পিআর পদ্ধতির নির্বাচন আসলে কী? কীভাবে কাজ করে? এ পদ্ধতিতে কাদের লাভ? রাজনৈতিক দলগুলোর মতপার্থক্য কোথায়? বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে স্ট্রিমের প্রতিবেদনে জানুন বিস্তারিত।
স্ট্রিম প্রতিবেদক
বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে বিদ্যমান গতানুগতিক নির্বাচন পদ্ধতি (এফপিটিপি) ও সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতির নির্বাচনব্যবস্থার পরিবর্তে মিশ্র সদস্য আনুপাতিক (এমএমপিআর) পদ্ধতি প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস।
গত বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) রাজধানীর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) মিলনায়তনে ‘জনমতের প্রতিফলনে কার্যকর নির্বাচনব্যবস্থা: এমএমপি শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে নতুন এ পদ্ধতি উপস্থাপন করে দলটি। দলটি বলেছে, এ ধরনের পদ্ধতি বাস্তবসম্মত নির্বাচনব্যবস্থা গড়ে তোলার পাশাপাশি বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও গণমানুষের মতামতের প্রকৃত প্রতিফলন নিশ্চিত করবে।
আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বেশ কিছুদিন ধরে পিআর পদ্ধতি আলোচনায় রয়েছে। একাধিক দল পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবি তুলেছে। তবে পিআর পদ্ধতির প্রয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে দলগুলোর মধ্যে কিছু পার্থক্যও রয়েছে।
বাংলাদেশ, ভারত ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলো নির্বাচনব্যবস্থায় ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ বা এফপিটিপি পদ্ধতি অনুসরণ করে। এ পদ্ধতিতে দেশকে বিভিন্নসংখ্যক সংসদীয় আসনে ভাগ করা হয়। ভোটারেরা প্রতিটি আসনে বিভিন্ন দলের মধ্যে থেকে নিজেদের পছন্দের একজন প্রার্থীকে বেছে নেয় এবং যে প্রার্থী সর্বাধিক ভোট পায় সে বিজয়ী হয়।
পিআর পদ্ধতিতে কোনো নির্দিষ্ট আসনে সর্বোচ্চ ভোট পাওয়া প্রার্থীকে জয়ী ঘোষণা করা হয় না। বরং এ পদ্ধতিতে প্রতিটি ভোট যেন সংসদে প্রতিনিধিত্ব করে, তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হয়। সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনব্যবস্থার বেশ কয়েকটি ধরন রয়েছে। সবচেয়ে প্রচলিত হচ্ছে পার্টি তালিকা পদ্ধতি। এখানে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের আগে একটি প্রার্থী তালিকা প্রস্তুত করে। ভোটারেরা নির্দিষ্ট কোনো প্রার্থীকে নয়, একটি দলকে ভোট দেন। নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পায়, সেই অনুপাতে তালিকা থেকে প্রার্থীরা সংসদে নির্বাচিত হন।
বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, পিআর পদ্ধতিতে একটি দলের সংসদে আসনের সংখ্যা সারা দেশে প্রাপ্ত ভোটের শতকরা হারের সমানুপাতিক হয়।
উদাহরণ হিসেবে, বাংলাদেশের ৩০০ আসনের সংসদে কোনো দল সারা দেশে ১ শতাংশ ভোট পেলে তারা ৩টি আসন পাবে। সরকার গঠনের জন্য একটি দল বা জোটকে মোট ভোটের ৫১ শতাংশ পেতে হবে। এককভাবে কোনো দল এ পরিমাণ ভোট না পেলে জোট করতে হয়।
বর্তমানে বিএনপির শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চায়। তবে বিএনপি দৃঢ়ভাবে এ পদ্ধতির বিরোধিতা করে আসছে।
এনসিপি সংসদের উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতির পক্ষে থাকলেও জামায়াতে ইসলামী নিম্নকক্ষেও পিআর পদ্ধতি প্রয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে।
এ ধরনের পদ্ধতি গ্রহণ করা হবে কি না, তা এখনো স্পষ্ট নয়। পিআর পদ্ধতি ছোট দলের জন্য সীমাবদ্ধতা থাকলেও জোট তাদের ভাগ্য বদলে দিতে পারে। একটি কার্যকর জোট ছোট দলের জন্য ভোটের হার বাড়াতে পারে। পিআর পদ্ধতি চালু হলে আরও বেশি জোটের গঠনের সম্ভবনা আছে। কে এম মহিউদ্দিন, অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
চলতি মাসের ১৯ জুলাই পিআর পদ্ধতির নির্বাচনসহ সাত দফা দাবিতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতীয় সমাবেশ করে জামায়াতে ইসলামী।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে সংবিধান সংস্কার কমিশন সংসদের উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন এবং নিম্নকক্ষে সরাসরি নির্বাচনের প্রস্তাব করে। তখন থেকেই পিআর পদ্ধতি নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়।
সংবিধান সংস্কার কমিশন আরও প্রস্তাব দেয় যে পিআর ভিত্তিক উচ্চকক্ষে প্রতিনিধিত্বের জন্য একটি দলকে জাতীয় নির্বাচনে অন্তত ১ শতাংশ ভোট পেতে হবে।
ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউয়ের দেশভিত্তিক র্যাঙ্কিং অনুযায়ী, অস্ট্রেলিয়া, সুইডেন, পর্তুগাল, নিউজিল্যান্ড, জার্মানি ও তুরস্কসহ বিশ্বে ৯৩টি দেশে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন হয়। দক্ষিণ এশিয়ার দেশ নেপাল মিশ্র পিআর পদ্ধতি ও শ্রীলঙ্কা পার্টি লিস্ট পদ্ধতি ব্যবহার করছে।
এদিকে, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিসহ (সিপিবি) নবগঠিত কয়েকটি বামপন্থী দল ও জোট সংসদে উচ্চকক্ষের প্রয়োজন নেই বলে মত দিয়েছে এবং পুরো সংসদে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন করার দাবি জানিয়েছে।
আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টিও বলেছে উচ্চকক্ষের প্রয়োজন নেই, তবে সংসদে পিআর পদ্ধতি প্রয়োজন।
অনেক দল এ বিষয়ে একমত হলেও এখনো পূর্ণ ঐক্যমত গড়ে ওঠেনি। অন্যদিকে, দেশের অন্যতম বৃহৎ দল বিএনপি প্রকাশ্যে এ পদ্ধতির বিরোধিতা করেছে।
বিতর্ক হচ্ছে, পিআর পদ্ধতি গ্রহণ করা উচিত কি না কিংবা বিকল্প কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, কেবল পিআর পদ্ধতি এলে কে বা কোন দল সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে?
স্বাধীনতার পর থেকে ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ১৯৭৩ ছাড়া কোনো দলই ৫০ শতাংশ ভোট পায়নি।
১৯৭৩ সালের নির্বাচনে ৭৩ দশমিক ২ শতাংশ ভোট নিয়ে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়। ১৯৭৯ সালে বিএনপি পায় ৪১ দশমিক ২ শতাংশ; ১৯৮৬ সালে জাতীয় পার্টি পায় ৪২ দশমিক ৩৪ শতাংশ; ১৯৯১ সালে বিএনপি পায় ৩০ দশমিক ৮১ শতাংশ; ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ পায় ৩৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ এবং ২০০১ সালে বিএনপি পায় ৪১ দশমিক ৪ শতাংশ ভোট।
২০০৮ সালে ৪৯ শতাংশ ভোট পেয়েও আওয়ামী লীগ ২৩০টি আসন জেতে কিন্তু ৩৩ দশমিক ২ শতাংশ ভোট পেয়েও বিএনপি পায় মাত্র ৩০টি আসন।
২০০৮ সালের পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে বিএনপি প্রায় ৯০টি আসন এবং আওয়ামী লীগ প্রায় ১৪৭টি আসন পেত।
পিআর পদ্ধতি থাকলে ১৯৭৩ সালের নির্বাচন ছাড়া অন্য কোনো নির্বাচনে কোনো দল এককভাবে সরকার গঠন করতে পারত না।
বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, বর্তমান রাজনৈতিক প্রবণতা ও ভোটারদের আচরণ পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায়, কোনো দলের পক্ষে এককভাবে সারাদেশে ৫০ শতাংশ ভোট পাওয়া ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে।
বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির আল্লামা মামুনুল হক বৈঠকে বলেন, গতানুগতিক নির্বাচন পদ্ধতি (এফপিটিপি) ও পিআর উভয়ের সীমাবদ্ধতা আছে। বাংলাদেশের জন্য মিক্সড মেম্বার প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (এমএমপিআর) একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও ন্যায়সঙ্গত মডেল।
এমএমপিআর পদ্ধতিতে প্রথমে ৩০০ আসনে গতানুগতিক পদ্ধতিতে ভোট হবে। এরপর পিআর পদ্ধতিতে প্রতিটি দলের মোট ভোটের হিসাব করা হবে। কোনো দলের প্রাপ্ত আসন ভোট অনুপাতে কম হলে বাড়তি আসন দিয়ে সমন্বয় করা হবে। যে দল অন্তত ১ শতাংশ ভোট পাবে, সে প্রতিনিধিত্বের যোগ্য হবে।
স্ট্রিমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এনসিপির যুগ্ম প্রধান সমন্বয়ক আরিফুর রহমান তুহিন বলেন, তাঁরা উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতি চান। তাঁরা মনে করেন, সংসদের উচ্চকক্ষ সাংবিধানিক বিষয় ও নাগরিকদের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে এমন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
অন্যদিকে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ড. আসাদুজ্জামান রিপন বলেছেন, পিআর পদ্ধতি তৃণমূল ভোটারদের অধিকার ক্ষুণ্ন করে।
আসাদুজ্জামান রিপন আরও বলেন, পিআর পদ্ধতি কখনোই প্রকৃত গণতান্ত্রিক কাঠামো তৈরি করে না। এ পদ্ধতি স্থানীয় ভোটারদের পছন্দের প্রার্থীকে সরাসরি ভোট দেওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। এটি গণতান্ত্রিক অধিকার লঙ্ঘন করে।
আসাদুজ্জামান রিপনের বক্তব্য বিএনপির প্রকাশ্য অবস্থানকে আরও স্পষ্ট করে।
চলতি মাসের ১৯ জুলাই সংবাদমাধ্যমে বিএনপির দলীয় সূত্র থেকে জানানো হয়, তারা সংসদের উচ্চকক্ষে প্রস্তাবিত পিআর পদ্ধতির বিষয়ে অন্য দলের সঙ্গে একমত হবে না। বিষয়টি চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হলে রাজনৈতিকভাবে তা মোকাবিলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি।
ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক শেখ ফজলুল করীম মারুফ স্ট্রিমকে বলেন, বর্তমান পদ্ধতিতে সংখ্যালঘুরা অনেক সময় সংখ্যাগরিষ্ঠের ওপর শাসন করে। আমরা এই পদ্ধতি পরিবর্তন করতে চাই। মাত্র ৪০ শতাংশ ভোট পেয়ে ২০০টির বেশি আসন জিতে যেকোনো দল একনায়কের শাসন প্রতিষ্ঠা করবে। যা গণতন্ত্রের নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তাই আমরা এর পরিবর্তন চাই।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক শর্তসাপেক্ষে এবং সমঝোতার ভিত্তিতে পিআর পদ্ধতির পক্ষে মত দিয়েছেন।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেছেন, তিনি পিআর পদ্ধতির পক্ষে, তবে বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় আগামী নির্বাচন বিদ্যমান পদ্ধতিতেই হওয়া উচিত।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞেরা বলেছেন, ছোট সমর্থনভিত্তিক দলগুলো সরকারি প্রতিনিধিত্ব পেতে লড়াই করছে। পিআর পদ্ধতি তাদের সংসদে প্রতিনিধিত্বের সুযোগ দেবে। আর কার্যকর জোট গঠন করলে তাদের অবস্থান আরও শক্তিশালী হতে পারে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. সুলতান মাহমুদ রানা স্ট্রিমকে বলেন, পিআর পদ্ধতি সেসব দেশে ভালো কাজ করে যেখানে পরিপক্ব রাজনৈতিক সংস্কৃতি, শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বিদ্যমান। বাংলাদেশের বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর পিআর পদ্ধতির পক্ষে ও বিপক্ষে বিভিন্ন বক্তব্য গণতন্ত্রের জন্য ভাল।
সুলতান মাহমুদ আরও বলেন, পিআর পদ্ধতিতে ভোটার তাদের পছন্দের ব্যক্তিকে সরাসরি নেতা হিসেবে বেছে নিতে পারে না, যা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বিরোধী। আবার গতানুগতিক নির্বাচন পদ্ধতিতে ছোট দলগুলো সংসদে সঠিক প্রতিনিধিত্ব পায় না, এটিও গণতন্ত্রের মূল্যবোধের বিরুদ্ধে। পিআর পদ্ধতি চালু হলে ছোট দলগুলো সংসদে আসার সুযোগ পাবে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক কে এম মহিউদ্দিন বলেন, এ ধরনের পদ্ধতি গ্রহণ করা হবে কি না, তা এখনো স্পষ্ট নয়। পিআর পদ্ধতি ছোট দলের জন্য সীমাবদ্ধতা থাকলেও জোট তাদের ভাগ্য বদলে দিতে পারে। একটি কার্যকর জোট ছোট দলের জন্য ভোটের হার বাড়াতে পারে। পিআর পদ্ধতি চালু হলে আরও বেশি জোটের গঠনের সম্ভবনা আছে।
বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে বিদ্যমান গতানুগতিক নির্বাচন পদ্ধতি (এফপিটিপি) ও সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতির নির্বাচনব্যবস্থার পরিবর্তে মিশ্র সদস্য আনুপাতিক (এমএমপিআর) পদ্ধতি প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস।
গত বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) রাজধানীর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) মিলনায়তনে ‘জনমতের প্রতিফলনে কার্যকর নির্বাচনব্যবস্থা: এমএমপি শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে নতুন এ পদ্ধতি উপস্থাপন করে দলটি। দলটি বলেছে, এ ধরনের পদ্ধতি বাস্তবসম্মত নির্বাচনব্যবস্থা গড়ে তোলার পাশাপাশি বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও গণমানুষের মতামতের প্রকৃত প্রতিফলন নিশ্চিত করবে।
আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বেশ কিছুদিন ধরে পিআর পদ্ধতি আলোচনায় রয়েছে। একাধিক দল পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবি তুলেছে। তবে পিআর পদ্ধতির প্রয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে দলগুলোর মধ্যে কিছু পার্থক্যও রয়েছে।
বাংলাদেশ, ভারত ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলো নির্বাচনব্যবস্থায় ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ বা এফপিটিপি পদ্ধতি অনুসরণ করে। এ পদ্ধতিতে দেশকে বিভিন্নসংখ্যক সংসদীয় আসনে ভাগ করা হয়। ভোটারেরা প্রতিটি আসনে বিভিন্ন দলের মধ্যে থেকে নিজেদের পছন্দের একজন প্রার্থীকে বেছে নেয় এবং যে প্রার্থী সর্বাধিক ভোট পায় সে বিজয়ী হয়।
পিআর পদ্ধতিতে কোনো নির্দিষ্ট আসনে সর্বোচ্চ ভোট পাওয়া প্রার্থীকে জয়ী ঘোষণা করা হয় না। বরং এ পদ্ধতিতে প্রতিটি ভোট যেন সংসদে প্রতিনিধিত্ব করে, তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হয়। সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনব্যবস্থার বেশ কয়েকটি ধরন রয়েছে। সবচেয়ে প্রচলিত হচ্ছে পার্টি তালিকা পদ্ধতি। এখানে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের আগে একটি প্রার্থী তালিকা প্রস্তুত করে। ভোটারেরা নির্দিষ্ট কোনো প্রার্থীকে নয়, একটি দলকে ভোট দেন। নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পায়, সেই অনুপাতে তালিকা থেকে প্রার্থীরা সংসদে নির্বাচিত হন।
বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, পিআর পদ্ধতিতে একটি দলের সংসদে আসনের সংখ্যা সারা দেশে প্রাপ্ত ভোটের শতকরা হারের সমানুপাতিক হয়।
উদাহরণ হিসেবে, বাংলাদেশের ৩০০ আসনের সংসদে কোনো দল সারা দেশে ১ শতাংশ ভোট পেলে তারা ৩টি আসন পাবে। সরকার গঠনের জন্য একটি দল বা জোটকে মোট ভোটের ৫১ শতাংশ পেতে হবে। এককভাবে কোনো দল এ পরিমাণ ভোট না পেলে জোট করতে হয়।
বর্তমানে বিএনপির শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চায়। তবে বিএনপি দৃঢ়ভাবে এ পদ্ধতির বিরোধিতা করে আসছে।
এনসিপি সংসদের উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতির পক্ষে থাকলেও জামায়াতে ইসলামী নিম্নকক্ষেও পিআর পদ্ধতি প্রয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে।
এ ধরনের পদ্ধতি গ্রহণ করা হবে কি না, তা এখনো স্পষ্ট নয়। পিআর পদ্ধতি ছোট দলের জন্য সীমাবদ্ধতা থাকলেও জোট তাদের ভাগ্য বদলে দিতে পারে। একটি কার্যকর জোট ছোট দলের জন্য ভোটের হার বাড়াতে পারে। পিআর পদ্ধতি চালু হলে আরও বেশি জোটের গঠনের সম্ভবনা আছে। কে এম মহিউদ্দিন, অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
চলতি মাসের ১৯ জুলাই পিআর পদ্ধতির নির্বাচনসহ সাত দফা দাবিতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতীয় সমাবেশ করে জামায়াতে ইসলামী।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে সংবিধান সংস্কার কমিশন সংসদের উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন এবং নিম্নকক্ষে সরাসরি নির্বাচনের প্রস্তাব করে। তখন থেকেই পিআর পদ্ধতি নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়।
সংবিধান সংস্কার কমিশন আরও প্রস্তাব দেয় যে পিআর ভিত্তিক উচ্চকক্ষে প্রতিনিধিত্বের জন্য একটি দলকে জাতীয় নির্বাচনে অন্তত ১ শতাংশ ভোট পেতে হবে।
ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউয়ের দেশভিত্তিক র্যাঙ্কিং অনুযায়ী, অস্ট্রেলিয়া, সুইডেন, পর্তুগাল, নিউজিল্যান্ড, জার্মানি ও তুরস্কসহ বিশ্বে ৯৩টি দেশে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন হয়। দক্ষিণ এশিয়ার দেশ নেপাল মিশ্র পিআর পদ্ধতি ও শ্রীলঙ্কা পার্টি লিস্ট পদ্ধতি ব্যবহার করছে।
এদিকে, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিসহ (সিপিবি) নবগঠিত কয়েকটি বামপন্থী দল ও জোট সংসদে উচ্চকক্ষের প্রয়োজন নেই বলে মত দিয়েছে এবং পুরো সংসদে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন করার দাবি জানিয়েছে।
আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টিও বলেছে উচ্চকক্ষের প্রয়োজন নেই, তবে সংসদে পিআর পদ্ধতি প্রয়োজন।
অনেক দল এ বিষয়ে একমত হলেও এখনো পূর্ণ ঐক্যমত গড়ে ওঠেনি। অন্যদিকে, দেশের অন্যতম বৃহৎ দল বিএনপি প্রকাশ্যে এ পদ্ধতির বিরোধিতা করেছে।
বিতর্ক হচ্ছে, পিআর পদ্ধতি গ্রহণ করা উচিত কি না কিংবা বিকল্প কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, কেবল পিআর পদ্ধতি এলে কে বা কোন দল সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে?
স্বাধীনতার পর থেকে ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ১৯৭৩ ছাড়া কোনো দলই ৫০ শতাংশ ভোট পায়নি।
১৯৭৩ সালের নির্বাচনে ৭৩ দশমিক ২ শতাংশ ভোট নিয়ে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়। ১৯৭৯ সালে বিএনপি পায় ৪১ দশমিক ২ শতাংশ; ১৯৮৬ সালে জাতীয় পার্টি পায় ৪২ দশমিক ৩৪ শতাংশ; ১৯৯১ সালে বিএনপি পায় ৩০ দশমিক ৮১ শতাংশ; ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ পায় ৩৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ এবং ২০০১ সালে বিএনপি পায় ৪১ দশমিক ৪ শতাংশ ভোট।
২০০৮ সালে ৪৯ শতাংশ ভোট পেয়েও আওয়ামী লীগ ২৩০টি আসন জেতে কিন্তু ৩৩ দশমিক ২ শতাংশ ভোট পেয়েও বিএনপি পায় মাত্র ৩০টি আসন।
২০০৮ সালের পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে বিএনপি প্রায় ৯০টি আসন এবং আওয়ামী লীগ প্রায় ১৪৭টি আসন পেত।
পিআর পদ্ধতি থাকলে ১৯৭৩ সালের নির্বাচন ছাড়া অন্য কোনো নির্বাচনে কোনো দল এককভাবে সরকার গঠন করতে পারত না।
বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, বর্তমান রাজনৈতিক প্রবণতা ও ভোটারদের আচরণ পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায়, কোনো দলের পক্ষে এককভাবে সারাদেশে ৫০ শতাংশ ভোট পাওয়া ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে।
বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির আল্লামা মামুনুল হক বৈঠকে বলেন, গতানুগতিক নির্বাচন পদ্ধতি (এফপিটিপি) ও পিআর উভয়ের সীমাবদ্ধতা আছে। বাংলাদেশের জন্য মিক্সড মেম্বার প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (এমএমপিআর) একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও ন্যায়সঙ্গত মডেল।
এমএমপিআর পদ্ধতিতে প্রথমে ৩০০ আসনে গতানুগতিক পদ্ধতিতে ভোট হবে। এরপর পিআর পদ্ধতিতে প্রতিটি দলের মোট ভোটের হিসাব করা হবে। কোনো দলের প্রাপ্ত আসন ভোট অনুপাতে কম হলে বাড়তি আসন দিয়ে সমন্বয় করা হবে। যে দল অন্তত ১ শতাংশ ভোট পাবে, সে প্রতিনিধিত্বের যোগ্য হবে।
স্ট্রিমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এনসিপির যুগ্ম প্রধান সমন্বয়ক আরিফুর রহমান তুহিন বলেন, তাঁরা উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতি চান। তাঁরা মনে করেন, সংসদের উচ্চকক্ষ সাংবিধানিক বিষয় ও নাগরিকদের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে এমন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
অন্যদিকে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ড. আসাদুজ্জামান রিপন বলেছেন, পিআর পদ্ধতি তৃণমূল ভোটারদের অধিকার ক্ষুণ্ন করে।
আসাদুজ্জামান রিপন আরও বলেন, পিআর পদ্ধতি কখনোই প্রকৃত গণতান্ত্রিক কাঠামো তৈরি করে না। এ পদ্ধতি স্থানীয় ভোটারদের পছন্দের প্রার্থীকে সরাসরি ভোট দেওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। এটি গণতান্ত্রিক অধিকার লঙ্ঘন করে।
আসাদুজ্জামান রিপনের বক্তব্য বিএনপির প্রকাশ্য অবস্থানকে আরও স্পষ্ট করে।
চলতি মাসের ১৯ জুলাই সংবাদমাধ্যমে বিএনপির দলীয় সূত্র থেকে জানানো হয়, তারা সংসদের উচ্চকক্ষে প্রস্তাবিত পিআর পদ্ধতির বিষয়ে অন্য দলের সঙ্গে একমত হবে না। বিষয়টি চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হলে রাজনৈতিকভাবে তা মোকাবিলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি।
ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক শেখ ফজলুল করীম মারুফ স্ট্রিমকে বলেন, বর্তমান পদ্ধতিতে সংখ্যালঘুরা অনেক সময় সংখ্যাগরিষ্ঠের ওপর শাসন করে। আমরা এই পদ্ধতি পরিবর্তন করতে চাই। মাত্র ৪০ শতাংশ ভোট পেয়ে ২০০টির বেশি আসন জিতে যেকোনো দল একনায়কের শাসন প্রতিষ্ঠা করবে। যা গণতন্ত্রের নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তাই আমরা এর পরিবর্তন চাই।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক শর্তসাপেক্ষে এবং সমঝোতার ভিত্তিতে পিআর পদ্ধতির পক্ষে মত দিয়েছেন।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেছেন, তিনি পিআর পদ্ধতির পক্ষে, তবে বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় আগামী নির্বাচন বিদ্যমান পদ্ধতিতেই হওয়া উচিত।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞেরা বলেছেন, ছোট সমর্থনভিত্তিক দলগুলো সরকারি প্রতিনিধিত্ব পেতে লড়াই করছে। পিআর পদ্ধতি তাদের সংসদে প্রতিনিধিত্বের সুযোগ দেবে। আর কার্যকর জোট গঠন করলে তাদের অবস্থান আরও শক্তিশালী হতে পারে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. সুলতান মাহমুদ রানা স্ট্রিমকে বলেন, পিআর পদ্ধতি সেসব দেশে ভালো কাজ করে যেখানে পরিপক্ব রাজনৈতিক সংস্কৃতি, শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বিদ্যমান। বাংলাদেশের বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর পিআর পদ্ধতির পক্ষে ও বিপক্ষে বিভিন্ন বক্তব্য গণতন্ত্রের জন্য ভাল।
সুলতান মাহমুদ আরও বলেন, পিআর পদ্ধতিতে ভোটার তাদের পছন্দের ব্যক্তিকে সরাসরি নেতা হিসেবে বেছে নিতে পারে না, যা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বিরোধী। আবার গতানুগতিক নির্বাচন পদ্ধতিতে ছোট দলগুলো সংসদে সঠিক প্রতিনিধিত্ব পায় না, এটিও গণতন্ত্রের মূল্যবোধের বিরুদ্ধে। পিআর পদ্ধতি চালু হলে ছোট দলগুলো সংসদে আসার সুযোগ পাবে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক কে এম মহিউদ্দিন বলেন, এ ধরনের পদ্ধতি গ্রহণ করা হবে কি না, তা এখনো স্পষ্ট নয়। পিআর পদ্ধতি ছোট দলের জন্য সীমাবদ্ধতা থাকলেও জোট তাদের ভাগ্য বদলে দিতে পারে। একটি কার্যকর জোট ছোট দলের জন্য ভোটের হার বাড়াতে পারে। পিআর পদ্ধতি চালু হলে আরও বেশি জোটের গঠনের সম্ভবনা আছে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের চলমান সংলাপ পর্বে অংশ নিয়ে নারী প্রতিনিধিত্ব প্রসঙ্গে প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। দলটি বলেছে, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলো যেন সংরক্ষিত ৫০ আসনের বাইরে ৩০০টি সাধারণ আসনের অন্তত ৫ শতাংশে নারী প্রার্থী মনোনয়ন দেয়।
৩ ঘণ্টা আগেজামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, আগামী নির্বাচন হতে হবে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ। এর জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হবে। বিলম্বে নির্বাচন হলে জটিলতা তৈরি হতে পারে—এই অজুহাতে কোনো ‘প্রিম্যাচিউরড ডেলিভারি’ চান না তাঁরা।
৪ দিন আগেতিনি লেখেন, প্রাণহানির শিকার নিরীহ ব্যক্তিবর্গ এবং তাদের শোক-সন্তপ্ত পরিবারগুলোর পাশে আমাদের হৃদয়ের সকল অনুভূতি। বাংলাদেশকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে এবং প্রতিটি সঙ্কটকে সংহতি নিয়ে মোকাবিলা করতে হবে।
৫ দিন আগেসর্বস্তরের নেতা-কর্মীদের উদ্ধার কাজে সহায়তা, আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসায় সহযোগিতা এবং সংশ্লিষ্ট বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করার আহ্বানও জানিয়েছেন নাহিদ ইসলাম৷
৬ দিন আগে