামাজ শেষে নিজ গ্রামে এই কৃষককে দাফন করা হয়। কৃষক জালালের মৃত্যুতে তাঁর পরিবারে নিশ্চিতভাবেই সংকট ডেকে আনবে। যে সামান্য রোজগারের আশায় তিনি প্রতিদিন শ্রীপুর আসতেন, সেই রোজগারের পথটাই চিরতরে বন্ধ হয়ে গেল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়ানো দেড় মিনিটের সেই ভিডিওটি হয়তো মুছে যাবে। কিন্তু জীবনের ভার বইতে থাকা এক সাধারণ মানুষের করুণ পরিণতির এই নীরব স্বীকারোক্তিটি অনেকের হৃদয়ে একটি গভীর ক্ষত রেখে গেল।

Ad 300x250

সম্পর্কিত