ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী শরিফ ওসমান হাদি গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনার পর ‘রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’ ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সম্ভাব্য প্রার্থীদের আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স এবং ব্যক্তিগত গানম্যান নিয়োগ দিতে একটি নীতিমালা করেছে সরকার। নির্বাচনের ফল ঘোষণার তারিখ থেকে পরবর্তী ১৫ দিন পর্যন্ত এই লাইসেন্সের মেয়াদ থাকবে। একজন ব্যক্তি একজনের বেশি গানম্যান রাখতে পারবেন না। সোমবার (১৫ ডিসেম্বর) এক প্রজ্ঞাপনে এমন তথ্য জানিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এর মাধ্যমে রাজনীতিবিদদের নিরাপত্তা পুরোপুরি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না; বরং অস্থিতিশীলতার বিরুদ্ধে জনগণ ও পুলিশকে এক হয়ে কাজ করতে হবে।
নীতিমালায় বলা হয়েছে, জননিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বজায় রাখা ও নির্বাচনকালীন সহিংসতা প্রতিরোধে ‘রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও জাতীয় সংসদ সদস্য পদপ্রার্থীদের অনুকূলে আগ্নেয়াস্ত্র লাইসেন্স ও রিটেইনার নিয়োগ নীতিমালা, ২০২৫’ প্রণয়ন করা হয়েছে।
সরকার যাঁদের ‘রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’ হিসেবে স্বীকৃতি কিংবা অনুমোদন দেবে এবং নির্বাচন কমিশনে বৈধভাবে মনোনয়নপত্র দাখিল ও গৃহীত জাতীয় সংসদ সদস্য পদপ্রার্থীকে এই অনুমোদন দেওয়া হবে।
জেলা ম্যাজিস্ট্রেট অথবা সরকার যাঁদের কর্তৃপক্ষ হিসেবে ক্ষমতা দেবে, তাঁরা হবেন লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষ। রিটেইনার বলতে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বা পদপ্রার্থীর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা রক্ষায় নিয়োজিত ও অনুমোদিত সশস্ত্র ব্যক্তিকে বোঝানো হয়েছে। আগ্নেয়াস্ত্র আইন ১৮৭৮ এবং আগ্নেয়াস্ত্র বিধিমালা ১৯২৪-এর অধীনে এই নীতিমালা করা হয়েছে।
যাঁদের লাইসেন্স দেওয়া হবে
সরকার স্বীকৃত রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হতে হবে এবং ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য মনোনয়নপত্র দাখিল করতে হবে। উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে গোয়েন্দা সংস্থা) যাচাইকৃত নিরাপত্তা ঝুঁকি বিদ্যমান থাকতে হবে। পাশাপাশি শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা এবং অস্ত্র সংরক্ষণের নিরাপদ ব্যবস্থা থাকতে হবে।
এই নীতিমালার অধীনে লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে এ-সংক্রান্তে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জারিকৃত অন্যান্য নীতিমালা ও বিধান প্রযোজ্য হবে। তবে ব্যক্তিগত আয়করসংক্রান্ত শর্ত শিথিলযোগ্য হবে। শুধু আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে সীমিত ক্যালিবারের (এনপিবি) অস্ত্র অনুমোদনযোগ্য হবে; একাধিক অস্ত্রের লাইসেন্স অনুমোদন দেওয়া হবে না। স্বয়ংক্রিয় বা সামরিক অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হবে না।
লাইসেন্সের মেয়াদ
এই নীতিমালার আওতায় অনুমোদিত লাইসেন্সের মেয়াদ নির্বাচনের ফল ঘোষণার তারিখ থেকে পরবর্তী ১৫ দিন পর্যন্ত হবে। এই সময়ের পর লাইসেন্স স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল বলে গণ্য হবে। তবে শর্ত থাকে যে, লাইসেন্স প্রাপ্তির জন্য জারিকৃত নীতিমালার অন্যান্য শর্ত পূরণ হলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই সাময়িক লাইসেন্সকে সাধারণ লাইসেন্সে রূপান্তর করতে পারবে।
লাইসেন্সের মেয়াদ অতিক্রান্ত হলে বা লাইসেন্স বাতিল হওয়ার পরও কোনো লাইসেন্সধারী সেটির বিপরীতে কোনো আগ্নেয়াস্ত্র নিজ দখলে রাখলে তাঁর বিরুদ্ধে প্রচলিত আইন অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
রিটেইনার বা গানম্যান নিয়োগের শর্ত
কেবল প্রকৃত নিরাপত্তা ঝুঁকি থাকলে রিটেইনার বা গানম্যান নিয়োগ অনুমোদনযোগ্য হবে। রাজনৈতিক কার্যক্রমে প্রভাব বিস্তারের উদ্দেশ্যে কিংবা ভয়ভীতি প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে রিটেইনার নিয়োগ বা অনুমোদন দেওয়া যাবে না।
কোনো রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বা পদপ্রার্থী লাইসেন্সপ্রাপ্তির যোগ্য হলে এবং তিনি আগ্নেয়াস্ত্র ক্রয়ে অসমর্থ বা অনিচ্ছুক হলে, বৈধ লাইসেন্সপ্রাপ্ত আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে—এমন, তা পরিচালনায় সক্ষম এবং রিটেইনার হতে ইচ্ছুক কোনো ব্যক্তিকে আগ্নেয়াস্ত্রসহ রিটেইনার হিসেবে নিয়োগ দিতে পারবেন।
রিটেইনারের যোগ্যতা
রিটেইনারকে বাংলাদেশি নাগরিক হতে হবে এবং ন্যূনতম বয়স ২৫ বছর হতে হবে। অপরাধমুক্ত ও পুলিশ ক্লিয়ারেন্স থাকতে হবে। আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হতে হবে (সশস্ত্র বাহিনী বা বাংলাদেশ পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত সদস্যরা অগ্রাধিকার পাবেন)। সরকারি হাসপাতাল থেকে প্রাপ্ত মেডিকেল ফিটনেস সনদ থাকতে হবে।
একজন রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বা পদপ্রার্থীর জন্য সর্বোচ্চ একজন রিটেইনার নিয়োগযোগ্য হবে। নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে রিটেইনারের মেয়াদও সমাপ্ত হবে।
রিটেইনার নিয়োগের পদ্ধতি
রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বা পদপ্রার্থী জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে নির্ধারিত ফরমে আবেদন করবেন। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট দুই কর্মদিবসের মধ্যে প্রাথমিক যাচাই করবেন। পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার নিরাপত্তা যাচাই তিন কর্মদিবসের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে।
সব প্রতিবেদন সন্তোষজনক হলে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট অবিলম্বে রিটেইনার লাইসেন্স অনুমোদন দিতে পারবেন। রিটেইনারের অনুকূলে কোনো আগ্নেয়াস্ত্র লাইসেন্স ইস্যু করা হবে না; রিটেইনার কেবল আগ্নেয়াস্ত্র বহনকারী হবেন। অস্ত্রসংক্রান্ত সব দায় লাইসেন্সধারীর ওপর বর্তাবে।
আচরণবিধি
অস্ত্র বহনকালে সর্বদা লাইসেন্স ও অনুমোদনপত্র সঙ্গে রাখতে হবে। এই অস্ত্র ব্যবহার করে কাউকে ভয়ভীতি প্রদর্শন বা হয়রানি করা যাবে না। নিরাপত্তা ছাড়া অন্য কোনো কাজে বা উদ্দেশ্যে এই লাইসেন্সের আওতাভুক্ত অস্ত্র ব্যবহার করা যাবে না। এই লাইসেন্স ও লাইসেন্সভুক্ত অস্ত্র হস্তান্তরযোগ্য হবে না। প্রতিটি লাইসেন্সধারীর জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্দেশ তাৎক্ষণিকভাবে পালন বাধ্যতামূলক।
তদারকি ও বাতিল
অপব্যবহার, নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন অথবা সরকারের অন্য কোনো বিধি-বিধান লঙ্ঘন করলে কোনো কারণ দর্শানো ছাড়াই লাইসেন্স প্রদানকারী বা অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিকভাবে লাইসেন্স বা রিটেইনার অনুমোদন বাতিল করতে পারবে।
নির্বাচনকালীন বিধান
নির্বাচন কমিশনের আচরণবিধির সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রাখতে হবে। এই নীতিমালা নির্বাচন কমিশন ঘোষিত আচরণবিধির পরিপূরক হবে এবং কোনোভাবেই সেই আচরণবিধির ব্যত্যয়ে ব্যবহৃত হবে না। নির্বাচন কমিশন ঘোষিত আচরণবিধি লঙ্ঘন স্বতন্ত্র অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। লাইসেন্স বা রিটেইনার নিয়োগ বাতিল বা স্থগিতের বিরুদ্ধে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আপিল করা যাবে।
আগে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঠিক করতে হবে
রাজনীতিবিদদের নিরাপত্তায় আইন করার পাশাপাশি দেশের সার্বিক পরিস্থিতিও স্থিতিশীল করতে হবে বলে মনে করেন সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি নাজমুল হক। স্ট্রিমকে তিনি বলেন, ‘সরকার তো ভেবেচিন্তেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভালো হবে মনে করেই করেছে। পুরোপুরি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া এগুলো দিয়ে কোনো কাজ হবে না। আগে আমাদের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঠিক করতে হবে। আইন দিয়ে আসলে কিছু কন্ট্রোল করা কঠিন হয়ে পড়ে।’
গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তি কিংবা সংসদ সদস্যপ্রার্থীদের অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়ার সিদ্ধান্ত কতটা সফলতা আনবে—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি ব্যক্তিগত জীবনে দেখেছি, যাদের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে, প্রয়োজনের সময় তারা সেটা ব্যবহার করতে পারেননি। অনেক সময় তাদের পিস্তলও ছিনতাই করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমার চাকরিজীবনে এমন অভিজ্ঞতা আছে।’
হাদির হত্যাকারীর ভারতে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যর্থতা কি না—এই প্রশ্নে পুলিশের সাবেক এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, আমরা সব অপরাধ দমন করতে পারি না। সব অপরাধীকে ধরতেও পারি না। আন্তরিকতার সঙ্গে চেষ্টা করেও অনেক সময় ব্যর্থ হতে হয়। এটা তেমন একটি ঘটনা হতে পারে। পুলিশ হলেই সবকিছু করতে পারবে—এমন নয়।’
তিনি বলেন, ‘ওই আসামি (হাদির আততায়ী) কারও না কারও আত্মীয়, কারও না কারও পরিচিত। কেউ না কেউ তাকে দেখেছে। তাদের কি কোনো দায়িত্ব নেই তাকে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার? জনগণকে অবশ্যই পুলিশকে সহায়তা করতে হবে।’
তবে হাদির হত্যাচেষ্টাকারীরা পালিয়ে গেছেন কিনা, সেই সম্পর্কে এখনই সবকিছু বলা যাবে না বলে মন্তব্য করেছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। ওসমান হাদির হত্যাচেষ্টাকারীরা দেশে আছে নাকি পালিয়ে গেছে—এমন প্রশ্নের উত্তরে সোমবার (১৫ ডিসেম্বর) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘সবকিছু তো এখানে বলা যাবে না।’
এর আগে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে বলা হয়, সংসদ নির্বাচন ও গণভোট সামনে রেখে পুলিশের পক্ষ থেকে সব রাজনৈতিক দলের জন্য নিরাপত্তা প্রটোকল সরবরাহ করা হবে। এই প্রটোকলে রাজনৈতিক নেতা এবং আসন্ন নির্বাচনে সম্ভাব্য প্রার্থীরা তাদের বাসস্থান, কার্যালয়, চলাচল, জনসভা ও সাইবার স্পেসে কীভাবে নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন—সে বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হবে। গণঅভ্যুত্থানের সম্মুখসারির নেতৃত্ব ও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতাদের বাড়তি নিরাপত্তা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
ঢাকা-৮ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দেওয়া হাদি গত শুক্রবার ঢাকার বিজয়নগর এলাকায় হামলার শিকার হন। চলন্ত রিকশায় থাকা হাদিকে গুলি করেন চলন্ত মোটরসাইকেলের পেছনে বসে থাকা আততায়ী। গুলিটি লাগে হাদির মাথায়।
এ ঘটনায় রোববার রাতে পল্টন থানায় হত্যাচেষ্টার মামলা করেন ইনকিলাব মঞ্চের সদস্য সচিব আব্দুল্লাহ আল জাবের।