ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে। অনেক প্রতিবন্ধী ভোটারের মতোই বহুদিন পর আবার ভোট দিতে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন ঢাকা জেলার সাভার উপজেলার আমিনবাজারের ধোবারই গ্রামের বাসিন্দা শাহ আলম। প্রতিবন্ধী হওয়ার কারণে ২০০১ সালের পর আর কোনো নির্বাচনে ভোট দিতে পারেননি তিনি।
এই গ্রামের সরু কাঁচা রাস্তা এখন পাকা হয়েছে। ফলে এবার তাঁকে ভোটকেন্দ্রে নেওয়া আগের চেয়ে সহজ হবে। তবে তাঁর সবচেয়ে বড় চিন্তা—যদি ভোটকেন্দ্রে দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, তাহলে তাঁকে নিয়ে যাওয়া ব্যক্তি আগের মতোই বিরক্ত হয়ে মাঝপথে ফেলে চলে যেতে পারেন।
শাহ আলম বলেন, ‘গত দুই নির্বাচনে তো সাধারণ মানুষই ভোট দিতে পারেনি, প্রতিবন্ধীদের কথা কেউ ভাববে—এটা যেন কল্পনাই করা যায় না। ২০০৮ সালের নির্বাচনে ভোট দিতে না পেরে খুব কষ্ট পেয়েছিলাম।’
শাহ আলম আরও বলেন, ‘আমি তো পঙ্গু মানুষ। হাঁটতে পারি না, তাই অন্যের সাহায্য লাগে। যদি ভোটকেন্দ্রে হুইলচেয়ারের ব্যবস্থা থাকত এবং আমাকে একটু আগে ভোট দিতে দিত, তাহলে সাহস পেতাম। কারও কটু কথা না শুনেই ভোটটা দিতে পারতাম।’
গত কয়েকটি জাতীয় নির্বাচনে এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন (এএইচআরসি), ফ্রিডম হাউস এবং ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন ফর ইলেকটোরাল সিস্টেমস (আইএফইএস)—তাদের পর্যবেক্ষণ রিপোর্টে উল্লেখ করেছে, দেশের অধিকাংশ ভোটকেন্দ্র প্রতিবন্ধীদের জন্য উপযোগী নয়। র্যাম্প নেই, দরজার প্রস্থ কম, ব্রেইল উপকরণ অনুপস্থিত—ফলে হুইলচেয়ারে থাকা কিংবা দৃষ্টিহীন ভোটারদের অংশগ্রহণ প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।
এ অবস্থায় নির্বাচন কমিশন বলছে, যদিও তাদের কাছে প্রতিবন্ধী ভোটারদের স্বতন্ত্র তালিকা নেই, তবুও বিশেষ প্রয়োজনসম্পন্ন ভোটারদের মর্যাদা, স্বাধীনতা এবং গোপনীয়তার সঙ্গে ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে।
নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ ঢাকা স্ট্রিমকে বলেন, ‘আমার জানা মতে আমরা প্রতিবন্ধী ভোটারদের আলাদা তালিকা তৈরি করিনি। তবে তাদের ভোটদানের অধিকার নিশ্চিতে কমিশন অত্যন্ত গুরুত্ব দিচ্ছে।’
আখতার আহমেদ জানান, বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠকের পর সিদ্ধান্ত হয়েছে—প্রতিবন্ধী ভোটাররা ভোটদানের সময় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাবেন, তাদের লাইনে দাঁড়াতে হবে না।
২০০৭ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকারবিষয়ক কনভেনশন অনুমোদন করে এবং ২০১৩ সালে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার ও সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করে। উভয় আইনি কাঠামোই মর্যাদা ও স্বাধীনতার সঙ্গে ভোট দেওয়ার অধিকার নিশ্চিত করে।
বাংলাদেশে নিবন্ধিত প্রতিবন্ধী ভোটারের সংখ্যা ৩০ লাখের বেশি। তবে ধারণা করা হয়, সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনে তাদের মাত্র ১০ শতাংশ ভোট দিতে সক্ষম হয়েছিলেন।
গত ৬ নভেম্বর নির্বাচন ভবনে আয়োজিত এক সংলাপে ইসি, জাতিসংঘ, সাইটসেভার্সসহ বিভিন্ন প্রতিবন্ধী সংগঠনের প্রতিনিধি অংশ নেন।
সেই সংলাপে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) নাসির উদ্দিন বলেন, ‘আমরা চাই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা সমাজের মূলধারায় সম্পূর্ণভাবে যুক্ত হোক। তারা যে সুপারিশ দিয়েছেন, আমরা তার সঙ্গে একমত। ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের আগে সব বাস্তবায়ন না হলেও জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া হবে। ভোটকেন্দ্রগুলো যতটা সম্ভব প্রতিবন্ধীবান্ধব করা হবে এবং দীর্ঘমেয়াদে আরও উন্নয়ন করা হবে—তাদের সঙ্গে পরামর্শ করেই।’
ইসি জানিয়েছে, এই লক্ষ্যে ইউনাইটেড নেশনস ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (ইউএনডিপি) কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে।
নির্বাচন কমিশনের একাধিক কর্মকর্তা জানান, দেশে ঠিক কতজন প্রতিবন্ধী ভোটার আছেন তা নিশ্চিত তথ্য নেই। ধারণা ৩০ লাখ থেকে ৫০ লাখ। এই বিশাল ভোটারগোষ্ঠীর ভোটাধিকার নিশ্চিত করতেই এবার বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রবাসী ভোটারদের মতোই প্রতিবন্ধী ভোটারদের অংশগ্রহণও অগ্রাধিকার পেয়েছে।
নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাউসদ বলেন, ‘ভোটকেন্দ্রে প্রবেশগম্যতা কম থাকায় আমরা ভেবেছিলাম পরিবার থেকে অনুমতি-সাপেক্ষে বাবা, মা, স্ত্রী, ছেলে বা মেয়ের সাহায্যে ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা রাখব। তবে যেহেতু প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা নিজেরাই পছন্দমতো সহায়তা নিতে চান, তাই সেই স্বাধীনতা আমরা বজায় রেখেছি।’
আব্দুর রহমানেল মাউসদ আরও জানান, প্রিজাইডিং অফিসারদের প্রশিক্ষণে স্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হবে—প্রতিবন্ধী ভোটারদের লাইনে দাঁড়াতে হবে না। তাঁরা এলেই সরাসরি ভোট দিতে পারবেন। একাধিক প্রতিবন্ধী ভোটার এলে শারীরিকভাবে দুর্বল ও অসুস্থদের আগে সুযোগ দেওয়া হবে। প্রবীণদেরও একই অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।