leadT1ad

রাজনৈতিক নেতারা ‘নীতি পুলিশ’ হয়ে ওঠেন কেন

সেবাগ্রহীতাদের কাছ থেকে মাসুদের বিরুদ্ধে অভিযোগ শোনার পর সেতুমন্ত্রী বলেন, ‘মাসুদের সঙ্গে দেখা হলেই প্রায় আমি বলি, মাসুদ তুমি ভালো হয়ে যাও। কিন্তু সে এখনো পুরোপুরি ভালো হয়নি।’

স্ট্রিম ডেস্ক
প্রকাশ : ০১ অক্টোবর ২০২৫, ২৩: ৪৩
স্ট্রিম গ্রাফিক

শেখ হাসিনার শাসনামলে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের একটি মন্তব্য, ‘মাসুদ ভালো হয়ে যাও’, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক ‘ভাইরাল’ হয়। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে বিআরটিএর মিরপুর কার্যালয় পরিদর্শনে গিয়ে প্রতিষ্ঠানটির তৎকালীন উপপরিচালক মাসুদ আলমকে উদ্দেশ করে তিনি এই মন্তব্য করেছিলেন। সেবাগ্রহীতাদের কাছ থেকে মাসুদের বিরুদ্ধে অভিযোগ শোনার পর সেতুমন্ত্রী বলেন, ‘মাসুদের সঙ্গে দেখা হলেই প্রায় আমি বলি, মাসুদ তুমি ভালো হয়ে যাও। কিন্তু সে এখনো পুরোপুরি ভালো হয়নি।’

আপাতদৃষ্টিতে এই কথাগুলো দুর্নীতিবিরোধী একটি পদক্ষেপ মনে হতে পারে। কিন্তু একজন মন্ত্রী হিসেবে প্রশাসনিক অনিয়মের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিলেন না তিনি। এর পরিবর্তে জনসমক্ষে ও গণমাধ্যমের সামনে একজন কর্মকর্তাকে নিছক তিরস্কার করলেন। এতে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি হিসেবে তাঁর নিজের ভূমিকা পালন করা হলো না। অপর দিকে অনিয়মকে করা হলো হালকা।

এই রকম প্রক্রিয়া আরও বহু রকমে, বহু ধরনে এখন চারদিকে দেখা যাচ্ছে। নৈতিক খবরদারি থেকে সরাসরি ব্যক্তির নাগরিক পরিসরে ঘটছে অনুপ্রবেশের ঘটনা।

গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে মতপার্থক্য নিরসনের উপায় হলো আলোচনা, বিতর্ক এবং নির্বাচন—সহিংস হুমকি নয়। যখন রাজনৈতিক নেতারা প্রতিপক্ষকে নির্মূল করার ভাষা ব্যবহার করেন, তখন তা তাদের অনুসারীদের জন্যও সহিংস আচরণে লিপ্ত হতে বার্তা দেয়।

নারী অধিকার ইস্যুতে বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্যের বিস্তার

এই প্রবণতা যখন বিদ্বেষমূলক রূপ ধারণ করে, তখন তা আরও বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। চলতি বছর নারী অধিকার সংস্কার কমিশনের কিছু সুপারিশ নিয়ে হেফাজতে ইসলামসহ বিভিন্ন ইসলামপন্থী দল তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায়। কমিশন সুপারিশ করে বিয়ে, তালাক, উত্তরাধিকার ও ভরণপোষণে সব ধর্মের নারীদের জন্য সমান অধিকার নিশ্চিত করার। এর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয় হেফাজত।

এই প্রেক্ষাপটে আয়োজিত এক সমাবেশে নারী সংস্কার কমিশনের সদস্যদের প্রতি অবমাননাকর ও কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য দেন একাধিক বক্তা। যদিও মূলধারার গণমাধ্যমে সমাবেশে ব্যবহৃত 'বেশ্যা' শব্দটি সরাসরি উদ্ধৃত হয়নি, বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা ও নাগরিক সমাজ এই সমাবেশে নারী বিদ্বেষী এবং অবমাননাকর বক্তব্যের তীব্র নিন্দা জানায়। হেফাজতে ইসলামের মহাসমাবেশে জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহর মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের উপস্থিতি এই বিতর্ককে আরও উস্কে দেয়। হাসনাত আবদুল্লাহ নিজেও সমালোচনার মুখে পড়েন।

সহিংস ভাষা ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হুমকি

একইভাবে, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে সহিংস ভাষার ব্যবহারও বাড়ছে। ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরীফ ওসমান হাদী শাহবাগে তার এক বক্তব্যে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে উদ্দেশ্য করে যে অশালীন ভাষা ব্যবহার করেন, তা পত্রিকায় ছাপা যায় না।

গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে মতপার্থক্য নিরসনের উপায় হলো আলোচনা, বিতর্ক এবং নির্বাচন—সহিংস হুমকি নয়। যখন রাজনৈতিক নেতারা প্রতিপক্ষকে নির্মূল করার ভাষা ব্যবহার করেন, তখন তা তাদের অনুসারীদের জন্যও সহিংস আচরণে লিপ্ত হতে বার্তা দেয়। রাজনৈতিক ময়দান তখন হয়ে ওঠে অস্থিতিশীল।

জামায়াতের আরেক নেতা, ইসলামী বক্তা মুফতি আমির হামজা সম্প্রতি সমালোচনায় পড়েছেন। বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলে ‘বিদ্বেষপূর্ণ’, ‘ভুয়া’ মন্তব্য নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া ও তার বাইরে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হলে গণমাধ্যমে নিজেকে ‘সুস্থ নই’ বলে ক্ষমা চান তিনি। উল্লেখ্য, মুফতি আমির হামজা কুষ্টিয়া-৩ আসন থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতের প্রতিনিধিত্ব করবেন।

রাজনীতিতে সহিংসতাকে বৈধতা দেওয়ার প্রবণতা

এ বছর মে মাসের শেষদিকে জামায়াত নেতা এ টি এম আজহারের মুক্তির প্রতিবাদে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সামনে আন্দোলনরত একজন নারীকে প্রকাশ্যে লাথি মারেন আকাশ চৌধুরী নামের এক জামায়াত নেতা। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী সে সময় প্রাথমিকভাবে তাঁকে বহিষ্কার করে। আটকের কিছুদিন পর জামিন পান তিনি। জামিনে মুক্ত হওয়ার পর জামায়াতের কর্মীদের দ্বারা তাঁকে ফুল দিয়ে বরণ করার দৃশ্যও দেখা যায়।

জামায়াতের আরেক নেতা, ইসলামী বক্তা মুফতি আমির হামজা সম্প্রতি সমালোচনায় পড়েছেন। বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলে ‘বিদ্বেষপূর্ণ’, ‘ভুয়া’ মন্তব্য নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া ও তার বাইরে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হলে গণমাধ্যমে নিজেকে ‘সুস্থ নই’ বলে ক্ষমা চান তিনি। উল্লেখ্য, মুফতি আমির হামজা কুষ্টিয়া-৩ আসন থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতের প্রতিনিধিত্ব করবেন।

সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে লক্ষ্য করে হুমকি
এদিকে রাজনৈতিক নেতাদের লাগামহীন বক্তব্য দেশের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকেও ছাড়ছে না। গত ২৩ সেপ্টেম্বর জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতা সার্জিস আলম নির্বাচন কমিশনকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘এনসিপির মার্কা শাপলাই হতে হবে। অন্য কোনো অপশন নাই। নাহলে কোনো নির্বাচন কীভাবে হয় আর কে কীভাবে ক্ষমতায় গিয়ে মধু খাওয়ার স্বপ্ন দেখে, সেটা আমরাও দেখে নিব’।

এই বক্তব্য কেন বিপজ্জনক? কারণ নির্বাচন কমিশনের মতো একটি স্বাধীন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি এই বক্তব্য সরাসরি হুমকি। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরপেক্ষভাবে কাজ করার কথা। তাদের সিদ্ধান্তে সংক্ষুব্ধ হলে আইনি পথে প্রতিকার চাওয়ার সুযোগ রয়েছে। হুমকি কোনো গণতান্ত্রিক পদ্ধতি নয়।

সহিংসতায় উস্কানি দেওয়া, মানহানি করা, ঘৃণা ছড়ানো বা কোনো নাগরিকের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করা দণ্ডনীয় অপরাধ, এবং কোনো রাজনৈতিক নেতাই এই আইনের ঊর্ধ্বে নন। এরপরেই আসে সাংবিধানিক সীমারেখা।

ছাত্র রাজনীতিতে ক্ষমতার অপব্যবহার

এখতিয়ার লঙ্ঘনের এই সংস্কৃতি জাতীয় পর্যায় থেকে ছাত্র রাজনীতিতেও সংক্রমিত হয়েছে। গেল সপ্তাহে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্যসেন হলে নির্বাচিত একজন ছাত্রনেতা টেস্টিং সল্ট থাকায় ক্যান্টিন মালিককে ৩ হাজার টাকা জরিমানা করেন।

একজন ছাত্রনেতার দায়িত্ব শিক্ষার্থীদের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে যথাযথ কর্তৃপক্ষের (হল প্রশাসন) কাছে উপস্থাপন করা। নিজ হাতে আইন তুলে নেওয়া নয়। যখন কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নিজেদের নির্ধারিত ক্ষমতার বাইরে গিয়ে বিচারক বা আইন প্রয়োগকারীর ভূমিকা পালন করে, তখন তা সার্বিকভাবে আইনের শাসনকেই দুর্বল করে দেয়।

রাজনৈতিক বক্তব্যের সীমারেখা কোথায়?
ওপরের সব কটি ঘটনা প্রশ্ন তুলতে বাধ্য করে, রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্য ও কর্মকাণ্ডের প্রকৃত সীমারেখাটি কোথায়? গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মত প্রকাশের স্বাধীনতা একটি মৌলিক অধিকার। কিন্তু তা নিরঙ্কুশ নয়। এর প্রথম এবং সবচেয়ে মৌলিক সীমারেখাটি হলো দেশের আইন। সহিংসতায় উস্কানি দেওয়া, মানহানি করা, ঘৃণা ছড়ানো বা কোনো নাগরিকের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করা দণ্ডনীয় অপরাধ, এবং কোনো রাজনৈতিক নেতাই এই আইনের ঊর্ধ্বে নন। এরপরেই আসে সাংবিধানিক সীমারেখা। বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, সংসদসহ কোনো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে হেয় করা বা হুমকি দেওয়া সাংবিধানিক রীতিনীতির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। তৃতীয়ত, প্রত্যেক রাজনৈতিক পদের একটি নির্দিষ্ট এখতিয়ার বা কার্যপরিধি রয়েছে। সেই এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া বা শাস্তি আরোপ করা ক্ষমতার অপব্যবহার। রাজনৈতিক নেতারা সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তি। তাই তাদের আচরণ ও ভাষা সামাজিক শিষ্টাচারের মানদণ্ড নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

যদি নেতারা নিজের ভাষা ও আচরণে সংযম না দেখান, তবে অনুসারীরাও সহিংসতায় উদ্বুদ্ধ হবেন। আর দীর্ঘমেয়াদে তা সমাজকে বিভক্ত করবে এবং গণতন্ত্রকে দুর্বল করবে।

অদ্ভুত দ্বন্দ্বে বাংলাদেশ

মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা করতে গিয়ে আমরা কখনো কখনো লাগামহীন বক্তব্যকে বৈধতা দিচ্ছি। রাজনীতির ভাষা ক্রমেই শালীনতা হারাচ্ছে, সহিংস হুমকি ও কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য যেন রাজনৈতিক হাতিয়ার হয়ে উঠছে। এর ফলে শুধু রাজনৈতিক সংস্কৃতি নয়, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও আইনের শাসনও ঝুঁকির মুখে পড়ছে।

যদি নেতারা নিজের ভাষা ও আচরণে সংযম না দেখান, তবে অনুসারীরাও সহিংসতায় উদ্বুদ্ধ হবেন। আর দীর্ঘমেয়াদে তা সমাজকে বিভক্ত করবে এবং গণতন্ত্রকে দুর্বল করবে। তাই এখন জরুরি হলো রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে শালীনতার পথে ফিরিয়ে আনা, আইনের শাসনকে শক্তিশালী করা এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি সম্মান দেখানো। এই দায়িত্ব প্রথম পালনীয় দায়িত্বশীল রাজনৈতিক ব্যক্তিদের।

Ad 300x250

সম্পর্কিত