leadT1ad

শঙ্কায় পাহাড়িয়ারা, পাশে অনেকে

মানববন্ধনে এক পাহাড়িয়া নারী বলেন, ‘আমাদের দাবি আমরা এখানেই থাকতে চাই। এই জায়গা আমরা ছাড়তে চাই না।’

স্ট্রিম প্রতিবেদকরাজশাহী
প্রকাশ : ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০২: ০৪
পাহাড়িয়াদের পাশে দাঁড়িয়েছেন অনেকেই। স্ট্রিম ছবি

রাজশাহী নগরীর মোল্লাপাড়ায় ‘মালপাহাড়িয়া’ সম্প্রদায়ের পরিবারগুলো তাদের ৫৩ বছরের পুরনো বসতবাড়িতেই থাকতে চায়। এ নিয়ে এখনও শঙ্কার মধ্যে আছে তারা। এ অবস্থায় তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন অনেকে। খোঁজ নিয়েছেন খোদ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও। তিনি দলের স্থানীয় নেতাদের পাহাড়িয়াদের পাশে থাকতে বলেছেন।

এদিকে শুক্রবার (৫ সেপ্টেম্বর) মালপাহাড়িয়াদের মহল্লায় খাসি জবাই করে খাইয়ে-দাইয়ে যখন তাদের ‘বিদায়’ দেওয়ার কথা ছিল। ঠিক সেখানে গিয়ে মানববন্ধন করেছেন রাজশাহীর বিক্ষুব্ধ নাগরিক, মানবাধিকারকর্মী, আদিবাসী সংগঠনের নেতা, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। তারা বলেছেন, এই জমি পাহাড়িয়াদের দিতে হবে, যাতে কেউ আর দখল করতে না পারে।

স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৫৩ বছর আগে রাজশাহী শহরের ১৬ কাঠা জমিতে বাড়ি করার সুযোগ পান মালপাহাড়িয়া জনগোষ্ঠীর ছয়টি পরিবার। তিন প্রজন্ম পরে সেই বাড়ির সংখ্যা বেড়ে হয় ১৬টি। জায়গাটি বর্তমানে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের (রাসিক) ২ নম্বর ওয়ার্ডে অবস্থিত। সম্প্রতি সাজ্জাদ আলী নামের স্থানীয় এক ব্যক্তি দাবি তোলেন, ১৯৯৪ সালে মালপাহাড়িদের জমি কিনেছেন তিনি। এখন দখল নেবেন। এ জন্য ১৬টি পরিবারকে ৩০ লাখ টাকা দিয়েছেনও তিনি। তাঁর চাপে তিনটি পরিবার ইতিমধ্যে মহল্লা ছেড়ে চলে গেছে। রোববার (৭ সেপ্টেম্বর) বাকিদের যেতে হতো। আর আগে জায়গা দখল উপলক্ষে শুক্রবার ওই সব পরিবারের সদস্যদের খাসি জবাই করে খাওয়ানোর কথা ছিল সাজ্জাদ আলী। এ সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশ হলে বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়।

বৃহস্পতিবার পুলিশ গিয়ে জানিয়ে দেয়, কোনো খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন হবে না। পাহাড়িয়ারা তাদের জমিতেই থাকবেন। আর সাজ্জাদ আলীর দলিল যাচাই-বাছাই করা হবে। পাহাড়িয়াদের ১৩টি পরিবারের ১৩ জন ও সাজ্জাদ আলীকে বৃহস্পতিবার বিকেলে কাশিয়াডাঙ্গা জোনের উপপুলিশ কমিশনারের (ডিসি) কার্যালয়ে ডেকেছিল পুলিশ। সেখানে পাহাড়িয়ারা গেলেও অনুপস্থিত ছিলেন সাজ্জাদ আলী। তাঁকে শহরের বড়কুঠি ভূমি অফিসের সহকারী কমিশনার (ভূমি) আরিফ হোসেন ডেকেছিলেন, তাই সেখানে উপস্থিত হতে পারেননি বলে দাবি করেছেন সাজ্জাদ আলী।

পাহাড়িয়াদের মনে ভয়

মালপাহাড়িয়াদের বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদের বিষয়টি জানাজানির পর দেশব্যাপী তোলপাড় শুরু হলেও এখনো ভয়ে আছে পরিবারগুলো। নিজেদের নিরাপত্তা চেয়ে বৃহস্পতিবার রাতে নগরের কাশিয়াডাঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) কাছে আবেদন করেছেন তারা।

এতে বলা হয়েছে, সাজ্জাদ আলী তাঁদের ভয়ভীতি দেখিয়ে বসতবাড়ি থেকে বিতাড়িত করার চেষ্টা করছেন। এতে তারা খুবই ভয়ের মধ্যে জীবনযাপন করছেন। চরমভাবে নিরাপত্তার অভাব বোধ করছেন। এ জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়েছে তাঁরা।

তবে অভিযোগ অস্বীকার করে শুক্রবার দুপুরে সাজ্জাদ আলী বলেন, ‘আমি কোনো ভয় দেখাচ্ছি না। আমি সুন্দরভাবেই বিদায় দিতে চেয়েছিলাম। জমি আমার, আমি এটা ভূমি অফিসকে বলেছি। তারা আমাকে কিছু জানায়নি। তারা কী করছে সেটা আমি কিছু জানি না।’

পাহাড়িয়াদের অধিকারের দাবিতে মানববন্ধন। স্ট্রিম ছবি
পাহাড়িয়াদের অধিকারের দাবিতে মানববন্ধন। স্ট্রিম ছবি

সাজ্জাদের হিসেবেও ঠকানো হয়েছে পাহাড়িয়াদের

সাজ্জাদ আলী দাবি করেছেন, পাহাড়িয়া পরিবারগুলোকে ১৬ কাঠা জমির দাম বাবদ তিনি বিভিন্ন সময় প্রায় ৩০ টাকা দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর হিসেবেও জমির বর্তমান বাজার দরের চেয়ে কম ধরেছেন তিনি।

বোয়ালিয়া থানা ভূমি অফিসের অধীনে পাহাড়িয়াদের জমিগুলো। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় একজন দলিল লেখক জানান, সরকারি হিসেবে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে হড়গ্রাম মৌজায় প্রতি শতাংশ ধানি জমির মূল্য ৩ লাখ ৯০ হাজার ৩০৬ টাকা। একই পরিমাণ জমি ভিটা হলে মূল্য ৫ লাখ ৬০ হাজার ৩৩০ টাকা এবং ভিটায় বাড়ি থাকলে প্রতি শতাংশের মূল্য ৭ লাখ ১৮ হাজার ২৬৫ টাকা ধরা হবে।

সরকারি হিসেবে এই দর হলেও বাস্তবে মোল্লাপাড়ার জমির বাজার মূল্য আরও বেশি। ওই এলাকায় প্রতি শতাংশ বাড়ি শ্রেণির জমি বিক্রি হয় ৪০ লাখ টাকা পর্যন্ত। মোল্লাপাড়ার যে এলাকায় পাহাড়িয়াদের বাড়ি, সেদিকে প্রতি শতাংশ বিক্রি হয় ১৫ থেকে ১৮ লাখ টাকা কাঠা হিসেবে।

হিসেবে অনুযায়ী, ১ কাঠা সমান ১ দশমিক ৬৫ শতাংশ হিসেবে পাহাড়িয়াদের বাড়ির মোট জমির পরিমাণ দাঁড়ায় ২৬ দশমিক ৪ শতাংশ। চলতি বাজার দর অনুযায়ী ১৬ কাঠা জায়গার বর্তমান দাম প্রায় ৪ কোটি টাকা।

পাহাড়িয়াদের পাশে অনেকে

শঙ্কায় থাকা পাহাড়িয়াদের পাশে দাঁড়িয়েছেন অনেকে। শুক্রবার বিকেরে পাহাড়িয়াদের পাড়া পরিদর্শন করেছেন রাজশাহী মহানগর বিএনপি ও ছাত্রদলের প্রায় ৩০ জন নেতা। তাঁরা নেতা জানান, বসতভিটা ছাড়ার বিষয়টি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নজরে এসেছে। তিনি দলের স্থানীয় নেতাদের এ বিষয়ে খোঁজখবর নিতে বলেছেন। পাহাড়িয়াদের যাতে মানবাধিকার লঙ্ঘন না হয়, সেটি নিশ্চিত করতেও স্থানীয় নেতাদের বলেছেন তিনি।

এদিকে পাহাড়িয়াদের পাশে দাঁড়িয়েছে জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টিও (এনসিপি)। দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক কৈলাশ চন্দ্র রবিদাস স্ট্রিমকে জানিয়েছেন, তাঁর দলের প্রধান নাহিদ ইসলামও পাহাড়িয়াদের বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদের বিষয়টি অবগত। তিনিও পাহাড়িয়াদের পাশে থাকার নির্দেশনা দিয়েছেন। এ জন্য জেলা সমন্বয়ক কমিটির যুগ্ম সমন্বয়কারী শামীমা সুলতানা মায়া সার্বক্ষণিক খোঁজ রাখছেন।

পাহাড়িয়াদের আইনি সহায়তা দিতে পাশে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)। সংস্থাটির রাজশাহী ইউনিটের সমন্বয়কারী সামিনা বেগম পাহাড়িয়া পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেছেন। এ ছাড়াও পাশে দাঁড়িয়েছে জাতীয় আদিবাসী পরিষদ, আদিবাসী গবেষণা পরিষদ, সিসিবিভিও, পাহাড়িয়া ছাত্র পরিষদ, বরেন্দ্র ইয়ুথ ফোরাম, জুলাই-৩৬ পরিষদসহ নানা সংগঠন।

পাড়ায় প্রতিবাদী মানববন্ধন

পাহাড়িয়াদের বসতবাড়ি রক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবিতে শুক্রবার সকালে ওই মহল্লায় মানববন্ধন হয়েছে। এতে বক্তব্য দেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. গোলাম সারোয়ার, আদিবাসী গবেষণা পরিষদের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম, বাসদের জেলার সদস্যসচিব শামসুল আবেদীন ডন, এনসিপি নেত্রী শামীমা সুলতানা মায়া, মানবাধিকারকর্মী আরিফ ইথার, জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক সুভাষ চন্দ্র হেমব্রম, দপ্তর সম্পাদক প্রদীপ লাকড়া, পাহাড়িয়া ছাত্র পরিষদের উত্তম সিংহ প্রমুখ।

মানববন্ধনে এক পাহাড়িয়া নারী বলেন, ‘আমাদের দাবি আমরা এখানেই থাকতে চাই। এই জায়গা আমরা ছাড়তে চাই না।’ আরেক তরুণী বলেন, ‘আগে আমরা ভয় পেয়েছিলাম, তাই জায়গা ছেড়ে দিচ্ছিলাম। সংবাদ প্রকাশের পর সবাই এসেছেন। এখন আমরা সাহস পাচ্ছি।’

উচ্ছেদ চেষ্টার প্রতিবাদ জানিয়ে আদিবাসী গবেষণা পরিষদের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম বলেন, ‘এখানে আদিবাসীরা দীর্ঘ ৫৩ বছর ধরে এখানে বাস করছে। একদল ভূমিদস্যু এটা দখল করতে চায়। আমরা মনে করি, এই জমি তাদের, তারা থাকবে। তাদের উচ্ছেদ আমরা মানব না। আমরা দলমত সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে সবাই এসেছি। এই জমি আদিবাসীদের, এখানেই তারা থাকবে।’

পাহাড়িয়াদের জমি কেনার দাবি ও দখল চেষ্টার প্রতিবাদ জানিয়ে মানবাধিকারকর্মী আরিফ ইথার বলেন, ‘এখানে আদিবাসীরা ৫৩ বছর ধরে বাস করছেন। তারা থাকা অবস্থায় ১৯৯৪ সালে এ জমি বিক্রি হয় কি করে? যদি বিক্রি হয়ও তাহলে সাজ্জাদ এত দিন কোথায় ছিলেন? হঠাৎ কেন দখলে নিতে আসতে হচ্ছে? কেন তিনি নিজের জমি নিতে টাকা দেবেন? আবার কাগজ ঠিক থাকলে তিনি কেন পুলিশের ডাকে গেলেন না? এসব প্রশ্নের উত্তর চাই।’

এ ছাড়া মানববন্ধনে অংশ নেন আদিবাসী গবেষক রতন টপ্পো, সিসিবিভিওর প্রতিনিধি বিপ্লব মুর্মু, সাংস্কৃতিক কর্মী সাগর হোসেন, বরেন্দ্র ইয়ুথ ফোরামের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আতিকুর রহমান, রাবি শিক্ষার্থী অনুপম প্রান্ত টুডু, বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সুশান্ত হেমব্রম, এডিশন মিনজ, তৃতীয় লিঙ্গের আবুল হাসনা পলি এবং পাহাড়িয়া জনগোষ্ঠীর নারী-পুরুষ।

এদিকে পাহাড়িয়াদের নিয়ে খবর প্রকাশ করায় ধন্যবাদ জানিয়ে উন্নয়নকর্মী যোসেফ হাঁসদা বলেন, ‘পত্রিকার নিউজের মাধ্যমেই আমরা খবরটা পেয়েছি। এখন আমাদের দাবি- এই মানুষগুলো যেন নির্ভয়ে জীবনযাপন করতে পারে, সেটা যেন প্রশাসন নিশ্চিত করে।’

জানতে চাইলে কাশিয়াডাঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আজিজুল বারী বলেন, ‘নিরাপত্তা চেয়ে পাহাড়িয়ারা আমাদের কাছে আবেদন করেছেন। তাদের নিরাপত্তার আপাতত সংকট নেই। আমরা আছি।’

Ad 300x250

শঙ্কায় পাহাড়িয়ারা, পাশে অনেকে

জুলাই সনদ বাস্তবায়ন বিষয়ে বিএনপি: বিপ্লব নয়, নতুন সাংবিধানিক ব্যবস্থার প্রবর্তন ক্যু হিসেবে গণ্য হবে

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচন কীভাবে হয়, গুরুত্ব কোথায়

জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণপরিষদ গঠনের প্রস্তাব দিল এনসিপি

ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেল: সব নির্যাতন সহ্য করে আমরা শিক্ষার্থীদের পাশে ছিলাম

সম্পর্কিত