leadT1ad

সংসদ থেকে ডাকসু-জাকসু: ‘বট বাহিনী’ কি ক্ষমতাবানদের নতুন হাতিয়ার

গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ শাসনামলের শেষ দিকে ‘বট আইডি’ হয়ে উঠেছিল অনলাইনে দলটির রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের ঘায়েলের অন্যতম হাতিয়ার। তাঁদের পতন হয়েছে, তবে জারি আছে বট আইডির উপদ্রব। কিন্তু বট আইডির কার্যক্রম এখন আর আওয়ামী লীগের পক্ষে সমর্থন জোগাতে ব্যবহার হচ্ছে না। বট আইডির সাম্প্রতিক ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, মূলত ইসলামী ছাত্রশিবির সংশ্লিষ্ট কিছুর সমালোচনা করলেই হানা দিচ্ছে বট আইডির আক্রমণ।

স্ট্রিম গ্রাফিক

‘বট’ হলো এমন একটি সফটওয়্যার প্রোগ্রাম বা অ্যাপ্লিকেশন, যা মানুষের পরিবর্তে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কোনো নির্দিষ্ট কাজ করতে পারে। ডিজিটাল এই যুগের কাজের সুবিধা অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের বটের উদ্ভব হয়েছে, তার মধ্যে— চ্যাটবট, ওয়েব ক্রলার, সোশ্যাল মিডিয়া বট, গেমিং বট প্রভৃতি ব্যাপক জনপ্রিয়। এরমধ্যে ‘বট আইডি’ বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া অ্যাকাউন্টে উপদ্রব বাংলাদেশের রাজনীতিতে কি ধীরে ধীরে একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে উঠেছে, সাম্প্রতিক নানান বাস্তবতায় এই প্রশ্ন এখন ভুক্তভোগীদের।

বিগত আওয়ামী লীগের শাসনামলেই ‘বট’ শব্দটির সঙ্গে এদেশের মানুষের পরিচয় ঘটে। বিশেষত ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে তৎকালীন শাসক দল একতরফাভাবে যে নির্বাচন করেছিল, সে সময় অনেক ভুয়া আইডি দিয়ে নির্বাচনের পক্ষে প্রচারণা চালানোর প্রমাণ পাওয়া যায়। তবে এই ‘বট’ শব্দটি আলোচনার কেন্দ্রে এসেছিল ২০১৬ সালে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়ান বটের হস্তক্ষেপের পর থেকে। বিবিসির তথ্য বলছে, মূলত ওই সময় থেকেই বট আইডি ব্যবহার করে নানা রকম হেনস্তামূলক কর্মকাণ্ড আলোচিত হয়ে আসছে।

বাংলাদেশে ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকে জাতীয় ও ছাত্র রাজনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে বট আইডি ইস্যু। দেশের রাজনীতিতে এখন বটের প্রভাব এতটাই যে অনেকেই বলছেন, বিভ্রান্তি সৃষ্টির ক্ষেত্রে বটের মতো ডিজিটাল শক্তি অনেক বড় হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে। বর্তমানে সেসব ঘটছেও। বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আসন্ন ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সক্রিয় হয়ে উঠেছে এসব ভুয়া বা বট আইডি। এসব আইডির উপদ্রবে অতিষ্ঠ হয়ে অনেক প্রার্থীর জীবন এখন বিভীষিকাময়। ডাকসুর সহ-সভাপতি পদের এক প্রার্থী তো বিষয়টি নিয়ে বৃহস্পতিবার (৪ সেপ্টেম্বর) তাঁর ভেরিফায়েড ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে বলেছেন, ‘আমার ডাকসুতে জিতা লাগবে না, কেবল বেঁচে থাকতে চাই।’

অন্যদিকে এই বট আইডির মাধ্যমে অপপ্রচার, সাইবার বুলিং এবং ‘ফেক পপুলারিট’ বা ভুয়া জনপ্রিয়তা তৈরি করে নির্বাচনী পরিবেশ দূষিত করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিভিন্ন প্যানেলের একাধিক প্রার্থী। তবে বট আইডির কারণে অনলাইনে বিশেষত আক্রমণের শিকার হচ্ছেন নারী প্রার্থীরা।

যেভাবে ‘বট’-এর উৎপত্তি

১৯৬৬ সাল। এমআইটির বিজ্ঞানী জোসেফ ওয়াইজেনবাউম ‘এলিজা’ নামে প্রথম একটি চ্যাটবট তৈরি করেন, যা মানুষের কথার প্রতিক্রিয়া দিতে পারত। সেই চ্যাটবট যে আজকে এমন বিশাল ‘বটবৃক্ষ’ হয়ে বট-সংস্কৃতির মাধ্যমে অনলাইনে ভুয়া বাস্তবতা তৈরিতে ভূমিকা রাখবে, তা কি স্বয়ং জোসেফ ওয়াইজেনবাউমও ভেবেছিলেন!

১৯৬৬ সালে ‘এলিজা’ নামে প্রথম চ্যাটবট তৈরি করেন এমআইটির বিজ্ঞানী জোসেফ ওয়াইজেনবাউম। সংগৃহীত ছবি
১৯৬৬ সালে ‘এলিজা’ নামে প্রথম চ্যাটবট তৈরি করেন এমআইটির বিজ্ঞানী জোসেফ ওয়াইজেনবাউম। সংগৃহীত ছবি

২০১৪ সালের ১১ মার্চ সিএনএন টেক-এ প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ‘ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব ওয়ান্ডারার’ নামে ১৯৯৩ সালে চালু হয় প্রথম ওয়েব বট। সাধারণত এই ওয়েবসাইটের বটগুলো স্ক্রিপ্ট দিয়ে চালিত হয়। চমকপ্রদ তথ্য হলো, একসঙ্গে এরা হাজার হাজার অ্যাকাউন্ট নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। পরে এই প্রক্রিয়া ‘বটনেট’ নামে সারা দুনিয়ায় পরিচিতি পেয়েছে।

তবে বিশ্ববব্যাপী স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তির প্রোগ্রাম হলেও বাংলাদেশে এই বট-সংস্কৃতির বাস্তবতা ভিন্ন। এখানে মূলত নির্দিষ্ট মতাদর্শ বা উদ্দেশ্যের ব্যক্তিদের দ্বারা চালিত ফেক আইডিই ‘বট আইডি’ নামে পরিচিতি পেয়েছে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বট আইডি বলতে আমরা সাধারণত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ভুয়া বা ফেক আইডিগুলোকেই বুঝে থাকি, যা শুধু ক্ষতিকর এবং মানুষকে হেনস্তার অস্ত্র হিসেবেই ব্যবহৃত হয়। কিন্তু পৃথিবীতে প্রথম যখন ‘বট’ শব্দটির আবির্ভাব ঘটেছিল, তখন এটি মজার এক প্রযুক্তি হিসেবেই চিহ্নিত হয়েছিল।

বট নিয়ে ২০১৯ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর বিবিসি এক গবেষণামূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বট’ শব্দটি এসেছে ‘রোবট’ থেকে। বট মূলত সফটওয়্যার দ্বারা পরিচালিত স্বয়ংক্রিয় একটি প্রোগ্রাম, যা পুনরাবৃত্তিমূলক কাজ করতে সক্ষম। এ প্রযুক্তি মূলত মানুষের আচরণ অনুকরণ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কমেন্ট, লাইক বা শেয়ারের কাজ করে।

সাইবার হামলা থেকে অপপ্রচার: সব খারাপ কাজেই বট

বটের কিছু ইতিবাচক প্রভাব থাকলেও দুনিয়াজুড়ে এই প্রযুক্তির নেতিবাচক ব্যবহার ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে। ২০১৮ সালের ২৬ এপ্রিল ক্যাসপারস্কি ল্যাবের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ‘ম্যালিশিয়াস বট’ নামের এক ধরনের বট সাইবার আক্রমণ ও তথ্য চুরিতে ব্যবহৃত হয়। রাজনৈতিক অঙ্গনেও এই বটের আধিপত্য এখন অনেক। বিভিন্ন দেশের রাজনীতিবিদদের ভুয়া জনপ্রিয়তা তৈরি করতে এই বটের জুড়ি নেই। না, এটা শুধু মুখের কথা নয়, বিশ্লেষণ আর পরিসংখ্যানও তা-ই বলছে।

২০২৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশি অনলাইন তথ্য যাচাই ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান ডিসমিসল্যাবের এক বিশ্লেষণে বলা হয়, বট আইডির মাধ্যমে কিছু ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতাদের পোস্টে হাজার হাজার লাইক ও কমেন্ট দিয়ে ভুয়া জনপ্রিয়তা দেখানো হয়। বাংলাদেশে যা এখন বিরাট এক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

‘ম্যালিশিয়াস বট’ নামের এক ধরনের বট সাইবার আক্রমণ ও তথ্য চুরিতে ব্যবহৃত হয়
‘ম্যালিশিয়াস বট’ নামের এক ধরনের বট সাইবার আক্রমণ ও তথ্য চুরিতে ব্যবহৃত হয়

বাংলাদেশি গণমাধ্যমের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এখানে বট আইডিগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ভিন্নমত দমনসহ নানা ধরনের অপপ্রচার, ভুয়া ছবি ও নারী হেনস্তার কাজে ব্যবহৃত হয়।

নির্বাচনী প্রেক্ষাপট

গণমাধ্যমে প্রকাশিত নানা প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগ একতরফাভবে যে জাতীয় নির্বাচন করেছিল, তাতে বটের প্রভাব ছিল গভীর। ২০২৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর তথ্য ব্যবস্থায় প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে কাজ করা ডিজিটালি রাইটের তথ্য যাচাই ও গবেষণা প্ল্যাটফর্ম ডিসমিসল্যাবের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ওই বছরের জানুয়ারি মাসে আওয়ামী লীগ যে নির্বাচন করেছিল, তার আশপাশের সময়ে দলটির সমর্থনে ১ হাজার ৩৬৯টি ফেসবুক প্রোফাইল নিয়ে সক্রিয় ছিল একটি বিশাল বট নেটওয়ার্ক। এই নেটওয়ার্ক ২১ হাজারের বেশি মন্তব্য পোস্ট করে আওয়ামী লীগকে সমর্থন এবং বিএনপির সমালোচনা করে। যদিও ওই নির্বাচনে বিএনপিসহ বেশির ভাগ দল অংশগ্রহণ করেনি।

এই অনুসন্ধান থেকে স্পষ্ট হয় বাংলাদেশের বট আইডিগুলোর প্রবণতাও। যার মধ্যে অন্যতম হলো, একই মন্তব্য শতাধিক প্রোফাইল থেকে পোস্ট করা।

ডিসমিসল্যাবের ওই বিশ্লেষণে উঠে আসে এক ভয়ংকর তথ্য। দেখা যায়, তাঁদের অনুসন্ধানে উঠে আসা বট আইডিগুলোর ৭৭ শতাংশ প্রোফাইলই নারীদের নামে তৈরি করা। মজার বিষয় হলো, অধিকাংশ বট আইডির প্রোফাইলেই দেখা যায় একই ব্যক্তির ছবি।

ডাকসু নির্বাচনে বট আইডির প্রভাব

আগামীকাল ৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) নির্বাচন। এ নির্বাচন কেন্দ্র করে প্রার্থীরা একাধিকবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘স্মিয়ার ক্যাম্পেইন’ বা প্রতিপক্ষের চরিত্র হননমূলক কার্যক্রমের শিকার হওয়ার অভিযোগ করেছেন। ডাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিশেষত নারী প্রার্থীদের টার্গেট করে বট আইডির মাধ্যমে তাঁদের চরিত্রহনন ও ‘বডি শেমিং’ করা হচ্ছে বলে সম্প্রতি গণমাধ্যমের একাধিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। গত এক সপ্তাহে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায়, স্বতন্ত্র ছাত্রজোট, প্রতিরোধ পর্ষদ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সংসদ, ছাত্রদল মনোনীত প্যানেলসহ স্বতন্ত্রভাবে দাঁড়ানো প্রার্থীরাও নানাভাবে হেনস্তার শিকার হচ্ছেন। তাসনিম আফরোজ ইমি, আবিদুল ইসলাম খান, উমামা ফাতেমা, আব্দুল কাদের, মেঘমল্লার বসু, ফারিয়া মতিন ইলাসহ নির্বাচনে অংশ নেওয়া অন্তত ২০ জন প্রার্থী বট আক্রমণের শিকার হয়ে বর্তমানে এর বিরুদ্ধে সরব অবস্থান নিয়েছেন।

সবশেষ ৪ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার এক ফেসবুক প্রতিক্রিয়ায় বট আইডির উপদ্রব ও তার প্রভাব নিয়ে ডাকসু নির্বাচনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সংসদের পক্ষ থেকে সহ-সভাপতি পদপ্রার্থী আব্দুল কাদের ফেসবুকে এক প্রতিক্রিয়ায় লেখেন, ‘আমার ডাকসুতে জেতা লাগবে না, কেবল বেঁচে থাকতে চাই। এতটুকু দয়া অন্তত আমাকে দেখানোর অনুরোধ। সেই রাজাকার নিয়ে কথা বলার পর থেকেই যে শুরু হইছে, প্রতিনিয়ত সেটা আরও বাড়তেছে। তারপর থেকেই আমি ঘুমাতে পারি না, মাঝরাতে জেগে যাই, শরীর কাঁপতে থাকতে। একটা মানুষকে নিয়ে আর কত করবেন? মানুষের কতটুকুও বা ধৈর্য ক্ষমতা থাকে, আমি আর কত দিন নিতে পারব জানি না। কেবল অনলাইনে এই হেনস্তাটা আমার পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকলেও মানা যাইত, বাড়িতে গিয়ে আমার আম্মাকে পর্যন্ত কথা শোনাচ্ছেন!’

বট আইডির আরেক ভুক্তভোগী প্রতিরোধ পর্ষদ থেকে ডাকসু নির্বাচনে সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্পাদক পদপ্রার্থী ফারিয়া মতিন। তিনি স্ট্রিমকে বলেন, ২০২৩ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে মঙ্গল শোভাযাত্রায় প্ল্যাকার্ড নিয়ে নামায় বট আইডির গণহারের রিপোর্টের কারণে আমার ফেসবুক আইডি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এদিকে এখন যখনই আমি নির্দিষ্ট একটা আদর্শের বিরুদ্ধে কিছু বলছি, সঙ্গে সঙ্গে বট আইডিগুলো আমাকে স্লাটশেমিং করছে, বডি শেমিং করছে, নানা ধরনের কটূ কথা বলছে। কোনো যৌক্তিক সমালোচনার বদলে বুলিং করতেছে।

ফারিয়া আরও বলেন, ডাকসু নির্বাচন কেন্দ্র করে এই আক্রমণ অনেক বেশি বেড়ে গেছে। শিবিরের আদর্শ-বিরোধী কথা বললেই লাগাতার আমার সব পোস্টে বট আইডির ‘হাহা’ রিয়্যাক্টের বন্যা বয়ে যায়।

এই বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ইসলামী ছাত্র শিবিরের সভাপতি ও ডাকসু নির্বাচনে জিএস পদপ্রার্থী এস এম ফরহাদের সঙ্গে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সাড়া পাওয়া যায়নি। ৬ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় তাঁকে ক্ষুদেবার্তা পাঠানো হলেও এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি ফরহাদের পক্ষ থেকে।

‘ডাকসু নির্বাচন কেন্দ্র করে এই আক্রমণ অনেক বেশি বেড়ে গেছে। শিবিরের আদর্শ-বিরোধী কথা বললেই লাগাতার আমার সব পোস্টে বট আইডির ‘হাহা’ রিয়্যাক্টের বন্যা বয়ে যায়।’

একই চিত্র জাকসু নির্বাচনেও

এদিকে দীর্ঘ ৩৩ বছর পর চলতি বছরের ১১ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (জাকসু) নির্বাচন। সেখানকার প্রার্থীদেরও একই অভিযোগ, বট আইডির মাধ্যমে ছড়ানো অপতথ্য দিয়ে সাইবার বুলিং করা হচ্ছে প্রতিপক্ষের প্রার্থীদের। বিগত এক সপ্তাহের গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করেও এর সত্যতা মিলেছে।

ছাত্রদলের প্যানেল থেকে জাকসু নির্বাচনে সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদপ্রার্থী তানজিলা হোসাইন বৈশাখী স্ট্রিমকে বলেন, ‘আমরা তো আসলে জানি বট অ্যাটাকগুলো কারা করে, কোন অর্গানাইজেশন করে। কয়েকদিন আগে এক টকশো’তে, বট আক্রমণ ও নারী নারী নিরাপত্তা ইস্যুতে ওই অর্গানাইজেশনকে লক্ষ্য করে আমি কিছু প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিলাম। ওই টকশোর পরেই ফেসবুকে আমার বিরুদ্ধে বট অ্যাটাক শুরু হয়। আমার পোস্টগুলোতে ফেক আইডি থেকে অজস্র ‘হাহা’ রিয়্যাক্ট পড়তে থাকে।

সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ৪৯তম আবর্তনের শিক্ষার্থী বৈশাখী আরও বলেন, ওই বট আইডিগুলোতে একটা মজার বিষয় খেয়াল করি। বেশিরভাগ আইডিতেই শেখ মুজিবের ছবি ও মুজিবের আদর্শের বয়ান লক্ষ করা যায়। কিন্তু আইডিগুলো আচরণ দেখলেই বোঝা যায়, সেগুলো লীগের না। আগে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কিছু বললে যেই আইডিগুলো বট অ্যাটাক করতো, এখন অন্য একটা অর্গানাইজেশন বা রাজনৈতিক আদর্শের বিরুদ্ধে বললে ওই আইডিগুলোই অ্যাটাক করছে।

এছাড়াও বৈশাখী বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়েও যখনই নারীদের সমস্যা দিয়ে বা কোনো প্রোগ্রেসিভ বিষয়ে কথা কথা বলেছি, তখনও বট অ্যাটাকের শিকার হয়েছি। কিন্তু আমার মনে হয় আওয়ামী লীগের পতনের পর এই গ্রুপটা খুবই অর্গানাইজড হয়ে গেছে। এরা যে শুধু রাজনৈতিক নারীদের আক্রমণ করছে এমনটা নয়। যেকোনো নারী যখন নিজেকে এক্সপ্রেস করছে, তাঁদেরই আক্রমণ করছে বট বাহিনী। এটা আগের চেয়ে অনেক বেশি বেড়ে গেছে।

জাকসুর আরেক প্রার্থী ৫১ তম আবর্তনের নাটক ও নাট্যকল বিভাগের শিক্ষার্থী সোহাগী সাইমাও তুলে ধরেন বট বিড়ম্বনার কথা।

জাকসু নির্বাচনে সংশপ্তক পর্ষদ থেকে সহ-সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী সোহাগী স্ট্রিমকে বলেন, আওয়ামী লীগের আমলে আমরা বট বাহিনী দেখিনি। তখন অনলাইনেরর চেয়ে অফলাইনেই বেশি প্রোপাগান্ডা তৈরি করা হতো ক্ষমতাসীনদের পক্ষে। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় (২০১৮ সালের আগস্টে) আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওয়াবায়দুল কাদের নিজে সংবাদমাধ্যমে আমাকে নিয়ে অপতথ্য প্রচার করেছেন। তখন ছাত্রলীগের পরিচালিত নানান পেজ থেকে আমাকে লাগাতার হেনস্তা করা হয়েছে। তবে এখন আক্রমণের ধরন পাল্টেছে। এখন যেসব পেজ বা আইডি থেকে হেনস্তা করার চেষ্টা করা হয়, সেগুলো বট আইডি বা ফেক আইডি।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) ভবন। সংগৃহীত ছবি
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) ভবন। সংগৃহীত ছবি

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ছাত্রনেতা আরও বলেন, যেকোনো ইস্যুতে পোস্ট করলেই এসব বট আইডি আক্রমণ করে না। যখন আমি শিবির সম্পর্কিত, মৌলবাদ সম্পর্কিত বা উগ্রপন্থীদের নিয়ে কিছু পোস্ট করি, তখনই বট আইডিগুলো আক্রমণ করে। কিংবা যেদিনই আমরা শিবিরের বিরুদ্ধে কোনো কর্মসূচী করি, এরপর টানা চার-পাঁচদিন বট আইডির আক্রমণ চলে। শুধু আমি না, যেসব সাধারণ শিক্ষার্থী আমার পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছে, তাঁদেরও বট আইডি থেকে হেনস্তা করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ (বাগছাস) সমর্থিত প্যানেলের সাধারণ সম্পাদক (জিএস) প্রার্থী আবু তৌহিদ মোহাম্মদ সিয়াম স্ট্রিমকে বলেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যত আন্দোলন হয়েছে, সব আন্দোলনে নারীরা সামনের সাড়িতে থাকার পরেও সাইবার স্পেসে কোনো কমফোর্ট জোন না পাওয়ায় অনেকগুলো পদে, বিশেষ করে হল সংসদে অনেকক্ষেত্রে একজন প্রার্থীও দাঁড়ায়নি। ব্যাপারটা খুবই হতাশাজনক এবং সারা বাংলাদেশের জন্যই লজ্জাজনক। যেই বিশ্ববিদ্যালয় নারীদের জন্য সবচেয়ে বড় কমফোর্ট জোন, সেই বিশ্ববিদ্যালয়েই নারীরা সামনে আসার সাহস পাচ্ছে না।

৪৯তম আবর্তনের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের এই শিক্ষার্থী স্ট্রিমকে বলেন, আমরা দেখি সবসময় একটা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধেই অভিযোগটা যায়। কারণ যেসব আইডি মুহুরমুহ বট অ্যাটাক দেয়, সেসব আইডির ভেতরে লেখা থাকে ‘সাদিক কায়েমকে ভালোবাসি’ বা ‘জামায়াতের আমিরকে ভালোবাসি’। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের দিকেই সন্দেহটা যায় যে, তাঁরা সবচেয়ে বড় বটফোর্স নিয়ন্ত্রণ করে। যদিও ওই সংগঠনের লোকজন বলে এগুলো তাঁদের দায় না। কিন্তু তাঁরা তো তাঁদের কমিটিই প্রকাশ করে না। তাঁদের বেশিরভাগ কর্মী অপ্রকাশিত থাকে, ফলে তাঁদের খুব সহজ এটা ডিনাই করা।

এ অভিযোগের বিষয়ে কথা হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামি ছাত্র শিবিরের দপ্তর ও প্রচার সম্পাদক এবং জাকসু নির্বাচনে শিবির সমর্থিত সমন্বিত শিক্ষার্থীজোট প্যানেল থেকে সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী মোহাম্মদ মাজহারুল ইসলামের সঙ্গে। ৪৮তম আবর্তনের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী মাজহারুল পাল্টা অভিযোগ করে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের যখন প্যানেল ঘোষণা হল, তখন আমাদের নারী প্রার্থীকে ইঙ্গিত করে বট এবং রিয়েল আইডি দিয়ে কুরুচিপূর্ণ কমেন্ট ও অসম্মানজনক কমেন্ট করা হয়েছে।

মাজহারুল আরও বলেন, আমরা আমাদের জায়গায় খুবই ট্রান্সপারেন্ট, আমরা এই জায়গাগুলোতে প্রশাসনের স্টেপ চাই। বট আইডির পেছনে আইডেন্টিটি আসলে কার সেটা আসলে কখনও প্রমাণিত না। যেকেউ যেকারো কেমোফ্লাজ করতেই পারে। আমরা চাই এই জিনিসগুলো কনক্লুশনে আসুক। এই জিনিসগুলো রাষ্ট্রীয়ভাবে ফাইন্ড আউট হোক।

আওয়ামী লীগ সরকারের সময়েও যখনই নারীদের সমস্যা দিয়ে বা কোনো প্রোগ্রেসিভ বিষয়ে কথা কথা বলেছি, তখনও বট অ্যাটাকের শিকার হয়েছি। কিন্তু আমার মনে হয় আওয়ামী লীগের পতনের পর এই গ্রুপটা খুবই অর্গানাইজড হয়ে গেছে। এরা যে শুধু রাজনৈতিক নারীদের আক্রমণ করছে এমনটা নয়। যেকোনো নারী যখন নিজেকে এক্সপ্রেস করছে, তাঁদেরই আক্রমণ করছে বট বাহিনী।

সংশ্লিষ্টরা যা বলছেন

বট আইডির গতি প্রকৃতি ও ভয়াবহতা নিয়ে কথা হয় বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক ফ্যাক্ট-চেকিং নেটওয়ার্ক (আইএফসিএন) স্বীকৃত ফ্যাক্ট-চেকিং প্রতিষ্ঠান ফ্যাক্টওয়াচের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ড. সুমন রহমানের সঙ্গে।

অনলাইনে তথ্য প্রবাহ ও তথ্য যাচাই বিশেষজ্ঞ সুমন রহমান জানান, বট আইডি পরিচালনার জন্য রয়েছে অবকাঠামো, অর্থায়ন ও পরিকল্পনা। বট আইডির নেটওয়ার্ক মূলত নির্বাচনের মতো ইভেন্টগুলোর আগে খুব সক্রিয় হয়ে উঠে। এদের উদ্দেশ্য সাধারণত রাজনৈতিক বিপরীত মতকে দমন করা এবং সাইবার জগতে জনসাধারণের চিন্তাকে প্রভাবিত করা।

তিনি জানান, গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমাচ্যুত আওয়ামী লীগের আমলে অনলাইনে ব্যাপক নজরদারী ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বা সাইবার সিকিউরিটি আইনের কারণে বট নেটওয়ার্ক কিছুটা কম সক্রিয় ছিল। আইনগুলো সমস্যাজনক ছিল। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আইনগুলো সংশোধন করলেও এর তেমন প্রয়োগ দেখা যায় না, তাই বট আইডির পরিচালকরা নির্ভয়ে মানুষকে হেনস্তার কাজে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারছে।

এদিকে গত ১ সেপ্টেম্বর ডাকসু নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে ৩ সদস্যের একটি দল বিটিআরসির চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করেন। ওই সভায় সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রোপাগান্ডা, চরিত্রহনন এবং যৌন হয়রানিমূলক প্রচারণাগুলো বন্ধের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয় এবং এ ধরনের প্রচারণা বন্ধের বিষয়ে সম্ভাব্য সকল ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যাপারে বিটিআরসির পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে আশ্বস্ত করা হয়।

বিটিআরসি মূলত কী ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে এবং বট আইডি শনাক্ত করে সেগুলো বন্ধ করার ব্যাপারে বিটিআরসির অগ্রতি কতটা তা জানতে যোগাযোগ করা হয় বিটিআরসি-এর মিডিয়া কমিউনিকেশন উইংয়ের সঙ্গে। মিডিয়া উইংয়ের উপ-পরিচালক মো. জাকির হোসেন খাঁনের সঙ্গে ৬ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা থেকে ৭ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা পর্যন্ত একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন (পিসিএসডব্লিউ) এর তথ্যমতে, সংস্থাটি ২০২৪ সালেই ৯ হাজারের বেশি হয়রানির অভিযোগ পেয়েছে। অথচ এই সংখ্যাই আসল চিত্রের সামান্য অংশ। অধিকাংশ ঘটনা কোনো আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থায় পৌঁছায়ই না। অনেক নারী অভিযোগ করেন না—কারও ভয় প্রতিশোধের, কারও আবার আর কোনো ন্যায়বিচারের প্রত্যাশাই নেই।

এসব তথ্য আর বিশ্লেষণ বলছে, যে ‘বট’ একসময় মানুষের মজা ও কৌতূহলের বিষয় ছিল, এখন সেটি খোদ গণতন্ত্রের জন্যই চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে।

Ad 300x250
সর্বাধিক পঠিত

সম্পর্কিত