leadT1ad

সমুদ্রের গভীরে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের নতুন প্রতিযোগিতা

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক
ঢাকা

বিশ্বের দুই পরাশক্তির মধ্যে শুরু হয়েছে এক নতুন ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা। ছবি: সংগৃহীত।

প্রশান্ত মহাসাগরের গভীরে, সমুদ্রতলজুড়ে ছড়িয়ে আছে বাদামী ও কালো রঙের শিলাখণ্ড। এই শিলাগুলোকে বলা হয় পলিমেটালিক নডিউলস। এতে এমন গুরুত্বপূর্ণ ধাতব উপাদান রয়েছে যা নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন ও আধুনিক শিল্পের ভবিষ্যৎ গঠনে ব্যবহৃত হতে পারে।

হাওয়াই ও নিউজিল্যান্ডের মাঝামাঝি অবস্থিত কুক দ্বীপপুঞ্জে বর্তমানে গবেষণা জাহাজগুলো সমুদ্রতলের মানচিত্র তৈরি করছে। এখানেই যুক্তরাষ্ট্র ও চীন উভয় দেশ সম্পদের সম্ভাবনা যাচাই করছে—ফলে বিশ্বের দুই পরাশক্তির মধ্যে শুরু হয়েছে এক নতুন ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা।

টেরা গ্লোবাল ইনসাইটসের বিশ্লেষক জোসেলিন ট্রেইনার বলেন, দুটি দেশই প্রভাব বিস্তারে প্রতিযোগিতায় নেমেছে। প্রশান্ত মহাসাগরের তলদেশ এখন কেবল খনিজ সম্পদের ভান্ডার নয়। এটি হয়ে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে নতুন এক ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার মঞ্চ।

গভীর সমুদ্রের আকর্ষণ কেন বাড়ছে

কোবাল্ট, নিকেল ও ম্যাঙ্গানিজসহ গুরুত্বপূর্ণ খনিজের চাহিদা দ্রুত বাড়ছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি, প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিকাশে এসব উপাদান অপরিহার্য। স্থলভাগে খনিজের মজুত কমে আসছে এবং বাজারের বড় অংশ চীনের নিয়ন্ত্রণে থাকায় এখন দৃষ্টি যাচ্ছে সমুদ্রের নিচে।

তবে এখনো পর্যন্ত বাণিজ্যিকভাবে গভীর সমুদ্র খনন কোথাও শুরু হয়নি। পরিবেশগত ক্ষতির আশঙ্কায় বিষয়টি বিতর্কিত। অন্তত ৩৮টি দেশ এর ওপর নিষেধাজ্ঞা বা স্থগিতাদেশ চেয়েছে।

তবুও, বিশ্বের অন্যতম খনিজসমৃদ্ধ অঞ্চল হিসেবে প্রশান্ত মহাসাগর এখন নজরে এসেছে। কুক দ্বীপপুঞ্জের সমুদ্রসীমা প্রশান্ত মহাসাগরের বৃহত্তমগুলোর একটি। দেশটি এখনো সমুদ্রতল খনন অনুমোদন দেয়নি, তবে সম্ভাব্য বাণিজ্যিক উন্নয়ন নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছে। সরকার জানিয়েছে, বৈজ্ঞানিক মূল্যায়ন স্পষ্ট না হওয়া পর্যন্ত তারা খনন শুরু করবে না।

সমুদ্রের মাঝে কুক দ্বীপপুঞ্জের অবস্থান।
সমুদ্রের মাঝে কুক দ্বীপপুঞ্জের অবস্থান।

যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপ

এই বছরের এপ্রিলে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গভীর সমুদ্র খনন বাড়াতে একটি বিতর্কিত নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেন।

অক্টোবর মাসে একটি মার্কিন গবেষণা জাহাজ কুক দ্বীপপুঞ্জের সমুদ্রতলের মানচিত্র তৈরি ও তথ্য সংগ্রহ করছে। যুক্তরাষ্ট্র ২ লাখ ৫০ হাজার ডলার প্রযুক্তিগত সহায়তা দেবে, যা স্থানীয় সক্ষমতা বৃদ্ধি ও বিনিয়োগ আকর্ষণে ব্যবহার হবে।

মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর জানায়, প্রশান্ত মহাসাগরে ‘দায়িত্বশীল খনন ও বৈজ্ঞানিক গবেষণা অগ্রসর করতে’ তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

চীনের পরিকল্পনা

চীনও একই পথে এগোচ্ছে। এ বছর বেইজিং কুক দ্বীপপুঞ্জের সঙ্গে সমুদ্রতল সম্পদ উন্নয়ন ও গবেষণা বিষয়ে একটি চুক্তি করেছে। দুটি সরকার মিলে একটি ‘যৌথ কমিটি’ গঠন করবে এই কার্যক্রম তদারকি করতে।

চীন বর্তমানে আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমায় সবচেয়ে বেশি অনুসন্ধান লাইসেন্সধারী দেশ। তারা প্রশান্ত মহাসাগরের আরেক দ্বীপরাষ্ট্র কিরিবাতির সঙ্গেও অংশীদারত্বের কথা বিবেচনা করছে।

কুক দ্বীপপুঞ্জ তিনটি কোম্পানিকে অনুসন্ধান লাইসেন্স দিয়েছে—এর মধ্যে দুটি মার্কিন এবং একটি দেশীয় প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন। চীন সরকার এ বিষয়ে বিস্তারিত মন্তব্য করেনি।

কুক দ্বীপপুঞ্জ ছাড়াও হাওয়াই ও মেক্সিকোর মাঝের ক্ল্যারিয়ন-ক্লিপারটন অঞ্চল খনিজসমৃদ্ধ সমুদ্রতল হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ।

বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীরা সতর্ক করেছেন যে গভীর সমুদ্র খনন শুরু হলে তা সমুদ্রের প্রতিবেশ ব্যবস্থায় ভয়াবহ ক্ষতি আনতে পারে।

সম্ভাব্য প্রভাবের মধ্যে রয়েছে ক্ষতিকর শব্দ, কম্পন, পলির মেঘ, ও আলোক দূষণ—যা সামুদ্রিক প্রাণবৈচিত্র্যের জন্য দীর্ঘমেয়াদি হুমকি হতে পারে।

পলিমেটালিক নোডিউলগুলোতে কোবাল্ট, নিকেল এবং ম্যাঙ্গানিজের মতো কাঙ্ক্ষিত ধাতু থাকে। ছবি: সংগৃহীত।
পলিমেটালিক নোডিউলগুলোতে কোবাল্ট, নিকেল এবং ম্যাঙ্গানিজের মতো কাঙ্ক্ষিত ধাতু থাকে। ছবি: সংগৃহীত।

নাজুক সামুদ্রিক পরিবেশ নিয়ে উদ্বেগ

ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মহাসাগরবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ডগলাস ম্যাকাউলি সতর্ক করেছেন, গভীর সমুদ্র খননের প্রতিযোগিতা বাড়লে তা নাজুক সামুদ্রিক পরিবেশের জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠতে পারে।

তাঁর মতে, প্রস্তাবিত খনন কার্যক্রম পৃথিবীর সবচেয়ে ভঙ্গুর ও কম সহনশীল সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রে ঘটবে। তিনি বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন বর্জ্য পানির প্রভাব নিয়ে, যা খনিজ আহরণের পর সমুদ্রে ফেলা হবে।

কুক দ্বীপপুঞ্জের সঙ্গে চীনের চুক্তিতে বলা হয়েছে, তারা ‘আন্তর্জাতিক আইনের চেতনা এবং জাতিসংঘের ল অব দ্য সি কনভেনশনের নীতিমালা’ অনুসরণ করবে। এই কনভেনশন বিশ্ব সমুদ্রের ব্যবহার ও সম্পদ সুরক্ষার আইনি কাঠামো নির্ধারণ করে।

তবে যুক্তরাষ্ট্র এই কনভেনশনের সদস্য নয়। চীনসহ অনেক দেশ প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমালোচনা করেছে। কারণ তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক জলসীমায় সমুদ্রতল খনন দ্রুত এগিয়ে নিতে নির্দেশ দিয়েছেন। যদিও দেশটি এই আন্তর্জাতিক চুক্তির অংশ নয়।

ম্যাকাউলি সতর্ক করে বলেছেন, গুরুত্বপূর্ণ খনিজের ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা নিয়ন্ত্রণহীন শোষণের এক নতুন যুগের দ্বার খুলে দিতে পারে। তাঁর ভাষায়, এটি ‘একটি বিপজ্জনক পান্ডোরার বাক্স খোলার মতো।’

কুক দ্বীপপুঞ্জের রারোটোঙ্গা দ্বীপ। ছবি: সংগৃহীত।
কুক দ্বীপপুঞ্জের রারোটোঙ্গা দ্বীপ। ছবি: সংগৃহীত।

কুক দ্বীপপুঞ্জে মিশ্র প্রতিক্রিয়া

স্থানীয় পর্যায়ে গভীর সমুদ্র খনন নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন এটি দেশের সমুদ্রের জন্য ক্ষতিকর, আবার অন্যরা মনে করেন এটি নিরাপদভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথ হতে পারে।

কুক দ্বীপপুঞ্জের সিবেড মিনারেল অথরিটি-র কর্মকর্তা এডওয়ার্ড হারম্যান জানান, দেশটি বর্তমানে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কেবল সামুদ্রিক গবেষণায় সহযোগিতা করছে। যাতে তাদের নিজস্ব সমুদ্রসম্পর্কে বৈজ্ঞানিক ধারণা বাড়ানো যায়।

অন্যদিকে, কুক দ্বীপপুঞ্জের পরিবেশ সংগঠন টে ইপুকারিয়া সোসাইটি-র পরিচালক আলানা মাতামারু স্মিথ স্বাধীন তত্ত্বাবধানের দাবি জানিয়েছেন। তিনি বলেন, গবেষণা কার্যক্রম মূলত সেই একই বিদেশি কোম্পানি ও পরাশক্তিরা পরিচালনা করছে, যারা ভবিষ্যতে সমুদ্রতল খনন থেকে মুনাফা অর্জন করতে চায়।

স্মিথের মতে, ‘শেষ পর্যন্ত গবেষণার নিয়ন্ত্রণ রয়ে গেছে খনন কোম্পানির হাতে, যারা আবার চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের তথ্যের ওপর নির্ভর করছে।’

তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘বিশ্বের এই দুই পরাশক্তি যখন চারপাশে ঘিরে ফেলছে, তখন আমাদের মতো ছোট দেশের কণ্ঠস্বর হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা বাড়ছে।’

তার ভাষায়, ‘তারা বিশ্বের মহাশক্তি, আর আমরা ছোট্ট কুক দ্বীপপুঞ্জ।’

সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান

Ad 300x250

সম্পর্কিত