leadT1ad

রাজনৈতিক সংস্কারে ‘জুলাই সনদ’: বাস্তবায়ন নিয়ে দলগুলোর মতভেদ

জুলাই সনদের প্রাথমিক খসড়া সোমবারের (২৮ জুলাই) মধ্যে সব রাজনৈতিক দলের কাছে পাঠানো হবে। দীর্ঘ সংলাপের পর এখন পর্যন্ত ১০টি বিষয়ে ঐকমত্য হলেও ৭টি বিষয়ের আলোচনা অসম্পূর্ণ এবং ৩টি ইস্যু এখনো আলোচনায় আসেনি।

মো. ইসতিয়াকঢাকা
প্রকাশ : ২৭ জুলাই ২০২৫, ২১: ১২
জুলাই সনদের খসড়া সোমবারের মধ্যে দলগুলোর কাছে পাঠানো হবে। ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংস্কার প্রশ্নে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন কয়েক মাস ধরে ধারাবাহিক সংলাপ চালিয়ে গেলেও এখনো বহু বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য রয়ে গেছে। বিশেষ করে আনুপাতিক নির্বাচনব্যবস্থা চালু, জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠন, প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধানের ক্ষমতার ভারসাম্য এবং সংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়োগপদ্ধতি সংস্কার নিয়ে এখনো বিভিন্ন দলের অবস্থান একেবারে ভিন্নমুখী।

জুলাই সনদ বা জুলাই ঘোষণাপত্রকে সংবিধানের মূলনীতিতে অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলাকে ‘বিভ্রান্তিমূলক’ বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী। জুলাই সনদ ও ঘোষণাপত্র দিতে না পারলে জুলাই উদযাপনে অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো ধরনের উদ্যোগ নেওয়ার এখতিয়ার নেই বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম।

অন্যদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ প্রশ্ন তুলেছেন, ‘যদি সব বিষয়ে ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে শতভাগ একমত হতে হয়, তাহলে আলোচনার প্রয়োজন কি ছিল?’ এই প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘এটা মানে নয় যে আমরা কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারিনি বা বিষয়গুলো বাতিল হয়েছে। বরং এসব নিয়ে ভবিষ্যতেও আলোচনা অব্যাহত থাকবে এবং আমরা আশাবাদী।’

আজ রোববার (২৭ জুলাই) ঘোষণা দিয়েছেন যে আগামীকাল সোমবার (২৮ জুলাই) ‘জুলাই সনদ’-এর প্রাথমিক খসড়া রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হবে। কমিশনের লক্ষ্য, ৩১ জুলাইয়ের মধ্যেই সব আলোচনার সমাপ্তি টেনে একটি পূর্ণাঙ্গ সনদ তৈরি। ইতিমধ্যে ১০টি বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য তৈরি হয়েছে, তবে ৭টি বিষয়ে আলোচনা অসমাপ্ত এবং ৩টি বিষয়ে এখনো কোনো আলোচনা শুরু হয়নি।

এদিকে, খসড়া প্রস্তুতের পাশাপাশি একটি নতুন বিতর্ক সামনে এসেছে—এই সনদ বাস্তবায়নের পথ কী হবে? কেউ বলছে নির্বাচনের আগেই গণভোট আয়োজন করতে হবে, কেউ বলছে নির্বাচনের পরে সংসদীয় প্রক্রিয়ায় আইন করে সনদের প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে, আবার কেউ চাইছে একটি নতুন গণপরিষদ গঠন করে বিষয়গুলো চূড়ান্ত করতে।

ফলে ‘ঐকমত্য’র বাইরে এসে এখন আলোচনা কেন্দ্রীভূত হচ্ছে ‘বাস্তবায়নের ধরন’ নিয়ে। অনেকেই মনে করছেন, এগুলো একই জিনিস; কিন্তু কমিশন বলছে, জুলাই সনদ হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যেসব সংস্কার প্রস্তাবে নীতিগত ঐকমত্য হয়েছে তার লিখিত দলিল, যেখানে থাকবে একটি ভূমিকা, পটভূমি ও প্রতিশ্রুতি অধ্যায়।

সব মিলিয়ে, এই মুহূর্তে প্রশ্নটা কেবল ঐকমত্যে পৌঁছানোর নয়—বরং যেটুকু ঐকমত্য হয়েছে, সেটিও সঠিকভাবে বাস্তবায়ন। কমিশন যদিও আশাবাদী যে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই একটি গ্রহণযোগ্য জুলাই সনদ তৈরি হবে, কিন্তু রাজনৈতিক বাস্তবতা বলছে, এখনো দীর্ঘ পথ বাকি।

সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে আলোচনা চলছে। ছবি: সংগৃহীত
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে আলোচনা চলছে। ছবি: সংগৃহীত

জুলাই সনদ: গণতান্ত্রিক সংস্কারের এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশ্রুতি

গত ৬ জুন জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ‘জুলাই সনদ’কে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশ্রুতিরূপে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘জুলাই সনদ হলো একটি জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে সংস্কার কমিশন যে প্রস্তাবনা পেশ করেছে, সেগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলো যে বিষয়গুলোতে সম্মতি প্রকাশ করেছে, সেগুলোর একটি তালিকা এই সনদে সংযুক্ত থাকবে।’ অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে গঠন করা হয় মোট ১১টি কমিশন। এসব কমিশনের সুপারিশ ও প্রস্তাবনা নিয়ে গত কয়েক মাস ধরে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। আলোচনার ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হয়েছে সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন খাতের সংস্কারবিষয়ক ১৬৬টি সুপারিশে। এই সংলাপে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) প্রায় ৩০টি রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করেছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, এসব প্রস্তাবনার মধ্যে ৮০টির বেশি বিষয়ে রাজনৈতিক দল সম্মত হয়েছে। বাকি গুরুত্বপূর্ণ ২০টির ওপর আলোচনার মধ্যে দিয়ে এখনো চলছে মতবৈষম্য দূর করার চেষ্টা। কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, এই ২০টির মধ্যে অন্তত পাঁচটি বিষয়ে ইতিমধ্যে ঐকমত্য গড়ে উঠেছে, যদিও ছয় থেকে সাতটি বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। অন্যদিকে, ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘আমাদের এখন মৌলিক কিছু বিষয়ে ঐকমত্য অর্জন অপরিহার্য। কারণ, তা না হলে আমরা স্বৈরাচারের পুনরুত্থান ঠেকাতে সক্ষম হব না।’

যদিও কমিশন এই সম্মিলিত সংস্কার প্রস্তাবনাকে আপাতত ‘জুলাই সনদ’ নামে উল্লেখ করছে, তবুও ভবিষ্যতে এর নাম পরিবর্তনের সম্ভাবনা রয়েছে। অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘এটি মূলত একটি জাতীয় সনদ; তবে ‘জুলাই সনদ’ বলা হচ্ছে। কারণ, এটি ২০২৪ সালের জুলাই মাসে ঘটে যাওয়া ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে গৃহীত সিদ্ধান্তের প্রতিফলন।’

আলী রীয়াজ আরও বলেন, ‘জাতীয় কিংবা জুলাই সনদ যাই হোক না কেন, এটি আগামী দিনে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি মাইলফলক হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ বলেন, সার্বিকভাবে জুলাই সনদ বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কারের জন্য একটি নির্ধারণমূলক দলিল হিসেবে আশা জাগাচ্ছে। যা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যকার মতপার্থক্য কমিয়ে এক ঐকমত্যের ভিত্তিতে দেশকে একটি গণতান্ত্রিক ও জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার পথ সুগম করবে।

রাজনৈতিক ঐকমত্যের চ্যালেঞ্জ

২ জুন দ্বিতীয় ধাপের আলোচনায় রাজনৈতিক দলগুলো সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে পরিবর্তন, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতিত্ব, নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমাসংক্রান্ত বিধান সংশোধন এবং হাইকোর্টের বিকেন্দ্রীকরণ—এই পাঁচটি মূল প্রস্তাবে একমত হয়েছে। ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় দফার আলোচনায় প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতাসংক্রান্ত বিষয়, দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী পদে ভিন্ন ব্যক্তির নিয়োগসংক্রান্ত প্রস্তাবও উঠে এসেছে। পাশাপাশি জাতীয় সাংবিধানিক পরিষদ (এনসিসি) গঠন, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন ও সরকারি কর্ম কমিশনের মতো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়েও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। কিছু রাজনৈতিক দল এখনো এই বিষয়গুলোতে ঐকমত্যে আসতে পারেনি বলে জানান বদিউল আলম মজুমদার।

অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ মন্তব্য করেন, ‘সব ইস্যুতে সবাই একমত হবে এমন ধারণা বাস্তবসম্মত নয়। সংস্কার কমিশনের কিছু প্রস্তাবে ঐকমত্য হয়নি। কারণ, প্রতিটি দলই নিজের স্বার্থ তুলে ধরতে চায়। তাই যদি সবাই নিজের শক্তি দেখাতে চায়, তাহলে ঐকমত্য তৈরি করা কঠিন।’

জুলাই সনদের বাস্তবায়ন কীভাবে হবে

অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ওপর ভিত্তি করে চূড়ান্ত করা জুলাই সনদটি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হিসেবে আলোচনায় এসেছে। কারণ, এ ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ভিন্নমত রয়েছে। সংস্কার প্রস্তাবগুলো যখন দলগুলোর কাছে উপস্থাপন করা হয়, তখন বাস্তবায়নের জন্য ছয় ধরনের বিকল্প পথ দেওয়া হয়েছিল—নির্বাচনের আগে অধ্যাদেশের মাধ্যমে, নির্বাচনের আগে গণভোটের মাধ্যমে, নির্বাচনের সময় গণভোটের মাধ্যমে, গণপরিষদের মাধ্যমে, নির্বাচনের পরে সাংবিধানিক সংশোধনের মাধ্যমে এবং নির্বাচিত সংসদ বা আইনসভা থেকে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে।

বিএনপি, সিপিবি-বাসদসহ বেশ কয়েকটি দল জাতীয় সংসদকে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন একমাত্র মাধ্যম হিসেবে দেখছে, যেখানে প্রস্তাবিত সংস্কারগুলো আইন হিসাবে গৃহীত হবে। অন্যদিকে, এনসিপি গণপরিষদ নির্বাচন করে সনদ বাস্তবায়নের পক্ষে। আবার জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মতো কিছু দল পরিপূর্ণ রাজনৈতিক ঐকমত্য না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষার করার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তাদের মতে, সব দল যদি সনদে সম্মত হয়, তখনই নির্বাচিত সংসদে বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। এই দ্বিধা ও মতবৈষম্যের কারণে জুলাই সনদ কার্যকর করার পথে বাধার আশঙ্কাও উঠেছে। তবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ এ ব্যাপারে বেশি উদ্বিগ্ন নন। তিনি বলেন, ‘আমরা মূলত কী পরিবর্তন প্রয়োজন, সেটি নির্ধারণে মনোযোগ দিচ্ছি, কিন্তু কীভাবে তা বাস্তবায়ন হবে—সেটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মিলিত সিদ্ধান্তে নির্ধারিত হবে।’

Ad 300x250

৩০০ আসনের ৫ শতাংশে নারী প্রার্থী মনোনয়নের প্রস্তাব বিএনপির

পিআর পদ্ধতি: কার লাভ কার ক্ষতি

রাজনৈতিক সংস্কারে ‘জুলাই সনদ’: বাস্তবায়ন নিয়ে দলগুলোর মতভেদ

কেন্দ্রীয় কমিটি ছাড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সব কমিটি বাতিল

নায়ক জসীমের মতো অকালে চলে গেলেন তাঁর ছেলে ‘ওউন্ড’ ব্যান্ডের ভোকালিস্ট-বেজিস্ট এ কে রাতুল

সম্পর্কিত