leadT1ad

আদিবাসীরা এখনো অস্তিত্বের লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে: সন্তু লারমা

স্ট্রিম প্রতিবেদকঢাকা
প্রকাশ : ০৯ আগস্ট ২০২৫, ১৭: ৪২
আপডেট : ০৯ আগস্ট ২০২৫, ১৯: ১৪
আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস পালিত হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। স্ট্রিম ছবি

আদিবাসীদের ভবিষ্যৎ এখনো অনিশ্চয়তা ও শঙ্কায় ভরা। পাহাড় ও সমতলের বেশিরভাগ আদিবাসী এখনো নিপীড়নের মুখে অস্তিত্বের লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। ছাত্র-জনতার নেতৃত্বে ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তার সংস্কার কার্যক্রমে আদিবাসীদের কার্যকর কোনো সংগঠন বা নেতৃত্বের সঙ্গে সংলাপের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেনি।

শনিবার (৯ আগস্ট) কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসের এক সভায় বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমার (সন্তু লারমা) লিখিত বক্তব্যে এ মন্তব্য করা হয়। অসুস্থতার কারণে তিনি সভায় উপস্থিত থাকতে পারেননি।

ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার শনিবার সকাল থেকে রঙিন হয়ে উঠেছিল পাহাড় ও সমতলের নানা সম্প্রদায়ের মানুষের উপস্থিতিতে। ঐতিহ্যবাহী পোশাক, হাতে নিজস্ব বাদ্যযন্ত্র, গলায় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীকী মালা। সব মিলিয়ে যেন ঢাকার বুকে উঠে এসেছিল এক ক্ষুদ্র বাংলাদেশ, যেখানে ভাষা, সংস্কৃতি ও অধিকার মিলেমিশে দাঁড়িয়েছে এক মঞ্চে।

আজ ৯ আগস্ট রাষ্ট্রীয়ভাবে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উদ্‌যাপিত হয়। সাংবিধানিক স্বীকৃতি এবং আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারসহ সাত দফা দাবিতে এই সমাবেশ করেছে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম।

এদিন ‘আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও ভবিষ্যৎ গঠনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সার্থক প্রয়োগ’ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম আয়োজন করে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস–২০২৫-এর প্রধান কর্মসূচি। সকাল ১০টায় জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয় অনুষ্ঠান। উদ্বোধনী বক্তব্য দেন ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সমাজকল্যাণ এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ।

অস্তিত্ব আজও হুমকির মুখে: সন্তু লারমা

সন্তু লারমার লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানের পর, অন্তর্বর্তী সরকারের নানা সংস্কার কার্যক্রমে আদিবাসীদের কোনো কার্যকর সংলাপ বা অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়নি। পাহাড় ও সমতলের অধিকাংশ আদিবাসী এখনো ভূমি হারিয়ে, দেশান্তরী হয়ে কিংবা নিত্য নিপীড়নের মুখে অস্তিত্বের লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।

সন্তু লারমা। ফাইল ছবি
সন্তু লারমা। ফাইল ছবি

ওই লিখিত বক্তব্যে আরও বলা হয়, ‘১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর যে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছিল, তা ২৮ বছরেও বাস্তবায়ন করেনি রাষ্ট্র। পাহাড়ে বিদ্যমান সমস্যাগুলো নতুন নতুন রূপে দেখা দিচ্ছে। সমতলের পরিস্থিতি আরও নাজুক। ভূমি থেকে উচ্ছেদ, নারী নিপীড়ন, বৈষম্য, বিচারহীনতা এসবের মধ্য দিয়ে প্রান্তিক থেকে আরও প্রান্তিক হয়ে যাচ্ছেন আদিবাসীরা।'

সন্তু লারমার বক্তব্যে তিনি আদিবাসী অধিকার আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য প্রগতিশীল নাগরিক সমাজ, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী ও রাজনৈতিক নেতাদের আহ্বান জানান।

মানবাধিকার কর্মী ও রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্য

অনুষ্ঠানে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী সারা হোসেন বলেন, মাইকেল চাকমার গুম হওয়ার পর ফিরে আসা, কল্পনা চাকমা, আলফ্রেড সরেন, পীরেন স্নালের হত্যার বিচারের দাবিতে এখনই সোচ্চার হতে হবে।

সারা হোসেন প্রশ্ন তোলেন, পাহাড়ে অধিকার আন্দোলনে সক্রিয় থাকার কারণে যাঁরা বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন, তাঁরা কেন এখনো ফিরতে পারছেন না? বম সম্প্রদায়ের অনেকে এখনো বাড়িছাড়া হয়ে আছেন, অথচ ন্যূনতম আইনি সহায়তাও তারা পাচ্ছেন না।

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম জানান, অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরেও আদিবাসীদের জন্য ইতিবাচক কোনো পরিবর্তন আসেনি।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘জুলাই অভ্যুত্থানের সময় দেয়ালচিত্রে আদিবাসী অধিকারের কথা উঠে এসেছিল। কিন্তু এক বছর পরও পাহাড়ে দখল, রাখাইনে করিডর দেওয়ার নামে অস্থিতিশীলতা সবই চলছে। সংস্কার কমিশন হয়েছে, কিন্তু আদিবাসীদের জন্য হয়নি। তাই লড়াই ছাড়া পথ নাই।’

বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজল দেবনাথ বলেন, ‘পাতা ছেঁড়া নিষেধ’ নামে গ্রাফিতি পাঠ্যবইয়ে ছাপানো হয়েছিল। যেখানে লেখা ছিল, ‘হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, আদিবাসী, বাঙালি—সবাই এক’। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সরকার নিজেই সেই পাতাটি ছিঁড়ে ফেলেছে।

আদিবাসী দিবসের বিভিন্ন স্লোগান। স্ট্রিম ছবি
আদিবাসী দিবসের বিভিন্ন স্লোগান। স্ট্রিম ছবি

বাসদের সহসাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় স্লোগান ছিল ‘পাহাড় কিংবা সমতলে, লড়াই চলবে সমানতালে’। কিন্তু রাষ্ট্র কোনো ভূমিকা নেয়নি।

নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী ও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের যুগ্ম সমন্বয়কারী জাকির হোসেন বলেন, ‘সরকার ক্ষমতায় আসার পেছনে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন থাকলেও, সরকারের কাজে সেই বৈষম্যবিরোধী অবস্থান দেখা যায়নি।’

সাত দফা দাবি

সমাবেশ থেকে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম সাতটি দাবি উত্থাপন করে—

১. আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারসহ সাংবিধানিক স্বীকৃতি।

২. পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন ও সময়সূচিভিত্তিক রোডম্যাপ ঘোষণা।

৩. সমতল অঞ্চলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক মন্ত্রণালয় ও ভূমি কমিশন গঠন।

৪. আদিবাসীদের সম্পর্কে বিকৃত বা মিথ্যা তথ্য প্রচারকারী গণমাধ্যম ও প্রতিষ্ঠান বন্ধ।

৫. আদিবাসীদের ওপর নিপীড়ন–নির্যাতন বন্ধ ও সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার।

৬. জাতিসংঘের ‘আদিবাসী বিষয়ক ঘোষণাপত্র’ (২০০৭) ও আইএলও ১৬৯ কনভেনশন অনুসমর্থন এবং আইএলও ১০৭ বাস্তবায়ন।

৭. রাষ্ট্রীয়ভাবে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উদ্‌যাপন।

Ad 300x250

সম্পর্কিত