leadT1ad

মার্কিন বন্দর প্রস্তাব: কোয়াডের হাতছানিতে কোন পথে হাঁটবে বাংলাদেশ

তুফায়েল আহমদ
মার্কিন বন্দর প্রস্তাব: কোয়াডের হাতছানিতে কোন পথে হাঁটবে বাংলাদেশ। স্ট্রিম গ্রাফিক

বিশ্ব ভূ-রাজনীতির সদা পরিবর্তনশীল প্রেক্ষাপটে কোয়াড উদ্যোগ একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত ফোরাম হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারত নিয়ে গঠিত এই জোটটি শুরুতে মানবিক সহায়তা সমন্বয়ের একটি দল হিসেবে যাত্রা করলেও, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একটি বহুমুখী প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়েছে। ইতিমধ্যেই কোয়াড্রিল্যাটারাল সিকিউরিটি ডায়ালগ বা চতুর্পাক্ষিক নিরাপত্তা সংলাপ (কোয়াড) ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ব্যাপক কৌশলগত প্রভাব ফেলছে।

কোয়াডের উৎপত্তি এবং কর্মপন্থা

২০০৪ সালে ভারত মহাসাগরের ভয়াবহ সুনামির পর সম্মিলিত সহায়তা কার্যক্রমের আলোচনার মধ্যে দিয়ে কোয়াডের প্রথম সূত্রপাত। ওই সময় যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারত—এই চারটি দেশ দুর্যোগ মোকাবিলায় একটি দল গঠন করেছিল। তবে কোয়াডের আনুষ্ঠানিক ধারণাটি প্রথম ২০০৭ সালে জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে উত্থাপন করেন। কিন্তু বাহ্যিক চাপ, অভ্যন্তরীণ অনৈক্য এবং একটি সুস্পষ্ট ও অভিন্ন কৌশলগত লক্ষ্যের অভাবে এই জোটটি দ্রুতই গতি হারিয়ে ফেলে ও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। প্রায় এক দশকের বিরতির পর, ‘মুক্ত, উন্মুক্ত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ইন্দো-প্রশান্ত’ অঞ্চলের অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ২০১৭ সালে কোয়াডকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়। বিশ্লেষকরা দাবি করেন, এই অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক ও সামরিক প্রভাব বিস্তারের চেষ্টার প্রতিক্রিয়া হিসেবেই কোয়াড আবার পুনরুজ্জীবিত হয়েছে।

কোয়াডের কার্যপদ্ধতির মূল বৈশিষ্ট্য হলো পারস্পরিক স্বার্থরক্ষা ও বহুমুখী কর্মপন্থা। কোয়াড ন্যাটোর মতো কোনো আনুষ্ঠানিক সামরিক জোট নয়। কোয়াড পরিচালিত হয় সদস্য দেশগুলোর নেতাদের নিয়মিত শীর্ষ সম্মেলন, মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক এবং নির্দিষ্ট সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলিতে কাজের মাধ্যমে। এই সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলো হলো সামুদ্রিক নিরাপত্তা, সন্ত্রাস দমন, সাইবার নিরাপত্তা, উন্নত অবকাঠামো নির্মাণ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং জনস্বাস্থ্যের মতো বিস্তৃত বিষয়। কোয়াডের সামরিক সহযোগিতার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো মালাবার নৌ-মহড়া। ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি দ্বিপাক্ষিক মহড়া হিসেবে শুরু হলেও এখন কোয়াডের চারটি সদস্য দেশই মালাবার নৌ-মহড়ায় অংশ নেয়।

অন্যদিকে, চীন কোয়াডকে তার প্রভাববলয় সংকোচন করার একটি কৌশল হিসেবে দেখে। এমনকি কোয়াডকে ‘এশীয় ন্যাটো’ বলেও চিহ্নিত করে।

ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং আঞ্চলিক গতিপ্রকৃতি

কোয়াডের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের ক্ষমতা ভারসাম্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। চীনের উত্থান ও তার বৃহৎ বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) কোয়াডের পুনরুত্থানের গতি বাড়িয়েছে এবং এর আলোচ্যসূচি গঠনে মূল ভূমিকা রেখেছে। নিয়মভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা বজায় রাখা, সমুদ্রে চলাচল ও আকাশপথে উড্ডয়নের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা এবং এই অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য একটি স্বচ্ছ ও টেকসই বিকল্প মডেল উপস্থাপন করাই কোয়াডের মূল লক্ষ্য। এ কারণে অনেকেই কোয়াডকে একটি ভারসাম্য রক্ষাকারী জোট হিসেবে দেখেন।

অন্যদিকে, চীন কোয়াডকে তার প্রভাববলয় সংকোচন করার একটি কৌশল হিসেবে দেখে। এমনকি কোয়াডকে ‘এশীয় ন্যাটো’ বলেও চিহ্নিত করে। ফলে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে একটি জটিল ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, যেখানে ছোট দেশগুলোকে প্রায়শই প্রধান শক্তিগুলোর মধ্যে সূক্ষ্ম ভারসাম্য বজায় রাখতে হিমশিম খেতে হয়। কোয়াড তার সমমনা অন্যান্য দেশগুলোর সঙ্গেও যোগাযোগ বাড়াচ্ছে, যা ‘কোয়াড প্লাস’ নামে পরিচিত। এই চেষ্টা এই অঞ্চলে কোয়াডের সমর্থনে একটি বৃহত্তর জোট গঠনের উচ্চাকাঙ্ক্ষাকেই তুলে ধরে।

চীনের বিআরআই প্রকল্পের বিরুদ্ধে প্রায়শই ঋণের ফাঁদ তৈরি এবং সুবিধাভোগী দেশগুলোর ওপর বেইজিংয়ের কৌশলগত প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ ওঠে।

‘কোয়াড পোর্টস ফর ফিউচার’ কর্মসূচি: প্রভাব বিস্তারের মাধ্যম

কোয়াডের অসামরিক ও উন্নয়নমূলক নীতির একটি মূল অংশ হলো ‘কোয়াড পোর্টস ফর ফিউচার’ কর্মসূচি। এই উদ্যোগের লক্ষ্য ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলজুড়ে টেকসই, সহনশীল এবং উচ্চমানের বন্দর অবকাঠামো নির্মাণে সহায়তা করা। এই কর্মসূচির মাধ্যমে কোয়াড সদস্যরা তাদের সম্মিলিত দক্ষতা ও সম্পদ ব্যবহার করে প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান, সর্বোত্তম অনুশীলন বিনিময় এবং বন্দর প্রকল্পগুলিতে সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ আকর্ষণে সমন্বয় করতে চায়। এর মূল উদ্দেশ্য হলো নিরাপদ এবং নির্ভরযোগ্য সামুদ্রিক অবকাঠামো তৈরি করা, যাতে যোগাযোগ বৃদ্ধি পায়, বাণিজ্য সহজ হয় এবং সরবরাহ ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা শক্তিশালী হয়। সম্প্রতি ভারতে অনুষ্ঠিত আঞ্চলিক বন্দর ও পরিবহন সম্মেলন এই কর্মসূচির অগ্রগতিরই প্রমাণ দেয়।

চীনের বন্দর-কেন্দ্রিক অবকাঠামো উন্নয়নের একটি নির্ভরযোগ্য বিকল্প প্রস্তাব করাই এই উদ্যোগের প্রধান উদ্দেশ্য। চীনের বিআরআই প্রকল্পের বিরুদ্ধে প্রায়শই ঋণের ফাঁদ তৈরি এবং সুবিধাভোগী দেশগুলোর ওপর বেইজিংয়ের কৌশলগত প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ ওঠে। বৃহত্তর কৌশলগত লক্ষ্য অর্জনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক অবকাঠামোতে বিনিয়োগের মাধ্যমে কোয়াড এই অঞ্চলে বৃহত্তর অর্থনৈতিক সংহতি ও স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি করতে চায়।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ঐতিহ্যগতভাবে ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়’ নীতির ওপর ভিত্তি করে চলে। ২০২১ সালে কোয়াডের ব্যাপারে বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত সতর্ক করে বলেছিলেন, কোয়াডে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ চীন-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে ‘মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত’ করবে।

কোয়াডের সঙ্গে বাংলাদেশের সতর্ক পথচলা

ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ এই ভূ-রাজনৈতিক মেরুকরণের কেন্দ্রে রয়েছে। বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই চীনের বিআরআই প্রকল্পের অধীনে অবকাঠামো খাতে বড় বিনিয়োগ পেয়েছে। তবে ঢাকা ইন্দো-প্যাসিফিক ধারণাটির সঙ্গেও সতর্কভাবে যুক্ত হচ্ছে। ২০২৩ সালে বাংলাদেশ ১৫-দফা সংবলিত একটি ‘ইন্দো-প্যাসিফিক রূপরেখা’ প্রকাশ করে, যেখানে ‘মুক্ত, উন্মুক্ত, শান্তিপূর্ণ, নিরাপদ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ইন্দো-প্যাসিফিক’ অঞ্চলের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এই রূপরেখাটি কোয়াডের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে মিল রাখলেও, এই জোটে যোগদানের কোনো সরাসরি সমর্থন বা প্রতিশ্রুতি দেয়নি।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ঐতিহ্যগতভাবে ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়’ নীতির ওপর ভিত্তি করে চলে। ২০২১ সালে কোয়াডের ব্যাপারে বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত সতর্ক করে বলেছিলেন, কোয়াডে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ চীন-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে ‘মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত’ করবে। জবাবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, দেশের পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণের সার্বভৌম অধিকার বাংলাদেশের রয়েছে।

‘কোয়াড পোর্টস ফর ফিউচার’ কর্মসূচি সম্প্রতি এই বিষয়টিকে আবারও আলোচনায় এনেছে। চলতি বছরের ২০ সেপ্টেম্বর ইকোনমিক টাইমসের এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, এই কর্মসূচির অধীনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গোপসাগরে নিজেদের উপস্থিতি প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশে একটি বন্দর নির্মাণের দিকে নজর দিচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে এই অঞ্চলে চীনের প্রভাবের বিপরীতে ভারসাম্য আনা গেলেও এই পদক্ষেপটি ভারতের জন্য অস্বস্তি সৃষ্টি করছে। ইকোনমিক টাইমসের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বন্দর খাতে তাদের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এই সপ্তাহে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঢাকায় সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সঙ্গে একটি প্রাথমিক বৈঠক করেছে। এই বিষয়ে অবগত ব্যক্তিরা ইকোনমিক টাইমসকে জানিয়েছেন, কোনো সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়ার আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রথমে একটি সম্ভাব্যতা যাচাই করবে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীরা বলছেন, বাংলাদেশের জন্য এই ধরনের প্রস্তাব একদিকে যেমন সুযোগ তৈরি করে, তেমনি চ্যালেঞ্জও নিয়ে আসে।

যুক্তরাষ্ট্রের বন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়ে বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে স্পষ্ট কোনো অবস্থান ব্যাখ্যা না করার কারণে ধোঁয়াশা বাড়াছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীরা বলছেন, বাংলাদেশের জন্য এই ধরনের প্রস্তাব একদিকে যেমন সুযোগ তৈরি করে, তেমনি চ্যালেঞ্জও নিয়ে আসে। একদিকে এই ধরনের পদক্ষেপ দেশের ক্রমবর্ধমান সামুদ্রিক খাতের জন্য প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ ও প্রযুক্তি আনতে পারে এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করতে পারে, তেমনি অন্যদিকে বাংলাদেশকে বৃহৎ শক্তিগুলোর প্রতিযোগিতার ঘূর্ণাবর্তে আরও গভীরভাবে টেনে নিতে পারে, যা বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার চীনের সঙ্গে সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করার সম্ভাবনা রাখে।

বাংলাদেশের দৃষ্টিভঙ্গি হলো সতর্কতার সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করা। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশের উচিত কৌশলগত অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে সব প্রধান শক্তির কাছ থেকে বিনিয়োগ ও অংশীদারিত্ব আকর্ষণ করা, কিন্তু তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার জালে জড়িয়ে না পড়া। বাংলাদেশের ইন্দো-প্যাসিফিক রূপরেখা এই কৌশলেরই প্রতিফলন। এই কৌশল বাংলাদেশের জোটনিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রেখেও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও যোগাযোগ ক্ষেত্রে কোয়াড-নেতৃত্বাধীন উদ্যোগে অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়। বাংলাদেশে কোয়াড-সমর্থিত সম্ভাব্য বন্দর নির্মাণ এই ভারসাম্য রক্ষার নীতির জন্য একটি বড় পরীক্ষা হবে, যা এই অঞ্চলের ভূ-রাজনীতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত