স্ট্রিম ডেস্ক
সম্প্রতি কিছু ভাইরাল ফেসবুক রিলে দেখা গেছে বাংলাদেশি তরুণরা ভারী অস্ত্র নিয়ে লড়াই করছে। ভিডিওতে তাদের সহযোদ্ধাদের মৃতদেহও দেখা যায়। ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরে বেড়াচ্ছে এরকম কিছু ভয়াবহ ভিডিও। বাংলাদেশি তরুণ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ফ্রন্টলাইনে লড়ছে। মাইন পরিষ্কারের মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজও করছে তারা।
সম্প্রতি বাংলা স্ট্রিমের এক প্রতিবেদনেও ইউক্রেনে বাংলাদেশিদের ‘যুদ্ধ দাস’ হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার ভয়ানক গল্প উঠে আসে। অনেক বাংলাদেশিকে ভুয়া চাকরির প্রলোভনে রাশিয়ায় পাঠানো হয় এবং সেখানে জোর করে যুদ্ধে নামানো হয়। প্রতিবেদনে, নিখোঁজ হওয়া ও নির্যাতনের মতো ভয়াবহ ঘটনাও উঠে এসেছে।
এই প্রবণতা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটি এক বৃহত্তর সংকটের প্রতিফলন। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক হতাশা, বেকারত্ব ও বৈষম্য বহু তরুণকে দূরবর্তী এক রক্তক্ষয়ী সংঘাতে ঠেলে দিচ্ছে। এর সঙ্গে বাংলাদেশের সামাজিক-অর্থনৈতিক সংকটের গভীর সম্পর্ক রয়েছে।
রাশিয়ায় বিক্রি হয়ে যাওয়া হাবিবুল্লাহর গল্প
কিছু দিন আগে স্ট্রিম কথা বলেছিল ইউক্রেন যুদ্ধে নিহত নরসিংদীর তরুণ হাবিবুল্লাহ ভূঁইয়ার পরিবারের সঙ্গে। বিশ বছর বয়সী এই তরূণ ইতালি নিয়ে যাওয়ার আশ্বাসে দেশ ছাড়েন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাশিয়ায় পৌঁছে পড়েন এক ভয়ংকর ফাঁদে। সেখান থেকে তাঁকে পাঠানো হয় রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধক্ষেত্রে ‘যুদ্ধ-দাস’ হিসেবে। শেষ পর্যন্ত রাশিয়ার পক্ষ হয়ে লড়তে গিয়ে প্রাণ হারান এই তরুণ বাংলাদেশি। নরসিংদীর এই যুবক ভাবতেন, ইউরোপে পৌঁছাতে পারলেই জীবন বদলে যাবে। হয়তো একদিন বাবা-মায়ের ঘরটা পাকা করবেন, ভাইবোনদের পড়াশোনার খরচ দেবেন। সেই স্বপ্নের পথই তাঁকে টেনে নিয়ে গেল যুদ্ধক্ষেত্রে।
হাবিবুল্লাহর বাবা আবু সিদ্দিক ভূঁইয়া জানালেন, পরিবারের সামান্য সঞ্চয় আর ধার-কর্জ করে ছেলের বিদেশযাত্রার খরচ জোগাড় করেছিলেন তাঁরা। খরচ হয়েছিল বিশ লাখ টাকা। ‘সে খুব হতাশ ছিল,’ বললেন আবু সিদ্দিক। ‘আমরা চাইনি সে এমন থাকুক। তাই সব ঋণ-ধার করে টাকার ব্যবস্থা করেছি। আমাদের কখনো এত বড় ঋণ নিতে হয়নি, কিন্তু ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে করেছি।’
হাবিবুল্লাহর মা মনসুরা বেগমের চোখে এখনো জল। তিনি বললেন, ‘ভিসা পাওয়ার পর দালাল জানায়, সে হাবিবুল্লাহকে প্রথমে ওমরাহর জন্য সৌদি আরবে নিয়ে যাবে। বলে, হজের ভিসা হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখি, আমার ছেলে রাশিয়ায়।’ পরে জানা যায়, মানবপাচারকারীরা প্রায় ২৮ লাখ টাকায়—মানে আনুমানিক ১৮ থেকে ২০ হাজার ডলার—হাবিবুল্লাহকে রুশ সেনাবাহিনীর কাছে বিক্রি করে দিয়েছিল।
হাবিবুল্লাহর মতোই নরসিংদীর ব্রহ্মান্দী গ্রামের বদিউজ্জামানও একইভাবে ইতালি যাওয়ার স্বপ্নে প্রতারিত হয়েছেন। তাকেও রাশিয়ায় পাঠানো হয়। বদিউজ্জামানের মা লিলি বেগম বললেন, ‘সে বেঁচে আছে, না মরে গেছে—এখন শুধু আল্লাহই জানেন।’
চাকরির স্বপ্ন থেকে যুদ্ধের দুঃস্বপ্নে
বাংলাদেশি তরুণরা নিজের ইচ্ছায় যুদ্ধে যাচ্ছে না। তারা মানবপাচারকারীদের ফাঁদে পড়ছে। রাশিয়া ২০২৪ সালে বিদেশিদের সেনাবাহিনীতে নিয়োগ সহজ করার যে আদেশ জারি করে, সেটিই এই পাচারের সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। দালাল চক্রগুলো ‘কারখানার চাকরি’র প্রলোভন দেখিয়ে তরুণদের রাশিয়া বা ইউরোপে পাঠানোর প্রস্তাব দেয়। তারা প্রতিটি পরিবারের কাছ থেকে ৯ থেকে ১২ লাখ টাকা নেয়। পরিবারগুলো ঋণ ও সঞ্চয়ের টাকা থেকে এই টাকা দেয়।
রাশিয়ায় পৌঁছেই শুরু হয় প্রতারণা। সেখানে পাসপোর্ট কেড়ে নেওয়া হয়। তরুণদের রুশ ভাষায় লেখা সামরিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করা হয়। অনেক সময় নির্বাসন বা কারাদণ্ডের হুমকি দিয়ে ভয় দেখানো হয়। এরপর তাদের পাঠানো হয় ‘স্টর্ম-জেড’ নামে পরিচিত আক্রমণ ইউনিটে, যেখানে খুব অল্প প্রশিক্ষণেই তাদের ইউক্রেনের গোলার মুখে ঠেলে দেওয়া হয়।
গবেষকদের মতে, এ সংকট স্কিল মিসম্যাচ বা ‘দক্ষতা-বৈষম্য’-এর ফল। দেশে অতি শিক্ষিত তরুণদের সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু চাকরির সুযোগ কমছে। ফলে বিদেশগমন ও প্রতারণার ঝুঁকি বেড়েছে।
বাংলাদেশে ব্যাপক দারিদ্র্য ও বেকারত্ব তরুণদের এমন প্রলোভনের সহজ শিকার করছে। কঠোর শীত ও অস্থিরতার জন্য পরিচিত একটি দেশে কারখানার চাকরির প্রস্তাবে রাজি হওয়া থেকেই বোঝা যায় তাদের হতাশার গভীরতা।
সরকারি ও আন্তর্জাতিক সূত্রে জানা গেছে, অন্তত ৬৭টি মানবপাচারচক্র এই কাজে সক্রিয়। ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যমতে, ২০২৩ সাল থেকে রাশিয়ায় যুদ্ধে যোগ দেওয়া দক্ষিণ এশীয় নাগরিকের সংখ্যা প্রায় ৭৫০ জন। এর মধ্যে ভারতীয়দের পরেই দ্বিতীয় অবস্থানে বাংলাদেশিরা।
অর্থনৈতিক সংকট: তরুণদের হতাশা ও অদৃশ্য দেয়াল
বাংলাদেশ এখন তরুণদের দেশ—১৭ কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় ২৮ শতাংশই ১৫ থেকে ২৯ বছরের তরুণ। এই প্রজন্মই হতে পারত দেশের উন্নয়নের চালিকাশক্তি। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। অনেকে এখন ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছে না, কেউ বিদেশের পথে, কেউ প্রতারণার ফাঁদে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তি জরিপ ২০২৪ বলছে, সার্বিক বেকারত্বের হার ৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ। শুনতে কম মনে হলেও, ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণদের মধ্যে এই হার তিন গুণ বেশি—১১ দশমিক ৪৬ শতাংশ। দেশের ২৬ লাখ বেকারের অর্ধেকেরও বেশি তরুণ। এর মধ্যে ৯ লাখ স্নাতক, অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় পড়েও কাজ নেই। এই শিক্ষিত তরুণদের বেকারত্বের হার ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ—সবচেয়ে বেশি।
আন্তর্জাতিক গ্রোথ সেন্টারের (আইজিসি) ২০২৫ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সব বেকারের মধ্যে ৭৯ শতাংশই তরুণ। উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্ব এখন ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ—মাত্র এক দশকে চারগুণ বেড়েছে। আরও উদ্বেগের বিষয়, তরুণদের ২০ শতাংশ এখন শিক্ষা, কর্ম বা প্রশিক্ষণ—কোনোটির সঙ্গেই যুক্ত নয় (এনইইটি শ্রেণি) । তাদের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ নারী।
বিশ্লেষকদের মতে, শিক্ষার সম্প্রসারণ হয়েছে, কিন্তু তার সঙ্গে কর্মসংস্থান বাড়েনি। ফলে “ডিগ্রিধারী বেকার” এখন এক নতুন সামাজিক বাস্তবতা।
অন্যদিকে ৯ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতি তরুণদের জীবন আরও কঠিন করে তুলেছে। প্রায় ৯২ শতাংশ তরুণ কাজ করছে অনানুষ্ঠানিক খাতে—যেখানে চাকরির নিরাপত্তা নেই, বেতন অনিশ্চিত। ২০২৪ সালের আন্দোলনের সময় ও পরবর্তী মাসগুলোয় আরও ২১ লাখ মানুষ চাকরি হারিয়েছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এই সংকট আরও বাড়িয়েছে। আমদানি খরচ বেড়েছে ৩০–৪০ শতাংশ। উপসাগরীয় অঞ্চলে চাকরির সংকটে প্রবাসী আয়ও কমেছে। এই আয় ছিল জিডিপির ১২ শতাংশ।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় তরুণদের ক্ষোভের বিস্ফোরণ এ বাস্তবতারই প্রতিফলন। সানেমের এক জরিপে দেখা গেছে, ৫৪ শতাংশ তরুণ মনে করে, চাকরির প্রধান বাধা দুর্নীতি ও পক্ষপাতিত্ব। ৪০ শতাংশ তরুণ সুযোগ পেলে বিদেশে কাজ করতে চায়।
আইজিসির প্রতিবেদনে একটি সতর্কবাণীও আছে—“যদি দ্রুত কর্মসংস্থান না বাড়ানো যায়, বাংলাদেশ উন্নয়নের সুফল পাওয়ার আগেই বার্ধক্যজনিত সমাজে পরিণত হবে।”
এক কথায়, শিক্ষিত তরুণ প্রজন্ম এখন এক অদৃশ্য দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে—যেখানে আশা আছে, কিন্তু পথ নেই।
সরকারের পদক্ষেপ
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনুসের সরকার ইতোমধ্যে মানবপাচারবিরোধী ৬৭টি মামলা করেছে এবং দালাল চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তার করেছে। সরকার রাশিয়ার সঙ্গে কূটনৈতিকভাবে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে আলোচনাও চালাচ্ছে। তবে রাশিয়া দাবি করেছে, কেউ জোর করে কাউকে যুদ্ধে নেওয়া হয়নি। অপরদিকে ইউক্রেন জানায়, তারা বেশ কয়েকজন বাংলাদেশিকে আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে পেয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্রামীণ পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধি, মানবপাচারবিরোধী আইন বাস্তবায়ন এবং তরুণদের জন্য টেকসই কর্মসংস্থান সৃষ্টি জরুরি। আইজিসি পরামর্শ দিয়েছে, জাতীয় কর্মসংস্থান নীতি (এনইপি) ২০২২ বাস্তবায়ন, প্রতি বছর অন্তত ৩৫ লাখ নতুন চাকরি সৃষ্টি, দক্ষতা উন্নয়ন ও নারী-অংশগ্রহণ বাড়ানো প্রয়োজন।
এ সংকট কেবল বাংলাদেশের নয়, পুরো বৈশ্বিক দক্ষিণের প্রতিচ্ছবি, যেখানে অর্থনৈতিক অস্থিরতা তরুণদের ঠেলে দেয় বিপজ্জনক পথে। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তোহিদ হোসেনের ভাষায়, ‘এই দালাল চক্র দমন করা কঠিন। কিন্তু দেশে কর্মসংস্থান না থাকলে তরুণরা মরীচিকা খুঁজবে বিদেশে, শেষমেশ খুঁজে পাবে কবর।’
সম্প্রতি কিছু ভাইরাল ফেসবুক রিলে দেখা গেছে বাংলাদেশি তরুণরা ভারী অস্ত্র নিয়ে লড়াই করছে। ভিডিওতে তাদের সহযোদ্ধাদের মৃতদেহও দেখা যায়। ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরে বেড়াচ্ছে এরকম কিছু ভয়াবহ ভিডিও। বাংলাদেশি তরুণ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ফ্রন্টলাইনে লড়ছে। মাইন পরিষ্কারের মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজও করছে তারা।
সম্প্রতি বাংলা স্ট্রিমের এক প্রতিবেদনেও ইউক্রেনে বাংলাদেশিদের ‘যুদ্ধ দাস’ হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার ভয়ানক গল্প উঠে আসে। অনেক বাংলাদেশিকে ভুয়া চাকরির প্রলোভনে রাশিয়ায় পাঠানো হয় এবং সেখানে জোর করে যুদ্ধে নামানো হয়। প্রতিবেদনে, নিখোঁজ হওয়া ও নির্যাতনের মতো ভয়াবহ ঘটনাও উঠে এসেছে।
এই প্রবণতা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটি এক বৃহত্তর সংকটের প্রতিফলন। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক হতাশা, বেকারত্ব ও বৈষম্য বহু তরুণকে দূরবর্তী এক রক্তক্ষয়ী সংঘাতে ঠেলে দিচ্ছে। এর সঙ্গে বাংলাদেশের সামাজিক-অর্থনৈতিক সংকটের গভীর সম্পর্ক রয়েছে।
রাশিয়ায় বিক্রি হয়ে যাওয়া হাবিবুল্লাহর গল্প
কিছু দিন আগে স্ট্রিম কথা বলেছিল ইউক্রেন যুদ্ধে নিহত নরসিংদীর তরুণ হাবিবুল্লাহ ভূঁইয়ার পরিবারের সঙ্গে। বিশ বছর বয়সী এই তরূণ ইতালি নিয়ে যাওয়ার আশ্বাসে দেশ ছাড়েন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাশিয়ায় পৌঁছে পড়েন এক ভয়ংকর ফাঁদে। সেখান থেকে তাঁকে পাঠানো হয় রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধক্ষেত্রে ‘যুদ্ধ-দাস’ হিসেবে। শেষ পর্যন্ত রাশিয়ার পক্ষ হয়ে লড়তে গিয়ে প্রাণ হারান এই তরুণ বাংলাদেশি। নরসিংদীর এই যুবক ভাবতেন, ইউরোপে পৌঁছাতে পারলেই জীবন বদলে যাবে। হয়তো একদিন বাবা-মায়ের ঘরটা পাকা করবেন, ভাইবোনদের পড়াশোনার খরচ দেবেন। সেই স্বপ্নের পথই তাঁকে টেনে নিয়ে গেল যুদ্ধক্ষেত্রে।
হাবিবুল্লাহর বাবা আবু সিদ্দিক ভূঁইয়া জানালেন, পরিবারের সামান্য সঞ্চয় আর ধার-কর্জ করে ছেলের বিদেশযাত্রার খরচ জোগাড় করেছিলেন তাঁরা। খরচ হয়েছিল বিশ লাখ টাকা। ‘সে খুব হতাশ ছিল,’ বললেন আবু সিদ্দিক। ‘আমরা চাইনি সে এমন থাকুক। তাই সব ঋণ-ধার করে টাকার ব্যবস্থা করেছি। আমাদের কখনো এত বড় ঋণ নিতে হয়নি, কিন্তু ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে করেছি।’
হাবিবুল্লাহর মা মনসুরা বেগমের চোখে এখনো জল। তিনি বললেন, ‘ভিসা পাওয়ার পর দালাল জানায়, সে হাবিবুল্লাহকে প্রথমে ওমরাহর জন্য সৌদি আরবে নিয়ে যাবে। বলে, হজের ভিসা হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখি, আমার ছেলে রাশিয়ায়।’ পরে জানা যায়, মানবপাচারকারীরা প্রায় ২৮ লাখ টাকায়—মানে আনুমানিক ১৮ থেকে ২০ হাজার ডলার—হাবিবুল্লাহকে রুশ সেনাবাহিনীর কাছে বিক্রি করে দিয়েছিল।
হাবিবুল্লাহর মতোই নরসিংদীর ব্রহ্মান্দী গ্রামের বদিউজ্জামানও একইভাবে ইতালি যাওয়ার স্বপ্নে প্রতারিত হয়েছেন। তাকেও রাশিয়ায় পাঠানো হয়। বদিউজ্জামানের মা লিলি বেগম বললেন, ‘সে বেঁচে আছে, না মরে গেছে—এখন শুধু আল্লাহই জানেন।’
চাকরির স্বপ্ন থেকে যুদ্ধের দুঃস্বপ্নে
বাংলাদেশি তরুণরা নিজের ইচ্ছায় যুদ্ধে যাচ্ছে না। তারা মানবপাচারকারীদের ফাঁদে পড়ছে। রাশিয়া ২০২৪ সালে বিদেশিদের সেনাবাহিনীতে নিয়োগ সহজ করার যে আদেশ জারি করে, সেটিই এই পাচারের সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। দালাল চক্রগুলো ‘কারখানার চাকরি’র প্রলোভন দেখিয়ে তরুণদের রাশিয়া বা ইউরোপে পাঠানোর প্রস্তাব দেয়। তারা প্রতিটি পরিবারের কাছ থেকে ৯ থেকে ১২ লাখ টাকা নেয়। পরিবারগুলো ঋণ ও সঞ্চয়ের টাকা থেকে এই টাকা দেয়।
রাশিয়ায় পৌঁছেই শুরু হয় প্রতারণা। সেখানে পাসপোর্ট কেড়ে নেওয়া হয়। তরুণদের রুশ ভাষায় লেখা সামরিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করা হয়। অনেক সময় নির্বাসন বা কারাদণ্ডের হুমকি দিয়ে ভয় দেখানো হয়। এরপর তাদের পাঠানো হয় ‘স্টর্ম-জেড’ নামে পরিচিত আক্রমণ ইউনিটে, যেখানে খুব অল্প প্রশিক্ষণেই তাদের ইউক্রেনের গোলার মুখে ঠেলে দেওয়া হয়।
গবেষকদের মতে, এ সংকট স্কিল মিসম্যাচ বা ‘দক্ষতা-বৈষম্য’-এর ফল। দেশে অতি শিক্ষিত তরুণদের সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু চাকরির সুযোগ কমছে। ফলে বিদেশগমন ও প্রতারণার ঝুঁকি বেড়েছে।
বাংলাদেশে ব্যাপক দারিদ্র্য ও বেকারত্ব তরুণদের এমন প্রলোভনের সহজ শিকার করছে। কঠোর শীত ও অস্থিরতার জন্য পরিচিত একটি দেশে কারখানার চাকরির প্রস্তাবে রাজি হওয়া থেকেই বোঝা যায় তাদের হতাশার গভীরতা।
সরকারি ও আন্তর্জাতিক সূত্রে জানা গেছে, অন্তত ৬৭টি মানবপাচারচক্র এই কাজে সক্রিয়। ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যমতে, ২০২৩ সাল থেকে রাশিয়ায় যুদ্ধে যোগ দেওয়া দক্ষিণ এশীয় নাগরিকের সংখ্যা প্রায় ৭৫০ জন। এর মধ্যে ভারতীয়দের পরেই দ্বিতীয় অবস্থানে বাংলাদেশিরা।
অর্থনৈতিক সংকট: তরুণদের হতাশা ও অদৃশ্য দেয়াল
বাংলাদেশ এখন তরুণদের দেশ—১৭ কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় ২৮ শতাংশই ১৫ থেকে ২৯ বছরের তরুণ। এই প্রজন্মই হতে পারত দেশের উন্নয়নের চালিকাশক্তি। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। অনেকে এখন ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছে না, কেউ বিদেশের পথে, কেউ প্রতারণার ফাঁদে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তি জরিপ ২০২৪ বলছে, সার্বিক বেকারত্বের হার ৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ। শুনতে কম মনে হলেও, ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণদের মধ্যে এই হার তিন গুণ বেশি—১১ দশমিক ৪৬ শতাংশ। দেশের ২৬ লাখ বেকারের অর্ধেকেরও বেশি তরুণ। এর মধ্যে ৯ লাখ স্নাতক, অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় পড়েও কাজ নেই। এই শিক্ষিত তরুণদের বেকারত্বের হার ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ—সবচেয়ে বেশি।
আন্তর্জাতিক গ্রোথ সেন্টারের (আইজিসি) ২০২৫ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সব বেকারের মধ্যে ৭৯ শতাংশই তরুণ। উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্ব এখন ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ—মাত্র এক দশকে চারগুণ বেড়েছে। আরও উদ্বেগের বিষয়, তরুণদের ২০ শতাংশ এখন শিক্ষা, কর্ম বা প্রশিক্ষণ—কোনোটির সঙ্গেই যুক্ত নয় (এনইইটি শ্রেণি) । তাদের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ নারী।
বিশ্লেষকদের মতে, শিক্ষার সম্প্রসারণ হয়েছে, কিন্তু তার সঙ্গে কর্মসংস্থান বাড়েনি। ফলে “ডিগ্রিধারী বেকার” এখন এক নতুন সামাজিক বাস্তবতা।
অন্যদিকে ৯ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতি তরুণদের জীবন আরও কঠিন করে তুলেছে। প্রায় ৯২ শতাংশ তরুণ কাজ করছে অনানুষ্ঠানিক খাতে—যেখানে চাকরির নিরাপত্তা নেই, বেতন অনিশ্চিত। ২০২৪ সালের আন্দোলনের সময় ও পরবর্তী মাসগুলোয় আরও ২১ লাখ মানুষ চাকরি হারিয়েছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এই সংকট আরও বাড়িয়েছে। আমদানি খরচ বেড়েছে ৩০–৪০ শতাংশ। উপসাগরীয় অঞ্চলে চাকরির সংকটে প্রবাসী আয়ও কমেছে। এই আয় ছিল জিডিপির ১২ শতাংশ।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় তরুণদের ক্ষোভের বিস্ফোরণ এ বাস্তবতারই প্রতিফলন। সানেমের এক জরিপে দেখা গেছে, ৫৪ শতাংশ তরুণ মনে করে, চাকরির প্রধান বাধা দুর্নীতি ও পক্ষপাতিত্ব। ৪০ শতাংশ তরুণ সুযোগ পেলে বিদেশে কাজ করতে চায়।
আইজিসির প্রতিবেদনে একটি সতর্কবাণীও আছে—“যদি দ্রুত কর্মসংস্থান না বাড়ানো যায়, বাংলাদেশ উন্নয়নের সুফল পাওয়ার আগেই বার্ধক্যজনিত সমাজে পরিণত হবে।”
এক কথায়, শিক্ষিত তরুণ প্রজন্ম এখন এক অদৃশ্য দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে—যেখানে আশা আছে, কিন্তু পথ নেই।
সরকারের পদক্ষেপ
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনুসের সরকার ইতোমধ্যে মানবপাচারবিরোধী ৬৭টি মামলা করেছে এবং দালাল চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তার করেছে। সরকার রাশিয়ার সঙ্গে কূটনৈতিকভাবে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে আলোচনাও চালাচ্ছে। তবে রাশিয়া দাবি করেছে, কেউ জোর করে কাউকে যুদ্ধে নেওয়া হয়নি। অপরদিকে ইউক্রেন জানায়, তারা বেশ কয়েকজন বাংলাদেশিকে আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে পেয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্রামীণ পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধি, মানবপাচারবিরোধী আইন বাস্তবায়ন এবং তরুণদের জন্য টেকসই কর্মসংস্থান সৃষ্টি জরুরি। আইজিসি পরামর্শ দিয়েছে, জাতীয় কর্মসংস্থান নীতি (এনইপি) ২০২২ বাস্তবায়ন, প্রতি বছর অন্তত ৩৫ লাখ নতুন চাকরি সৃষ্টি, দক্ষতা উন্নয়ন ও নারী-অংশগ্রহণ বাড়ানো প্রয়োজন।
এ সংকট কেবল বাংলাদেশের নয়, পুরো বৈশ্বিক দক্ষিণের প্রতিচ্ছবি, যেখানে অর্থনৈতিক অস্থিরতা তরুণদের ঠেলে দেয় বিপজ্জনক পথে। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তোহিদ হোসেনের ভাষায়, ‘এই দালাল চক্র দমন করা কঠিন। কিন্তু দেশে কর্মসংস্থান না থাকলে তরুণরা মরীচিকা খুঁজবে বিদেশে, শেষমেশ খুঁজে পাবে কবর।’
বিশ্ববিখ্যাত ভারতীয় সাহিত্য তাত্ত্বিক ও যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক মঙ্গলবার (১৫ অক্টোবর, ২০২৫) ঢাকায় এসেছেন। কুষ্টিয়ায় জাতীয় লালন উৎসব ও লালন মেলায় অংশ নিতে বাংলাদেশে আসেন তিনি। লালন ফকিরের ১৩৫তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে
১৯ ঘণ্টা আগেসুইজারল্যান্ডের জেনেভায় জাতিসংঘের ওয়াটার কনভেনশনের ষষ্ঠ যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের প্রথম অধিবেশনে সোমবার (১৩ অক্টোবর) বক্তব্য দেন বাংলাদেশের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু বিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বিশ্বনেতাদের প্রতি আহ্বান জানান—ন্যায়সঙ্গত, টেকসই ও সমানাধিকারভিত্তিক পানি ব্যবস্থাপনায় ঐক্যবদ্ধ হওয়ার
১ দিন আগেঅন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ পাঁচটি দুর্বল শরিয়াহভিত্তিক বেসরকারি ব্যাংক একীভূত করার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। সোমবার (১৩ অক্টোবর ২০২৫) একীভূত হওয়ার অনুমোদন পাওয়া ব্যাংকগুলো হলো—ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক এবং সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক।
১ দিন আগেঅক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানের (টিটিপি) নেতা নূর ওয়ালি মেহসুদকে লক্ষ্য করে আফগানিস্তানের একাধিক শহরে পাকিস্তান বিমান হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। এই ঘটনায় পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় মারাত্মক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।
২ দিন আগে