leadT1ad

ভেনেজুয়েলা ‘দাসত্বের শান্তি’ মেনে নেবে না: নিকোলাস মাদুরো

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক
ঢাকা

সোমবার (১ ডিসেম্বর, ২০২৫) রাজধানী কারাকাসে এক সমাবেশে ভেনেজুয়েলার রাষ্ট্রপতি নিকোলাস মাদুরো তার হাত দিয়ে হৃদয়ের আকৃতি তৈরি করছেন। ছবি: সংগৃহীত।

ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো বলেছেন, তার দেশ কোনো ‘দাসত্বের শান্তি’ মেনে নেবে না। সোমবার রাজধানী কারাকাসে হাজারো সমর্থকের সমাবেশে ভাষণে তিনি এই ঘোষণা দেন। মাদুরো দেশে শান্তির আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করে জনগণের প্রতি ‘নিরঙ্কুশ আনুগত্য’ প্রদর্শনের প্রতিশ্রুতি দেন।

মাদুরো বলেন, ভেনেজুয়েলা শান্তি চায়। তবে সে শান্তি হবে ‘সার্বভৌমত্ব, সমতা ও স্বাধীনতার ভিত্তিতে’। তিনি ঘোষণা করেন, ‘আমরা দাসত্বের শান্তি চাই না। উপনিবেশের শান্তি চাই না। ভেনেজুয়েলা কখনো উপনিবেশ হবে না, কখনো দাস হবে না।’

তার এই বক্তব্য আসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বে চাপ বাড়ার প্রেক্ষাপটে। বিষয়টি দুই দেশের দীর্ঘদিনের উত্তেজনাকে আরও তীব্র করেছে। দেশটির বিরোধী দল, আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক ও যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ—মাদুরোর শাসন অবৈধ। অপরদিকে মাদুরো যুক্তরাষ্ট্র তার দেশের সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ণ করার চেষ্টা করছে বলে সমালোচনা করেন।

ট্রাম্প প্রশাসন সম্প্রতি ক্যারিবীয় এলাকায় সামরিক উপস্থিতি বাড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এ কার্যক্রমকে মাদকবিরোধী অভিযান বলে দাবি করছে। তবে কারাকাস বলছে, এটি মাদুরোকে সরানোর উদ্দেশ্যেই করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র সেখানে ১৫ হাজার সৈন্য মোতায়েন করেছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিমানবাহী রণতরিও পাঠিয়েছে। পাশাপাশি তারা কার্টেল দে লস সোলেসকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ ঘোষণা করেছে। এ গোষ্ঠীকে মাদুরো নেতৃত্ব দেন বলে যুক্তরাষ্ট্র দাবি করে। সেপ্টেম্বর থেকে যুক্তরাষ্ট্র ক্যারিবীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরে অন্তত ২১টি অভিযানে কথিত মাদকবাহী নৌকা ধ্বংস করেছে, যাতে ৮৩ জন নিহত হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অভিযানে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তি প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি। অন্যদিকে ভেনেজুয়েলার অভিযোগ, যুক্তরাষ্ট্র দেশের বিশাল প্রাকৃতিক সম্পদ, বিশেষত তেলের নিয়ন্ত্রণ নিতে মাদুরো সরকারকে সরাতে চাইছে। মাদুরো বলেন, যুক্তরাষ্ট্র তাদের বিরুদ্ধে ‘মানসিক সন্ত্রাস’ চালাচ্ছে। তিনি জানান, গত ২২ সপ্তাহে তারা এমন আক্রমণ সহ্য করেছেন, যা মানসিক সন্ত্রাসেরই সমতুল্য। এই সময় দেশের জনগণ দেশপ্রেম ও সহনশীলতার পরিচয় দিয়েছে।

এদিকে ট্রাম্প স্বীকার করেছেন যে তিনি মাদুরোর সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, কথোপকথন ‘ভাল বা খারাপ’ কোনোটাই হয়নি। রয়টার্সের খবরে বলা হয়, ২১ নভেম্বরের ওই সংক্ষিপ্ত কথোপকথনে ট্রাম্প মাদুরোকে নিরাপদে দেশ ছাড়ার প্রস্তাব দেন।

জবাবে মাদুরো জানান, তিনি দেশ ছাড়তে রাজি, তবে তার ও পরিবারের জন্য পূর্ণ আইনি দায়মুক্তি থাকতে হবে। তাকে ও আরও শতাধিক ভেনেজুয়েলান কর্মকর্তার ওপর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সব নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে হবে। এছাড়া আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে থাকা মামলাও বন্ধ করতে হবে।

কিন্তু ট্রাম্প তার বেশিরভাগ শর্ত প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি মাদুরোকে এক সপ্তাহ সময় দেন দেশ ছাড়ার জন্য। শুক্রবার সেই সময়সীমা শেষ হলে ট্রাম্প শনিবার থেকে ভেনেজুয়েলার আকাশসীমা বন্ধ ঘোষণা করেন। সোমবার ট্রাম্প তার নিরাপত্তা দলের সঙ্গেও বৈঠক করেন। এতে সামরিক পদক্ষেপের সম্ভাবনাও আলোচনায় ওঠে।

ট্রাম্পের আকাশসীমা বন্ধ ঘোষণার পর গুঞ্জন ছড়িয়েছিল যে মাদুরো দেশ ছেড়ে গেছেন। পরিস্থিতি ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য সেনা মোতায়েন নিয়ে ভেনেজুয়েলায় উদ্বেগ বাড়ছে। সীমান্ত দিয়ে যাতায়াতকারী সাধারণ মানুষ যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য হামলা নিয়ে উদ্বিগ্ন।

এদিকে ভেনেজুয়েলা দেশজুড়ে সেনা মোতায়েন করছে। রাজধানী কারাকাস, বিমানবন্দরগামী মহাসড়ক এবং উপকূলীয় এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী ভ্লাদিমির পাদ্রিনো লোপেজ সামরিক সরঞ্জাম প্রদর্শন করেছেন। এর মধ্যে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও যুদ্ধবিমান রয়েছে।

ভেনেজুয়েলার কিছু সূত্র জানায়, তাদের সামরিক সক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তুলনীয় নয়। তাই তারা ভিন্ন কৌশল বিবেচনা করছে। এর মধ্যে থাকতে পারে অনিয়মিত হামলা, নাশকতা, অপরাধী গোষ্ঠী, সরকারপন্থী শক্তি ও সম্ভাব্য গেরিলা গোষ্ঠীর সহায়তায় প্রতিরোধ অভিযান। লক্ষ্য হবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা। এতে দেশের মানুষ আরও উদ্বিগ্ন। অনেকে বলছেন, তারা মাদুরোর বিদায় চাইলেও ভয় পাচ্ছেন যে পরিস্থিতি সহিংসতায় গড়িয়ে পড়তে পারে।

মার্কিন প্রশাসন জানায়, তারা মাদুরোকে বৈধ প্রেসিডেন্ট হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না। সাম্প্রতিক নির্বাচনে মাদুরোর জয়কে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো ‘প্রহসন’ বলে উল্লেখ করেছে। স্বাধীন পর্যবেক্ষকরা জানিয়েছেন, নির্বাচনে বিরোধী দলই সুস্পষ্টভাবে জয়ী হয়েছিল।

মাদুরো ২০১৩ সালে হুগো শাভেজের মৃত্যুর পর ক্ষমতায় আসেন। তখন থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক টানাপোড়েনে রয়েছে। ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনে মাদুরোর বিজয়কে যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক মহল প্রশ্নবিদ্ধ বলে উল্লেখ করেছে। বিরোধী দল ও পর্যবেক্ষকরা এসব নির্বাচনকে কারচুপিপূর্ণ বলে দাবি করে। মাদুরো সরকারের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিরোধী দমন এবং অর্থনৈতিক সংকট বাড়ানোর অভিযোগও রয়েছে।

ট্রাম্প প্রশাসনের প্রথম মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্র ‘সর্বোচ্চ চাপ’ নীতি গ্রহণ করে। তেলের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে মাদুরোকে সরিয়ে বিরোধী নেতা হুয়ান গুইদোকে অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করার চেষ্টা চলে। বাইডেন আমলে উত্তেজনা কমলেও ২০২৫ সালে ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর তা আবার তীব্র হয়।

২০২৪ সালের নির্বাচনে বিরোধী প্রার্থী এদমুন্দো গনজালেস বিজয় দাবি করেন। তবে নির্বাচন কমিশন মাদুরোকে জয়ী ঘোষণা করে। এতে দেশে অস্থিরতা বাড়ে এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আরও কমে যায়। ২০২৫ সালে মাদুরো সরকারের দমন-পীড়ন গণগ্রেপ্তার থেকে সরে গিয়ে লক্ষ্যভিত্তিক অভিযানে রূপ নেয়।

ভেনেজুয়েলার বিরোধী দল যুক্তরাষ্ট্রের চাপকে ঘিরে বিভক্ত। বিরোধী নেতৃত্বে থাকা মারিয়া কোরিনা মাচাদোকে সমালোচনা করা হচ্ছে, কারণ তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপের পক্ষে বক্তব্য দিচ্ছেন। সমালোচকদের মতে, তিনি মাদুরোর হুমকিকে অতিরঞ্জিত করছেন। সাক্ষাৎকারগুলোতে মাচাদো বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপের ফলেই মাদুরোর পতন শিগগিরই ঘটবে। তবে বিরোধীদলে মতভেদ রয়েছে। কেউ যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ চান না, কারণ এতে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হতে পারে। আবার কেউ হস্তক্ষেপকে সমর্থন করছেন দীর্ঘদিনের দমন-পীড়নের কারণে। সাবেক অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট হুয়ান গুইদো যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যায়নের সঙ্গে একমত।

নভেম্বরের ফোনালাপটি ব্রাজিল, কাতার ও তুরস্কের মধ্যস্থতায় হয়। এটি পরিস্থিতি শান্ত করার বহুপাক্ষিক প্রচেষ্টার ইঙ্গিত দেয়। কোলোম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেত্রো কার্তাহেনাকে আলোচনার নিরপেক্ষ স্থান হিসেবে প্রস্তাব করেন। তবে এই অচলাবস্থা খোলা সংঘাতে রূপ নিতে পারে।

মাদুরোর কঠোর ভাষণ দেশে তার সমর্থন কিছুটা শক্তিশালী করছে। তবে দীর্ঘমেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের চাপ তাকে সমঝোতায় বাধ্য করতে পারে অথবা সরকারের ভেতরে ভাঙন সৃষ্টি করতে পারে। যদিও কূটনৈতিক পথ এখনো খোলা, পারস্পরিক অবিশ্বাস অগ্রগতিকে থামিয়ে রাখছে।

বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য তেলসম্পদের নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে সম্পর্কিত হতে পারে। অন্যদিকে মাদুরোর টিকে থাকার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে সামরিক বাহিনীর আনুগত্য এবং রাশিয়া, চীন ও ইরানের সমর্থন। ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি বোঝার জন্য ওপেকের প্রতিক্রিয়া এবং বিরোধী দলের ঐক্য গুরুত্বপূর্ণ সূচক হবে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত