leadT1ad

সাবেক আইজিপি মামুন কেন ‘রাজসাক্ষী’ হতে চাইলেন

চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার ওপর দমন অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দাঁড়িয়ে তিনি বললেন, ‘আমি দোষী। আমি এই মামলার প্রকৃত তথ্য আদালতের সামনে তুলে ধরতে চাই।’

মো. ইসতিয়াক
প্রকাশ : ১১ জুলাই ২০২৫, ১৭: ০৯
আপডেট : ১১ জুলাই ২০২৫, ১৯: ০৬
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। স্ট্রিম গ্রাফিক

গত বছর জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন ‘রাজসাক্ষী’ হতে সম্মতি দিয়েছেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ গতকাল বৃহস্পতিবার (১০ জুলাই) তাঁর এই আবেদন গ্রহণ করেছেন।

এই মামলার অন্য দুই আসামি—সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের ২৬-২৭ জুলাই ঢাকাসহ দেশের নানা স্থানে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় সংঘটিত হত্যাকাণ্ড ও নিপীড়নের ঘটনায় এদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা ছিল।

কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে সাবেক আইজিপি বললেন, ‘আমি দোষী’

গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বিচারকের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘আমি দোষী। আমি আমার অপরাধ স্বীকার করছি এবং এই মামলার প্রকৃত ঘটনা, সহঅপরাধীদের ভূমিকা ও জুলাই হত্যাকাণ্ডের পূর্ণ বিবরণ আদালতের সামনে তুলে ধরতে চাই।’

সাবেক আইজিপির এই স্বীকারোক্তির পর আদালত তাকে ‘অ্যাপ্রুভার’ বা রাজসাক্ষী হিসেবে গ্রহণ করে নিরাপত্তার স্বার্থে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন।

গ্রেপ্তার হওয়ার পর আদালতে সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন। ছবি: সংগৃহীত
গ্রেপ্তার হওয়ার পর আদালতে সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন। ছবি: সংগৃহীত

রাজসাক্ষী কী

সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী মোনাকেব বাহার স্ট্রিমকে বলেন, ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৩৭ ধারায় রাজসাক্ষী সম্পর্কে বিস্তারিত উল্লেখ আছে। এই ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয় স্বীকার করেন এবং আদালতের সামনে সম্পূর্ণ সৎ ও নিরপেক্ষভাবে সেই অপরাধের বিস্তারিত বিবরণ দেন—সঙ্গে অন্য অভিযুক্তদের সংশ্লিষ্টতার তথ্যও প্রকাশ করেন—তাহলে আদালত শর্তসাপেক্ষে তাঁকে ক্ষমা করতে পারেন।

এই ধরনের সাক্ষীকেই বলা হয় রাজসাক্ষী বা অ্যাপ্রুভার। তবে রাজসাক্ষী হতে গেলে কিছু গুরুত্বপূর্ণ শর্ত পূরণ করতে হয়। প্রথমত, তাঁকে অবশ্যই নিজের জড়িত থাকার বিষয়টি অকপটে স্বীকার করতে হবে। দ্বিতীয়ত, ঘটনার সম্পূর্ণ বিবরণ নিরপেক্ষভাবে তুলে ধরতে হবে। তৃতীয়ত, অপর অভিযুক্তদের ভূমিকা সম্পর্কেও সত্য ও স্বচ্ছ তথ্য দিতে হবে। এবং চতুর্থত, বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাঁকে হেফাজতে থাকতে হবে যাতে কেউ তাকে প্রভাবিত করতে না পারে।

দোষ স্বীকার ও রাজসাক্ষীর সুবিধা

একজন সাবেক আইজিপি—রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পুলিশ কর্মকর্তার এমন স্বীকারোক্তি বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম। এর ফলে এই মামলার প্রমাণপত্রে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে।

আইনজীবীরা বলছেন, চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন সরাসরি ট্রাইব্যুনালের কাছে বলেছেন তিনি ওই গণহত্যার ঘটনায় জড়িত ছিলেন এবং সেই সময়কার শীর্ষ রাজনৈতিক নেতৃত্বের নির্দেশ অনুযায়ী অভিযান পরিচালনা করেছিলেন।

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী তাজুল ইসলাম বলেন, ‘এটা মামলার জন্য একটা টার্নিং পয়েন্ট। কারণ রাজসাক্ষীর জবানবন্দির ভিত্তিতেই অন্যদের বিরুদ্ধে মামলার ভিত্তি আরও শক্ত হবে।’

ফৌজদারি আইন অনুযায়ী, যদি কোনো অপরাধী আদালতের কাছে রাজসাক্ষী হওয়ার আবেদন করেন এবং তার জবানবন্দি সত্য ও মামলার প্রমাণ হিসেবে কার্যকর হয়, তাহলে আদালত তাঁকে শর্তসাপেক্ষে ক্ষমা করতে পারেন। এই ক্ষমা হতে পারে সম্পূর্ণ দায়মুক্তি অর্থাৎ মামলায় আর তাঁর বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে না। আবার আদালত চাইলে তাঁকে স্বল্প মেয়াদের শাস্তি দিতে পারেন, তবে এটি হবে নামমাত্র এবং প্রতীকী। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আইন অনুযায়ী রাজসাক্ষীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যাবে না, এটা স্পষ্টভাবে আইনে নিষিদ্ধ এবং আদালতের এখতিয়ার সীমিত।

তবে রাজসাক্ষী হওয়ায় যেহেতু তিনি অপর আসামিদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন, তাই তাঁর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে সর্বদা উদ্বেগ থাকে। রাজসাক্ষী যাতে কোনো ধরনের ভয়, চাপ বা হুমকির মুখে না পড়েন, সে জন্য তাঁকে বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত কারাগারে ‘সেফ কাস্টডি’ বা বিশেষ নিরাপত্তা হেফাজতে রাখা হয়। এই সময়ে তাঁকে সাধারণ কয়েদিদের সঙ্গে রাখা হয় না। আলাদা সেল, সীমিত যোগাযোগ এবং উন্নত পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তাঁর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়।

আইনজীবীদের মতে, আদালত যদি মনে করেন যে রাজসাক্ষী তাঁর বক্তব্যে পুরোপুরি সৎ ছিলেন এবং মামলার সত্য উদঘাটনে বড় ভূমিকা রেখেছেন, তাহলে তাঁকে সম্পূর্ণ দায়মুক্তির পাশাপাশি ভবিষ্যতে কোনো মামলায় পুনরায় একই অপরাধে অভিযুক্ত করা যাবে না। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আদালতের ওপর নির্ভরশীল।

সুতরাং রাজসাক্ষী হওয়া মানে শুধু দায়মুক্তি নয়, বরং আইনি সুরক্ষা ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার আওতায় আসাও বটে। যদিও এর বিপরীতে কিছু সামাজিক ও ব্যক্তিগত ঝুঁকিও থেকেই যায়।

আইজিপির স্বীকারোক্তির গুরুত্ব ও সম্ভাব্য আইনি ফলাফল

সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের স্বীকারোক্তি শুধু মামলার গতি পাল্টে দিচ্ছে না। এটি বাংলাদেশের বিচার ও নিরাপত্তা ইতিহাসে এক নজিরবিহীন ঘটনা। দেশের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা প্রধান নিজেই নিজের অপরাধ স্বীকার করায় রাষ্ট্রযন্ত্রের আত্মস্বীকৃত ব্যর্থতার প্রতিফলন ঘটেছে, যা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের অবস্থানকে নৈতিকভাবে দুর্বল করেছে। এ ছাড়া মামলার মূল কাঠামোতে থাকা গোপন তথ্য, চেইন অব কমান্ডের নির্দেশনা, কল রেকর্ড ও মৌখিক আদেশগুলো এখন রাজসাক্ষীর মাধ্যমে আইনি সাক্ষ্যরূপে আদালতে উপস্থাপন করা সম্ভব হবে, যা প্রমাণ সংগ্রহকে অনেক সহজ ও শক্তিশালী করবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সাবেক আইজিপি সরাসরি প্রধান আসামি হিসেবে থাকা শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে আদালতে সাক্ষ্য দিতে রাজি হয়েছেন। তাঁর জবানবন্দি ট্রাইব্যুনালে মূল প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত হবে।

জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আহসালুন বারী বলেন, চলমান মামলায় চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের সাক্ষ্য গ্রহণের পর আদালত যদি মনে করেন যে তিনি সম্পূর্ণ সত্য বলেছেন, তাহলে তাঁকে সম্পূর্ণ খালাস দেওয়া হতে পারে। যদি তিনি আংশিক তথ্য দেন, তাহলে স্বল্প মেয়াদের শাস্তি পেতে পারেন। তবে যদি মিথ্যা তথ্য দেন বা সত্য গোপন করেন, তাহলে তিনি আবার আসামি হিসেবে বিবেচিত হয়ে শাস্তির মুখোমুখি হবেন।

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী তাজুল ইসলাম উল্লেখ করেছেন, তিনি এখন সাক্ষী হিসেবে গণ্য হচ্ছেন এবং বিচারক যদি তার সাক্ষ্যে সন্তুষ্ট হন, তাহলে তাঁকে ক্ষমা করতে পারবেন; কিন্তু এর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণই আদালতের এখতিয়ার।

অতীতে রাজসাক্ষীর উদাহরণ

বাংলাদেশে রাজসাক্ষীর সংখ্যা খুবই কম এবং ইতিহাসে এটি হাতেগোনা ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ও স্মরণীয় নজির হলো নূরে আলমের ঘটনা। নূরে আলম ছিলেন কুখ্যাত সন্ত্রাসী এরশাদ সিকদারের দেহরক্ষী। তিনি আদালতে নিজের দোষ স্বীকার করে রাজসাক্ষী হন এবং এরশাদ সিকদারের বিরুদ্ধে প্রমাণস্বরূপ সাক্ষ্য দেন। তাঁর এই সাক্ষ্যের ভিত্তিতে এরশাদ সিকদারের বিরুদ্ধে ফাঁসির আদেশ কার্যকর হয়। এছাড়া ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার অন্যতম আসামি মুফতি আবদুল হান্নানকেও রাজসাক্ষী হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু পরে অন্য মামলার ফাঁসির কারণে তিনি এই সুযোগ নিতে পারেননি।

আহসানুল বারীর মতে, এত উচ্চপর্যায়ের কোনো ব্যক্তি রাজসাক্ষী হওয়ার ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে এবারই প্রথম ঘটল। সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের রাজসাক্ষী হওয়ার বিষয়টি তাই বিচারব্যবস্থায় এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। এটি শুধু এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে নয়, বরং দেশের উচ্চস্তরের অপরাধমূলক ঘটনাগুলোর তদন্ত ও বিচারে নতুন মাত্রা যোগ করবে। এর মাধ্যমে দেশের আইনি প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও সত্য উদ্ঘাটনের সম্ভাবনা বাড়বে, যা আগে কখনো দেখা যায়নি।

মামলার প্রেক্ষাপট ও পরের ধাপ

২০২৪ সালের জুলাই মাসে দেশের কোটা সংস্কার আন্দোলন ব্যাপক গণ-আন্দোলনে রূপ নেয়। সেই বিক্ষোভ দমন করতে সরকার পুলিশ, র‌্যাব ও সশস্ত্র বাহিনী ব্যবহার করে যা এক ভয়াবহ নৃশংসতায় পরিণত হয়। জাতিসংঘের তদন্ত দল জানিয়েছে, এই ঘটনাতে ১ হাজার ৪৩৭ জন নিহত, অন্তত ১১০ জন গুম এবং প্রায় ১৫ হাজার মানুষ আহত হন। ঘটনার তদন্তের জন্য একটি আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়, যেখানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনসহ আটজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়।

মামলার পরবর্তী ধাপে আগামী ৩ আগস্ট থেকে মামুনের সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হবে, যা অন্যান্য আসামিদের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। রাজসাক্ষী হিসেবে তাঁর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কারা কর্তৃপক্ষকে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত