leadT1ad

নিউইয়র্কে পুলিশ কর্মকর্তা হত্যা

বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত দিদারুলের হত্যাকারী কে এই শেন তামুরা, কেন করেছিলেন হামলা

বন্দুক সহিংসতা পর্যবেক্ষণকারী অলাভজনক সংস্থা ‘গান ভায়োলেন্স আর্কাইভ’-এর তথ্য অনুযায়ী, এ হামলা চলতি বছরে যুক্তরাষ্ট্রে ২৫৪তম ভিড়ের মধ্যে এলোমেলো গুলির (ম্যাস শুটিং) ঘটনা।

স্ট্রিম ডেস্ক
প্রকাশ : ০২ আগস্ট ২০২৫, ১৬: ৫০
আপডেট : ০২ আগস্ট ২০২৫, ১৮: ৪৮
পার্ক অ্যাভিনিউয়ে হামলাকারী শেন ডেভন তামুরা। ছবি: সংগৃহীত

যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় গত সোমবার (২৯ জুলাই) সন্ধ্যায় নিউইয়র্ক শহরের পার্ক অ্যাভিনিউয়ে এক বন্দুকধারীর গুলিতে চারজন নিহত হন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত নিউইয়র্ক পুলিশের সদস্য দিদারুল ইসলামও (৩৬) ছিলেন।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বরাত দিয়ে ওই সময় মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন জানায়, হামলার পর সন্দেহভাজন বন্দুকধারী আত্মহত্যা করেছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে।

স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৭টার দিকে পুলিশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সবাইকে পার্ক অ্যাভিনিউ ও ইস্ট ৫১তম স্ট্রিট এলাকা এড়িয়ে চলার আহ্বান জানায়।

৩৪৫ পার্ক অ্যাভিনিউয়ের ওই ভবনে ন্যাশনাল ফুটবল লিগ (এনএফএল), ইনভেস্টমেন্ট ফার্ম ব্ল্যাকস্টোন, রুডিন ম্যানেজমেন্ট কার্যালয় ও জেপি মরগান চেজের করপোরেট অফিস রয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা বার্তাসংস্থা এএফপিকে জানান, আবাসন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রুডিন ম্যানেজমেন্টের কার্যালয়ে হামলা হয়েছে।

বন্দুক সহিংসতা পর্যবেক্ষণকারী অলাভজনক সংস্থা ‘গান ভায়োলেন্স আর্কাইভ’-এর তথ্য অনুযায়ী, এ হামলা চলতি বছরে যুক্তরাষ্ট্রে ২৫৪তম ভিড়ের মধ্যে এলোমেলো গুলির (ম্যাস শুটিং) ঘটনা।

দিদারুলকে নিউইয়র্ক পুলিশের শ্রদ্ধা। ফেসবুক থেকে নেওয়া ছবি
দিদারুলকে নিউইয়র্ক পুলিশের শ্রদ্ধা। ফেসবুক থেকে নেওয়া ছবি

প্রাথমিক তদন্তে যা জানা গেল

স্থানীয় সময় ৩০ জুলাই পুলিশ জানায়, দেহরক্ষী বর্ম (বডি আর্মর) পরে পার্ক অ্যাভিনিউয়ের রুডিন ম্যানেজমেন্টের কার্যালয়ে হামলাকারী ব্যক্তির নাম শেন ডেভন তামুরা।

হামলার পরপরই শেন তামুরা ঘটনাস্থলেই আত্মহত্যা করেন। পুলিশ তাঁর পকেট থেকে হাতে লেখা নোট উদ্ধার করে।

নোটে তামুরা উল্লেখ করেন, তিনি ‘ক্রনিক ট্রম্যাটিক এনসেফালোপ্যাথি (সিটিই)’ রোগে ভুগছিলেন।

সিটিই হলো অ্যালঝাইমারের মতো মস্তিষ্কের রোগ, যা দীর্ঘদিন মাথায় আঘাতের ফলে হতে পারে। সিএনএন জানিয়েছে, এ রোগ সাধারণত আমেরিকান ফুটবল খেলোয়াড়দের মধ্যে বেশি দেখা যায়।

নোটে তামুরা যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ফুটবল লিগের (এনএফএল) বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন, এনএফএল নিজের জনপ্রিয়তা টিকিয়ে রাখতে খেলোয়াড়দের মস্তিষ্কের অসুখের কথা গোপন রাখে।

তবে এবিসি নিউজ জানিয়েছে, তামুরা কখনো এনএফএলে খেলেননি। ক্যালিফোর্নিয়ার একটি হাইস্কুলে পড়াকালীন আমেরিকান ফুটবল খেলতেন তিনি।

পাশাপাশি পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে তামুরা সত্যিই সিটিইতে ভুগছিলেন কিনা, এর কোনো প্রমাণ মেলেনি। চিকিৎসকদের মতে, মৃত ব্যক্তির ক্ষেত্রে সিটিই নিশ্চিতভাবে শনাক্ত করা সম্ভব নয়।

তামুরার গাড়ি তল্লাশি করে অতিরিক্ত গুলি, একটি রিভলভার, একটি ব্যাকপ্যাক ও ওষুধপত্র উদ্ধার করেছে পুলিশ।

পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, শেন তামুরা হর্সশু লাস ভেগাসে নজরদারি বিভাগের কাজে থাকা অবস্থায় নিজের সুপারভাইজারের কাছ থেকে রাইফেল ও গাড়ি কিনেছিলেন। ওই সুপারভাইজার বৈধভাবে এআর-১৫ ধরনের রাইফেলটি কিনেছিলেন। পরে তিনি সেটি তামুরাকে ১ হাজার ৪০০ ডলারে বিক্রি করেন। এ বিক্রয় আইনসিদ্ধ ছিল কি না, তা এখনো স্পষ্ট নয়। পুলিশ সুপারভাইজারের পরিচয় প্রকাশ করেনি। তারা বলেছে, তিনি তদন্তে সহযোগিতা করছেন এবং তার বিরুদ্ধে কোনো অপরাধের অভিযোগ আনা হয়নি।

অফিস ভবনের বাইরে বন্দুক হাতে শেন তামুরা। ছবি: সিসিটিভি ফুটেজ থেকে পাওয়া
অফিস ভবনের বাইরে বন্দুক হাতে শেন তামুরা। ছবি: সিসিটিভি ফুটেজ থেকে পাওয়া

স্থানীয় সময় গত সোমবার (২৯ জুলাই) নিউইয়র্কের মেয়র এরিক অ্যাডামস জানান, প্রাথমিক তদন্তে ধারণা করা হচ্ছে শেন তামুরা লিফট ব্যবহারে ভুলের কারণে এনএফএল সদর দপ্তরের পরিবর্তে রুডিন ম্যানেজমেন্টে চলে গিয়েছিল।

পুলিশের সূত্রে বিবিসি জানিয়েছে, এর আগে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার কারণে দু’বার শেন তামুরাকে আটকে রাখা হয়েছিল।

কি ঘটেছিল সেদিন

পুলিশ কমিশনার টিশ জানান, সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, শেন তামুরা সন্ধ্যা ৬টা ৩০ মিনিটের কিছু আগে একটি বিএমডব্লিউ গাড়ি থেকে নেমে এম-৪ রাইফেল হাতে নিয়ে পাবলিক প্লাজা পেরিয়ে ৩৪৫ পার্ক অ্যাভিনিউ ভবনে প্রবেশ করে।

এরপর তিনি গুলি চালানো শুরু করেন এবং তাঁর গুলিতে করপোরেট নিরাপত্তা দায়িত্বে থাকা এক পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হন। গুলি বর্ষণের সময় লবিতে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করা এক নারীকে লক্ষ্য করেও গুলি চালান তামুরা।

তারপর নিরাপত্তা ডেস্কে থাকা এক গার্ডকে গুলি করে এবং লবিতে থাকা আরেক ব্যক্তিকেও গুলি করে।

পরে তামুরা লিফটে চেপে রুডিন ম্যানেজমেন্টের ৩৩তম তলার অফিসে পৌঁছে সেখানে একজনকে গুলি করে হত্যা করেন।

রক্তক্ষয়ী এই ঘটনা শেষে শেন তামুরা নিজ বুকে গুলি চালিয়ে আত্মহত্যা করেন।

সোমবার (২৯ জুলাই) বিকেলে ২৭ বছর ধরে ৩৪৫ পার্ক অ্যাভিনিউয়ে পরিচ্ছন্নতাকর্মী সেবিয়ে নেলোভিচ আরও একটি স্বাভাবিক দিনের মতো নিজের কাজ শুরু করেন। শিফট শুরুর দুই ঘণ্টা পর, যখন তিনি ৩৩তম তলায় কাজ করছিলেন, তখন গুলির শব্দ শুনতে পান। সংবাদমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এই লোমহর্ষক ঘটনার বর্ণনা করেন ৬৫ বছর বয়সী নারী।

ঘটনাস্থলে পুলিশের কড়া পাহারা। ছবি: রয়টার্স
ঘটনাস্থলে পুলিশের কড়া পাহারা। ছবি: রয়টার্স

৩৩তম তলায় গুলির শব্দ শোনার পর তিনি পরিষ্কারের কাজ বাদ দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে রিসেপশনের পাশের কাচের দরজার দিকে এগোন। হঠাৎ কাচের দরজাটা কাঁপতে শুরু করে এবং ভেঙে পড়ে। শেন তামুরা তাঁর দিকে বন্দুক তাক করলে তিনি চিৎকার করে বলেন, আমি পরিচ্ছন্নতাকর্মী। আমি পরিচ্ছন্নতাকর্মী। তামুরা তাঁর আশপাশে গুলি চালাতে শুরু করেন। নেলোভিচ দৌড়াতে শুরু করেন। একটি আলমারি খুঁজে পান এবং তার ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেন।

আলমারির ভেতরে লুকিয়ে থাকা অবস্থায় নেলোভিচ তাঁর সুপারভাইজারকে টেক্সট করেছিলেন, কিন্তু কোনো প্রকার শব্দে তাঁর অবস্থান ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয়ে ফোন বন্ধ করে দেন। দুই থেকে তিন ঘণ্টা তিনি নিস্তব্ধতায় বসে প্রার্থনা করছিলেন শুধু।

কে এই শেন তামুরা

২৭ বছর বয়সী শেন তামুরা লাস ভেগাসে বসবাস করতেন এবং সেখানের একটি ক্যাসিনোতে কাজ করতেন।

লাস ভেগাসের পুলিশ বিভাগ তামুরাকে গোপন অস্ত্র বহনের অনুমতিপত্র দিয়েছিল। এ ছাড়া, নেভাডা প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটরস লাইসেন্সিং বোর্ডের পক্ষ থেকে তামুরাকে একটি ওয়ার্ক কার্ড দেওয়া হয়েছিল। এবিসি নিউজ জানিয়েছে, তামুরার সর্বশেষ ঠিকানা ছিল লাস ভেগাসের একটি গেটেড কমিউনিটিতে।

হর্সশু হোটেল ও ক্যাসিনোর মুখপাত্র মঙ্গলবার (৩০ জুলাই) জানিয়েছেন, তামুরা লাস ভেগাসের ওই প্রতিষ্ঠানের নজরদারি বিভাগে কর্মরত ছিলেন।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বরাত দিয়ে ওই সময় মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন জানায়, হামলার পর সন্দেহভাজন বন্দুকধারী আত্মহত্যা করেছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে।

এক স্কুল কর্মকর্তার বরাতে নিউইয়র্ক টাইমস জানায়, শেন তামুরা লস অ্যাঞ্জেলেসে হাইস্কুল সম্পন্ন করেছিলেন। সেখানে তামুরা প্রতিযোগিতামূলক ফুটবল খেলতেন। তামুরার সাবেক সহপাঠী ক্যালেব ক্লার্ক জানান, তামুরা ছিলেন ‘বোকা’ ধরনের মানুষ। তবে তাঁর কখনো মনে হয়নি তামুরা মানসিকভাবে অসুস্থ।

তামুরা হাইস্কুল জীবনের এক পর্যায়ে গ্রানাডা হিলস চার্টারে রানিং ব্যাক হিসেবে খেলেছেন।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক কর্মকর্তার বরাতে জানা গেছে, তামুরার বাবা টেরেন্স তামুরা লস অ্যাঞ্জেলেস পুলিশ ডিপার্টমেন্টে (এলএপিডি) ১৮ বছর কর্মরত ছিলেন। ওই কর্মকর্তা আরও জানিয়েছেন, টেরেন্স তামুরা এলএপিডি থেকে অবসর নিয়ে পরে লাস ভেগাসে চলে যান।

শেন তামুরা সেখানে তাঁর বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকতেন।

কি আছে তামুরার সুইসাইড নোটে

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক সূত্র জানিয়েছে, তামুরার অ্যাপার্টমেন্ট তল্লাশির সময় মা ও বাবার জন্য রেখে যাওয়া একটি আত্মহত্যার নোট খুঁজে পান তদন্তকারীরা। নোটে লেখা ছিল: ‘মা, আমি যখন তোমার আর বাবার চোখের দিকে তাকাই, কেবল হতাশা দেখি। আমি তোমাকে ভালোবাসি, মা। আমি দুঃখিত।’

হামলার পর আত্মহত্যা করা তামুরার ওয়ালেটে তিন পৃষ্ঠার একটি নোট পাওয়া গেছে। পুলিশের প্রকাশিত নোটে লেখা ছিল: ‘টেরি লং ফুটবল আমাকে সিটিই দিয়েছে। আমাকে এক গ্যালন অ্যান্টিফ্রিজ খেতে বাধ্য করেছে। তুমি এনএফএল (আমেরিকার ন্যাশনাল ফুটবল লিগ)-এর বিরুদ্ধে যেতে পারো না, ওরা তোমাকে গুঁড়িয়ে দেবে।’

টেরি লং পিটসবার্গ স্টিলার্সের সাবেক খেলোয়াড় ছিলেন। টেরি লংও সিটিইতে আক্রান্ত হয়ে ২০০৫ সালে আত্মহত্যা করেন।

তামুরার চিরকুটে আরও লেখা ছিল, ‘আমার মস্তিষ্কটা গবেষণা করো প্লিজ, আমি দুঃখিত। রিককে বলে দিও আমি সবকিছুর জন্য দুঃখিত।’

পুলিশ জানিয়েছে, ওয়ালেটে পাওয়া নোটে সুপারভাইজারের প্রতি ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন শেন তামুরা।

২৭ বছর বয়সী শেন তামুরা লাস ভেগাসে বসবাস করতেন এবং সেখানের একটি ক্যাসিনোতে কাজ করতেন। লাস ভেগাসের পুলিশ বিভাগ তামুরাকে গোপন অস্ত্র বহনের অনুমতিপত্র দিয়েছিল। এ ছাড়া, নেভাডা প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটরস লাইসেন্সিং বোর্ডের পক্ষ থেকে তামুরাকে একটি ওয়ার্ক কার্ড দেওয়া হয়েছিল।

গার্ড অব অনার জানিয়ে দিদারুলকে নিউইয়র্ক পুলিশের বিদায়

স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার (৩১ জুলাই) নিউইয়র্কের ম্যানহাটনে শেন তামুরার গুলিতে নিহত মার্কিন পুলিশ সদস্য বাংলাদেশি অভিবাসী দিদারুল ইসলামের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। শোক-শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় দিদারুল ইসলামকে শেষবিদায় জানিয়েছেন হাজারো মানুষ।

মার্কিন সংবাদমাধ্যম ইউএসএ টুডে জানায়, নিউইয়র্ক পুলিশ বিভাগ (এনওয়াইপিডি) অফিসার দিদারুলকে ‘গার্ড অব অনার’ প্রদান করেছে।

নিউইয়র্কের গভর্নর ক্যাথি হোকুল এক বিবৃতিতে বলেছেন, দিদারুল ইসলাম ছিলেন একজন দায়িত্বশীল স্বামী, পিতা ও নিবেদিতপ্রাণ কর্মকর্তা।

নিউইয়র্ক সিটির পুলিশ কমিশনার জেসিকা টিশ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘নিজের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে চূড়ান্ত ত্যাগ স্বীকার করেছেন দিদারুল। তিনি একজন বীর।’

নিউইয়র্ক সিটির মেয়র এরিক অ্যাডামস বলেন, ‘আমি এখানে মেয়র হিসেবে নই, একজন অভিভাবক হিসেবে, একজন পিতা হিসেবে এসেছি। একজন পিতার জন্য সন্তানকে কবর দেওয়ার চেয়ে দুঃখজনক আর কিছু হতে পারে না।’

তথ্যসূত্র: এবিসি নিউজ, সিএনএন, দ্য গার্ডিয়ান, রয়টার্স, এপি, এএফপি

Ad 300x250

সম্পর্কিত