leadT1ad

গণভোট, নোট অব ডিসেন্টের পর বিতর্কে নতুন সংযোজন ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ’

মো কামরুল হাসান
মো কামরুল হাসান

স্ট্রিম গ্রাফিক

জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায় হিসেবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের নতুন প্রস্তাবিত ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ’ নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন বিতর্ক। প্রস্তাবিত এই পরিষদ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিএনপি, বামপন্থী ও ইসলামিক রাজনৈতিক দলগুলো।

চলতি অক্টোবরে ঐকমত্য কমিশনে অংশ নেওয়া ২৬টি রাজনৈতিক দল জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেছে। তবে গণভোট, নোট অব ডিসেন্ট, নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নিয়ে বিতর্কের মাঝেই সংবিধান সংস্কার পরিষদের প্রস্তাবকে “নতুন রাজনৈতিক শঙ্কার উৎস” হিসেবে দেখছেন অনেকেই।

সংবিধান সংস্কার পরিষদ কী ও কীভাবে কাজ করবে

মঙ্গলবার (২৮ অক্টোবর) রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জুলাই জাতীয় সনদের বাস্তবায়নের উপায় সম্পর্কিত সুপারিশ প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে তুলে দেয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।

কমিশনের খসড়া অনুযায়ী, গণভোটে উপস্থাপিত প্রশ্নে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট ‘হ্যাঁ’ হলে আসন্ন জাতীয় সংসদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়েই গঠিত হবে সংবিধান সংস্কার পরিষদ। অর্থাৎ, সংসদের ৩০০ সাধারণ ও ৫০ সংরক্ষিত আসনের মোট ৩৫০ জন জনপ্রতিনিধিই পরিষদের সদস্য হবেন।

সংসদ নির্বাচনের ফল ঘোষণার জাতীয় সংসদের প্রচলিত নিয়মানুযায়ী ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে পরিষদের প্রথম অধিবেশন আহ্বান করা হবে এবং ন্যূনতম ৬০ সদস্যের উপস্থিতিতে এর কার্যক্রম চলবে। কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নিয়মিত কার্যক্রমের পাশাপাশি সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসেবেও কাজ করবে।

এই পরিষদের মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়েছে ২৭০ দিন (নয় মাস)। এর মধ্যে পরিষদ যদি গণভোটে অনুমোদিত প্রস্তাবগুলো সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে ব্যর্থ হয়, তবে সেগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানের অংশ হয়ে যাবে।

কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ জানিয়েছেন, ২৭০ দিনের মধ্যে উচ্চকক্ষ গঠন সম্ভব না হলে অতিরিক্ত আরও ৪৫ কার্যদিবস সময় পাবে সংসদ।

‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ চাপিয়ে দেওয়া যাবে না’

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে এ বিষয়ে কোনো আলোচনা বা ঐকমত্য ছাড়াই এই প্রস্তাব সংযোজনের সমালোচনা করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, “সংবিধান সংস্কার পরিষদ’ নামে একটি নতুন ধারণা যুক্ত করা হয়েছে, যা আগে কমিশনের আলোচনায় ছিল না এবং এ নিয়ে কোনো ঐকমত্যও হয়নি।”

“নতুন সংসদকে সংবিধান সংস্কার কমিশনের ভূমিকা চাপিয়ে দেওয়া যায় না,” বলে মন্তব্য করেন তিনি।

বিএনপির মতে, নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্ব কেবল জাতীয় সংসদ ও রাষ্ট্রপতি নির্বাচন আয়োজন করা। বিএনপি যে গণভোটের প্রস্তাব দিয়েছে, তার মাধ্যমে জনগণ যদি জুলাই জাতীয় সনদে সম্মতি দেয়, সেটিই জনগণের সার্বভৌম সিদ্ধান্ত হিসেবে গণ্য হবে। সে ক্ষেত্রে জাতীয় সংসদ ও সংসদ সদস্যরা সনদ বাস্তবায়নে বাধ্য থাকবেন — যেভাবে জুলাই জাতীয় সনদে ঐকমত্যে পৌঁছানো হয়েছিল।

সালাহউদ্দিন আহমদ আরও বলেন, “২৭০ দিনের মধ্যে সংস্কার বাস্তবায়ন না হলে সেটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে যুক্ত হবে— এটা হাস্যকর। এসব প্রস্তাব কীভাবে সুপারিশে এলো, বোঝা যাচ্ছে না। তারা জাতীয় ঐকমত্য নয়, বরং জাতীয় অনৈক্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে।”

বাসদ (মার্ক্সবাদী) সমন্বয়ক মাসুদ রানা বলেন, সংবিধান সংস্কার পরিষদ নতুন বিতর্ক সৃষ্টি করতে পারে। “এটি ঐক্যের চেষ্টাকে ভেস্তে দিতে পারে,” বলেন তিনি।

তার মতে, পরিষদের মেয়াদ শেষে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে যুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়াটি রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়াবে। “সংবিধান বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতা জোরদার করার বদলে এই বিকল্প পথ নতুন সংকট তৈরি করবে,” মন্তব্য করেন তিনি।

এই ব্যবস্থাকে অবাস্তব উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এই স্বয়ংক্রিয় অন্তর্ভুক্তির প্রক্রিয়া সম্পন্ন করবে কে, সেটা আদেশে উল্লেখই করা হয়নি।”

একই বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশও। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব অধ্যক্ষ হাফেজ মাওলানা ইউনুস আহমেদ বলেন, “সমঝোতার স্বার্থে আদেশকে সাংবিধানিক আদেশের মর্যাদা থেকে নামিয়ে আনুষ্ঠানিক আদেশ করা হয়েছে, যা জুলাই ঘোষণাপত্রের মতোই অকার্যকর কাগুজে নথিতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি করছে।”

তিনি বলেন, “ধারা ‘ঙ’-তে বলা হয়েছে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পরিষদ তার কাজ শেষ করতে না পারলে সংবিধান সংস্কার বিল আইন রূপে কার্যকর হবে। কিন্তু কে কার্যকর করবে, সে বিষয়ে কোনো নির্দেশনা নেই।”

তাঁর মতে, সরকার পরিষদের সভাপ্রধান নিয়োগের মাধ্যমে একচ্ছত্র কর্তৃত্ব স্থাপন করতে পারবে। “উপ-সভাপ্রধান অবশ্যই বিরোধী দল থেকে নেওয়া উচিত,” বলেন তিনি।

গণভোট নিয়েও বিতর্ক

ঐক্যমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ সংবাদ সম্মেলনে জানান, নির্বাচনের দিন বা তার আগের যেকোনো দিন সরকার গণভোট আয়োজন করতে পারে।

তবে ইসলামী আন্দোলনের মতে, “গণভোট অবশ্যই জাতীয় নির্বাচনের আগে হওয়া উচিত।”

তাদের অভিযোগ, খসড়ায় বলা হয়েছে, পরিষদ গণভোটে অনুমোদিত প্রস্তাব ‘বিবেচনা করবে’। এতে গণভোটের সিদ্ধান্তকে বাধ্যতামূলক অবস্থান থেকে নামিয়ে “বিবেচনাযোগ্য” করে ফেলা হয়েছে, যা জুলাই সনদের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করছে।

বাসদ (মার্ক্সবাদী) নেতা মাসুদ রানা বলেন, “গণভোট নির্বাচনের দিনেই হওয়া উচিত। না হলে সংস্কার বাস্তবায়নের আশাও নস্যাৎ হয়ে যাবে। যেসব দলের নোট অব ডিসেন্ট আছে, তারা গণভোটের বিপক্ষে কাজ করবে। উদাহরণস্বরূপ, বিএনপির মতো বিপুল জনসমর্থিত দল যদি বিপক্ষে অবস্থান নেয়, গণভোটসহ পুরো প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হবে।”

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, “গণভোট ও নির্বাচন একই দিনে, দুই ব্যালটে অনুষ্ঠিত হবে— এটাই বিএনপির অবস্থান। এর বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।”

তিনি আরও যোগ করেন, “যারা অন্য সুপারিশ করছে সেটা তাদের ব্যাপার, বিএনপির নয়। আমাদের অবস্থান অপরিবর্তিত থাকবে।”

নোট অব ডিসেন্ট: ঐকমত্যের ফাঁক উন্মোচন

ঐকমত্য কমিশনের সংবাদ সম্মেলনে অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানান, “কমিশন যে বিষয়গুলো সংযুক্ত করে আদেশ দিতে বলছে, সেগুলোর ব্যাপারে কিছু দলের নোট অব ডিসেন্ট আছে। তবে আমরা বলছি—জনগণের সম্মতি নিন; যদি জনগণ সম্মতি দেয়, তাহলে সেটিই গণভোটের মাধ্যমে অনুমোদিত হবে।”

জুলাই সনদের ৮৪টি সুপারিশের মধ্যে ৫৩টিতে বিভিন্ন দল ও জোটের ভিন্নমত রয়েছে। বিএনপি, বামদল ও ইসলামিক দলগুলো এর মধ্যে রয়েছে।

বিএনপির সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, “জুলাই সনদে বিভিন্ন দফায় আমাদের এবং অন্য দলের ভিন্নমত রয়েছে। নোট অব ডিসেন্ট যেসব বিষয়ে দেওয়া হয়েছে, নির্বাচনে ম্যান্ডেট পেলে দলগুলো নিজেদের ইশতেহারে সেটি বাস্তবায়ন করতে পারবে।”

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, “বাম দলগুলোর কিছু নোট অব ডিসেন্ট আছে। সেগুলোও আদেশে আসেনি। এ বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা থাকা উচিত ছিল।”

উচ্চকক্ষ ও আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নিয়েও প্রশ্ন

বিএনপির নেতা সালাহউদ্দিন আহমদ অভিযোগ করেন, “উচ্চকক্ষ গঠনের বিষয়ে কমিশন ভোটের আনুপাতিক হারে আসন বণ্টনের প্রস্তাব দিয়েছে। অথচ ঐকমত্য ছিল ১০০ সদস্যের উচ্চকক্ষ গঠনে, কিন্তু কীভাবে নির্বাচিত হবে তা নির্ধারিত হয়নি। কেউ ভোটের অনুপাতে, কেউ আসনের অনুপাতে চেয়েছিল। কমিশন এখানে নিজেদের প্রস্তাব চাপিয়ে দিয়েছে।”

একই বিষয়ে আমীর খসরু বলেন, “ঐকমত্যের বাইরে গিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। বিএনপি সংসদ নির্বাচনের আগে গণভোট আয়োজনের প্রস্তাবে ঐকমত্য নয়, তাই সেদিকে যাওয়ারও সুযোগ নেই।”

কমিশন কী বলছে

মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিক্রিয়া আমরা এখনো জানি না। তাই কোনো মন্তব্য করা স্পেকুলেশন হবে। আমরা আশা করি, তারা এটিকে ইতিবাচকভাবে নেবে। কারণ আমাদের অনেক সুপারিশে ঐকমত্য আছে।”

তিনি বলেন, সরকারের প্রতি আমাদের পরামর্শ —জুলাই জাতীয় সনদে যে অঙ্গীকার করা হয়েছে, তার ভিত্তিতেই কাজ করতে হবে। আমরা চাই, এই প্রক্রিয়া জাতীয় ঐক্যকে দৃঢ় করুক, বিভাজন নয়।

রয়েছে আরও প্রশ্ন

পার্লামেন্ট বিশেষজ্ঞ এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুলতান মাহমুদ রানা বলেন, একটি দেশের জন্য সংসদ সর্বোচ্চ সার্বভৌম কর্তৃপক্ষ। তাদের ওপরে অন্য কোনো বডি কোনো কিছু চাপিয়ে দিতে পারে কিনা—সে বিষয়ে প্রশ্ন আছে। আবার মেয়াদের ভেতর সংবিধান সংস্কার না হলে, তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে সংযুক্ত হবে এমন রেফারেন্সও খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা—সে বিষয়ে আমি সন্দিহান। তবে সংবিধান বিশেষজ্ঞরা এ বিষয়ে ভালো বলতে পারবেন।

আমাদের যখন প্রচলিত ফর্মুলা আছে সেটা আগে দেখে নেওয়া দরকার ছিলো। প্রচলিত ফর্মুলা বলতে গণভোট বা অধ্যাদেশ পাসের মাধ্যমে সংসদ দ্বারা যেভাবে প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়।

যদি সংবিধান চালু রেখে সংবিধান সংস্কার করতেই হয়, সেক্ষেত্রে তো দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থন নিয়েই করতে হবে। তাহলে পার্লামেন্টের ওপর অন্যকেউ কীভাবে কোনো কিছু চাপিয়ে দিতে পারে? বরং সংসদ তার সদস্যদের মাধ্যমে সংবিধান সংস্কারের কাজ কীভাবে সম্পন্ন হবে তা ঠিক করবে। যাকে আমরা বলছি ‘পার্লামেন্ট লেজিসলিয়েশন’ বা ‘সংসদীয় আইন’।

Ad 300x250

সম্পর্কিত