leadT1ad

পরিচয়ের সীমানা পেরিয়ে যেভাবে স্বীকৃতি পাচ্ছেন রোহিঙ্গা শহীদ নূর মোস্তফা

নূর মোস্তফার স্বীকৃতি প্রতীকীর চেয়েও বেশি। চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থান জাতীয় পরিচয় গঠনের একটি চলমান ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া হিসেবে ভূমিকা রাখছে

স্ট্রিম প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১২ জুলাই ২০২৫, ১৮: ৩৪
শহীদ নূর মোস্তফা। স্ট্রিম গ্রাফিকস

চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থানে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন রোহিঙ্গা সন্তান নূর মোস্তফা। তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে শহীদের স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলাদেশ সরকার। গণ-আন্দোলন কেমন করে জাতি-গোত্রের সংকীর্ণ পরিচয়কে মুছে মানুষের পরিচয়কে বড় করে তোলে, তার এক দৃষ্টান্ত নূর মোস্তফা।

কক্সবাজারের ঈদগাঁওয়ে জন্ম ও বেড়ে ওঠা নূর মোস্তফার। তাঁর পরিবার নব্বই দশকের গোড়ায় মায়ানমারে জাতিগত নির্মূল অভিযান থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে এসছিল। বাবার সতর্কবার্তা উপেক্ষা করে জুলাই আন্দোলনে যোগ দেন নূর। একদিন পর হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। ৫ আগস্ট ঈদগাঁও থানার কাছে এক বিক্ষোভে অংশ নেওয়ার সময় তিনি গুলিবিদ্ধ হন।

পরিচয়হীন জন্ম বাংলাদেশের মাটিতে

১৯৯২ সালে নূর মোস্তফার বাবা শফিউল আলম কক্সবাজারের ঈদগাঁও উপজেলায় বসবাস শুরু করেন। সেখানেই ২০০৭ সালে নূরের জন্ম। মা নূর বেগম। মায়ের নামেই ছেলের নাম। ১৭ বছর বয়সী নূর ছিলেন মাদ্রাসার দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী। প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন দাখিল পরীক্ষা দেওয়ার।

নুরের কোনো মোবাইল ফোন ছিল না। আন্দোলনে বিজয়ের দিন ৫ আগস্ট নূর কীভাবে যেন একটি ফোন পেতে সক্ষম হয়। সেই ফোনে তাঁর বাবা শফিউল আলমকে তিনি দেখান আবু সাইদের গুলিবিদ্ধ হওয়ার ছবি। তাঁর বাবা জুলাই রেকর্ডসের কাছে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, 'নূর তাঁকে বলেছিলেন, "তারাও আমার মতো ছাত্র। ওরা যাদি গুলি খেতে পারে, তাহলে আমি কেন পারব না? তুমি কেন আমাকে আগে বাধা দিয়েছ।"’

কাঁদতে কাঁদতে শফিউল আলম বলেন, ‘অন্যরা যেভাবে দেশের জন্য শহীদ হয়ে সম্মানিত হয়েছে, আমি চাই আমার ছেলেকেও একই সম্মান দেওয়া হোক। আমার আর কোনো ইচ্ছা নেই। টাকা দিয়ে আমি কী করব।’

একটি নাম, একটি লড়াই, একটি ইতিহাস

সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম নিশ্চিত করেছেন নূর মোস্তফার নাম সরকারি নথিভুক্ত করার প্রস্তুতি চলছে। তবে জাতিগত পরিচয়ের গণ্ডি পার হয়ে এই পর্যায়ে আসতে তৈরি হয়েছে এক পথ পার হওয়ার গল্প। সেই গল্প প্রান্তিক পর্যায়ে একদল মানুষের নিরলস লেগে থাকার।

এই স্বীকৃতির পেছনে রয়েছে জুলাই রেকর্ডসের অক্লান্ত প্রচেষ্টা। প্ল্যাটফর্মটি জুলাই আন্দোলনের গল্প সংগ্রহ, সংরক্ষণ এবং ছড়িয়ে দিতে কাজ করছে। জনসাধারণের স্মৃতি থেকে মুছে যাওয়ার ঝুঁকির মুখে থাকে ইতিহাস। সেই ঝুঁকিকে মোকাবিলা করতে কাজ করছে তারা।

একই উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করছে স্টুডেন্টস অ্যালায়েন্স ফর ডেমোক্রেসি (এসএডি) এবং এমপাওয়ারিং আওয়ার ফাইটার্স। প্রান্তিক পর্যায়ের গণ-অভ্যুত্থানকে জাতীয় সীমানাইয় ছড়িয়ে যাওয়ার পথ খুলে দিয়েছে তারা। ইতিহাস সংরক্ষণে কেন্দ্রের আধিপত্যের বাইরে যাওয়ার এক অসাধারণ উদ্যোগ নিয়েছে এই প্লাটফর্মগুলো ।

আন্দোলনের ভিত: প্রান্ত থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত

আন্দোলন শুরু হয়েছিল কোটাকেন্দ্রিক বৈষম্যের বিরোধিতা করে। পরে দ্রুত তা রাজনৈতিক সংস্কার, নাগরিক অধিকার এবং ন্যায়বিচারের সামাজিক আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল। কেন্দ্র থেকে প্রান্ত পর্যন্ত, দেশজুড়ে লাখ লাখ মানুষ এই আন্দোলনে জড়িত হয়।

‘জুলাই রেকর্ডস’-এর প্রতিষ্ঠাতারা এই আন্দোলনের ব্যাপকতার সামগ্রিক চিত্র সংরক্ষণ নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। তাঁরা আশঙ্কা করেছিলেন দাপ্তরিক বয়ান থেকে ঘটনার অনেক দিক বাদ যেতে পারে। এক সরকারের বয়ান বাতিল করে দিতে পারে পরের সরকার।

প্ল্যাটফর্মের অন্যতম সংগঠক কাজী ওয়ালী উল্লাহ স্ট্রিমকে বলেন, 'আন্দোলন তীব্র হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অসংখ্য আবেগ, আকাঙ্ক্ষা আর আশা দানা বেঁধেছিল। কিন্তু ৫ আগস্টের পরে দিন গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে হাজির হয়েছে নতুন রাজনৈতিক দৃশ্যপট। ততই বেদনাদায়কভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে জুলাইয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের যত্ন নেওয়া আর অগ্রাধিকার নেই।’

‘আমরা জুলাইয়ের না-বলা গল্পগুলো সংগ্রহ করার টার্গেট নিই। আর তার জন্য সংগ্রহ করি প্ল্যাটফর্মহীন মানুষের নিজেদের পক্ষে বলা কথা এবং ইতিহাসের খাঁটি দলিল হিসেবে ঘটনার অকৃত্রিম বিবরণ’—তিনি আরও যোগ করেন।

নূরের গল্প আবিষ্কার উন্মোচন

চট্টগ্রামের স্থানীয় শহীদদের সন্ধান করতে গিয়ে ১৪ মার্চ জুলাই রেকর্ডস প্রথমে নূর মোস্তফার গল্প আবিষ্কার করে। সে রাতেই তাদের ফেসবুক পেজে তা প্রকাশ করা হয়। কাকতালীয়ভাবে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস সেদিন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের সঙ্গে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবির পরিদর্শন করছিলেন।

পরে ২৬ মার্চ তাঁরা শহীদ নূর মোস্তফার মা নূর বেগমের একটি লিখিত সাক্ষাৎকার এবং ২৯ মার্চ তাঁর বাবার একটি ভিডিও সাক্ষাৎকার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করে জুলাই রেকর্ডস।

কাজী ওয়ালী উল্লাহ বলেন, ‘যখন আমরা শুনলাম যে, শুধুমাত্র বাংলাদেশের বৈধ নাগরিক নয় বলে নূরের নাম তালিকাভুক্ত করা হয়নি, তখন আমরা ঠিক করি তাকে নিয়ে কথা বলা বন্ধ না করার। নূরের পরিবার গত শতকের নব্বই দশক থেকে এখানে বসবাস করছেন। আমরা নূরের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আমাদের সামর্থ্যের সবটুকু খরচের সিদ্ধান্ত নিই। কারণ নূর আমাদের জন্য তাঁর সবকিছু ত্যাগ করেছিলেন।‘

প্ল্যাকার্ড থেকে প্রেসক্লাব পর্যন্ত

ডিসেম্বরে প্রতিষ্ঠার পর থেকে জুলাই রেকর্ডস ১৩০টি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। এর মধ্যে কিছু সাক্ষাৎকার দুই ঘণ্টার বেশি দীর্ঘ। যাঁদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন শহীদ পরিবার, আহত ব্যক্তি ও প্রত্যক্ষদর্শী। এমনই একটি পরিবার ছিল রোহিঙ্গা শহীদ নূর মোস্তফার।

শহীদ নুরের সাক্ষাৎকারটি প্রকাশের পর থেকে জুলাই রেকর্ডস তাদের সক্রিয়তা আরও বাড়িয়েছে। নিজেদের বক্তব্য জানানোর জন্য দুয়ারে দুয়ারে কড়া নেড়েছে। নীতিনির্ধারক পর্যায়ের কেউ গল্পটি শুনবেন এই আশায়।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিয়মিত পোস্ট এবং একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশের পাশাপাশি, ২৯ মার্চ জুলাই রেকর্ডস ও স্টুডেন্ট অ্যালায়েন্স ফর ডেমোক্রেসির (এসএডি) যৌথ উদ্যোগে চট্টগ্রামের বিপ্লব উদ্যানে মানববন্ধন করা হয়।

৪ এপ্রিল, জুলাই রেকর্ডস এবং এমপাওয়ারিং আওয়ার ফাইটার্সের একটি যৌথ আবেদন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টার কাছে জমা দেওয়া হয়।

১৭ এপ্রিল জুলাই রেকর্ডস এবং স্টুডেন্টস অ্যালায়েন্স ফর ডেমোক্রেসি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রাজু ভাস্কর্যের সামনে মানববন্ধন করে নূরের দ্রুত শহীদ স্বীকৃতি দাবি করে।

২৬ এপ্রিল, অ্যান্টি হেজেমনি মুসলিম ইউনিটি প্ল্যাটফর্ম রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে একটি সমাবেশ করে। সেই অনুষ্ঠানে আয়োজক মুহাম্মদ মিজানুর রহমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে নূর মোস্তফাকে শহীদের সম্মান জানাতে অনুরোধ করেন।

সরকার নূরের আত্মত্যাগকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগ পর্যন্ত এই সংগঠনগুলো ক্রমাগত মানুষের কাছে নূর মোস্তফার শহীদ স্বীকৃতির দাবি নিয়ে পৌঁছেছেন। তাদের নিরন্তর প্রয়াস মানুষের মধ্যে ব্যাপক সমর্থন তৈরি হয়। অনেকেই হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের ছবি পোস্ট করেছেন।

আন্দোলনের সময় জুলাইকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছিলেন শিল্পী দেবাশীষ চক্রবর্তী। তিনি নূর মোস্তফার স্বীকৃতি দাবি করে একটি ডিজিটাল পোস্টার প্রকাশ করেন।

পরিচয়ের সংজ্ঞা পার হয়ে

‘অচেনা, জাতিগতভাবে বৈষম্যের শিকার এবং স্বল্প পরিচিত নূর মোস্তফাকে আমরা জুলাই অভ্যুত্থানের অন্যতম ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছি। শেষ পর্যন্ত আমরা তা করতে সফলও হয়েছি।'—মন্তব্য করেন জুলাই রেকর্ডসের আরেক সংগঠক সুলাইম মাহমুদ। তিনি এই অর্জনের জন্য সম্মিলিত প্রচেষ্টাকে কৃতিত্ব দেন।

নূর মোস্তফার স্বীকৃতি প্রতীকীর চেয়েও বেশি। চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থান জাতীয় পরিচয় গঠনের একটি চলমান ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া হিসেবে ভূমিকা রাখছে। কারণ, এই দেশের মানুষ এখনও নিজেদের জিজ্ঞাসা করছে—বাংলাদেশি হওয়ার অর্থ কী? ধর্মীয় ও জাতিগত বৈচিত্র্যের মধ্যে মিশে যাওয়া একটি ঔপনিবেশ-পরবর্তী দেশের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার অর্থ কী।

রোহিঙ্গা পরিবারের সন্তান নূর মোস্তফার জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ হওয়ার স্বীকৃতি এইসব পরিচয়ের সংজ্ঞা নির্ধারণের পরিধি ব্যাপক করে তুলবে।

বিষয়:

Ad 300x250

ফিরে দেখা বুয়েটের সেই তিন আন্দোলন

ডিপ্লোমা বনাম বিএসসি: পদোন্নতি ও পদমর্যাদা নিয়ে দ্বন্দ্ব

‘প্রয়োজন হলে’ সেনা মোতায়েনের কথা বলেছি: ডাকসু চিফ রিটার্নিং কর্মকর্তা

রামেকে ১৭ কোটি টাকার ওষুধ এনে দিলেন তরুণ চিকিৎসক শীর্ষ শ্রেয়ান

শিবিরের প্যানেলে সর্ব মিত্র চাকমা: ‘জাত-বিরোধী কর্মকাণ্ড’ বলছেন পাহাড়ি শিক্ষার্থীরা

সম্পর্কিত