leadT1ad

কেমন গেল ডাকসু–জাকসুর প্রথম মাস

স্ট্রিম প্রতিবেদক
স্ট্রিম প্রতিবেদক
ঢাকা
স্ট্রিম কোলাজ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জাকসু) নির্বাচনের এক মাসেরও বেশি সময় অতিবাহিত হয়েছে। শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশার মধ্যে দায়িত্ব নেওয়া নবনির্বাচিত কমিটিগুলোর এই সময়ের কর্মকাণ্ডে প্রশংসিত উদ্যোগের পাশাপাশি সমালোচিত ও বিতর্কিত কিছু ঘটনাও ঘটেছে। কেউ এখতিয়ারবহির্ভূত কাজের অভিযোগে সমালোচিত, আবার কেউ অভিযোগ করছেন, প্রশাসনের তেমন সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না। বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি নির্ধারিত কক্ষও।

ডাকসু: বিতর্ক যেন নিত্যসঙ্গী

গত ৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচনে ২৮টির মধ্যে ২৩টি পদে জয় পায় শিবির সমর্থিত ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের প্রার্থীরা। ১১ সেপ্টেম্বর উপাচার্য ও ডাকসুর সভাপতি নিয়াজ আহমদ খান নবনির্বাচিতদের কাছে দায়িত্বগ্রহণের চিঠি পাঠান। পরে ১৪ সেপ্টেম্বর কার্যনির্বাহী পরিষদের প্রথম সভার মাধ্যমে নতুন কমিটি আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরু করে।

দায়িত্ব গ্রহণের পর বেশ কিছু উদ্যোগের কারণে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে আসেন ডাকসু ও হল সংসদের নেতারা।

ডাকসু ভবনের জন্য শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি) কেনার উদ্যোগের খবর প্রকাশিত হলে সাধারণ শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের মধ্যে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়। তাঁরা বলেন, শিক্ষার্থীদের আবাসন, পরিবহন বা খাবারের মানের মতো মৌলিক সমস্যাগুলোর সমাধান না করে এসি কেনা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অগ্রাধিকার নিয়ে প্রশ্ন তোলে।

গত ৮ অক্টোবর নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে দেওয়া এক স্ট্যাটাসে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের (বাগছাস) ঢাবি শাখার আহ্বায়ক আব্দুল কাদের বলেন, ‘বাস্তবতার আলোকে ডাকসু নেতাদের থেকে এমন বিলাসিতা অপ্রত্যাশিত। সেই জায়গায় কোনোপ্রকার নিয়মের তোয়াক্কা না করে, কোষাধ্যক্ষকে ডিঙ্গিয়ে, নিজে বারবার ফোন দিয়ে প্রেশারাইজ করা আরও অ্যালার্মিং। যেটা উনিশের ডাকসুতে ছাত্রলীগ চাইলেও লীগের তাবেদারী করা প্রশাসন অনুমোদন দেয়নি, সেটা পঁচিশে এসে নিরপেক্ষ প্রশাসন ফোন কল পেয়েই চাপে পড়ে দিয়ে দিলেন!’

বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৯-২০ সেশনের শিক্ষার্থী জুনায়েত রাসেল স্ট্রিমকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের তো আরও অনেক সমস্যা আছে। আবাসন সমস্যা, শ্রেণিকক্ষ সংকট, গবেষণা সেন্টারে বরাদ্দের অভাব। সাধারণ শিক্ষার্থীদের সমস্যার শেষ নাই। সেখানে ডাকসু নেতাদের অফিসে এসি বসানো আমার কাছে বিলাসিতা মনে হচ্ছে।’

গত ৭ অক্টোবর শহীদ আবরার ফাহাদ স্মরণে ‘ভারতীয় আধিপত্যবাদ ও বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব: স্মরণে শহীদ আবরার ফাহাদ’ শীর্ষক এক সেমিনার আয়োজন করে ডাকসু। এতে অতিথি হিসেবে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন আবরার ফাহাদের ভাই আবরার ফাইয়াজ, ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি সিরাজুল ইসলাম, ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদী, ইউনাইটেড পিপল (আপ) বাংলাদেশের প্রধান সমন্বয়ক রাফে সালমান, জবান পত্রিকার সম্পাদক রেজাউল করিম রনি, মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আব্দুর রব প্রমুখ। তবে আমন্ত্রিত হলেও অনুষ্ঠানে উপস্থিত হননি জাতীয় নাগরিক পার্টির সদস্যসচিব আখতার হোসেন।

এই অনুষ্ঠানের অতিথিদের নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। জাতীয় নাগরিক পার্টির যুগ্ন সদস্যসচিব (দপ্তর) সালেহ উদ্দিন সিফাত এক ফেসবুক পোস্টে লেখেন, ‘৭ই অক্টোবর আধিপত্যবাদবিরোধী দিবস উপলক্ষে সেমিনার আয়োজন করেছে ডাকসু। ভালো উদ্যোগ। কিন্তু তাঁদের বক্তা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদী সময়ের আধিপত্যবিরোধী অগ্রগামী সৈনিকদের সম্পূর্ণ আড়াল করে দিয়েছে এবং কেবল নিজেদের রাজনৈতিক বন্ধুদের সামনে এনেছে।’

এ বিষয়ে বাগছাসের আব্দুল কাদের স্ট্রিমকে বলেন, ‘আমাদের মনে রাখতে হবে, ডাকসু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সর্বজনীন প্লাটফর্ম। সুতরাং ডাকসুর পক্ষ থেকে যদি কোনো আয়োজন হয়ে থাকে তাহলে সেখানে সব পক্ষের সমান অন্তর্ভুক্তি থাকা প্রয়োজন। অথচ শহীদ আবরার ফাহাদের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ডাকসু যে আয়োজন করেছে, তাতে কয়েকজন ব্যতীত সবাই ইসলামি ছাত্র শিবিরের বন্ধুপ্রতিম সংগঠনের ব্যক্তিবর্গ।’

এ ছাড়া সম্প্রতি মুহসীন হলের নবনির্বাচিত ভিপি ছাদিক হোসেন সিকদারের নামে হলে ১০০ খাট স্থাপনের খবর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তবে হল প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. সিরাজুল ইসলাম জানান, বিষয়টি ওই ছাত্রনেতার নয়, বরং হল প্রশাসনের উদ্যোগে সম্পন্ন হয়েছে। ডাকসুর আগেই এই তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছিল।

আবার সূর্যসেন হলের ক্যাফেটেরিয়ায় খাবারে টেস্টিং সল্ট ব্যবহার ও কর্মীর হাফ প্যান্ট পরার অভিযোগে হলের ক্যাফেটেরিয়াকে তিন হাজার টাকা জরিমানা করেন ভিপি আজিজুল হক। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমেদ বলেন, ছাত্র সংসদের এই ধরনের প্রশাসনিক ক্ষমতা নেই।

তবে এগুলো ছাড়াও ‘শরৎ উৎসব’ আয়োজন, শিক্ষকদের চলমান আন্দোলনে সংহতি জানানো, বাসের লাইভ ট্র্যাকার অ্যাপের পরীক্ষামূলক কার্যক্রমসহ বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেন ডাকসু নেতারা।

গত এক মাসে ডাকসুর কাজ ও নানা বিতর্ক নিয়ে এর নির্বাহী সদস্য রায়হান উদ্দীনের সঙ্গে কথা হয় স্ট্রিমের। গত এক মাসে কাজের মূল্যায়ন করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘কিছু কাজ হয়েছে পলিসিগত জায়গায়, কিছু কাজ হয়েছে সরাসরি স্টুডেন্টদের লাইফস্টাইল ইমপ্রুভমেন্টের জায়গায়। এক মাস তো আসলে খুব কম সময় ছিল। কম সময় বলতে, আমরা নির্বাচন হওয়ার প্রায় ২০ দিনের মধ্যে আসলে ডাকসুতে বসতেই পারি নাই ঠিকঠাক। কারণ, রুম রেডি ছিল না। সে জন্য আমাদের কাজের শুরুর দিকে সংকট তৈরি হয়েছিল। তো সব মিলিয়ে এক মাসে আমরা আলহামদুলিল্লাহ, আমাদের এক্সপেক্টেশন যেগুলো ছিল সেগুলো ফিলাপ করতে পেরেছি। যে কাজগুলো পেন্ডিং ছিল, সেগুলো অলরেডি হচ্ছে আরকি।’

তাঁদের বিভিন্ন কাজ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। এ প্রসঙ্গে রায়হান বলেন, ‘বিতর্ককে আমরা সব সময় ওয়েলকাম করি। কারণ, বিতর্ক যেকোনো প্ল্যাটফর্মের জন্য চালিকাশক্তি। আর যে বিতর্কগুলো রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, সেগুলো স্টুডেন্টদের কাছে ক্লিয়ার। আর যে বিতর্কগুলো আসলেই বিতর্ক, মানে আমাদেরকে প্রশ্ন করার মতো, ডাকসুকে জবাবদিহির আওতায় নিয়ে আসার মতো, সে প্রশ্নগুলোকে আমাদের ভিপি থেকে শুরু করে সবাই ওয়েলকাম করেছে। যেগুলোর যৌক্তিক জবাব আমাদের কাছে ছিল, সেগুলো জবাব দেয়ার চেষ্টা করছি। যেখানে আমাদের ভুল মনে হয়েছে, সেখানে আমরা শুধরানোর চেষ্টা করছি।’

জাকসু: কক্ষের অভাবে কাজ করতে পারছেন না নির্বাচিতরা

অন্যদিকে প্রায় ৩৩ বছর পর অনুষ্ঠিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) শুরু থেকেই একটি বড় ধরনের সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ১১ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলসহ কয়েকটি প্যানেল ভোট বর্জনের ঘোষণা দেয়। ভোট গণনা চলাকালে দুজন নির্বাচন কমিশনার অনিয়মের অভিযোগ তুলে পদত্যাগ করলে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন আরও ঘনীভূত হয়।

এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এখন পর্যন্ত নবনির্বাচিত কমিটিকে কক্ষ বুঝিয়ে দেয়নি। এর ফলে দায়িত্ব পালনে সমন্বয়হীনতা দেখা দিচ্ছে বলে মত প্রার্থীদের। তা ছাড়া, প্রশাসনের পক্ষ থেকে খুব একটা সহযোগিতা পাচ্ছেন না বলেও অভিযোগ তাঁদের।

জাকসুর সাধারণ সম্পাদক মো. মাজহারুল ইসলাম স্ট্রিমকে বলেন, ‘জাকসুর এক মাস পেরিয়ে গেলেও মূলত আমাদের অফিসটা আমাদের জন্য ভালোভাবে প্রস্তুত করিয়ে দেওয়া হয়নি। যেটার কারণে আমাদের সার্বিক সমন্বয়হীনতার একটা জায়গা দেখা গিয়েছে। এ ছাড়া আমরা ক্যাম্পাসের বড় বড় কিছু সমস্যা নিয়ে সরাসরি কাজ করতে চেয়েছিলাম। এর মধ্যে রয়েছে অটোমেশন, ইন্টারনেট এবং মেডিকেল সমস্যা। এই জায়গাগুলোতে আমরা সরাসরি কিছু অনুসন্ধান করেছি, কয়েক জায়গায় অনেক কিছু বের করে প্রশাসনের সহায়তা চেয়েছি। এই জায়গায় প্রশাসনের ত্বরিত বাস্তবায়নে একটু গাফিলতি দেখা গিয়েছে। প্রশাসন আরও আন্তরিক হলে আমাদের এই কাজগুলো আরেকটু এগিয়ে যেত।’

ইতিহাস বিভাগের ৫২তম আবর্তনের শিক্ষার্থী তাহফীজ মো. মাশরাফি স্ট্রিমকে বলেন, ‘জাকসুর পর সবারই একটা আশা ছিল যে এতদিন ধরে ক্যাম্পাসে যে সমস্যাগুলো তাঁরা ফেস করছিল, সেগুলোর সমাধান হবে। তবে যথাযথভাবে দায়িত্ব বুঝিয়ে না দেওয়ায় এখনো আশানুরূপ কোনো পদক্ষেপ আমরা দেখতে পাইনি। যেমন, আমাদের ক্যাম্পাসে এখন সবচেয়ে বড় হলো পরিবহন সমস্যা। আমরা ভেবেছিলাম জাকসুর পর এটার সমাধান হবে। কিন্তু এখনো তা হয়নি।’

মাশরাফি আরও বলেন, ‘ক্যাম্পাসে অটোমেশন নেই। যেটা জাকসুর পর চালু হবে বলে ভেবেছিলাম। আমাদের একটা পরীক্ষার ফরম জমা দিতে গেলে প্রশাসনিক ভবন থেকে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অফিস অনেক দৌড়াদৌড়ি করতে হয়। অটোমেশন চালু হলে এ সমস্যাটা থাকত না। জাকসুর প্রার্থীদের দায়িত্বগুলো সময় মতো বুঝিয়ে দেওয়া হলে, আমার মনে হয়, অনেক ক্ষেত্রেই একটা পরিবর্তন দেখতে পেতাম।’

নির্বাচিত প্রতিনিধিরা এখতিয়ারবহির্ভূত কোনো কাজ করছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে মাশরাফি বলেন, ‘আমি এমন কিছু দেখিনি। বরং তাঁরা ভালো কিছু কাজ করেছে। আর তাঁদের এখতিয়ারে যে কাজগুলো আছে, যেগুলো না করায় তাঁদের নিয়ে সমালোচনা হতে পারে, সেগুলো আমার মনে হয়, দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলে তাঁরা শুরু করবে।’

উভয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা আশা করেছিলেন, নবনির্বাচিত ছাত্র সংসদগুলো তাদের দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত সমস্যা, যেমন—আবাসন সংকট, খাবারের নিম্নমান, পরিবহন সমস্যা, গ্রন্থাগারের সীমাবদ্ধতা ও নিরাপদ ক্যাম্পাস নিশ্চিত করার মতো বিষয়গুলোতে মনোযোগ দেবে। তবে এক মাসের কর্মকাণ্ড পর্যালোচনায় দেখা যায়, কমিটিগুলো প্রশংসনীয় কিছু উদ্যোগ নিলেও অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক বিতর্কই তাদের যাত্রাপথকে বেশি প্রভাবিত করছে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত